জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি-২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ-১০ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশ ও কর্মকৌশল

শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশ ও কর্মকৌশল

[সৃজনশীলতা শব্দের আরবি হলো الإبداعية আর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Creativity। সৃজনশীলতা বলতে বুঝায় মানব অভ্যন্তরে লুকায়িত একাধিক প্রতিভা ও গুণের সমষ্টি; যা শুধু ব্যক্তিগত উন্নতি সাধনে সহায়ক তা নয় বরং একটি জাতির রুচিবোধ, শিল্পসৌন্দর্য, বিজ্ঞানমনস্কতা ইত্যাদিরও পরিচয় বহন করে। যে জাতি যত বেশি সৃজনশীল, পৃথিবীর বুকে সেই জাতি ততই উন্নত। সৃজনশীলতা হলো নিজের দক্ষতা ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে কোনো নতুন বা কল্পনাপ্রসূত আইডিয়াকে বাস্তবে রূপান্তর করা। আবৃত্তি, সাহিত্য রচনা, পেইন্টিং ইত্যাদি তো সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করেই, পাশাপাশি নতুন বা ভিন্ন আঙ্গিকে কোনো ব্যাপারে ধারণা দেওয়াটাও ক্রিয়েটিভিটিরই অংশ।অনেকে মনে করেন তাদের মধ্যে কোনো সৃজনশীলতা নেই। ধারণাটি একেবারেই ভুল। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সৃজনশীলতা থাকে। যত্ন, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে হয়। নিম্নে সৃজনশীলতার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং সৃজনশীলতা অর্জনের কিছু কর্মকৌশল নিয়ে মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধটি লেখার ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন জামিয়া পটিয়ার ফাযেল স্নেহাস্পদ মাওলানা উকাশা বিন আবিদ। শিক্ষার্থীদের উপকার্থে লেখাটি শিক্ষার্থীদের পাতায় প্রকাশ করা হল।—বিভাগীয় সম্পাদক]

 

সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি

      লেখক: বিভাগী সম্পাদক, শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ বিভাগ

সৃজনশীলতা কেন জরুরি?

সাধারণ জীবনে সৃজনশীলতার প্রভাব অনেক বেশি। সৃজনশীলতা চিন্তা ভাবনার বিকাশ ঘটায়। যেকোনো বিষয়কে গতানুগতির ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা করতে সাহায্য করে। সৃজনশীলতা এমন একটি অস্ত্র যা দৈনন্দিন কাজকে আনন্দময় করে তোলে, জীবনকে সহজ করে এবং একঘেঁয়েমি দূর করে। সৃজনশীলতা ক্রমাগত আপনার মনকে চ্যালেঞ্জ করে, যা আপনার মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এটি স্বাস্থ্য ও জীবনমানের উন্নতি তো ঘটায়ই, গবেষণা বলছে সৃজনশীলতা মৃত্যুঝুঁকিও কমায়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, সৃজনশীল মানুষের চিন্তাভাবনা গতানুগতিক ধারার বাইরে। অর্থাৎ সৃজনশীলতা আপনাকে সীমাবদ্ধ গণ্ডির বাইরে চিন্তা করতে শেখাবে, চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনবে।

শুধুমাত্র দৈনন্দিন জীবনেই নয়, সৃজনশীলতার প্রভাব কর্পোরেট জগৎ বা কর্মক্ষেত্রেও অনেক বেশি। সৃজনশীলতার মাধ্যমে নতুন নতুন আইডিয়া জেনারেট করা, কঠিন সমস্যার সমাধান করা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে অনন্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। এজন্য কর্মক্ষেত্রেও একজন ক্রিয়েটিভ ব্যক্তি অনেকাংশে এগিয়েই থাকেন।

শিক্ষার্থীরা নিজেদের সৃজনশীল

প্রতিভা বিকাশ করার কিছু কর্মকৌশল:

