জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জনকল্যাণ বিবেচনায় ইসলামের বিধান

জনকল্যাণ বিবেচনায় ইসলামের বিধান

 আবিদুর রহমান তালুকদার

      লেখক: বিশিষ্ট লেখক ও পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা-কিয়াস শরীয়তের মূল উৎস। এই উৎসমূলের পাশাপাশি শরীয়তের এমন কয়েকটি দলিল রয়েছে, যার ভিত্তিতে ফকীহ-মুজতাহিদগণ শরীয়তের অনেক বিধান উদ্ভাবন করছেন। মাসালিহ মুরসালা (مصالح مرسلة) বা জনকল্যাণ বিবেচনা ইসলামি আইন প্রণয়নে প্রভাবক ভূমিকা পালন করে। আরবি ‘মাসলাহা’ শব্দের বহুবচন হলো মাসালিহ। অর্থাৎ মঙ্গল, কল্যাণ ও স্বার্থ ইত্যাদি। মুরসালা অর্থ মুতলাক, তথা মুক্ত বা সাধারণ। ব্যবহারিক দিক থেকে এই যৌগিক শব্দটি জনকল্যাণ, গোষ্ঠী স্বার্থ ও কল্যাণচিন্তা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়।[1] مصالح مرسلة বলতে এমন কল্যাণকে বুঝায়, যে বিষয়ে শরীয়তপ্রণেতার পক্ষ থেকে কোনো অকাট্য ও স্পষ্ট দলিল নেই, অথবা এটির এমন কোনো মূল ভিত্তিও নেই, যার ওপর নির্ভর করে কিয়াস করা যায়। তবে তা গ্রহণে মুসলিম উম্মাহর ক্ষতির কোনো আশঙ্কা থাকে না; বরং বহুবিধ কল্যাণের নিশ্চয়তা থাকে। ফিকহবিদগণ এমন কল্যাণ (مصالح) গ্রহণের পক্ষে জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে শর্ত হলো, তা অকাট্য ও স্পষ্ট দলিলের বিরোধী হতে পারবে না এবং ইজমারও পরিপন্থি হবে না।

মুহাম্মদ আমিন শানকীতী (১৯০৫-১৯৭৪ খ্রি.) বলেন, জনকল্যাণের ওপর শরীয়তের অনেক বিধি-বিধান নির্ভরশীল। তিনি এটিকে তিনভাগে ভাগ করে করেন,

الأولى منها: ردء المفاسد، وهي المعروف عند الأصوليين بالضروريات، والثانية: جلب المصالح وهو المعروف عند الأصوليين بالحاجيات، والثالثة: الجري علىٰ مكارم الأخلاق، وأحسن العادات، وهو المعروف عند الأصوليين بالتحسينيات، والتتميميات.

  1. ‘জনসমস্যা লাঘব করা। এটিকে উসূল শাস্ত্রবিদগণ জরুরিয়াত (ضروريات) বলে অভিহিত করেন।
  2. প্রয়োজন সাধন করা। উসূলে ফিকহ শাস্ত্রে যা হাজিয়াত (حاجيات) নামে পরিচিত।
  3. শোভাবর্ধক ও সম্পূরক সামাজিক রীতি-নীতির অনুসরণ। যাকে উসূলে ফিকহের পরিভাষায় তাহসীনিয়াত (تحسينيات وتتميميات) বলা হয়।’[2]

ইমাম ইবনে তাইমিয়া মাসালিহ মুরসালার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন,

‘মুজতাহিদগণ যদি মনে করেন, কোনো কাজের মধ্যে প্রাধান্যযোগ্য ও অগ্রাধিকারমূলক কল্যাণ নিহিত আছে এবং শরীয়তে উক্ত কাজের পরিপন্থী কোনো নির্দেশনা বিদ্যমান না থাকে, তাকে মাসালিহ মুরসালা বা জনকল্যাণ বলে।’[3]

মুজতাহিদ ইমামগণ জনকল্যাণ বিবেচনার জন্য যে শর্তাবলি নির্ধারণ করেছেন তা হলো,

  1. শরীয়ত অনুমোদিত জনকল্যাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে।
  2. জনস্বার্থের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। অনিশ্চিত কল্যাণের সম্ভাবনায় এ বিবেচনা কার্যকর হবে না।
  3. দেশ ও জাতির সামগ্রিক কল্যাণ বিবেচনায় রাখতে হবে।

ইসলামি আইন প্রণয়নে জনকল্যাণের প্রভাব সম্পর্কে ইমাম শাতিবী (৫৩৮-৫৮৯ হি.)-এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য।

الشَّرِيْعَةُ مَبْنِيَّةٌ عَلَىٰ اعْتِبَارِ الْـمَصَالِحِ، وَأَنَّ الْـمَصَالِحَ إِنَّمَا اعْتُبِرَتْ مِنْ حَيْثُ وَضَعَهَا الشَّارِعُ كَذَلِكَ، لَا مِنْ حَيْثُ إِدْرَاكِ الـمكلَّف؛ إِذِ الْـمَصَالِحُ تختلف عند ذلك بالنسب والإضافات وَاسْتَقَرَّ بِالِاسْتِقْرَاءِ التَّامِّ أَنْ الْـمَصَالِحَ عَلَىٰ ثَلَاثِ مَرَاتِبَ، فَإِذَا بَلَغَ الْإِنْسَانُ مَبْلَغًا، فَهِمَ عَنِ الشَّارِعِ فِيهِ قَصْدَهُ فِي كُلِّ مَسْأَلَةٍ مِنْ مَسَائِلِ الشَّرِيعَةِ، وَفِي كُلِّ بَابٍ مِنْ أَبْوَابِهَا فَقَدْ حَصَلَ لَهُ وَصْفٌ هُوَ السَّبَبُ فِي تَنَزُّلِهِ مَنْزِلَةَ الْـخَلِيفَةِ لِلنَّبِيِّ ﷺ فِي التَّعْلِيمِ وَالْفُتْيَا وَالْـحُكْمِ بِمَا أَرَاهُ اللهُ.

“মানবকল্যাণের ওপরই শরীয়তের ভিত্তি। শরীয়তপ্রণেতার নির্ধারিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ওপর এটি নির্ভরশীল। মানুষের বোধ-জ্ঞানের ওপর নয়। স্থান-কাল-পাত্রের ভিন্নতার কারণে মানুষের বিবেক-বুদ্ধিও বৈচিত্র্যময় হয়। অনুসন্ধান দ্বারা প্রমাণিত, মানব কল্যাণের তিনটি স্তর রয়েছে। এ সকল স্তরে উন্নীত হওয়ার পর মানব-বিবেক শরীয়তপ্রণেতার প্রতিটি অধ্যায়ের সকল শাখা-মাসআলার মূল উদ্দেশ্য বোঝার যোগ্যতা অর্জন করে। শিক্ষা, প্রজ্ঞা ও ফতোয়ায় নবীর প্রতিনিধির স্থলে অভিষিক্ত হওয়ার সুবাদে মানুষ এ গুণ অর্জন করে। এ যোগ্যতা একমাত্র আল্লাহপ্রদত্ত।’[4]

রসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে জনকল্যাণের ভিত্তিতে শরীয়তের বিধান উদ্ভাবনের অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বর্ণনা করেন,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ k، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: «حَرَّمَ اللهُ مَكَّةَ، فَلَمْ تَحِلَّ لِأَحَدٍ قَبْلِيْ وَلَا لِأَحَدٍ بَعْدِيْ، أُحِلَّتْ لِيْ سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ، لَا يُخْتَلَىٰ خَلَاهَا، وَلَا يُعْضَدُ شَجَرُهَا، وَلَا يُنَفَّرُ صَيْدُهَا، وَلَا تُلْتَقَطُ لُقَطَتُهَا إِلَّا لِـمُعَرِّفٍ، فَقَالَ الْعَبَّاسُ h: إِلَّا الْإِذْخِرَ لِصَاغَتِنَا وَقُبُوْرِنَا؟ فَقَالَ: إِلَّا الْإِذْخِرَ».

