তাকলীদ অর্থাৎ শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের অনুসরণ করা এক সহজাত বিষয়। এটি ছাড়া জীবনগাড়ি দুই কদমও চলতে পারে না। তাকলীদ শুধু শরয়ী আহকাম ও মাসায়িলেই করা হয় না, বরং জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে তাকলীদ অনিবার্য। যারা কৃষিকাজ করে তারা তাদের বিজ্ঞদের অনুসরণ করে। যারা শিল্প ও বাণিজ্য করে তারা বিশেষজ্ঞদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিবেদিতপ্রাণ বিদ্বানরা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আলোর মশালে পরিণত করেন। বাচ্চা মা-বাবার গল্প করে, এটি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি প্রাণীকুলের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়।
তাকলীদে শখসীর আবশ্যকতা
মূল: শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী (রহ.)
তাসহীল ও তারতীব
শায়খুল হাদীস মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরী (রহ.)
মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ আমীন পালনপুরী
অনুবাদ: মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী
অনুবাদক: লেখক, গবেষক ও পীর সাহেব বায়তুশ শরফ, চট্টগ্রাম
তাকলীদের অর্থ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি পাওয়া যায়। তাই শুরুতেই এর সঠিক অর্থ বুঝতে হবে।
তাকলীদের অর্থ
তাকলীদ (تَقْلِيْدٌ) বাবে তাফয়ীল (تَفْعِيْلٌ)-এর মাসদার (ধাতুমূল)। যার অর্থ হচ্ছে, হার পরিধান করানো। এর মূল ধাতু হচ্ছে, قِلَادَةٌ। قِلَادَةٌ যখন মানুষের গলায় পরানো হয় তখন সেটাকে মালা ও হার বলা হয় এবং প্রাণীর গলায় পরানো হলে রশি বলা হয়। قَلَّدَهُ الْقِلَادَةَ-এর অর্থ হচ্ছে, হার পরানো। قَلَّدَ الْبَعِيْرَ-এর অর্থ হচ্ছে উটের গলায় রশি লাগানো। এ আলোচনায় তাকলীদের অর্থ হচ্ছে, কোনো মুজতাহিদকে নিজের ভক্তি-ভালোবাসার হার পরানো অর্থাৎ তাঁর ভক্ত হওয়া, তাঁকে নিজের চেয়ে বড় ধারণা এবং তাঁর অনুসরণ করা।
তাকলীদে শখসীর মর্ম
شَخْصٌ-এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ। এখানে সম্বন্ধসূচক ي আছে, কারণ شَخْصِيٌّ-এর অর্থ হচ্ছে, নির্দিষ্ট কোনো মানুষ। আর তাকলীদে শখসীর (تَقْلِيْدِ شَخْصِيْ) অর্থ হচ্ছে, মুজতাহিদ ইমামগণের মধ্য থেকে সুনির্দিষ্ট কারও অনুসরণ করা, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাঁকে ভক্তি-ভালোবাসার মালা পরানো এবং দীনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা স্থাপন করা।
হযরত (শায়খুল হিন্দ) রহ. ঈযাহুল আদিল্লায় এ আলোচনা বেশ বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। যার সার-সংক্ষেপ হচ্ছে,
بنائے تقلید فقط اِس امر پر ہے کہ جس فن میں کوئی کسی کی تقلید کرے، مُقَلِّد کے ذمہ یہ ضروری ہے کہ اس شخص کو اپنےحوصلہ کے موافق بالاجمال قابلِ تقلید سمجھتا ہو، اور فنِّ مذکور میں اس کی رائے اور فہم کا مُعْتَقِد ہو، اور بالاجمال یہ بات بھی جانتا ہو کہ وہ شخص حتَّی الوَسع اِس بات کی کوشش کرتا ہے کہ جو کہے مطابقِ قواعدِ فن کہے—علومِ سافِلہ سے لے کر علومِ عالیہ تک تقلید کا مدار اسی پر ہے، حتّٰی کہ تقلیدِ انبیاء بھی اسی امر پر موقوف ہے۔
‘তাকলীদের ভিত্তি একথার ওপর যে, যে শাস্ত্রে কেউ কারও তাকলীদ করে। তাকলীদকারীর দায়িত্বে এটি জরুরি যে, সেই ব্যক্তিকে নিজের আস্থা অনুযায়ী সার্বিকভাবে তাকলীদের যোগ্য বলে মনে করবে এবং উপর্যুক্ত শাস্ত্রে তাঁর মতামত ও সিদ্ধান্তের প্রতি ভক্ত-শ্রদ্ধাশীল হবে। সার্বিকভাবে একথা জেনে রাখতে হবে যে, ওই ব্যক্তি যথাসম্ভব একথার চেষ্টা করেন যে, তিনি যা বলেন তা শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ীই বলেন। জ্ঞানের প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর পর্যন্ত তাকলীদের ভিত্তি এরই ওপর নির্ভর। এমনকি আম্বিয়ায়ে কেরামের তাকলীদও এ বিষয়টির ওপর নির্ভরশীল।’[1]
তাকলীদের অর্থ নিয়ে বিভ্রান্তি
সাধারণভাবে তাকলীদের অর্থ হিসেবে ধারণা করা হয়, নিজের গলায় রশি বাঁধা অর্থাৎ নিজের লাগাম অন্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া আর তিনি যেখানেই নিয়ে যান অন্ধভাবে তার পেছনে পথ চলা। লোক বাকধারা আছে, تقلید کا قِلَادہ گردن میں ڈالنا (গলায় তাকলীদের রশি পরা) ও اندھی تقلید کرنا (অন্ধবিশ্বাস)। এ বাকধারা দু’টো এই ভুল বোঝাবুঝির ওপরই প্রচলিত। যেসব ব্যক্তি আরবি ভাষা সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা ভালো করেই জানেন যে, তাকলীদের এ অর্থ নিরেট ভুল। কেননা তাকলীদে রশি নিজের গলায় পরানো হয় না, বরং অন্যের গলায় পরানো হয়। আর তাও নিজের খুশি ও ইচ্ছায়। আর এখান থেকেই قَلَّدَهُ الْعَمَلَ (তাকেকাজটি সোপর্দ করেছে) এবং تَقْلِيْدُ الْقَاضِيْ (জজ বানানো) অর্থে ব্যবহৃত।
যদি তাকলীদের অর্থ নিজের গলায় রশি পরা হয়, তাহলে مُقَلِّدٌ (হার পরিয়ে দাতা) আর مُقَلَّدٌ (হার পরিধানকারী) দুইজনই একই ব্যক্তি হয়ে যায়। অথচ সত্তা فَاعِلٌ (কর্তা) ও مَفْعُوْلٌ (কৃত) একই হতে পারে না। অতএব তাকলীদের সঠিক অর্থ হচ্ছে, অন্যের গলায় হার পরানো। এ অবস্থায় লোকজন হচ্ছে مُقَلِّدٌ (হার পরিয়ে দাতা) আর ইমাম হচ্ছেন مُقَلَّدٌ (হার পরিধানকারী)।
তাকলীদের অর্থে পাওয়া এ ভুল বেঝাবুঝি যদি দূর করে নেওয়া যায় তাহলে তাকলীদের সঠিক অর্থ বুঝে যাবেন। তখন আশা করি যে, তাকলীদে শখসী নিয়ে সৃষ্ট অনেক প্রশ্নের এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে।
আরেকটি বিভ্রান্তি
অনুরূপভাবে দীনী আহকাম ও শরয়ী মাসায়িল সম্পর্কে আরেকটি বিভ্রান্তি পাওয়া যায় যে, প্রত্যেক হুকুম ও মাসআলার জন্য কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট দলিল তলব করা হয়। সাধারণভাবে দারুল ইফতা থেকে মাসায়িল জানার জন্য প্রশ্নকারী লিখে থাকেন যে, ‘কুরআন ও হাদীস থেকে জবাব দিন।’ তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, কোনো স্পষ্ট আয়াত বা হাদীস পেশ করুন। অথচ এটি তো সম্ভবই নয়, প্রত্যেক মাসআলার কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট করে উল্লেখ থাকা জরুরি নয়। অনেক মাসায়িল নসের ইঙ্গিতে বা নির্দেশনা বা দাবি থেকে বেরোয়। কিছু মাসায়িল উম্মতের ইজমা দ্বারাও সাব্যস্ত হয়। এছাড়া ইজতিহাদ ও কিয়াস একটি স্বতন্ত্র নীতি, যা দিয়ে মাসায়িল উদ্ভাবন করা হয়। কিন্তু এটি কী করে সম্ভব যে, প্রত্যেক মাসআলায় স্পষ্ট নস উপস্থাপন করতে হবে!?