  1. সর্বপ্রথম এই কথাটা মনে রাখতে হবে যে, মহান রাব্বুল আলামীন বনী আদম তথা ইনসানকে একটি অনন্য শক্তি দান করেছেন। সেটি হচ্ছে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি। এই যে টাকা-পয়সা-মুদ্রা যেগুলো ছাড়া পৃথিবী অচল হিসেবে আমরা জানি। এগুলোও কিন্তু মানুষের বুদ্ধি থেকে সৃষ্টি। আমাদেরকে যখন এই সুবিশাল পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল, আমাদের এবং অন্যান্য মাখলুকাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য ছিল খোদাপ্রদত্ত সেই অনন্য শক্তি তথা বিবেক ও বুদ্ধি৷ সুতরাং আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিটি বিষয় বিবেকবুদ্ধি দিয়ে সমাধান করা উচিত। এতে আমাদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকশিত হবে। স্বয়ং ঈমান বিল্লাহ থেকে আরম্ভ করে ইসলামের মৌলিক প্রতিটি বিষয়ে না দেখে ঈমান আনাটাও একপ্রকারের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ।
  2. পরিবর্তন এবং নতুন কিছু করার চিন্তাচেতনা লালন করা: একটি ইংরেজি প্রবাদ আছে, Necessity is the mother of invention প্রয়োজন হচ্ছে উদ্ভাবনের জননী। যতক্ষণ না আমরা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি, পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করি না কিংবা বিশ্বকে নতুন কিছু দেওয়ার ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করতে পারিনা, আমরা প্রকৃত অর্থে জ্ঞান অর্জন করতে পারি না এবং আমরা আমাদের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যগুলো নির্ধারণ করতে পারিনা।
  3. লক্ষ্য ও উপ-লক্ষ্যনির্ধারণ করা: উপলক্ষ্য দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, বিভিন্ন স্টেপ বা ধাপ যার মাধ্যমে মৌলিক উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়। অর্থাৎ লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমসমূহকে উপলক্ষ্য বলা হয়। একজন মুসলমানের জীবনের উদ্দেশ্য কি তা খোঁজার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ আমরা তা খোদ কুরআন ও হাদীসে খুঁজে পাই। তা হল আল্লাহর ইবাদত করা ও তার রেজামন্দি হাসিল করা, দীনের প্রসার, নিজের ও সমাজের ধর্মীয় ও পার্থিব স্বার্থ হাসিল করা এবং দীন ও ইসলামের সেবা করা। কিন্তু এই লক্ষ্যগুলি অর্জনের উপায় কী, আমাদের প্রথমে এই ধাপগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং প্রত্যেকটিকে চিহ্নিত করে সেগুলোর ওপর কাজ শুরু করতে হবে।
  4. লাইব্রেরির সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন এবং সমস্ত বিষয়ের ওপর যথাসম্ভব টুকটাক ধারণা অর্জনের চেষ্টা করা: বইয়ের চেয়ে উত্তম কোনো বন্ধু হতে পারে না। সুতরাং সৃজনশীলতা অর্জনে লাইব্রেরিতে যেতে হবে এবং সমস্ত জ্ঞানের ওপর ভাল বাছাই করা বইগুলি অধ্যয়ন করতে হবে। বইগুলোকে একটি আলো মনে করে অধ্যয়ন করতে হবে। এটা দিয়েই আমাদের প্রদীপ জ্বালাতে হবে এবং এর মাধ্যমেই হাজার হাজার নিভে যাওয়া প্রদীপ জ্বালাতে পারি। অনেকগুলি বিষয় অধ্যয়ন করার পরে, আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি বা একাধিক শিল্পের প্রতি আগ্রহ খুঁজে পাব।
  5. নিজেকে চিন্তাশীল হিসেবে গড়ে তোলা: লাইব্রেরিতে বই অধ্যয়ন করুন কিন্তু এই ভেবে যে, এসবই আমাদের কেবল চিন্তা করতে সাহায্য করতে পারে। এর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যাবে না। যদি বই পড়ে আমরা নিজের জন্য চিন্তা করতে সক্ষম না হই তবে ব্যাপক অধ্যয়ন আমাদের অহংকার অন্যের সামনে তুলে ধরা ছাড়া আর কোনো উপকার করতে পারে না। ভাবুন যে, পৃথিবীর মহান চিন্তাবিদদের সময়ে বই ছিল না। শুধুই চিন্তা করার সুযোগ ছিল। তাই আমাদেরও ভাবা উচিত। বদ্ধ ঘরে বা বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে বা ঘোরাঘুরির সময় একা চিন্তা করুন। একই জিনিসটি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করুন কারণ একাগ্রতার শক্তি আমাদের চিন্তার মধ্যে গভীরতা তৈরি করে।
  6. তথ্য এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো: তথ্য সাধারণত আমরা বই থেকে প্রাপ্ত হই এবং অভিজ্ঞতাগুলি বড়দের কাছ থেকে শিখি। তবে সেই তথ্য এবং অভিজ্ঞতাগুলি তখনই কার্যকর হয় এবং আমাদের সৃজনশীলতা তখনই বিকশিত হয়, যখন আমরা নিজেরা সেগুলি প্রয়োগ করি এবং তার থেকে ফলাফল বের করার চেষ্টা করি। অধ্যয়ন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন ছাড়াও আমাদের দিনের কিছুটা সময় এই তথ্য এবং অভিজ্ঞতা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা উচিত। কারণ অধ্যয়নের সময় চিন্তা করার শক্তি সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু বিশ্রাম, স্নান বা অবসর সময়ে চিন্তাশক্তির কোনো সীমাবদ্ধতা থাকে না। এই চিন্তাভাবনা আশানুরূপ ভাল একটি সমাধান বের করে দিতে পারে।
  7. কোনো ধারণা নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় সমালোচনা থেকে বিরত থাকা: বিজ্ঞানের সূত্র মতে, মস্তিষ্কের দুটি অংশ রয়েছে। ডান গোলার্ধটি (hemisphere) ধারণাগত অর্থাৎ সেটি ব্যাক্তিকে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা বা ধারণা করতে সাহায্য করে এবং বাম গোলার্ধটি বিশ্লেষণাত্মক এবং সমালোচনামূলক, যেটি কোনো বিষয় ভালো-খারাপ, উচিত-অনুচিত যাচাইসহ যে-কোনো ধরনের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। প্রতিটিরই রয়েছে নিজস্ব ভূমিকা এবং গুরুত্ব। কিন্তু যখন আমরা একটি নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করি, তখন কখনই বাম দিককে প্রাধান্য দিবেন না এবং সমালোচনা করতে পছন্দ করেন এমন বন্ধুর সাথে আলোচনা করবেন না। অন্যথায় সমালোচনা প্রথমে আমাদের সৃজনশীলতা বিকশিত করতে দেবেনা এবং সেটা আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই সমাপ্তি লাভ করবে। সম্পূর্ণ চিন্তা প্রক্রিয়া সমাপ্ত এবং প্রস্তুত হওয়ার পর বাম-মস্তিষ্কের নিকট উপস্থাপন করা এবং সমালোচনামূলক বন্ধুদের সমালোচনার সাথে এটিকে পরিমার্জিত করা, যাতে এর ত্রুটিগুলি উন্মোচিত হয় এবং পরিমার্জিত হয়।
  8. প্রশ্ন উত্থাপন করার মন-মানসিকতা তৈরি করা: বলা হয়ে থাকে, حسن السوال نصف العلم ভালো প্রশ্ন করা জ্ঞানের অর্ধেক। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) নবী করীম (সা.)-এর মজলিসে বসে অল্প বয়সে প্রশ্ন করতেন। অন্যান্য সাহাবীগণ তাকে ভদ্রতা শিক্ষা দিতেন এবং নীরব থাকার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু মহানবী (সা.) তাকে উৎসাহিত করতেন। এমনকি হযরত ওমর (রাযি.) তার সম্পর্কে বলতেন, ذو لسان سؤول وقلب عقول ‘অনুসন্ধিৎসু ও গভীর অনুধাবন শক্তির অধিকারী।’ তাই যতক্ষণ আমরা প্রশ্ন করার অভ্যাস তৈরি না করি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অনেক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হবো।
  9. কোনো বিষয়ের ওপর পালটা যুক্তি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আগ্রহী হওয়া: আমরা পড়েছি, গবেষণা করেছি এবং প্রশ্ন উত্থাপন করেছি। এখন কাজ হচ্ছে সে বিষয়ে পরষ্পর আলোচনা করা। মনে রাখা দরকার, যুক্তি-তর্ক জ্ঞানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উদাহরণস্বরূপ: একটি বিষয় অধ্যয়নের পরে একটি অনুমান দাঁড় করানো, তার সম্পর্কে দলিল-প্রমাণ পেশ করা, শক্তি ও দুর্বলতার যুক্তি খুঁজে বের করা এবং বিতর্ক করা। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক সক্রেটিসকে সেই সময়ে দার্শনিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল যখন তিনি এথেন্সে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে বসে কাউন্সিলরদের সাথে তর্ক করতেন এবং তাদের লা জওয়াব করে দিতেন। বিতর্ক এমন একটি জিনিস, যা আমাদের শক্তি এবং দুর্বলতাগুলিকে উন্মোচিত করে। একটি মিশন বা চিন্তার সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করার জন্য সম্মিলিতভাবে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেয়ে ভাল উপায় আর নেই৷
  10. সুস্থ রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাথে বন্ধুত্ব করা: যাতে আমরা তাদের কাছে থাকা বই থেকে উপকৃত হতে পারি। অন্যথায় যখন আমাদের কোনো একটি শাস্ত্রের প্রতি অনুরাগ তৈরি হয়, অতঃপর রুচি অনুযায়ী বই পাওয়া না যায়, তখন আমাদের রুচি মরে যায়। আর সৃজনশীল কাজ করা সম্ভব হয় না। কেননা ذوق তথা রুচিই সৃজনশীলতার প্রথম ধাপ।
  11. এমন কিছু বন্ধু রাখা, যাদের কাছ থেকে আমরা শিখতে পারি এবং কিছু বন্ধু রাখা, যাদের ভুল সংশোধন করতে পারি: এটি অন্য কথায় বলা যেতে পারে, একজন ছাত্র হয়ে পাশাপাশি একজন শিক্ষকও হোন; যাতে افادة (কারো উপকার সাধন করা) এবং استفادة (কারো থেকে উপকৃত হওয়া) উভয়টা একসাথে চলতে পারে। কারণ একজন বন্ধু যে কেবল আমাদের শেখায়, আমাদের ত্রুটিগুলি খুঁজে বের করে, সে আমাদেরকে অপরিপক্ক বোধ করতে পারে। আর যে বন্ধু শুধুমাত্র শিখেছে, সে আমাদের মধ্যে একটি ইতিবাচক জিনিস তৈরি করে, সে তার ত্রুটিগুলি সংশোধন এবং অপসারণের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে বিশ্লেষণের শক্তি বিকাশ করছে। এ ক্ষেত্রে কিছু নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। যেমন আত্মতুষ্টি এবং অহংকার তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে যে, এই ব্যক্তি আমার ওপর নির্ভরশীল। তারমানে আমি সবকিছু জানি। এই ধরনের আত্মতুষ্টি আমাদের মধ্যে থেকে আরও জানার আগ্রহ নষ্ট করে দেয়।
  12. ডায়াগ্রাম এবং মানচিত্রের মাধ্যমে লেখা, শেখা মনে রাখা: মানবমন সুসংগত জিনিসগুলি দ্রুত আয়ত্ত করতে পারে। এটি আপাত মিলের কারণে যে, মস্তিষ্কের কোষগুলিও একে অপরের সাথে সংযুক্তাবস্থায় থাকে। তাই ডায়াগ্রাম এবং মাইন্ড ম্যাপিংও ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো আমাদের সৃজনশীলতা এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সহায়ক হয়। আরমাইন্ড ম্যাপ হল একটি ডায়াগ্রাম যা আপনার কাজ, তালিকা এবং ধারণাগুলি উপস্থাপন করে এবং একটি উত্তর বা সমাধান পেতে লিঙ্ক সাজানো হয়। মাইন্ড ম্যাপিং আপনার ধারণার দীর্ঘ তালিকাকে আরও স্মরণীয় এবং সুসংগঠিত তালিকায় পরিণত করতে সাহায্য করতে পারে। যদি আপনি একটি ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন, সাংগঠনিক চার্ট তৈরি করেন, একটি প্রকল্পের জন্য চিন্তাভাবনা করেন ইত্যাদি, মাইন্ড ম্যাপিং আপনাকে আপনার কাজগুলিকে সহজ করতে সাহায্য করতে পারে।

সৃজনশীল চিন্তার তিনটি প্রধান উপাদান রয়েছে: (১) উদ্ভাবন; (২) সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা; এবং (৩) সার্থক লক্ষ্য অর্জনের সক্ষমতা।

উদ্ভাবন বলতে বিদ্যমান বা ঐতিহ্যবাহী জিনিস, ধারণা ইত্যাদিকে পৃথক উপায়ে নতুনভাবে একত্রিত করা বা পুনর্বিন্যাস করাকে বোঝায়। পৃথিবীতে যতগুলো সৃজনশীল কাজ হয়েছে সর্বক্ষেত্রে পুরনো জিনিস বা ধারণাকে নতুনভাবে পেশ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যখন নিউটন একটি আপেল পড়ে যেতে দেখেন, তখন এই প্রক্রিয়াটি নিউটন বা অন্য কারও কাছে অনন্য ছিল না, তবে নিউটন এই প্রক্রিয়াটিকে একটি বিশেষ উপায়ে দেখেছিলেন, এটিকে একটি নতুন অর্থ দিয়েছিলেন এবং এভাবে (Gravity) অভিকর্ষের সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। তবে শুধুমাত্র উদ্ভাবন চিন্তা কর্মকে সৃজনশীল করে তোলে না। সৃজনশীলতার জন্য উদ্ভাবন চিন্তার পাশাপাশিসমস্যাসমাধান করারও ক্ষমতা থাকা এবং সার্থক লক্ষ্য অর্জনের সক্ষমতা থাকা আবশ্যক।

সৃজনশীল ব্যক্তির কিছু বৈশিষ্ট্য:

মনোবিজ্ঞানীদের কথা হলো, সৃজনশীল ব্যক্তিদের কিছু এমন বৈশিষ্ট্য থাকে যা তাদেরকে অন্যদের থেকে পৃথক করে দেয়। যেমন; তারা সাধারণত স্বাধীনমনাও অন্যদের ওপর কম নির্ভরশীল হয়। যদিও পরিচিতরা তাদেরকে একগুঁয়ে এবং বিদ্রোহী ভাবে। সাধারণত মানুষকে আনন্দিত করার অনুভূতি কম থাকে। তারা অবিচল, তারা যে কাজটি করতে আগ্রহী তা করে অধ্যবসায়ের সাথে। ব্যর্থতা ও অসুবিধাগুলিকে ভয় পায় না। তাদের সঙ্গীরা তাদের ছেড়ে গেলেও তারা অবিচল থাকে।

সাধারণ মানুষ সরলতা, ধারাবাহিকতা এবং শৃঙ্খলা পছন্দ করে, অস্পষ্টতা এবং দ্বন্দ্ব থেকে দূরে পালিয়ে যায় এবং কল্পিত বিশৃঙ্খলাকে ভয় পায়। এর বিপরীতে সৃজনশীল ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্বে অনেকটা নমনীয়তা থাকে। তারা ভাবপ্রবণ, আবেগপ্রবণ, রোমান্টিক, কল্পনাবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ হয়ে থাকে। উদ্ভাবকদের নতুন আবিষ্কৃত আইডিয়াকে ভেঙে ফেলা এবং নতুন সমাধান খুঁজে পেতে আগ্রহী হয়ে থাকে। তারা সৃষ্ট জিনিসের চেয়ে সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় বেশি আগ্রহী। তাদের চিন্তাধারা থেকে আবিষ্কৃত গবেষণা, জটিলতা ও একক সিদ্ধান্তকে তারা ভয় পায় না।

তারা সাধারণ মানুষের চেয়ে তাদের শক্তি এবং দুর্বলতা সম্পর্কে বেশি সচেতন। তাদের বাড়ির পরিবেশ সাধারণত ইতিবাচক। ঘরোয়া মারামারি বিরল। তারা যে পরিবেশে অধ্যয়ন করে তা স্বৈরাচারী নয়; বরং প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করে। তাদের সাথে শিক্ষকের সম্পর্ক সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ। শিক্ষকমণ্ডলি তাদের সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করেন।

এই তথ্যের আলোকে নিজের মধ্যে সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি।

(ক) আপনার চিন্তা-ভবনাকে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। যদি আপনার মনে কোনো প্রশ্ন জাগে, তবে এটিকে কেবল শয়তানী ফিসফিস বলে উপেক্ষা করবেন না, বরং জ্ঞানী লোকদের কাছ থেকে উত্তর জানার চেষ্টা করুন।

(খ) কোনো একটি বিষয় নিয়ে পরস্পর বিরোধী চিন্তা-ভাবনা করার অনুশীলন করুন। নিজেদের চিন্তাধারা থেকে আবিষ্কৃত গবেষণা, জটিলতা ও একক সিদ্ধান্তকে ভয় না পাওয়া।

(গ) আপনার বাড়িতে এবং প্রতিষ্ঠানে এমন পরিবেশ তৈরি করুন যা সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে। সৃজনশীলতাকে দমিয়ে না রেখে, বরং নতুন ধারণাকে স্বাগত জানান।

(ঘ) সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনাকে উন্নীত করার জন্য অনেক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই পদ্ধতিগুলির মধ্যে একটি হল (Brainstorming) ব্রেনস্টর্মিং যেখানে একটি গ্রুপকে একটি সমস্যার যতটা সম্ভব সমাধানের পরামর্শ দিতে বলা হয়। প্রথম পর্যায়ে একটি সমাধান ভালো এবং সম্ভাব্য কিনা তা ফোকাস করা হয় না। ফলস্বরূপ সবাই উপহাস বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে চুপ থাকে না। পরবর্তী পদক্ষেপ হল এই পরামর্শগুলির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলি মূল্যায়ন করা এবং সেরা পরামর্শ গুলি নির্বাচন করা।

সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা:

সৃজনশীল চিন্তাধারার প্রেক্ষাপটে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, কিছু মানুষ ধর্মের ব্যাপারে চিন্তা ও কর্মের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে যায়, যা সঠিক নয়, যেমন প্রাচীনকালে গুপ্তবাদের গোষ্ঠী এবং আধুনিক যুগে কিছু মহল একেশ্বরবাদ হিসাবে ধর্মের মৌলিক ধারণাগুলিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। নুবুওয়াত, পরকাল, নামাজ, রোজা, হজ এবং যাকাতে অনেক সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছে। আমাদের সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহ আমাদের যে ধর্ম দিয়েছেন তা পরিবর্তন করা একেবারেই অন্যায়।

দীনকে গ্রহণ করতে হবে সেভাবে, যেভাবে তা নবী করীম (সা.)-কে দেওয়া হয়ে ছিল। ধর্মের ক্ষেত্রে, আমাদের সৃজনশীল ক্ষমতা প্রয়োগের প্রধান ক্ষেত্র হল ধর্মীয় আদেশ বোঝা, ধর্মপ্রচারের নতুন উপায় খুঁজে বের করা এবং জীবনে ধর্মপালনের পথে আসা বাধাগুলি মোকাবেলা করার বাস্তব উপায় খুঁজে বের করা। তা করতে গিয়ে আমরা যদি নিজেরাই দীনের কোনো পরিবর্তন করতে শুরু করি, তাহলে আমরা দুনিয়াতেও হারিয়ে যাব এবং পরকালেও ব্যর্থ হবো।

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা রফিক আহমদ সাহেব আল্লাহর জিম্মায়

দেশের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস শারেহুল হাদীস, ইফাদাতুল মুসলিম শরহে সহীহ মুসলিম ও ঈযাহুল মিশকাতসহ কয়েকটি হাদিস গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার মাওলানা রফিক আহমদ ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

শনিবার (১৪ জানুয়ারি) রাত ৮:১৫ মিনিটে পটিয়াস্থ নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিতসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি ৬ ছেলে ও দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও হাজার হাজার ছাত্র রেখে যান। উপমহাদেশের খ্যাতিমান আলেম পটিয়া মাদরাসার সাবেক শায়খুল হাদীস আল্লামা আল-ইমাম আহমদ (রহ.) তাঁর বাবা ছিলেন। পরের দিন (১৫ জানুয়ারি) রবিবার সকাল ১১টায় জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া প্রাঙ্গনে নামাজে জানাযা শেষে মাকবারায়ে আজিজীতে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। তাঁর জামিয়া পটিয়ার মহাপরিচালক আল্লামা ওবাইদুল্লাহ হাফজাহ (হাফি.) গভীর শোক এবং মরহুমের পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।

মাওলানা রফিক আহমদ ১৩৬৪ হিজরি মোতাবেক ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের চাঁন্দগাঁও থানার অন্তর্গত মোহরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের মোজাহের উলুম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা ইসমাইল তাঁকে মধু পান করান এবং তাঁর কানে আজান দেন। ১৯৫১ সালে পটিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে মুফতি আজিজুল হক (রহ.)-এর কাছে পবিত্র কুরআনের প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন। ১৩৮৬ হিজরি মোতাবেক ১৯৬৭ সালে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। আঞ্জুমানে ইত্তিহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের অধীনে দাওরায়ে হাদিসের বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।

১৯৬৯ সালে রাউজান ইমদাদুল ইসলাম মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৩৯১ হিজরি মোতাবেক ১৯৭২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। ১৯৭৪ সালে নানুপুর ওবায়দিয়া মাদারাসায় দাওরায়ে হাদিস শুরু করা হলে তিনি সেখানে মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে তিনি পটিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। পটিয়া মাদরাসায় তিনি হাদিস ও তাফসির বিষয়ক পাঠদানের পাশাপাশি ছাত্রাবাস তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তা ছাড়া দীর্ঘ সময় তিনি এই মাদরাসার তাফসির বিভাগের প্রধান ছিলেন।

হাদীস, ফিকহ, তাফসীরসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অনেক ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর কিছু রচনা ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে সমাদৃত। আল্লামা মুহাম্মদ রফিক আহমদ (রহ.)-এর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো: ১. সহীহ মুসলিম গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইফাদাতুল মুসলিম, ২. মিশকাতুল মাসাবিহের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইজাহুল মিশকাত, ৩. আকরাবুল ওয়াসায়েল ইলা শরহিশ শামায়েল, ৪. কুররাতুল আইনাইন, ৫. দরসে হিদায়া, ৬. আল কালামুল মুতাবার ফি তাউযীহি নুরি সাইয়িদিল বাশার, ৭. ইরশাদুত তালিবীন ফি আহওয়ালিল মুসাল্লিফীন, ৮. জাহরুন নুজুম ফি মারিফাতিল ফুনুনি ওয়াল উলুম, ৯. আল-ইনশাউল জাদিদ মাআল লুগাতি ওয়াল খিতাবাত ও ১০. হাদিস পরিচিতি: ভারত-বাংলাদেশের প্রাতঃস্মরণীয় আউলিয়া ও মুহাদ্দিসীনসহ ইত্যাদি।

তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন, আল্লামা আহমদ (ইমাম সাহেব হুজুর) (রহ.), খতিবে আজম আল্লামা সিদ্দীক আহমদ (রহ.), মাওলানা শাহ ইউনুস (রহ.), আল্লামা আমির হোসাইন (মির সাহেব হুজুর) (রহ.), মাওলানা ফজলুর রহমান (রহ.), মুফতি ইবরাহিম (রহ.) মাওলানা আবদুল্লাহ দরখাস্তি পাকিস্তান, মাওলানা খালেদ মাহমুদ, মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালভী (রহ.), মাওলানা হোসাইন আহমদ (রহ.), মাওলানা ইসহাক আল-গাজী (রহ.), ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান (রহ.) প্রমুখ। মহান আল্লাহ মরহুমকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমিন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