‘রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলা মক্কায় সকল প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ করেছেন। আমার পূর্বে কারও জন্য এখানে যুদ্ধ করা বৈধ ছিল না। পরেও কারও জন্য জায়েয হবে না। কিন্তু একটি দিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা আমার জন্য হালাল করা হয়েছিল। সুতরাং এখানকার ঘাস ও গাছপালা কর্তন করা যাবে না। শিকারি জন্তুকে ভয় দেখানো যাবে না। মালিকের নিকট পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো পতিত বস্তু কুড়িয়ে নেওয়া যাবে না।’ এ হাদীস শোনার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, কিন্তু ‘ইযখির’ নামক ঘাস কাটার অনুমতি দিলে জনস্বার্থ প্রাধান্য পেতো। কারণ এ ঘাস আমাদের বিভিন্ন জিনিস তৈরি এবং লাশ সমাহিত করার কাজে ব্যবহৃত হয়। রসুল (সা.) বললেন, ‘তবে তা কাটার অনুমতি দেওয়া গেল।”[5]

এখানে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) নিষিদ্ধ উদ্ভিদসমূহের মধ্যে ‘ইযখির’ নামক নির্দিষ্ট উদ্ভিদ কাটাকে জনকল্যাণের ভিত্তিতে বাদ দেওয়ার আবেদন করেন। যা রসুল (সা.) সমর্থন করেন। কারণ এ উদ্ভিদ সাধারণ মানুষের কাজে ব্যবহৃত হয়।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া আরও বলেন, ইসলামি শরীয়তের মূল ভিত্তি হলো, মানবতার কল্যাণ সাধন করা ও জনদুর্ভোগ লাঘব করা। সুতরাং আল্লাহর বিধি-নিষেধের আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে মানবতার সামগ্রিক কল্যাণ। শরীয়তের নির্দেশ অমান্য করে নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হওয়াই মানবজীবনের দুর্বিষহ ক্ষতির প্রধান কারণ। দুটি কল্যাণকর অথবা দুটি ক্ষতিকর বিষয়ের মুখোমুখি হলে মুমিনদের প্রতি শরীয়তের বিধান হলো, উভয়টির মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব হওয়া সাপেক্ষে কম ক্ষতিকর ও অধিক কল্যাণকর বিষয়টি গ্রহণ করা। একসঙ্গে দুটি ক্ষতির প্রতিরোধ সম্ভব না হলে তুলনামূলক কম হিতকর ও অধিক ক্ষতিকর বিষয়টি বর্জন করা। শরীয়তে এমন ব্যক্তিদের মান্যবর, নির্ভরযোগ্য ও নেতৃস্থানীয় মনে করা হয়, যারা দুটি কল্যাণের মধ্যে অধিক কল্যাণকর এবং দুটি মন্দের মধ্যে অধিকতর ক্ষতিকর বস্তুর পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। এমন যোগ্যতাসম্পন্ন ও সূক্ষ্ম প্রতিভার অধিকারী মহামনীষীগণ শরীয়তে ফকীহ-মুজতাহিদ হিসেবে খ্যাত। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পাপাচারী খলীফার আনুগত্য করা ও বিদআতপন্থি-ফাসেক ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করা একটি মন্দ কাজ। পাপিষ্ঠ খলীফার বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রতিরোধ-সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করা এবং অনুপযুক্ত ইমামের পেছনে নামাজ আদায় না করে জামাত বর্জন কারও ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষতিকর ও নিন্দনীয় কাজ। এমতাবস্থায় পাপাচারী খলীফার আনুগত্য সহ্য করা ও বিদআতপন্থি ইমামের পেছনে জামাত বর্জন না করে জামাতে শরিক হওয়াই ইসলামের নির্দেশনা। সুতরাং দুটি ক্ষতিকর কাজের মধ্যে তুলনামূলক অধিকতর ক্ষতিকর কাজকে বর্জন করে কম ক্ষতিকর বিষয়টি গ্রহণ করা ইসলামের দৃষ্টিতে বুদ্ধিমত্তার কাজ। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদাবান ও জলিলুল কদর সাহাবায়ে কেরাম জনকল্যাণের ভিত্তিতে ও মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে জালেম গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ[6] ও মুখতার সাকাফী[7]র পেছনে নামাজ আদায় করেছেন এবং তাদের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছেন।

জালেম গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রসঙ্গে হাসান বসরী (রহ.)-এর অভিমতটির পর্যালোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বসরার প্রসিদ্ধ মুজতাহিদ ও শীর্ষস্থানীয় তাবিয়ী হাসান বসরী (রহ.)-এর দরবারে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের জুলুমের প্রতিকার বিষয়ে তৎকালীন যুগের উলামায়ে কেরামের একটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তারা মুসলিম উম্মাহর স্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি আলোচনা করে বলেন, জালেম গভর্নর হাজ্জাজ নিরীহ জনগণের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে জব্দ করছে ও নামাজ পরিত্যাগ করছে। এ ধরনের অপকর্ম প্রতিকারে আপনার মতামত কী? উত্তরে তিনি বলেন,

‘আমি তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকারে যাওয়া ভালো মনে করি না। কেননা যদি এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের ওপর কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হয়ে থাকে, তবে তোমরা তরবারির মাধ্যমে তা প্রতিহত করতে পারবে না। আর যদি হাজ্জাজ কোনো বিপদ হিসেবে আপতিত হয়, তবে উত্তম বিচারকের ফায়সালা পর্যন্ত অপেক্ষা করো (فَاصْبِرُوْا حَتّٰى يَحْكُمَ اللّٰهُ بَيْنَنَا١ۚ وَهُوَ خَيْرُ الْحٰكِمِيْنَ۰۰۸۷[8])।’

ফতোয়া তলবকারীগণ তার কথা অগ্রাহ্য করে হাজ্জাজের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হয়। যার তিক্ত অভিজ্ঞতা ও অযাচিত ফলাফল ইতিহাসের পাঠকমাত্রই অবগত। হাজ্জাজের কর্মকাণ্ড এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, শরীয়তের বিধান অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা সকল মুসলমানের জন্য জরুরি ছিল। মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে,

«مَنْ رَأَىٰ مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَـمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَـمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيْمَانِ».

‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো অপকর্ম সংঘটিত হতে দেখলে, সর্বশক্তি দিয়ে তা পরিবর্তনের চেষ্টা করবে। শক্তিপ্রয়োগে সক্ষম না হলে মুখে প্রতিবাদ করবে। অপারগতায় অন্তরে হলেও প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। এটি দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।’[9]

হাজ্জাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সম্ভাব্য ফলাফল বিবেচনা করে হাসান বসরী চিন্তা করেন, তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সাধারণ মানুষের যে পরিমাণ ক্ষতি অপেক্ষা করছে, তা হবে ভয়াবহ বিপর্যয় ও অকল্পনীয় দুর্ভোগ। তিনি উপর্যুক্ত হাদীসকে সাধারণ অর্থে প্রয়োগ করার পরিবর্তে সর্বসাধারণের কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োগ করতে ইজতিহাদ করেন। তার ইজতিহাদের মূলনীতি ছিল এই, হাজ্জাজের বিরুদ্ধে জিহাদ করার মূল লক্ষ হলো, সর্বসাধারণের শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। যা হাজ্জাজের কারণে বিঘ্নিত হয়েছিল। হাজ্জাজের বিরুদ্ধে প্রতিকার কর্মসূচিতে লিপ্ত হলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ও মহা ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। যাতে সুফলের চেয়ে ক্ষতির পাল্লাই ভারি হবে। যার কারণে তিনি হাজ্জাজের বিরুদ্ধে জিহাদ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন নি। তিনি জালেম শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা জায়েয হওয়ার জন্য এ শর্ত আরোপ করেন যে, জিহাদের মাধ্যমে অর্জিত সুফল বর্তমান অবস্থার চেয়ে প্রবল হওয়ার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। যদি জিহাদের কারণে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়, তবে প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করা জায়েয হবে না।

তেমনিভাবে আবু সুফয়ানপুত্র ইয়াযীদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (রাযি.)-এর প্রতিরোধ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ থেকে সিংহভাগ সাহাবায়ে কেরাম বিরত থেকেছেন। বরং আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলেই তাঁকে কুফায় না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ তৎকালীন সময়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.)সহ অনেক জলিলুল কদর ও মর্যাদাবান সাহাবি জীবিত ছিলেন। তাদের কেউ ইয়াযীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কর্মসূচির অনুমতি প্রদান করেননি। তারা মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ইয়াযীদের মতো পাপিষ্ঠ ব্যক্তির খেলাফত মেনে নিয়েছেন এবং তার সকল অপকর্ম সহ্য করেছেন। এখানে সাহাবায়ে কেরামের প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল, জনকল্যাণ ও বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা। ইয়াযীদের প্রতিরোধে যে সুফল ও কল্যণের আশা ছিল, তার চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা ছিল ঢের বেশি। যে বাস্তবতার জ্বলন্ত সাক্ষী হলো ইতিহাসের ধারা ও নবী-প্রেমিকদের অশ্রুধারা। ইয়াযীদবিরোধী প্রতিকার কর্মসূচিতে আহলে বাইতের বিপুলসংখ্যক সদস্যের শাহাদতের কারণে মুসলিম উম্মাহর যে পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা পূরণ করা কিয়ামত পর্যন্তও সম্ভব হবে না।

রসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় জনকল্যাণের ভিত্তিতে মহৎ কর্ম বর্জন করার অনেক নজির রয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মূল কাঠামোর ওপর বায়তুল্লাহর পুনঃনির্মাণের বিষয়টি জনকল্যাণের ভিত্তিতে বর্জন করেছিলেন স্বয়ং রসুল (সা.)। তিনি হযরত আয়িশা (রাযি.)-কে উদ্দেশ করে বলেন,

عَنْ عَائِشَةَ زَوْجِ النَّبِيِّ ﷺ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ: « أَلَـمْ تَرَيْ أَنَّ قَوْمَكِ حِيْنَ بَنَوُا الْكَعْبَةَ اقْتَصَرُوْا عَنْ قَوَاعِدِ إِبْرَاهِيْمَ؟ قَالَتْ: فَقُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، أَفَلَا تَرُدُّهَا عَلَىٰ قَوَاعِدِ إِبْرَاهِيْمَ؟ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: لَوْلَا حِدْثَانُ قَوْمِكِ بِالْكُفْرِ لَفَعَلْتُ».

‘কাবা নির্মাণের প্রাক্কালে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ বাজেট সঙ্কটে ভুগছিল। যার ফলে তারা বায়তুল্লাহর অবিচ্ছেদ্য অংশ হাতিমকে (حطيم) বাইরে রেখে কাবাঘর নির্মাণ করেছিল। হযরত আয়িশা (রাযি.) বলেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনি কি বায়তুল্লাহকে ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পূর্ব-কাঠামোর ভিত্তিতে পুনঃনির্মাণ করতে চান? রসুল (সা.) বললেন, ‘মক্কাবাসীগণ সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে। এমন না হলে আমি অবশ্যই ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মূল কাঠামোর ওপর বায়তুল্লাহর পুনঃনির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করতাম।”[10]

হযরত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মূল কাঠামোর ভিত্তিতে বায়তুল্লাহর পুনঃনির্মাণ মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি কল্যাণকর ও মহৎকর্ম। কিন্তু এর ফলে ইসলামে নবদীক্ষিত মক্কার অধিবাসীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ভুল ধারণা সৃষ্টির প্রবল আশঙ্কা ছিল। বায়তুল্লাহর প্রতিবেশী মুসলমানদের একটি প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীর বিরূপ ধারণার অপনোদন বায়তুল্লাহর পুনঃনির্মাণের মতো মহৎ কাজের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার ফলে রসুল (সা.) মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি এড়িয়ে গেছেন। ইমাম নবভী (রহ.) বলেন, বিপরীতধর্মী একাধিক মহৎকর্মের সমাবেশ হলে অথবা দুটি ক্ষতিকর ও লাভজনক বিষয় একত্রিত হওয়ার পর উভয়ের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব না হলে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। হযরত আয়িশা (রাযি.) বর্ণিত উপর্যুক্ত হাদীস থেকে শরীয়তের আইন প্রণয়নের অনেক মূলনীতি পাওয়া যায়। ইমাম নবভী (রহ.)-এর বক্তবটি প্রণিধানযোগ্য:

وَفِيْ هَذَا الْـحَدِيْثِ دَلِيْلٌ لِقَوَاعِدَ مِنَ الْأَحْكَامِ مِنْهَا إِذَا تَعَارَضَتِ الْـمَصَالِحُ أَوْ تَعَارَضَتْ مَصْلَحَةٌ وَمَفْسَدَةٌ وَتَعَذَّرَ الْـجَمْعُ بَيْنَ فِعْلِ الْـمَصْلَحَةِ وَتَرْكِ الْـمَفْسَدَةِ بُدِئَ بِالْأَهَمِّ لِأَنَّ النَّبِيَّ ﷺ أَخْبَرَ أَنَّ نَقْضَ الْكَعْبَةِ وَرَدَّهَا إِلَىٰ مَا كَانَتْ عَلَيْهِ مِنْ قَوَاعِدِ إِبْرَاهِيمَ ﷺ مَصْلَحَةٌ وَلَكِنْ تُعَارِضُهُ مَفْسَدَةٌ أَعْظَمُ مِنْهُ وَهِيَ خَوْفُ فِتْنَةِ بَعْضِ مَنْ أَسْلَمَ قَرِيْبًا وَذَلِكَ لِـمَا كَانُوا يَعْتَقِدُونَهُ مِنْ فَضْلِ الْكَعْبَةِ فَيَرَوْنَ تَغْيِيْرَهَا عَظِيْمًا فَتَرَكَهَا ﷺ. [11]

স্মর্তব্য যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর (রাযি.) মক্কার মুসলমানদের খলীফা হওয়ার সুবাদে রসুল (সা.)-এর বাসনা ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং হযরত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর ভিত্তিতে বায়তুল্লাহর পুনঃনির্মাণ করেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর (রাযি.)-এর শাহাদতের পর উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান যখন মক্কার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন, পুনরায় বায়তুল্লাহকে পূর্বের কাঠামোতে ফিরিয়ে নেন। পরবর্তীতে আব্বাসি খলীফা মাহদী রসুল (সা.)-এর আকাঙ্ক্ষার আলোকে কাবার পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন সময়ে মদীনার প্রধান ফকীহ মালিক ইবনে আনাস (রহ.)-এর নিকট এ বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। ইমাম মালিক খলীফার এই উদ্যোগে সমর্থন দেননি। যার ফলে বায়তুল্লাহর কাঠামো কুরআইশনেতাদের নির্মিত ভিত্তির ওপর অদ্যাবধি বহাল রয়েছে এবং হাতিম কাবার বাইরেই থেকে গেছে। ইমাম ইবনে কসীর (রহ.) ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেন,

وَقَدْ هَمَّ ابْنُ الْـمَنْصُوْرِ الْـمَهْدِيُّ أَنْ يُعِيْدَهَا عَلَىٰ مَا بَنَاهَا ابْنُ الزُّبَيْرِ، وَاسْتَشَارَ الْإِمَامَ مَالِكَ بْنَ أَنَسٍ فِيْ ذَلِكَ، فَقَالَ: إِنِّيْ أَكْرَهُ أَنْ يَتَّخِذَهَا الْـمُلُوْكُ لُعْبَةً، يَعْنِيْ يَتَلَاعَبُوْنَ فِيْ بِنَائِهَا بِحَسْبِ آرَائِهِمْ، فَهَذَا يَرَىٰ رَأْيَ ابْنِ الزُّبَيْرِ، وَهَذَا يَرَىٰ رَأْيَ عَبْدِ الْـمَلِكِ بْنِ مَرْوَانَ. وَهَذَا يَرَىٰ رَأْيًا آخَرَ.

“ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, আল্লাহর ঘরকে নিয়ে রাজা-বাদশাহগণ ছিনিমিনি খেলবে তা আমি সাপোর্ট করতে পারি না। কেউ হযরত ইবনুয যুবাইর (রাযি.)-এর দোহাই দিয়ে, কেউ আবদুল মালিকের মতামত নিয়ে, কেউ অন্য যুক্তি উপস্থাপন করে কাবাকে খেলনায় পরিণত করবে এটা হতে পারে না।’[12]

ইতঃপূর্বে বাদশাহ হারুনুর রশীদও ইমাম মালিকের নিকট একই অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। যাতে তিনি হাজ্জাজ কর্তৃক নির্মিত বায়তুল্লাহকে ভেঙে হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর (রাযি.)-এর আদলে পুনঃনির্মাণ করার অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। বাদশাহকে ইমাম মালিক (রহ.) যে লোমহর্ষক জবাব দিয়েছিলেন তা ইবনে বাত্তাল (মৃ.৪৪৯ হি.)-এর ভাষায় এভাবে ব্যক্ত হয়েছে,

وقد روى أن هارون الرشيد ذكر لمالك بن أنس أنه يريد هدم ما بناه الحجاج من الكعبة، وأن يرده إلىٰ بنيان ابن الزبير، فقال له: ناشدتك الله يا أمير المؤمنين أن لا تجعل هذا البيت ملعبة للملوك، لا يشاء أحد منهم إلا نقض البيت وبناه، فتذهب هيبته من صدور الناس.

‘হে আমিরুল মুমিনিন! আমি আপনাকে কসম দিয়ে বলছি, এই ঘরকে রাজা-বাদশাহদের খেলনায় পরিণত করবেন না। ভাঙ্গা-গড়ার মারপ্যাঁচে পতিত হলে ক্রমান্বয়ে মানুষের অন্তর থেকে এর মহিমা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’[13]

একটি মহৎ কর্মে মুজতাহিদ ইমামগণের সমর্থন না দেওয়ার পেছনেও জনকল্যাণকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কারণ বায়তুল্লাহর মতো মহিমান্বিত একটি স্থাপনার ভাঙ্গা-গড়ার এই ধারা অব্যাহত থাকলে মুসলমানদের অন্তরে বিরাজমান বায়তুল্লাহর মর্যাদা ও মহিমা নষ্ট হয়ে যাবে। এতে মুসলিম উম্মাহর উন্নতি ও কল্যাণের পরিবর্তে দুর্ভোগ ও ক্ষতির মাত্রাই বর্ধিত হবে।

জনকল্যাণ ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ বিবেচনায় সাহাবায়ে কেরাম যেসকল যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উদাহরণ হলো, কুরআন সংকলন, খেলাফতের জন্য নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণ, রাষ্ট্রীয় কাজের সুবিধার্থে বিভিন্ন বিভাগের প্রবর্তন, জেলখানা স্থাপন, জুমুআ‘র নামাজের জন্য প্রথম আযান প্রবর্তন, মসজিদে নবভীতে মুসল্লি সংকুলানের নিমিত্তে সন্নিহিত ভূমির অধিগ্রহণ ইত্যাদি।

শরীয়তের উপর্যুক্ত বিধানসমূহ উদ্ভাবনে সাহাবায়ে কেরামের সামনে কুরআন-সুন্নাহর কোনো নস উপস্থিত ছিল না। নিছক জনস্বার্থ বিবেচনায় উপর্যুক্ত আইনসমূহ প্রণয়ন করেন। অতএব নির্দ্বিধায় বলা যায়, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে জনস্বার্থ বিবেচনায় আইন প্রণয়নের বিষয়ে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।[14]

মানবকল্যাণই শরীয়তের প্রতিপাদ্যবিষয়। জনকল্যাণ সাধন ও জনদুর্ভোগ লাঘব মৌলিক মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। মুজতাহিদ ইমামগণ শরীয়তের মূল উৎসে গভীর তত্ত্বানুসন্ধান করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, বিশ্ব মানবতার কল্যাণ সাধনই হলো শরীয়তের প্রধান লক্ষ্য। কুরআন-সুন্নাহর বিভিন্ন স্থানে শরীয়তের এ লক্ষ-উদ্দেশ্য বিঘোষিত হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা রসুল (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন,

وَمَاۤ اَرْسَلْنٰكَ اِلَّا رَحْمَةً لِّلْعٰلَمِيْنَ۰۰۱۰۷

‘আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’[15]

[1] মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহ খন্দকার, মাকাসিদ আশ-শরী‘আহ ও ইসলামের সৌন্দর্য, মুক্তদেশ প্রকাশন, ঢাকা, বাংলাদেশ (প্রথম সংস্করণ: ১৪৩৬ হি. = ২০১৫ খ্রি.), পৃ. ৪৮

[2] আমীন আশ-শানকীতী, আল-মাসালিহুল মুরসালা, মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা মুনাওওয়ারা, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪১০ হি. = ১৯৯০ খ্রি.). পৃ. ৬

[3] ইবনে তাইমিয়া, মাজমুআতুর রাসায়িল ওয়াল মাসায়িল, লাজনাতুত তুরাসিল আরবি, কায়রো, মিসর, খ. ৩, পৃ. ২২

[4] আশ-শাতিবী, আল-মুওয়াফাকাত, দারু ইবনি আফফান, রিয়াদ, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৭ হি. = ১৯৯৭ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ৪২-৪৩

[5] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ৯২, হাদীস: ১৩৪৯

[6] রক্তপিপাসু ও অত্যাচারী শাসক হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ৪০ হিজরীতে তায়েফে জন্মগ্রহণ করে। উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিকের শাসনামলে সে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব লাভ করে। বিভিন্ন অভিযানে তার নেতৃত্বে প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা যায়। তার হাতে তিনজন সাহাবী শাহাদতবরণ করেন। সে খলীফা আবদুল মালিকের নির্দেশে বিশিষ্ঠ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইরক (রাযি.)-কে প্রতিহত করার জন্য দীর্ঘ সাত মাস পর্যন্ত মক্কা অবরোধ করে রাখে। বায়তুল্লাহর বিপুল ক্ষতি সাধন করে এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর (রাযি.)-কে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে। জীবনের শেষপর্যায়ে সে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাযি.)-কেও হত্যা করে। এরপর সে পাগল হয়ে যায়। পেটে পোকার উৎপাতের কারণে সে মর্মান্তিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। দ্র. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ১০, পৃ. ১৬৩)

[7] মুখতার সাকাফী ৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে হিজাযের অন্তর্গত তায়েফ নগরীতে জন্মগ্রহণ করে। সে অত্যন্ত ধূর্ত, প্রতারক ও প্রবঞ্চক পরিচয়ে নিজের কর্মজীবন শুরু করে। উমাইয়াবিরোধী আন্দোলনে প্রথমে সে হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর (রাযি.)-এর পক্ষাবলম্বন করে। কুফায় গিয়েও সে বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নেয়। সে আবদুল্লাহ ইবনে মুতীকে অপসারণ করে কুফার ক্ষমতা দখল করে। একপর্যায়ে সে নুবুওয়াতের মিথ্যা দবিও করে। এরপর থেকে সে কাযযাব তথা মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচয় লাভ করে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর (রাযি.) স্বীয় ভ্রাতা মুসআব ইবনুয যুবাইরকে মুখতার সাকাফীর মোকাবেলায় প্রেরণ করেন। অভিযানের একপর্যায়ে সে মুসআব ইবনুয যুবাইরের হাতে পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর পর তার অনুসারীগণ শিয়া আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কায়সানিয়া নামে পরিচয় লাভ করে।

[8] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আ’রাফ, ৭:৮৭

[9] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৪ হি. = ১৯৫৫ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৫০, হাদীস: ৪৯

[10] মুসলিম, আস-সহীহ, খ. ৪, পৃ. ৯৭, হাদীস: ১৩৩৩

[11] আন-নাওয়াওয়ী, আল-মিনহাজ শরহু সহীহহি মুসলিম ইবনিল হাজ্জাজ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরাবী, বয়রুত, লেবনান (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৩৯২ হি. = ১৯৭২ খ্রি.), খ. ৯, পৃ. ৮৯

[12] ইবনে কসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরাবী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৮ হি. = ১৯৮৮ খ্রি.), খ. ৮, পৃ. ২৭৫

[13] ইবনে বাত্তাল, শরহু সহীহ আল-বুখারী, মাকতাবাতুর রাশীদ, রিয়াদ, সৌদি আরব (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪২৩ হি. = ২০০৩ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ২৬৪

[14] সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামী আইন ও আইন বিজ্ঞান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, বাংলাদেশ (প্রথম সংস্করণ: ১৪৩২ হি. = ২০১১ খ্রি.), প. ১৪৩

[15] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:১০৭

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