আলোচ্য মাসআলায় গায়রে মুকাল্লিদ আল্লামা মুহাম্মদ হুসাইন সাহেব বাটালভী তাকলীদে শখসী সম্পর্কে কুরআন করীম ও হাদীস শরীফের স্পষ্ট নির্দেশনা তলব করেছেন। অর্থাৎ কুরআনের এমন কোনো আয়াত বা এমন কোনো হাদীস শরীফ তাকে দেখানো হয় যেখানে একথা লেখা থাকবে যে, সকল মুসলমানের ওপর ইমাম আবু হানিফা রহ. বা ইমাম শাফিয়ী রহ. কিংবা অন্য কোনো ইমামের তাকলীদ ওয়াজিব। তিনি এ চ্যালেঞ্জ এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে দিয়েছেন যে, হিন্দুস্তানের হানাফীরা এমন নস কোথা থেকে দেখাবেন? অথচ এ ধরনের প্রশ্ন স্বয়ং বিভ্রান্তির ওপর প্রতিষ্ঠত যে, প্রত্যেক মাসআলার জন্য স্পষ্ট নস ও সহীহ হাদীসের প্রয়োজন নেই। এজন্য হযরত (শায়খুল হিন্দ) রহ. নিজের জবাবপত্রে সর্বপ্রথম তার থেকে দুটো মাসআলা—যা সকল মুসলমানের নিকট সার্বজনীন, বরং ইসলামের ভিত্তি এবং মুসলমানদের নিকট অত্যন্ত স্পষ্ট বিষয়গুলোর অন্যতম—স্পষ্ট নস তো তলব করেছেন, তার আগে এ দুই মাসআলা স্পষ্ট নস দ্বারা প্রমাণ করুন। তারপরই হানাফীদের থেকে দলিল দাবি করুন। প্রথম মাসআলা হচ্ছে, কুরআন শরীফের অনুসরণ করা ওয়াজিব হওয়া এবং দ্বিতীয় মাসআলা হচ্ছে হুযুর আকরম D-এর আনুগত্য ওয়াজিব হওয়া।
কিন্তু একই সাথে (তিনি) একথাও ইরশাদ করেছেন যে, প্রথম মাসআলা কুরআনে পাক দ্বারা সাব্যস্ত করা যাবে না। নতুবা تَوَقُّفُ الشَّيْءِ عَلَىٰ نَفْسِهِ[2] আবশ্যক হবে। আবার হাদীস দ্বারাও সাব্যস্ত করা যাবে না। কেননা হাদীসের ওয়াজিবুল ইত্তিবা (অনুসরণ আবশ্যকীয়) হওয়া এটি কুরআনে করীমের ওয়াজিবুল ইত্তিবা হওয়ার ওপর নির্ভর। অনুরূপভাবে দ্বিতীয় মাসআলাও হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত করা যাবে না। নতুবা تَوَقُّفُ الشَّيْءِ عَلَىٰ نَفْسِهِ আবশ্যক হবে। আবার কুরআন দ্বারাও সাব্যস্ত করা যাবে না। কেননা কুরআনের ওয়াজিবুল ইত্তিবা হওয়া রসুলের হাদীসের ওয়াজিবুল ইত্তিবা হওয়ার ওপর নির্ভরশীল।
সারাংশ হচ্ছে, কুরআনের ওয়াজিবুল ইত্তিবা হওয়া রসুলের হাদীসের ওয়াজিবুল ইত্তিবা হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। আর রসুলের হাদীস ওয়াজিবুল ইত্তিবা হওয়া কুরআনের ওয়াজিবুল ইত্তিবা হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। এতে দাওর[3] (গোলক-ধাঁধায়) পতিত হবে। যদি উভয়টির অনুসরণ ওয়াজিব হওয়া তৃতীয় কোনো দলিলের ওপর নির্ভরশীল হয় তখন প্রশ্ন হবে যে, এই তৃতীয় দলিল ওয়াজিবুল ইত্তিবা হওয়া কোথা থেকৈ সাব্যস্ত হয়েছে? যদি কুরআন ও হাদীসের ওপর এটি প্রমাণিত হওয়া নির্ভর করে তাহলে দাওর আরোপিত হবে অথবা তাসালসুল[4] (গোলকধাঁধায়) পতিত হবে। এ দুটো জিনিসই বাতিল। কাজেই বাটালভী সাহেবকে ওয়াজিব প্রমাণকারী দলিলের নসে সীমাবদ্ধ থাকার দাবি থেকে হাত ধুয়ে বসে থাকতে হবে। আর তিনি বাধ্য হবেন যে, এ দুই জিনিসের অনুসরণ ওয়াজিব হওয়া কুরআন-হাদীস ব্যতিরেকে তৃতীয় কোনো দলিল দ্বারা প্রমাণ করতে। এ অবস্থায় আমরাও ব্যক্তি-তাকলীদ সেই দলিল দ্বারা সাব্যস্ত করবো যা দিয়ে তিনি কুরআন-হাদীস ওয়াজিবুল ইত্তিবাহ হওয়া সাব্যস্ত করবেন।
সেই দলিল যা দিয়ে বাটালভী সাহেব কুরআন ও রসুলকে ওয়াজিবুল ইত্তিবা প্রমাণ করবেন তা তো কোনো নস হতে পারে না। কেননা নস অর্থাৎ নকলি দলিল কুরআন ও হাদীসেই সীমাবদ্ধ। হ্যাঁ, যদি কোনো ব্যক্তি নিজেকে নিজে অহীর বাহক ঘোষণা করেন এবং শেষনবী D-এর পর নিজেকে নিজে নবী ও রসুল বলে প্রচার করে এবং এ দাবি করেন যে, আমার ওপর অহীর মাধ্যমে নস নাযিল হয়েছে যে, কুরআন ও রসুলে আকরম সা.-এর অনুসরণ ওয়াজিব তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু কোনো মুসলমানের পক্ষ থেকে এটা কিভাবে আশা করা যায়? সুতরাং বেচারা বাটালভী সাহেব বাধ্য হবেন যে, কিতাবুল্লাহ ও রসুলুল্লাহর অনুসরণ ওয়াজিব হওয়া হয় ইজমায়ে উম্মত থেকে সাব্যস্ত করবেন অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলে। কেননা এ দুই বিষয়ও শরীয়তের দলিল। এ অবস্থায় হযরত (শায়খুল হিন্দ) রহ.ও তাকলীদে শখসীর আবশ্যকতা সেই দলিলেই প্রমাণ করে দেখাবেন।
[متن ادلۂ کاملہ]
دفعۂ خامِس: آپ ہم سے وجوبِ تقلید کی دلیل کے طالب ہیں—ہم آپ سے وجوبِ اتباعِ محمدی ﷺ، ووجوبِ اتباعِ قرآنی کی سند[5])) کے طالب ہیں، اگر ایک ان میں سے دوسرے کیلئے وجوبِ اتباع کی سند ہے تو پھر اس کے وجوبِ اتباع کی کیا سند؟ رسول اللہ ﷺ کا واجبُ الاتباع ہونا اگر قرآن شریف سے ثابت ہوتا ہے، تو قرآن شریف کا واجبُ الاتباع ہونا کہاں سے ثابت ہوا؟ اور قرآن شریف کا واجبُ الاتباع ہونا رسول اللہ ﷺ کے ارشاد سے ثابت ہوا، تو رسول اللہ ﷺ کا واجبُ الاتباع ہونا کہاں سے ثابت ہوا؟ بجز اس کے کہ آپ اپنے آپ کو یا اپنے اَقران[6])) واَمْثال کو مَہْبِطِ وَحْیِ آسمانی قرار دیں، اور رسول اللہ ﷺ کی خاتِمیَّت کو رَلَا مِلا دیں[7])) اور کوئی تدبیر نہیں! مگر ہرچہ[8])) باداباد آپ ایسی ہی سند غیر معتبر لائیں، اور دس نہیں بیس لے جائیں! ورنہ پھر ہماری طرف سے یہ گذارش ہے کہ آپ جس مَوْطِن[9])) سے سندِ وجوبِ اتباعِ نبوی وقرآنی نکال کر لائیں گے، اُسی مَوْطِن سے ہم سندِ وجوبِ اتباعِ امام نکال کر دکھائیں گے۔
