আল্লামা রফিক আহমদ (রহ.):
নিভৃতচারী এক জ্ঞানসাধকের বিদায়
বাংলাদেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ দীনি শিক্ষায়তন পটিয়া আল জামিয়া আল ইসলামিয়ার প্রবীণ মুহাদ্দিস, লেখক ও গবেষক হযরত আল্লামা রফিক আহমদ মোহরভী (রহ.) দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর বিগত ১৪ ডিসেম্বর’২২ ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর ইন্তেকালে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ হতে সময় লাগবে।
তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণধী ও সৃজনশীল মননের অধিকারী। ১৯৬৭ সালে আঞ্জুমানে ইত্তিহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের অধীনে দাওরায়ে হাদীসের বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭২ ইং সনে এস. এস. সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও ফার্সি ভাষায় তাঁর পারঙ্গমতা ছিল।
১৯৬৫ সনে ক্লাসিক্যাল যুক্তিবিদ্যা ও হিকমত-ফলসফার কিতাবাদি বিশেষত সদরা, শামসে বাযেগাহ, হামদুল্লাহ, উকলীদস, মুল্লা হাসান, খুলাসাতুল হিসাব, খিয়ালী, উমূরে আম্মা ইত্যাদির পঠন সমাপ্ত করেন। মেধাবী ও দক্ষ উস্তাদদের তত্ত্বাবধানে তাঁর জীবন ফলে ফুলে সমৃদ্ধ হয়৷ উস্তাদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হযরত মাওলানা মুফতি আজীজুল হক (রহ.), মাওলানা আহমদ (ইমাম সাহেব হুযুর) (রহ.), খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রহ.), মাওলানা শাহ ইউনুস (রহ.), মাওলানা আমির হোসাইন (মীর সাহেব হুযুর) (রহ.), মাওলানা ফজলুর রহমান (রহ.), মাওলানা মুফতি ইবরাহীম (রহ.), মাওলানা আবদুল্লাহ দরখাস্তী (রহ.) পাকিস্তান, মাওলানা খালেদ মাহমুদ (রহ.) লন্ডন, মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালবি (রহ.), মাওলানা হোসাইন আহমদ (রহ.), মাওলানা ইসহাক আল-গাজী (রহ.), ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান (রহ.) প্রমুখ।
পটিয়া আল জামিয়া আল ইসলামিয়ায় ৪৪ বছর তিনি শিক্ষকতার খিদমত আঞ্জাম দেন। দীর্ঘ পরিক্রমায় দরসে নিজামীর গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো পাঠদান করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। এতে তাঁর ইলমি গভীরতা ও বিষয়ভিত্তিক পাণ্ডিত্যের পরিচয় মেলে। কিতাবগুলোর মধ্যে রয়েছে, মুসলিম শরীফ, তাহাবী শরীফ, তিরমিযী শরীফ, শামায়েলে তিরমিযী, নাসায়ী শরীফ, মুয়াত্তা মালিক, মুয়াত্তা মুহাম্মদ, মিশকাত শরীফ (সম্পূর্ণ) নুখবাতুল ফিকার, ইবনে কাছীর, বায়যাবী শরীফ, তাফসীরে মাদারিক, শরহে আকাঈদ, হেদায়া ১ম, ৩য় ও ৪র্থ খণ্ড, কাওয়ায়েদ ফী উলূমিল হাদীস, মায়বুযী, সুল্লামুল উলূম, দীওয়ানে হামাসা, মাক্বামাতে হারিরী, মুখতাসারুল মা‘আনী, সাবয়ে’ মুআল্লাকাত, দীওয়ানে মুতানাব্বী, হুসামী ও কাফিয়া ইত্যাদি।
দরস ও তাদরীসের পাশাপাশি তিনি দীর্ঘকাল ছাত্রাবাস তত্ত্বাবধায়ক, মুনাযারা বিভাগ ও তাফসীরুল কুরআন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিপুলসংখ্যক দরসি ও গায়ের দরসি কিতাবের তিনি লেখক। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম ১. ইফাদাতুল মুসলিম শরহে সহীহ মুসলিম, ২. ঈযাহুল মিশকাত, ৩. আক্বরাবুল ওয়াসায়েল ইলা শরহিশ শামায়েল, ৪. কুররাতুল আইনাইন ফী শরহিল মুগাল্লাকাতি মুআত্তাইন, ৫. দরসে হিদায়া, ৬. হাদীস পরিচিতি: ভারত-বাংলাদেশের প্রাতঃস্মরণীয় আউলিয়া ও মুহাদ্দিসীন, ৭. ইরশাদুত তালিবীন ফী আহওয়ালিল মুয়াল্লিফীন, ৮. যাহরুন নূজুম ফী মা’রিফাতিল ফুনূনি ওয়াল উলূম, ৯. আল-ইনশাউল জাদীদ মা‘আল-লুগাতি ওয়াল খিতাবাত, ১০. হিদায়াতুল মুস্তারশিদীন ইলা হল্লি আভীসাতি কাসাসুন্নাবিয়্যীন, ১১. কাসাসুন্নাবিয়্যীন অনুবাদ, ১২. আল কালামূল মু’তাবার ফী তাউযীহি নূরি সায়্যিদিল বাশার ও ১৩. মহামানব (সা.)-এর নূর প্রসঙ্গ ইত্যাদিসহ আরও প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ তিনি রচনা করেন।
ছাত্রদের উপযোগী করে লেখা ইযাহুল মিশকাত বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেওবন্দের আল্লামা আনযার শাহ কাশ্মীরী (রহ.), আল্লামা আবদুল হক আ’যমী (রহ.), আল্লামা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপূরী (রহ.)-এর মতো খ্যাতনামা বিদ্বজ্জন ইযাহুল মিশকাতের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন,
‘শব্দবিশ্লেষণ, জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা ও বিতর্কিত মাসায়েলে প্রমাণসহ ইমামগণের অভিমত উপস্থাপন করতে লেখক যে অকৃত্রিম পরিশ্রম করেছেন তা সত্যই প্রসংশার যোগ্য। এতে ফিকহুল হাদীস, শরহুল হাদীস ও হুকমুল হাদীসের উপর নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হয়েছে এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মনীষীদের সূক্ষ্ম কথাগুলো অত্যন্ত সহজ ভাবে লেখা হয়েছে। এ ব্যাখ্যাগ্রন্থটি বিরক্তিকর দীর্ঘতা ও ক্ষতিকর সংক্ষিপ্ততা হতে মুক্ত। এ গ্রন্থটি অত্যন্ত সহায়ক, সহজ ও পরিপূর্ণ, এতে শিক্ষার্থীদের সামনে দীর্ঘতা পরিহার করে সারাংশ পেশ করা হয়েছে। এসময়ের ছাত্র-শিক্ষক-প্রবীণ সকলের জন্যই এ কিতাব অত্যন্ত উপকারী।’
মাওয়ায়েযে খতীবে আযম (রহ.) গ্রন্থে তিনি পটিয়া জামিয়ার শায়খুল হাদীস খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর মূল্যবান আলোচনা, বক্তৃতা ও দুর্লভ নসীহতগুলো সংকলন করেন।
আনওয়ারে আহমদী নামক গ্রন্থটি আল-জামিয়া পটিয়ার শায়খুল হাদীস ও সদরুল মুদাররিসীন হযরত মাওলানা আহমদ (ইমাম সাহেব হুযুর রহ.)-এর উর্দু ভাষায় রচিত জীবন-চরিত। আল-ইনশাউল জাদীদ মাআললুগাতি ওয়াল খিতাবাত গ্রন্থে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় ৩২টি বিষয়ের বিষয়ভিত্তিক আরবি-উর্দু-বাংলা-ইংরেজি শব্দ ভাণ্ডারসহ গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক আরবি রচনাবলি, পত্র, বক্তৃতা, সম্ভাষণ পত্র ও আবেদন পত্র সংবলিত এক চমৎকার সংকলন। ‘হাদীস পরিচিতি’ নামক গ্রন্থটি ভারত-বাংলাদেশের প্রাতঃস্মরণীয় আউলিয়া ও মুহাদ্দিসীন হাদীস শাস্ত্রের উৎস, উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস, হাদীসের বিস্তারিত পরিচিতি এবং উপমহাদেশে হাদীসচর্চার ইতিহাসসহ ভারত ও বাংলাদেশের মহান ও বিদগ্ধ হাদীস বিশারদদের জীবনী সংকলন।
তাঁর কর্মনিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তিতা তাঁর জীবনকে ঐতিহ্যমণ্ডিত করে। হেলাফেলা ও অবহেলায় তিনি সময় নষ্ট হতে দেননি। শিক্ষকতার পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগের সাথে তিনি জ্ঞানগবেষণায় জীবন উৎসর্গ করেন। এক দুবছর নয়, পুরো জীবন। কওমি অঙ্গনে টীকাটিপ্পনীসহ এতগুলো গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব অন্য কারও আছে কি না জানা নেই৷ থাকলেও যাঁদের আছে তিনি তাঁদের অন্যতম। আমাদের সমাজে অনেক দক্ষ ও প্রাজ্ঞ আলিম রয়েছেন কিন্তু লেখার হাত নেই। লেখার হাত আছে কিন্তু সময়ানুবর্তিতা নেই। ওয়াযের ময়দানে যেসব আলিম সক্রিয় তাঁদের পক্ষে কলম ধরা কঠিন। দরস-তাদরীস ও ওয়ায-নসিহতের আবেদন সাময়িক, লেখালেখির ফল দীর্ঘস্থায়ী। যে সময় বয়ে যায়, তা আর ফিরে আসে না।
আল্লামা রফিক আহমদ (রহ.)-এর ছেলে মাওলানা রিজওয়ান রফীক জমীরাবাদী বলেন, ‘তিনি সর্বাধিক যে মহান ব্যক্তির দীর্ঘ সান্নিধ্য অর্জন করেছেন তিনি হলেন নিজ পিতা আমার দাদাজি হযরত আল্লামা আহমদ (ইমাম সাহেব হুযুর রহ.)। তিনি যেমন তাঁর পিতা ছিলেন তেমনি ছিলেন তাঁর উস্তাদ এবং মুরশিদও । পিতাজি ৫০ বছর যাবৎ দাদাজির যে সান্নিধ্য পেয়েছেন তা বড়ই মহোত্তম জীবন ছিল বলে তিনি উল্লেখ করে বলেন, যখনই সুন্নত ও মুস্তাহাব পরিপন্থী কোন সামান্য কিছুও দাদাজির নজরে পড়ত সাথে সাথে তিনি কঠোরভাবে তা সংশোধনের তাগিদ দিতেন। যার ফলে তাঁর সুন্দর চরিত্র গঠনও প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্নতের চর্চায় তিনি বেশির ভাগ দিকনির্দেশনা ও তত্ত্বাবধান দাদাজির কাছেই পেয়েছেন।’
আমরা নিভৃতচারী এই জ্ঞানতাপস মনীষীর রুহের মাগফিরাত কামনা করি এবং দোয়া করি আল্লাহ তায়ালা হযরতকে জান্নাতুল ফিরদৌসে উচ্চ মাকাম নসিব করুন, আমিন।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন