বিধবা ও ডিভোর্সি নারীদের যেভাবে সম্মানিত করেছেন রসুলুল্লাহ (সা.)
মাওলানা হুমায়ুন আইয়ুব
লেখক: সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম২৪.কম
আমাদের সমাজে বিধবা ও ডিভোর্স হওয়া নারীদের বাঁকা চোখে দেখার প্রবণতা আছে। কেউ কেউ তো আবার এ ধরনের নারীদের বোঝাও মনে করে। কিন্তু ইসলাম এসব নারীদের জন্য রেখেছে সমান সম্মান। আর বিধবা বা ডিভোর্সি নারীরা অযোগ্য বা অসম্মানিত নন, তা মহানবী (সা.) নিজের জীবন থেকেই বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। চলুন দেখে নিই তাঁর একটি ঘটনা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা মেয়েটি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে আসেন। কুরাইশদের সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক কন্যা ছিলেন তিনি। গোত্র ও মায়ের দিক থেকে তাঁর বংশ মর্যাদা ছিল খুব উঁচু। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মুসলিম এই নারীর নাম হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশ (রযি.)। সম্পর্কে তিনি রসুল (সা.)-এর ফুফাতো বোন।
স্বামীকে হারিয়ে যায়নাব বিনতে জাহাশ হয়ে পড়েন খুব নিঃসঙ্গ। রসুল (সা.) হযরত যায়নাব (রযি.)-এর এ নিঃসঙ্গতা উপলব্ধি করেন এবং তাঁর জন্য একজন সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এবং তিনি চাইলেন, হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশ (রযি.)-কে তাঁরই পালক পুত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারিসা (রযি.)-এর সাথে বিয়ে দেবেন। সামাজিক মর্যাদায় যদিও দুজনের মাঝে ছিল বিশাল পার্থক্য, তবুও রসুল (সা.) তাঁর পালিত পুত্র যায়েদ (রযি.)-এর সাথে এই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কারণ যায়েদ (রযি.) ছিলেন একজন উঁচু মানের আলেম এবং যায়নাব (রযি.) ছিলেন একজন দানশীল মহিলা। রসুল (সা.) এই বিয়ের মাধ্যমে তাদের উভয়ের ইসলামী জীবন সমৃদ্ধ হবে—এ চিন্তা করেই এগিয়েছিলেন।
এরপর সম্মানিত নেতার মধ্যস্থতায় বিয়ে হয়ে যায় ফুপাতো বোন যায়নাবের সাথে পালক পুত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারিসা (রযি.)-এর। কিন্তু সেই বিয়েটা প্রথম থেকেই সুখের ছিল না, সেই বিয়েতে ছিল না কোনো ভালোবাসার বন্ধন। দিন কাটছিলো এভাবেই…. দুজনের মাঝে দূরত্ব বেড়েই চলছিল। কোনোভাবেই যেন মানসিক প্রশান্তি আসছিলো না।
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে নারী ও পুরুষকে বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সুখে-শান্তিতে পৃথিবীর জীবনকে উপভোগ করতে পারে। কিন্তু অনেক সময়ই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মানসিকতা বা চিন্তা-চেতনার মিল নাও হতে পারে। দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। এই দুর্বিষহ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে কেউ যদি ভালো থাকতে চায় এবং ডিভোর্স দিতে চায়, সেক্ষেত্রে ইসলামের কোনো বাধা নেই।
রসুল (সা.)-এর পরামর্শে হযরত যায়নাব (রযি.) ও হযরত যায়েদ ইবনে হারিসা (রযি.)-এর মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। যদিও তারা দুজনই ছিলেন সাচ্চা ঈমানদার। হযরত যায়নাব (রযি.) ছিলেন অত্যন্ত দীনদার একজন নারী এবং হযরত যায়েদ ইবনে হারিসা (রযি.) ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত একজন সাহাবী।
এরপর কিছু দিন চলে যায়, ইদ্দতকালীন সময়ও শেষ হয়। এবার মেয়েটির জন্য আবারো বিয়ের প্রস্তাব আসে। নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে, কে সেই ব্যক্তি যিনি একজন বিধবা এবং পরবর্তীতে ডিভোর্সি এমন একজন নারীকে বিয়ে করতে চান?
হ্যাঁ, সেই বিয়ের প্রস্তাবটি আসে সম্মানিত নেতা মুহাম্মদ রসুলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকে তাঁর নিজের জন্য! অ্যাডজাস্টমেন্ট না হওয়ায় বিয়ে ভেঙে যাওয়া এই নারীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেসময় সমালোচনা হয়েছে অনেক। কিন্তু রসুল (সা.) সেসব সমালোচনাকে স্তব্ধ করে দিয়ে আনন্দ ও সম্মানের সাথে গ্রহণ করেছিলেন হযরত যায়নাব (রযি.)-কে।
আর হ্যাঁ, রসুল (সা.)-এর সাথে হযরত যায়নাব (রযি.)-এর এই বিয়ের মাধ্যমে ইসলামে পালক সন্তানের অবস্থানও স্পষ্ট হয়ে যায়। কোনো শিশুকে পালক সন্তান হিসেবে নিলেও সেই শিশুটিকে তার জন্মদাতা পিতার পরিচয় নিয়েই থাকতে হবে এবং এ প্রসঙ্গে কুরআনের আয়াত নাযিল হচ্ছে,
فَلَمَّا قَضٰى زَيْدٌ مِّنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنٰكَهَا لِكَيْ لَا يَكُوْنَ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ حَرَجٌ فِيْۤ اَزْوَاجِ اَدْعِيَآىِٕهِمْ اِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا١ؕ وَكَانَ اَمْرُ اللّٰهِ مَفْعُوْلًا۰۰۳۷
‘অতঃপর যায়েদ যখন তার সাথে বিয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করলো, তখন আমি তাকে তোমার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করলাম, যাতে করে মুমিনদের মুখডাকা পুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে বিয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব নারীদের বিয়ে করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ অবশ্যই কার্যকর হতে হবে।’ (সূরা আল-আহযাব: ৩৭)
ডিভোর্সি সেই নারীর বিয়ে হয়ে গেল সম্মানিত নেতা মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে এবং তিনি হয়ে গেলেন উম্মুল মুমিনীন। কেমন ছিল সেই বিয়ের ওয়ালিমা?
হযরত আনাস (রযি.)-এর বর্ণনায়, তাঁর দেখা সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ওয়ালিমা ছিলো এটি এবং তখনকার সময়ে ওয়ালিমা অনুষ্ঠানে যেসব উন্নত খাবারের আয়োজন করা হতো তার সবই সেখানে ছিল।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রযি.) বলেন,
مَا أَوْلَـمَ النَّبِيُّ ﷺ عَلَىٰ شَيْءٍ مِنْ نِسَائِهِ مَا أَوْلَـمَ عَلَىٰ زَيْنَبَ.
‘রসুলুল্লাহ (সা.) হযরত যায়নাব (রযি.)-কে বিয়ে করার পর যত বড় ওয়ালিমা করেছিলেন তত বড় ওয়ালিমা তিনি তাঁর অন্য কোনো স্ত্রীর বেলায় করেননি।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৭/২৪, হাদীস: ৫১৬৮)
হযরত আনাস (রযি.) আরও বলেন,
لَـمَّا تَزَوَّجَ رَسُولُ اللهِ ﷺ زَيْنَبَ ابْنَةَ جَحْشٍ دَعَا الْقَوْمَ فَطَعِمُوْا.
‘রসুলুল্লাহ (সা.) যখন যায়নাব (রযি.)-কে বিয়ে করলেন তখন ওয়ালিমা করলেন এবং সে ওয়ালিমায় মানুষ রুটি-গোশত দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিল।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৬/১১৮, হাদীস: ৪৭৯১)
হ্যাঁ, আশেপাশে হাজারো কথায় জর্জরিত এক ডিভোর্সি নারীর ওয়ালিমার প্রোগ্রামটি এমনই অসাধারণ হয়েছিল। কী অসাধারণ মর্যাদায় সম্মানিত করেছিলেন তাঁকে তাঁর নতুন স্বামী!
হযরত যায়নাব (রযি.)-কে রসুল (সা.) তাঁর আগের সংসারের পরিণতি দিয়ে পরিমাপ করেননি। বরং পরিমাপ করেছেন তাঁর মাঝে বিদ্যমান ভালো গুণগুলো দিয়ে। বিয়ের পর এক অসাধারণ দাম্পত্য জীবন গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা দুজন। তৈরি করেছিলেন ভালোবাসার এক সুদৃঢ় বন্ধন।
এভাবেই সর্বোত্তম আদর্শ আল্লাহর রসুল (সা.) বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, একটি ইসলামি সমাজে বিধবা এবং ডিভোর্সি নারীরা কখনোই ‘অযোগ্য’ নন, ‘অসম্মানিত’ নন। বিধবা এবং ডিভোর্সি নারীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীও হোক ইতিবাচক। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীতে আসুক ইতিবাচক পরিবর্তন।