‘পঞ্চম দফা: আপনারা আমাদের কাছে তাকলীদ ওয়াজিব হওয়ার বিষয়ে দলিল তলব করেছেন। আমরা আপনাদের কাছে (হযরত) মুহাম্মদ সা.-এর আনুগত্য ওয়াজিব এবং কুরআনের অনুসরণ ওয়াজিব হওয়ার সনদ তলৰ করছি। যদি এ দুইয়ের মধ্যে একটি অন্যটির আনুগত্য ওয়াজিব হওয়ার সনদ হয় তাহলে সেই দ্বিতীয়টির আনুগত্য ওয়াজিব হওয়ার সনদ কী? রসুলুল্লাহ সা.-এর আনুগত্য ওয়াজিব হওয়া যদি কুরআন শরীফ দ্বারা সাব্যস্ত হয়, তবে কুরআন শরীফের অনুসরণ ওয়াজিব হওয়া কোথা থেকে সাব্যস্ত হবে? আর কুরআন শরীফের অনুসরণ ওয়াজিব হওয়া রসুলুল্লাহ সা.-এর ইরশাদ দ্বারা সাব্যস্ত হয়, তবে রসুলুল্লাহ সা.-এর আনুগত্য ওয়াজিব কোথা থেকে সাব্যস্ত হবে? এই নয় যে, আপনি নিজে নিজেকে অথবা ঘনিষ্ট ও ঘরানার কাউকে আসমানি অহীর বাহক ঘোষণা করবেন এবং রসুলুল্লাহ সা.-এ খতমে নুবুওয়াতকে ধুলোয় মিলে দেবেন। এছাড়া কোনো গতি আছে কি? কিন্তু সামান্যই কেন নয়, যা হওয়ার তাই হোক। আপনি অনির্ভরযোগ্য সনদই না হয় পেশ করুন! দশের পরিবর্তে ২০ নিয়ে যান। নতুবা আমাদের পক্ষ থেকে আবেদন হচ্ছে, আপনি যে ধরনের উৎস থেকে ইত্তিবায়ে নববী ও কুরআনীর ওয়াজিব হওয়ার সনদ পেশ করছেন সেই উৎস থেকেই আমি ইমামের তাকলীদ ওয়াজিব হওয়ার দলিল পেশ করে দেখাবো।’
জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে[10]
গায়রে মুকাল্লিদ আল্লামা মুহাম্মদ হুসাইন সাহেব বাটালভী যুগের মুজতাহিদ হওয়ার দাবিদার ছিলেন। কিন্তু তিনি ও তার ঘরানার সকল মুজতাহিদগণ মিলে হযরত (শায়খুল হিন্দ) রহ. -এর এত পরিষ্কার ও স্পষ্ট বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝতে পারেননি। তারা জবাবে বলেছেন যে,
سائل باوجودے کہ اہلِ اسلام میں سے ہے، پھر ہم سے وجوبِ اتباعِ کتاب وسنت کی دلیل—خلافِ آدَابِ مناظرہ—کیوں طلب کرتا ہے؟ کہ در صورتِ تسلیم اسلام کے، سائل کے نزدیک بھی واجب الاتباع ہونا کتاب وسنت کا مُسَلَّم ہی ہوگا؟ ورنہ دعوئے اسلام محض کذب ہو جائے گا۔
‘প্রশ্নকারী (শায়খুল হিন্দ) একজন মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ ওয়াজিব হওয়ার দলিল—বিতর্কের শিষ্টাচার পরিপন্থী—কেন দাবি করছেন? ইসলামকে মেনে নেওয়া সত্ত্বেও! প্রশ্নকারীর নিকটও কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ ওয়াজিব হওয়া অনস্বীকার্যই হবে। নতুবা মুসলমান হওয়ার দাবি নিরেট মিথ্যাই হবে।’[11]
না বুঝেই মিসবাহুল আদিল্লায় ইরান-তুরানের গল্প লিখেছেন। হযরত (শায়খুল হিন্দ) রহ. ঈযাহুল আদিল্লায় যথেষ্ট নোটিশ করেছেন। সম্মানিত আগ্রহী পাঠকগণ সেটি অবশ্যই অধ্যয়ন করুন। আমরা এখানে মূল মাসআলা নিয়ে সাধারণ পাঠকদের আগ্রহ সৃষ্টির জন্য অল্পবিস্তর আলোচনা পেশ করছি।
তাকলীদ স্বভাবজাত বিষয়
তাকলীদ অর্থাৎ শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের অনুসরণ করা এক সহজাত বিষয়। এটি ছাড়া জীবনগাড়ি দুই কদমও চলতে পারে না। তাকলীদ শুধু শরয়ী আহকাম ও মাসায়িলেই করা হয় না, বরং জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে তাকলীদ অনিবার্য। যারা কৃষিকাজ করে তারা তাদের বিজ্ঞদের অনুসরণ করে। যারা শিল্প ও বাণিজ্য করে তারা বিশেষজ্ঞদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিবেদিতপ্রাণ বিদ্বানরা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আলোর মশালে পরিণত করেন। বাচ্চা মা-বাবার গল্প করে, এটি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি প্রাণীকুলের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়।
খোদ গায়রে মুকাল্লিদ হযরাতও তাকলীদ বিষয়টিকে শুধু জায়েয নয়, বরং জরুরিও মনে করেন। এছাড়াও হাদীস শরীফের ওপর আমল করার জন্য হাদীসের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেখানে মহান পূর্বসূরিদের মতামতের অনুসরণ করা জরুরি।
মোটকথা যখন তাকলীদ বিষয়টির বৈধতা, বরং অপরিহার্যতা একটি স্বভাবজাত বিষয় এবং পক্ষ-বিপক্ষের সবাই এর প্রবক্তা, তখন দলিলের তেমন একটা প্রয়োজনীয় নয়। তারপরও হৃদয়ের প্রশান্তির জন্য নিম্নে কুরআন-হাদীস থেকে কিছু দলিল উল্লেখ করা হল।
- প্রথম দলিল: আল্লাহ তাআলার ইরশাদ,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اَطِيْعُوا اللّٰهَ وَاَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَاُولِي الْاَمْرِ مِنْكُمْۚ ۰۰۵۹
‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহর নির্দেশ, রসুলের নির্দেশ এবং তোমাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের নির্দেশও মেনে চল।’[12]
এ আয়াতে করীমায় আল্লাহ তাআলা ও রসুলুল্লাহ সা. ছাড়াও উলুল আমরের অনুসরণ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এ আয়াতে করীমা থেকে স্পষ্টভাবে আল্লাহ, রসুলের তালীদ ছাড়াও আনুগত্য ও তাকলীদ সাব্যস্ত হয়।
বাকি থাকল একথা যে, উলুল আমর কে? এ আলোচনা অনেক দীর্ঘ। এর সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে, প্রথম যুগে এর উদ্দেশ্য ছিল সেসব শাসকবর্গ যারা হয় নিজেরা শরীয়তের বিধিবিধানে পারদর্শী ছিলেন অথবা তারা নিজেরে সাথে এমন আলেমদের রাখতেন যারা প্রয়োজনের সময় তাঁদেরকে শরীয়তের বিধিবিধান বলতে পারেন এবং তাঁরা শাসকদেরকে হুকুম দিতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে এক দিকে শাসকবর্গ মূর্খতার শিকার হয়ে যায় আর অন্য দিকে শাসনব্যবস্থাও নুবুওয়াতের পদ্ধতি থেকে বিচ্যুত হয় এবং স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। তখন আলেমরা শাসকবর্গ থেকে দূরে সরে যান। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, শাসকরা শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলান আর ওলামায়ে কেরাম উম্মতের ধর্মীয় পথনির্দেশনার দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। আজ পর্যন্ত এ অবস্থাই অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং এ অবস্থায় উলুল আমরের উদ্দেশ্য ওলামায়ে কেরামই তো হবেন। শাসকরা যদি তাদের ফরমান শরীয়াসম্মত হয় তাহলে তারাও আয়াতে করীমার উদ্দেশ্য হবেন। নতুবা হবেন না। নববী ইরশাদ হচ্ছে,
«لَا طَاعَةَ لِـمَخْلُوْقٍ فِيْ مَعْصِيَةِ الْـخَالِقِ».
‘আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টির মাঝে সৃষ্টির আনুগত্য জায়েয নয়।’[13]
- দ্বিতীয় দলিল: আল্লাহ পাকের ইরশাদ:
فَسْـَٔلُوْۤا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَۙ۰۰۴۳
‘যদি তোমরা না জেনে থাক তাহলে যারা জানে তাদের থেকে জেনে নাও।’[14]
এ আয়াতে করীমা যদিও বিশেষ পরিস্থিতিতে নাযিল হয়েছে। কিন্তু যেহেতু শব্দ ব্যাপকতাসূচক, সুতরাং শব্দাবলির ব্যাপকতা ধর্তব্য হবে। উসূলে ফিকহর নীতি হচ্ছে,
الْعِبْرَةُ لِعُمُوْمِ اللَّفْظِ لَا لِـخُصُوْصِ الْـمَوْرِدِ.
‘নসের শব্দের ব্যাপকতা গ্রহণযোগ্য, শানে নুযুল ও অগ্র-পশ্চাতের বিশেষত্ব গ্রহণযোগ্য নয়।’[15]
এছাড়াও হযরত জাবির (ইবনে আবদুল্লাহ) রাদি. থেকে একটি মারফু হাদীসে বর্ণিত আছে, যা তাফসীরে আদ-দুররুল মানসুরে উপর্যুক্ত আয়াতের প্রেক্ষাপটে উল্লেখ করা হযেছে। একথা স্পষ্টভাবে বুঝে আসে যে, আয়াতে করীমাটি ব্যাপকতাবাচক। হাদীসটি হচ্ছে,
‘হুযুর আকরম সা. ইরশাদ করেছেন যে, দীনী কথা জানে এমন ব্যক্তির জন্য সমীচীন নয় যে, তিনি জানা সত্ত্বেও নিশ্চুপ থাকবেন। আবার জানে না এমন লোকেরও উচিত নয় যে, না জেনেও নীরব বসে থাকবে। যেহেতু আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, فَسْـَٔلُوْۤا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَۙ۰۰۴۳ (যদি তোমরা না জেনে থাক তাহলে যারা জানে তাদের থেকে জেনে নাও।)[16] সুতরাং মুমিনদের জন্য উচিত হচ্ছে যে, সে যেন একথা জেনে যেন যে, তার আমল শরীয়সম্মত নাকি শরীয়ত বিরোধী।’[17]
আর এটি জানার পদ্ধতি হচ্ছে, জ্ঞানীজনের কাছে জিজ্ঞাসা করা এবং তাঁরা যা নির্দেশনা দেবেন তা গ্রহণ করা। এরই নাম আনুগত্য ও তাকলীদ।
- তৃতীয় দলিল: হুযুর আকরম সা. ইরশাদ:
«عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْـخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْـمَهْدِيِّيْنَ، تَمَسَّكُوْا بِهَا، وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ». (رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُوْ دَاوُدَ وَالتِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ)
‘তোমরা আমার ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নত আকড়ে ধর, তাঁদেরকে দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করো এবং মাঢ়ির দাঁত দ্বারা মজবুতভাবে কামড়ে ধর।’[18]
এ হাদীস শরীফে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতের অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব এর দ্বারা সাধারণভাবে তাকলীদের ব্যাপারটি নির্দেশিত বলে সাব্যস্ত হয়।
- চতুর্থ দলিল: হযরত জাবির (ইবনে আবদুল্লাহ) রাদি. বলেন, আমরা (জিহাদের জন্য) একটি সফরে বের হই। আমাদের একজনের মাথায় পাথরের (আঘাত) লাগে, এতে তার মাথা জখম হয়। এরপর তার স্বপ্নদোষ হয়। তিনি তাঁর সঙ্গীদের কাছে মাসআলা জিজ্ঞাসা করলেন, আমার জন্য কি তায়াম্মুম করা জায়েয হবে? লোকজন জবাব দিলেন যে, আপনার কাছে যখন পানি আছে, কাজেই আপনার জন্য তায়াম্মুম করা জায়েয নেই। তিনি গোসল করলেন এবং এতে তাঁর মৃত্যু হয়ে গেল। যখন আমরা ফিরে এসে হুযুর আকরম সা.-এর খেদমতে আসি, তখন কেউ একথা হুযুর আকরম D-এর বললে হুযুর আকরম সা. ইরশাদ করলেন,
«قَتَلُوْهُ قَتَلَهُمُ اللهُ، أَلَّا سَأَلُوْا إِذْ لَـمْ يَعْلَمُوْا، فَإِنَّمَا شِفَاءُ الْعِيِّ السُّؤَالُ».
‘এই লোকেরা তাকে মেরে ফেলেছে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মেরে ফেলবেন। যখন তারা জানে না তখন জিজ্ঞাসা করে নিল না? অজ্ঞতার চিকিৎসা হচ্ছে তো জেনে নেওয়া।’[19]
আলেমদের থেকে মাসআলা জিজ্ঞাসা, তারপর তা অনুসরণ করাই তাকলীদ। এগুলো সবই সাধারণ তাকলীদ ওয়াজিব হওয়ার দলিল এবং উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা সাধারণভাবে তাকলীদ ওয়াজিব হওয়ার কোনো অস্বীকারকারী নেই, গায়রে মুকাল্লিদরা এটি মানেন।
তাকলীদে শখসী ও তাকলীদে গায়রে শখসী
সাধারণ তাকলীদ যার ফরজ ও ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত। এটি আবার দুই প্রকার। (১) তাকলীদে শখসী ও (2) তাকলীদে গায়রে শখসী। তাকলীদে শখসী হচ্ছে, সকল মাসআলায় বিশেষ কোনো ইমামের অনুসরণ করা। আর তাকলীদে গায়রে শখসী হচ্ছে, যে মাসআলায় যার মনে যা চায় অনুসরণ করা।
সোনালি যুগে যেহেতু আত্মপূজার প্রাবল্য ছিল না, এ করণে তাকলীদের দুই প্রকারের মধ্যে যেটির ওপর ইচ্ছা আমলের স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু সোনালি যুগের পর যখন আত্মপূজার প্রাবল্য হয়, তখন তাকলীদে গায়রে শখসীকে ক্ষতিকর এবং তাকলীদে শখসীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়। হযরত (শায়খুল হিন্দ) রহ. ঈযাহুল আদিল্লায় লিখেছেন,
ہمارا دعویٰ یہ ہے کہ اس زمانہ میں عوام کو—یعنی جو لوگ حسبِ اصطلاح وتعریف علماء وفقہاء نہ مجتہدین میں شمار کئے جاتے ہیں، نہ مُرَجحین میں داخل ہو سکتے ہیں علی الخصوص جبکہ وہ کسی مذہب کے پابند بھی ہو چکے ہوں—تقلیدِ شخصی ضروری ہے، ائمۂ مجتہدین میں سے جس کی چاہے ایک کی تقلید کریں، گو قابلِ تقلید واتباع اور بھی سمجھے جاتے ہیں، ہاں بوقتِ ضرورت کسی مسئلہ خاص میں اور ائمہ کی تقلید بھی مُباح ہے كَمَا هُوَ مَبْسُوْطٌ فِيْ كُتُبِ الْفِقْهِ، مگر یہ تقلیدِ شخصی کے منافی نہیں۔
اور یہ تقلید ممنوع ہے کہ اس زمانہ میں ہر ایک عام وخاص کو اباحتِ مُطْلَقَہ ومُطْلَقُ العنانی دی جائے کہ ہر مسئلہ میں جب چاہے جس کی چاہے تقلید کر لیا کرے۔
‘আমাদের দাবি হচ্ছে, এই যুগের সাধারণ মানুষের—যারা পরিভাষা ও ওলামা-ফুকাহার সংজ্ঞায় না মুজতাহিদের আওতায় পড়ে, আর না প্রমাণ নিরক্ষরদের মধ্যে অন্তর্ভুত হতে পারে। বিশেষ করে যখন তারা কোনো মাযহাবের অনুসারী হয়ে থাকে—তাদের জন্য তাকলীদে শখসী জরুরি; মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে থেকে যাঁকে ইচ্ছা একজনের তাকলীদ করবে। তবে অন্যান্য ইমামগণও তাকলীদ ও অনুসরণযোগ্য বলে ধারণা করা হবে। হ্যাঁ, প্রয়োজনবশত কোনো বিশেষ মাসআলায় অন্যান্য ইমামবর্গের তাকলীদ বৈধ। ফিকহের কিতাবসমূহে এর সবিস্তার বিবরণ রয়েছে। কিন্তু এটি ত্তাকলীদে শখসীর পরিপন্থী নয়।
আর এ যুগের প্রত্যেক সাধারণ-বিশিষ্টকে সাধারণভাবে বৈধতা ও স্বাধীনতা দেওয়া যায় যে, যেকোনো মাসআলায় যখন চায় যার ইচ্ছা তাকলীদ করবে—এ ধরনের তাকলীদ নিষিদ্ধ।’[20]
তাকলীদে শখসীর ইতিহাস
প্রথম দিকে অর্থাৎ দুইশত বছর পর্যন্ত তাকলীদে শখসীর প্রচলন কম ছিল। তাকলীদে গায়রে শখসীর ব্যাপক প্রচলন ছিল। উদ্ভুত মাসআলায় প্রত্যেক মানুষ যেকোনো আলেম থেকে জিজ্ঞাসা করে নিত। আর তিনি যে শরয়ী হুকুম দিতে তার ওপর আমল করতেন। কিন্তু দ্বিতীয় শতকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে দুই ধরনের চিন্তাধারার আবির্ভাব ঘটল, এক. ফুকাহায়ে মুহাদ্দিসীন ও দুই. মুহাদ্দিসীনে ফুকাহা।
‘মুহাদ্দিসীনে ফুকাহা’ বলতে সেসব হযরাত উদ্দেশ্য যাদের প্রধান কাজ হচ্ছে হাদীস রেওয়ায়েত করা, কিন্তু তাঁরা মুজতাহিদও ছিলেন। এজন্য তাঁরা হাদীস বর্ণনার পাশাপাশি মাসায়িলও বয়ান করতেন। লোকজন উপকৃত হওয়ার মানসে কিংবা প্রয়োজনবশত তাঁদের থেকে মাসায়িল জিজ্ঞাসা করতো এবং তাঁরা জবাব দিতেন। মুয়াত্তা ইমাম মালিক এর উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
আর ‘ফুকাহায়ে মুহাদ্দিসীন’ বলতে সেসব হযরাত উদ্দেশ্য, যাদের প্রকৃত কাজ ছিল ফিকহী মাসআলায় গবেষণা করা। যে যে মাসআলা তাঁরা উদ্ভাবন করতে তাঁরা তা গ্রন্থিত করতেন। তাঁরা হাদীস শরীফের বর্ণনা অনেক কম করতেন।
মুহাদ্দিসীনে ফুকাহার শিরোমণি হলেন ইমাম মালিক রহ.। আর ফুকাহায়ে মুহাদ্দিসীনের পুরোধা হলেন ইমাম আযম হযরত আবু হানিফা রহ.। অতঃপর এ পরম্পরা অব্যাহত থাকে এবং তাঁদের শিষ্যদের যুগ এল। ধীরে ধীরে মুসলমানরা দুটো অংশে বিভক্ত হয়ে গেল এবং ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারার অনুসরণ করতে লাগল।
ইমাম আবু হানিফা রহ. -এর শিষ্যদের ওপর আল্লাহ তাআলার বিশেষ দয়া ছিল যে, তাঁর শিষ্যরা অসামান্য যোগ্যতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও উসূল (মূলনীতি) ও ফুরূ’ (শাখা)-এ তাঁদের ইমাম থেকে খুব বেশি দূরে সরেননি। কিন্তু ইমাম মালিক রহ. -এর সাথে হয়েছে ব্যতিক্রম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাঁর বিশিষ্ট শাগরিদ ইমাম শাফিয়ী রহ. তাঁর থেকে ইলম অর্জন করে ইরাক চলে যান এবং ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর শিষ্যদের থেকেও ইলম অর্জন করেন। দুটো উৎস থেকে উপকৃত হওয়ার ফলাফল এই দাঁড়াল যে, তিনি তাঁর উস্তাদ ইমান মালিক রহ. থেকে উসূলেও পৃথক হয়ে গেলেন এবং ফুরূয়েও ভিন্নমত অবলম্বন করলেন। আর তাঁর পৃথক চিন্তাধারার সৃষ্টি হয়।
অতঃপর ইমাম শাফিয়ী রহ. -এর বিশিষ্ট শাগরিদ ইমান আহমদ ইবনে হাম্বল w খলকে কুরআনের মাসআলায় অসমান্য আত্মত্যাগ স্বীকার করেন। ফলে একদল তাঁর প্রতিও আস্থা জ্ঞাপন করেন। এভাবে এই চার ইমামদের জ্ঞান তাঁদের শিষ্যরা সংরক্ষণ করেন।
এই চার ইমাম ছাড়াও আরও অনেক মুজতাহিদ আর্বিভূত হন, কিন্তু তাঁরা ভালো শিষ্য পাননি, যারা তাঁর জ্ঞানকে সংরক্ষণ করবেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দী মুজতাহিদে পূর্ণ ছিল। এমন বিধিবিধান খুব কমই ছিল, যা জায়েয-নাজায়েয ও মুস্তাহাব-মকরুহ ইত্যাদিতে মতপার্থক্য হয়নি।
অন্যদিকে যুগ-প্রজন্মের মাঝে লোভ-লালসা সাধারণভাবে প্রবল হতে থাকে। তারা শিথিলতা খুঁজতে থাকে। যে মুজতাহিদের বক্তব্য নিজের খায়েশমতো পেত সেটা তারা গ্রহণ করত। এক সময় এমনও আশঙ্কার সৃষ্টি হয় যে, সুদৃঢ় দীন খাহেশাতের সমষ্টিতে পরিণত হয়ে না যায় এবং মুসলমানরা দীনের অনুসণের পরিবর্তে দীনকেই তাদের খাহেশাতের অনুসারী করে না নেয়। এ কারণে চতুর্থ শতাব্দীর শীর্ষ মনীষীগণ এমন প্রেক্ষাপটে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করেন। তাঁদের জ্ঞানে এটিই একটি বোধের উদয় হয় যে, এখন তাকলীদে গায়রে শখসী থেকে মানুষকে নিষেধ করতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে, তারা যেন ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদ করে। যাতে মানুষ তাকলীদে গায়রে শখসীর অন্তরালে আত্মপূজারি হয়ে না যায় এবং অযোগ্য মুজতাহিদের আর্বিভাবও বন্ধ হয়ে যায়।
রইল কথা এই প্রশ্নের যে, তাকলীদের জন্য কোন ধরনের ব্যক্তিদের নির্বাচন করা হবে। একথা তো স্পষ্ট যে, সাহাবাযুগের পর তাবিয়ীদের স্তর থেকে এমন ব্যক্তিদের নির্বাচন করা চায় যাঁদের ইলম সংরক্ষিত। কেননা শরীয়তের দলিল তিন প্রকার: (১) কুরআনে করীম, (২) সুন্নতে নববী ও (৩) সাহাবায়ে কেরামের সর্বসম্মত আমল।[21] কাজেই তাবিয়ীদের থেকে এমন ব্যক্তিদের নির্বাচন করা সমীচীন মনে হয়, যাঁরা তিন উৎসকে সামনে সামনে রেখে শরীয় হুকুম গ্রন্থনা করেছেন। তাবিয়ীদের মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব শুধু ইমাম আবু হানিফা রহ.-এরই ছিল। তবে সকল মুসলমানদের তাঁর প্রতি ঐকমত্য হওয়া কঠিন ছিল। কেননা উম্মতের এক বিশাল অংশ মুহাদ্দিসীনে ফুকাহার অনুসরণ করে। এজন্য তবয়ে-তাবিয়ীদের মধ্যে ইমাম মালিক রহ.-কে নির্বাচন করা হয়। ইমাম মালিক রহ.-এর ওপরও এ চিন্তাধারাকে ঐকমত্য করা সম্ভবপর ছিল না। একটি বড় সংখ্যা ইমাম শাফিয়ী রহ.-কে অনুসরণ করতেন এবং আরেকদল হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.-কে অনুসরণ করত। এ কারণে এ মহান দুই ব্যক্তিত্বকেও নির্বাচন করা হয়।
এভাবে চারজন ব্যক্তি মনোনীত হন। যাঁদের স্ব স্ব প্রভাব-বলয় ছিল এবং তাঁদের গবেষণা গ্রন্থিত ও বিন্যস্তও হয়েছিল। সুতরাং চতুর্থ শতাব্দী থেকে পুরো মুসলিম উম্মাহ এ চার ইমামের তাকলীদে শখসীর ওপর ঐকমত্য পোষণ করেছে এবং তাঁরে ছাড়া অন্য কারও তাকলীদ নাজায়েয বলা হয়েছে।[22]
ইজমায়ে উম্মতে তাকলীদে শখযী ওয়াজিব
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, তাকলীদে শখসীর আবশ্যকতা উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। আর ইজমায়ে উম্মত উসুলে শরীয়তের তৃতীয় দলিল। এর দ্বারা প্রমাণিত বিধানও অকাট্য হয়। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. শরহে সিফরুস সাআদা গ্রন্থে লিখেছেন,
لیکن قراردارِ علماء، ومصلحتِ دیدِ ایشاں، در آخر زماں، تعیین وتخصیصِ مذہب است، وضبط وربطِ کارِ دین ودنیا ہم دریں صورت بود۔
‘তবে আলেমদের প্রস্তাবনা ও তাঁদের দূরদর্শিতা হচ্ছে শেষ জামানায় মাযহাবের নির্ধারণ-নির্বাচন। দীন-দুনিয়ার শৃঙ্খলা ও সংহতির জন্য এটিই জরুরি ছিল।’[23]
হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. তাঁর ইনসাফ গ্রন্থে লিখেছেন যে,
وَبَعْدَ الْـمِائَتَيْنِ ظَهَرَ فِيْهِمِ التَّمَذْهَبُ لِلْمُجْتَهِدِيْنَ بِأَعْيَانِهِمْ، وَقَلَّ مَنْ كَانَ لَا يَعْتَمِدُ عَلَىٰ مَذْهَبِ مُجْتَهِدٍ بِعَيْنِه، وَكَانَ هَذَا هُوَ الْوَاجِبُ فِيْ ذَلِك الزَّمَانِ.
‘দ্বিতীয় শতাব্দীর পর মানুষের মাঝে বিশিষ্ট মুজতাহিদের তাকলীদের প্রবণতা সৃষ্টি হয়। বেশ কম মানুষই অবশিষ্ট ছিল যারা কোনো বিশিষ্ট মুজতাহিদের মাযহাবের প্রতি আস্থা স্থাপন করেনি। আর এ ব্যাপারটি সেই যুগে ওয়াজিব ছিল।’[24]
অর্থাৎ নুবুওয়াতের যুগ থেকে দূর হয়ে যাওয়ার কারণে উম্মতের মাঝে যেসব বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, অপরিপক্ক মুজতাহিদদের যেভাবে প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যেভাবে স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হয়েছিল এর চিকিৎসায় তাকলীদে শখসী ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না।
কিছু মানুষের মতপার্থক্য
সেই যুগে, বরং দুর্ভাগ্যবশত এর আগেও উম্মতের মাঝে এমন এক গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছিল যারা শুধু কুরআনকে দলিল বলে গ্রহণ করত। সুন্নতে নববী ও হাদীস শরীফকে তারা দলিল হিসেবে মানত না। এ ফেরকাকে আহলে কুরআন বলা হয়। বর্তমানেও পথিবীর কোনো প্রান্তে তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু তাদের বিতর্ক ইজমায়ে উম্মতের মাঝে ঝামেলা বাঁধাতে পারেনি। কেননা বিভ্রান্ত ফেরকার বিতর্কে ইজমায়ে উম্মতকে প্রভাবিত করতে পারেনি।
অনুরূপভাবে দ্বিতীয় শতাব্দীতেই আরও একটি ফেরকা আত্মপ্রকাশ করে। যারা কুরআনে করীম ছাড়াও হাদীস শরীকে দলিল হিসেবে মানে। কিন্তু এর নিম্নে সাহাবায়ে কেরামের সর্বসম্মত আমল ও কিয়াসকে শরীয়তের দলিল হিসেবে স্বীকার করে না। এসব লোক গোড়ার দিকে আহলে যাওয়াহের বা যাহেরি বলে খ্যাত ছিল। পরে ক্রমশ তারা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলা শুরু করে।[25] অর্থাৎ যারা কুরআনে করীম ছাড়াও হাদীসসমূহকে দলিল হিসেবে মানে। এর নীচে ইজমায়ে সাহাবা ও কিয়াসকে তারা দলিল হিসেবে স্বীকার করে না। এ ফেরকা আজও সক্রিয়। সময়ে-অসময়ে সেসব মাসআলা নিয়ে হইচই ও ঝামেলা করতে থাকে, যা সাহাবায়ে কেরামের যুগে ইজমা দ্বারা মীমাংসিত হয়েছে। যেমন তারাবীহর ২০ রকআত হওয়া। এ গ্রুপটা সেটিকে তাচ্ছিল্য করে সুন্নতে ওমরী আখ্যা দেয়। এদের মধ্যে যারা বেয়াদব তারা বিদআতে ওমরী বলার ধৃষ্টতা দেখায়। অনুরূপভাবে হযরত উসমান গনী রহ.-এর যুগে জুমার জন্য যে আযানটি বৃদ্ধি করা হয় সেটিকে এসব লোকে সুন্নতে উসমানী বলে ঠাট্টা করে।
এই দুই গ্রুপের মোকাবেলায় ৯০ ভাগ (মুসলমান) কুরআনে করীমকেও দলিল হিসেবে মানে। সুন্নতে নববীকেও দলিল হিসেবে মানেন। আর সাহাবায়ে কেরামের সর্বসম্মত আমলকেও দলিল হিসেবে গ্রহণ করে। তাঁদেরকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত বলা হয়। সুন্নতঅলা অর্থাৎ সুন্নতে নববীকে দলিল হিসেবে মান্যকারী; এ অংশ দ্বারা ফেরকায়ে আহলে কুরআন থেকে পৃথক হয়। আর জামায়াতঅলা অর্থাৎ জামায়াতে সাহাবার ইজমাকে দলিল হিসেবে মান্যকারী; এ অংশ দ্বারা ফেরকায় আহলে হাদীস থেকে পৃথক হয়। এটিই হাদীস শরীফের আলোকে মুক্তিপ্রাপ্ত দল। মিশকাত শরীফে হুযুর আকরম সা.-এর ইরশাদ:
‘অবশ্যই আমার উম্মত সেই পরিস্থিতির শিকার হবে বনি ইসরাইল যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল। সম্পূর্ণ তাদের মতো হুবহু। এমনকি তাদের কেউ প্রকাশ্যে আপন মায়ের সাথে কুকর্ম করে থাকলে আমার উম্মতের মাঝেও কিছু লোক এ কুকর্ম করবে। বনি ইসরাইল ৭২ ফেরকায় বিভক্ত হয়েছিল আর আমার উম্মত ৭৩ ফেরকায় বিভক্ত হবে। যাদের সবাই জাহান্নামে যাবে, একটি মাত্র জামায়াত ছাড়া। সাহাবায়ে কেরাম রাদি. জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসুল! তারা কারা? হুযুর আকরম D ইরশাদ করেন,
«مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ».
‘আমি ও আমার সাহাবীদের পথে যারা আছে।”[26]
এ হাদীস শরীফ এবং এছাড়া আরও বিভিন্ন হাদীস থেকে সাব্যস্ত যে, সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের অনুসরণও দীনের অংশ এবং মুক্তির জন্য জরুরি। এ কারণে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত তাকলীদে শখসীর জন্য সেসব ইমামদের নির্বাচন করেছেন যারা সাহাবীদের যুগের পরপরই এসেছেন, যাঁরা শরয়ী হুকুম-আহকাম গ্রন্থনা ও বিন্যাসে সাহাবাদের পদাঙ্ক অনুসরণের যত্ন নিয়েছেন।
মোদ্দাকথা ফেরকায়ে আহলে হাদীস শুধু আহলে সুন্নত। তারা ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়। অতএব তাদের বিতর্ক সৃষ্টি ইজমায়ে উম্মতের মধ্যে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারবে না।
আহলে হাদীস কি গায়রে মুকাল্লিদ?
ফেরকায়ে আহলে হাদীস, যাদেরকে গায়রে মুকাল্লিদ বলা হয়। সেটা এই হিসেবে যে, তারা চার ইমামের তাকলীদ করে না, নতুবা তারাও মুকাল্লিদ। কেননা গায়রে মুকাল্লিদ হওয়া এটাও স্বয়ং একটি চিন্তাধারা। যেহেতু যারাই আহলে হাদীস তারা নিজেদের মাসআলা আহলে আলেমের কাছেই জিজ্ঞাসা করে। যেভাবে একজন হানাফী স্বীয় মাসআলা কোনো হানাফী আলেমের কাছেই জিজ্ঞাসা করে। অতএব এটি তাকলীদে শখসী নয়তো আর কী? যদি আহলে হাদীসরা প্রকৃত অর্থেই গায়রে মুকাল্লিদ হত তাহলে তারা তাদের উদ্ভুদ মাসআলা শুধু তাদের আলেমদের থেকেই জিজ্ঞাসা করত না, বরং প্রত্যেক আলেম থেকে জিজ্ঞাসা করতো। হয় তিনি হানাফী হন বা শাফিয়ী কিংবা আহেল হাদীস। কিন্তু সবাই জানে যে, তারা তাদের আলেমদের থেকে মাসআলা জিজ্ঞাসা করেন। সুতরাং বোঝা গেল যে, তারাও অন্যদের মতো মুকাল্লিদ করে।
বাকি থাকলো এ প্রশ্নের যে, তারাও যখন মুকাল্লিদ হয়ে গেল, তাহলে চার ইমামের তাকলীদ কেন করে না? এর জবাব হচ্ছে, তারা চার ইমামের তাকলীদ এজন্যই করে না যে, চার ইমাম যেহেতু সাহাবায়ে কেরামের ইজমাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেন আর আহলে হাদীস ইজমাকে দলিল হিসেবে স্বীকার করে না। কিন্তু তারা মুসলমানদেরকে একথা পরিষ্কার করে বলতে পারে না। নতুবা উম্মত তাদেরকে ঘৃণা করবে। বরং হতে পারে যে, তাদের অধিকাংশ লোক আহলে হাদীসের জামায়াত থেকে পৃথক হয়ে যাবে। এজন্য তারা মানুষকে একথা বলে বিভ্রান্ত করে যে, এ চার ইমাম চারটি মূর্তি, তাঁদের তাকলীদ শিরক, তাঁদেরকে ছেড়ে দাও এবং আমাদের তাকলীদ করো। আল্লাহ তাআলা সকল মুসলমানদেরকে এদের ধোঁকাবাজি থেকে আমাদের হেফাজত করুন এবং তাঁর মর্জিমতো চলার তওফিক দান করুন। আমীন।
[1] মাহমুদ হাসান দেওবন্দী, ঈযাহুল আদিল্লা, মাতবায়ে কাসেমি দেওবন্দ, ইউপি, ব্রিটিশ ভারত (প্রথম সংস্করণ: ১৩৩০ হি. = ১৯১২ খ্রি.), পৃ. ১৩০-১৩১ (সংক্ষেপিত)
[2] অর্থাৎ কোনো বিষয়ের প্রমাণ খোদ সেই বিষয়ের ওপর নির্ভর হওয়া।
[3] দাওর (উর্দু: دَور): এটি تَوَقُّفُ الشَّيْءِ عَلَىٰ نَفْسِهِ-এর আরেক নাম।
[4] তাসালসুল (উর্দু: تَسَلْسُل): তাসালসুল হচ্ছে تَوَقُّفُ الشَّيْءِ عَلَىٰ غَيْرِهِ إِلَىٰ غَيْرِ النِّهَايَةِ অর্থাৎ একটি বিষয়ের প্রমাণ অন্য আরেকটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল হওয়া এবং দ্বিতীয় বিষয়টি তৃতীয় কোনো বিষয়ের ওপর, তৃতীয় বিষয়টি চতুর্থ কোনো বিষয়ের ওপর। এভাবে অনন্তহীনভাবে নির্ভরশীলতার পরম্পরা চলতে থাকার নাম।
[5] سَنَدْ: দলিল।
[6] أَقْرَانٌ: قَرِيْنٌ-এর বহুবচন: সমসাময়িক লোক, সমসাময়িক। أَمْثَالٌ: مِثْلٌ-এর বহুবচন: মতো, অনুরূপ। مَهْبَطٌ: অবতীর্ণ হওয়ার স্থান।
[7] অর্থাৎ হুযুর আকরম D-কে খাতামুন্নাবিয়ীনও মানে এবং একই সঙ্গে আপনার নিকট ঐশী প্রত্যাশে আসার দাবিও করে, যেমন অভিশপ্ত কাদিয়ানি করেছিল।
[8] অর্থাৎ সামান্যই কেন নয়, যা হওয়ার তাই হোক। এটি ফারসি বাগধারা। লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাধীনতা দেওয়া হল, আপনি যেমন ইচ্ছা তেমনই দলিল নিয়ে আসুন। চায় সেটি অগ্রহণযোগ্যই হোক না কেন? কিন্তু আনুন তো! আমরাও দেখি যে, আপনি নস অর্থাৎ নকলি দলিল কোথা থেকে নিয়ে আসেন?!
[9] مَوْطِن-এর প্রকৃত অর্থ: দেশ ও রণাঙ্গন। مَوْطِن থেকে হযরত (শায়খুল হিন্দ রহ)-এর কুরআন ও হাদীস ছাড়া অন্যান্য দুই দলিল ইজমায়ে উম্মত ও কিয়াস উদ্দেশ্য।
[10] মূলত: ڈھول کے اندر پول। একটি উর্দু বাগধারা। যার অর্থ হচ্ছে, ১. বস্তবে কিছু নেই, সবই লোকদেখানো, ২. কোনো সমস্যায় ফেঁসে যাওয়া, ৩. গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাওয়া ও ৪. কোনো কথা গোপনীয় থাকা।—স. চৌ.
[11] মুহাম্মদ আহসান আমরূহী, মিসবাহুল আদিল্লা লি-দাফয়িল আদিল্লা আল-আযিল্লা, মাতবায়ে ফয়েযে আম, দিল্লি, ব্রিটিশ ভারত (প্রথম সংস্করণ: ১২৯৫ হি. = ১৮৭৭ খ্রি.), পৃ. ৩২
[12] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নিসা, ৪:৫৯
[13] আত-তাবারানী, আল-মু’জামুল কবীর, খ. ১৮, পৃ. ১৭০, হাদীস: ৩৮১
[14] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নাহল, ১৬:৪৩ ও সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:৭
[15] রশীদ আহমদ গঙ্গুহী, আল-কাওকাবুদ দুররী আলা জামিয়িত তিরমিযী, মাতবাআতু নাদওয়াতিল উলামা লখনউ, ইউপি, ভারত (প্রথম সংস্করণ: ১৩৯৫ হি. = ১৯৭৫ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ১৭০
[16] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নাহল, ১৬:৪৩ ও সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:৭
[17] (ক) আস-সুয়ুতী, আদ-দুররুল মানসুর ফিত তাফসীর বিল মা’সুর, খ. ৫, পৃ. ১৩৩; (খ) আত-তাবারানী, আল-মু’জামুল আওসাত, খ. ৫, পৃ. ২৯৮, হাদীস: ৫৩৬৫; (গ) আদ-দায়লামী, আল-ফিরদাউসু বি-মাসূরিল খিতাব, খ. ৫, পৃ. ১৩৯, হাদীস: ৭৭৪৮
عَنْ جَابِرٍ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «لَا يَنْبَغِيْ لِلْعَالَـمِ أَنْ يَسْكُتَ عَنْ عِلْمِهِ، وَلَا يَنْبَغِيْ لِلْجَاهِلِ أَنْ يَسْكُتَ عَلَى جَهْلِهِ»، وَقَدْ قَالَ اللهُ: [فَسْـَٔلُوْۤا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَۙ۰۰۴۳] {النحل: 43 والأنبياء: 7}، فَيَنْبَغِيْ لِلْمُؤْمِنِ أَنْ يُعْرَفَ عَمَلُهُ عَلَىٰ هُدًى أَمْ عَلَىٰ خِلَافِهِ.
[18] (ক) আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, খ. ২৮, পৃ. ৩৭৫, হাদীস: ১৭১৪৫; (খ) ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, খ. ১, পৃ. ১৫, হাদীস: ৪২; (গ) আবু দাউদ, আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ২০০, হাদীস: ৪৬০৭; (ঘ) আত-তিরমিযী, আস-সুনান, খ. ৫, পৃ. ৪৪, হাদীস: ২৬৭৬; (ঙ) আত-তাবরীযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, আল-মাকতাবুল ইসলামী লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর, বয়রুত, লেবনান (তৃতীয় প্রকাশ: ১৪০৫ হি. = ১৯৮৫ খ্রি.), খ. 1, পৃ. ৫৮, হাদীস: ১৬৫
[19] আবু দাউদ, আস-সুনান, খ. ১, পৃ. ৯৩, হাদীস: ৩৩৬
عَنْ جَابِرٍ، قَالَ: خَرَجْنَا فِيْ سَفَرٍ فَأَصَابَ رَجُلًا مِنَّا حَجَرٌ فَشَجَّهُ فِيْ رَأْسِهِ، ثُمَّ احْتَلَمَ فَسَأَلَ أَصْحَابَهُ، فَقَالَ: هَلْ تَجِدُوْنَ لِيْ رُخْصَةً فِي التَّيَمُّمِ؟ فَقَالُوْا: مَا نَجِدُ لَكَ رُخْصَةً وَأَنْتَ تَقْدِرُ عَلَى الْـمَاءِ فَاغْتَسَلَ فَمَاتَ، فَلَمَّا قَدِمْنَا عَلَى النَّبِيِّ ﷺ أُخْبِرَ بِذَلِكَ فَقَالَ: «قَتَلُوْهُ قَتَلَهُمُ اللهُ أَلَا سَأَلُوْا إِذْ لَـمْ يَعْلَمُوْا فَإِنَّمَا شِفَاءُ الْعِيِّ السُّؤَالُ».
[20] মাহমুদ হাসান দেওবন্দী, ঈযাহুল আদিল্লা, কুতুবখানায়ে ফখরিয়া মুরাদাবাদ, ইউপি, ভারত, পৃ. ১১৭
[21] সাহাবায়ে কেরামের ইজমা ইজমায়ে উম্মতের সর্বোচ্চ পর্যায় এবং কিয়াসও শরীয়তের দলিল। তবে এটি স্বতন্ত্র কোনো দলিল নয়, বরং এটি উপর্যুক্ত তিন দলিলের অনুসরণসম্মত হতে হবে।
[22] পূর্বসূরি মুজতাহিদদের তাকলীদ এ কারণে নিষিদ্ধ স্থির হয়েছে যে, তাঁদের জ্ঞান গ্রন্থিত ছিল না এবং নতুন মুজতাহিদদের তাকলীদ এজন্য নাজায়েয স্থির হয়েছে যে, তারা তথাকথি মুজতাহিদ ছিল।
[23] (ক) মাহমুদ হাসান দেওবন্দী, ঈযাহুল আদিল্লা, কুতুবখানায়ে ফখরিয়া মুরাদাবাদ, ইউপি, ভারত, পৃ. ১১৭; (খ) আবদুল হক দেহলভী, তরীকুল ইফাদা ফী শারহি সিফরিস সাআদা, মুনশী নওল কিশোর প্রেস লখনউ, ইউপি, ব্রিটিশ ভারত, পৃ. ২২
[24] (ক) মাহমুদ হাসান দেওবন্দী, ঈযাহুল আদিল্লা, কুতুবখানায়ে ফখরিয়া মুরাদাবাদ, ইউপি, ভারত, পৃ. ১১৯; (খ) শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, আল-ইনসাফ ফী বয়ানি আসবাবিল ইখতিলাফ, দারুন নাফায়িস লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৪ হি. = ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ৭০
[25] প্রথম যুগে মুহাদ্দিসদেরকে আহলে হাদীস বলা হত, তারা মুজতাহিদ হোন বা গায়রে মুজতাহিদ। তবে মুহাদ্দিসীনে ফুকাহার চিন্তাধারার তাকলীদ করতেন। পূর্বসূরিদের বিভিন্ন বক্তব্য ও হাদীস শরীফের কিতাবসূহে যেখানেই আসহাবুল হাদীস বা আহলুল হাদীস শব্দটি এসেছে তা থেকে এসব হযরাতই উদ্দেশ্য। আহলে হাদীস ফেরকা উদ্দেশ্য নয়। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার প্রথম খণ্ডে بَابُ الْفِرَقِ بَيْنَ أَهْلِ الْـحَدِيْثِ وَأَصْحَابِ الرَّأْيِ নামে যে অধ্যয়টি কায়েম করেছেন, এখানেও আহলুল হাদীস থেকে মুহাদ্দিসরা উদ্দেশ্য। অতএব হযরত (শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী) রহ. অধ্যযের সূচনা করেছেন নিম্নোক্ত ভাষ্যে:
اعْلَمْ أَنَّهُ كَانَ مِنَ الْعُلَمَاءِ فِيْ عَصْرِ سَعِيْدِ بْنِ الْـمُسَيَّبِ وَإِبْرَاهِيْمَ وَالزُّهْرِيِّ، وَفِيْ عَصْرِ مَالِكٍ وَسُفْيَانَ، وَبَعْدَ ذَلِكَ قَوْمٌ يَكْرَهُوْنَ الْـخَوْضَ بِالرَّأْيِ، وَيَهَابُوْنَ الْفُتْيَا وَالْاِسْتِنْبَاطَ إِلَّا لِضَرُوْرَةِ لَا يَجِدُوْنَ مِنْهَا بُدًّا، وَكَانَ أَكْبَرُ هَمِهمْ رِوَايَة حَدِيْث رَسُوْلِ اللهِ ﷺ.
দেখুন: শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাহ আল-বালিগা, দারুল জীল, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২৬ হি. = ২০০৫ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ২৫৪
এ লেখা থেকে পরিষ্কার হয় যে, হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেবের বক্তব্যে আহলুল হাদীস থেকে উদ্দেশ্য মুহাদ্দিসগণ। তথাকথিত (আহলে হাদীস) ফেরকা নয়।
[26] (ক) আত-তাবরীযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, খ. 1, পৃ. ৬১, হাদীস: ১৭১; (খ) আত-তিরমিযী, আস-সুনান, খ. ৫, পৃ. ২৬, হাদীস: ২৬৪১, তিনি বর্ণনা করেন,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «لَيَأْتِيَنَّ عَلَىٰ أُمَّتِيْ مَا أَتَىٰ عَلَىٰ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ، حَتَّىٰ إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَىٰ أُمَّهُ عَلَانِيَةً لَكَانَ فِيْ أُمَّتِيْ مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ، وَإِنَّ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ تَفَرَّقَتْ عَلَىٰ ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِيْ عَلَىٰ ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَاحِدَةً»، قَالُوْا: وَمَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ: «مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ».