শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ বিভাগ
ইলমের জন্য একাগ্রতা ও আত্মত্যাগ জরুরি
আল্লামা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ
[আল–জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সোমবার বাদে যোহর জামিয়ার জামে মসজিদে ছাত্রদের উদ্দেশে ইসলাহী বয়ান করা হয়। প্রতি সপ্তাহে মুরব্বিরা ছাত্রদের আদর্শ জীবন গঠনের লক্ষ্যে মূল্যবান আলোচনা করে থাকেন। বিগত ২২ সফর ১৪৪৪ হিজরী মোতাবেক ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ইংরেজি সোমবার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন জামিয়া প্রধান আল্লামা ওবায়দুল্লাহ হামযা (দা. বা.)। এক ঘন্টা ব্যাপী দীর্ঘ সে ভাষণটির শ্রুতিলিপি করেছে জামায়াতে উলার ছাত্র মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ। বয়ানটি ছাত্রদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রয়োজনীয় সম্পাদনাসহ মাসিক আত-তাওহীদের ‘শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ বিভাগে’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হল।—সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি]
الحمد لله رب العالمين، والصلاه والسلام علىٰ سيد المرسلين محمد بن عبد الله وعلىٰ آله وأصحابه أجمعين، أمّا بعد فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمن الرحيم، [يَرْفَعِ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ١ۙ وَالَّذِيْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجٰتٍؕ ۰۰۱۱]، وقال النبي ﷺ: «مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهُّ فِي الدِّيْنِ» أو كما قال ﷺ.
সুহৃদ শিক্ষার্থীরা! আমাদের প্রিয় মাতৃক্রোড় আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, আজিজ দীনি দরসেগাহে সোমবারে নিয়মিত ইসলাহী কথা হয়। আমাদের বড়রা কথা বলেন। বছরের শুরু থেকেই তা ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। মাঝখানে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ইসলাহী বয়ান হয়নি। আশা করি, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের মুরব্বিরা প্রতি সোমবার তালেবে ইলমদের উদ্দেশে কথা বলবেন। এসব ইসলাহী জলসা করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা যে মাঝেমাঝে আমাদের উদ্দেশ্য থেকে ছিটকে পড়ি অথবা আমাদের আবেগের যে ঘাটতি অনুভব করি তা পূরণ করা। এটি আমাদেরকে কাজের প্রতি, পড়ালেখার প্রতি উৎসাহিত করে। অতএব এখানে যা কিছু আলোচনা করা হয়, তা ইখলাসের সাথে আমলের নিয়তে বলার ও শোনার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
আজ আমি আপনাদের সামনে আমাদের আকাবির ও বড়দের কিছু কথা আলোচনা করব। কারণ আকাবিরের কথা যেখানে আলোচনা করা হয়, সেখানে রহমত নাযিল হয়। ইমাম বুখারী (রহ.) ওস্তাদ সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহ.)-এর বরাতে কিতাবে উল্লেখ আছে,
عِنْدَ ذِكْرِ الصَّالِـحِيْنَ تَنْزِلُ الرَّحْمَةُ.
‘নেককার বান্দাদের আলোচনায় আল্লাহর রহমত নাযিল হয়।’[1]
তাই আশা করি, এই পবিত্র স্থানে তলেবে ইলমদের সামনে বড়দের আলোচনা দ্বারা আল্লাহ তাআলা অবশ্যই রহমত নাযিল করবেন।
তালেবে ইলমের মর্যাদা
প্রিয় শিক্ষার্থীরা! তালেবে ইলম আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই মর্যাদাবান। তিনি তাঁর রসুলের মাধ্যমে এ সংবাদ পাঠিয়েছেন,
«مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَلْتَمِسُ فِيْهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيْقًا إِلَى الْـجَنَّةِ».
‘কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর জন্য ইলম অর্জনে বের হয়, আল্লাহ পাক তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন।’[2]
খাজা বাকি বিল্লাহ (রহ.) কর্তৃক তালিবে ইলমের মাধ্যমে দোয়া করা
খাজা বাকি বিল্লাহ (রহ.) কোন এক মজলিসে বসা ছিলেন। মজলিসের উপস্থাপক তার অনেক প্রশংসা করতে লাগলেন। কিন্তু তিনি সেখানে চুপ ছিলেন, কিছুই বলেননি। এটা আল্লাহ তাআলার কাছে অপছন্দ হল। তাই তাঁর যে রুহানিয়াত ছিল, তা সাময়িকভাবে ছিনিয়ে নেয়। অতঃপর তিনি তা বুঝতে পারেন। (লক্ষ করুন, বড়দের অন্তর আয়নার মত পরিষ্কার ছিল। এই জন্য সামান্য দাগও তারা বুঝতে পারেন। আর আমাদের অন্তর পুরোটাই অন্ধকার। কাজেই কোন দাগ পড়লে দেখা যায় না।) খাজা বাকি বিল্লাহ (রহ.) এই বিষয়টা বুঝতে পেরে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন এবং আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চাইলেন, ইস্তেগফার করলেন। আল্লাহ পাক তাকে স্বপ্নযোগে বলেন, তুমি তালেবে ইলেমের কাছে যাও তাদের সাথে দোয়া করো আল্লাহ পাক তোমার দৌলত ফিরিয়ে দেবেন। সুতরাং বাকি বিল্লাহ (রহ.) তালিব ইলমের সন্ধানে বের হলেন। কারণ আল্লাহর কাছে তালেবে ইলম অত্যন্ত মর্যাদাবান, যাদের পদতলে ফেরেশতা ডানা বিছিয়ে দেন। কাজেই তালেবে ইলমকে তার এই মর্যাদা স্মরণ রাখতে হবে। সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। অযথা বাজারে ঘোরাফেরা, নিষিদ্ধ জিনিসের দিকে চোখ ফেরানো থেকে সংযত থাকতে হবে। ফেরেশতা আমার পদতলে ডানা বিছিয়ে দেন, আমি কীভাবে এই গুনাহের কাজ করি? তাই আমাদেরকে সব ধরণের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। তবেই আমরা তালেবে ইলমের সেই মর্যাদা অর্জন করতে পারবো।
অতঃপর বাকি বিল্লাহ (রহ.) এক মাদরাসায় আসলেন। তখন ছাত্ররা উনাকে দেখে মুসাফাহা করা শুরু করলেন। এত বড় একজন মানুষ এসেছেন। তখন তিনি বললেন, বাবারা আমি আজকে এসেছি তোমাদের দোয়া নেওয়ার জন্য, তোমাদের সাথে দোয়া করার জন্য। তাহলে বুঝা যায় তালেবে ইলেম আল্লাহর কাছে কত বড় দামি, যে একজন বুজুর্গকে দোয়া নেওয়ার জন্য তাদের কাছে পাঠান।
তালেবে ইলমকে খাওয়ানো মানে আল্লাহর রসুলকে খাওয়ানো
খাজা মুতাওয়াক্কিল শাহ (রহ.), তিনি গরিব মানুষকে খাওয়াতেন। রসুলুল্লাহ (সা.) তাকে স্বপ্নে বললেন তুমি তো প্রতিদিন আল্লাহকে খাওয়াও আমাকে খাওয়াবে না? তখন তিনি বুঝতে পারলেন, সাধারণ মানুষকে খাওয়ানো মানে আল্লাহকে খাওয়ানো যা হাদীসে আছে। কিন্তু তিনি পেরেশান হয়ে গেলেন, রসুলকে কিভাবে খাওয়াবো? তখন এলহাম হল, যে তুমি তালেবে ইলমকে খাওয়াও। তাতে রসুলকে খাওয়ানো হবে। কেননা তালেবে ইলমরা নবীর ওয়ারিস। আর নবীর ওয়ারিসকে খাওয়ানো মানে নবীকে খাওয়ানো। এজন্য যারা তালেবে ইলমদেরকে চাল-ডাল ও তেল দেন, তারা যেন তা রসুল (সা.) কে দেন।
আমরা কি আমাদের এই মর্যাদা বুঝি?! আমাদেরকে আমাদের এই মর্যাদা বুঝতে হবে। এই হাদীস শুনতে শুনতে প্রায় গতানুগতিক হয়ে গেছে,
«خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ».
‘পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।’[3]
থানভী (রহ.) বলেন, কোন দুনিয়াদার যদি তোমাকে ছোট মনে করে, তুমিও তাকে ছোট মনে কর। তারা আমাদেরকে বোকা মনে করে, আর নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবী ভাবে। মৃত্যুর পরে আমাদের এই বোকামিই কামিয়াবির কারণ হবে, আর তাদের এই বুদ্ধি ধ্বংসের কারণ হবে। এজন্য আমরা মনোবল হারাবো না।
ওলামায়ে কেরাম বড় মর্যাদাবান!
সাধারণত শাসক শ্রেণিকে মর্যাদাবান মনে করা হয়। অথচ ওলামায়ে কেরাম তাদের চেয়েও বড় মর্যাদাবান। কারণ
إنَّ الْـمُلُوْكَ لَيَحْكُمُونَ عَلَى الْوَرَىٰ
وَعَلَى الْـمُلُوْكِ لَتَحْكُمُ الْعُلَمَاءُ
‘শাসকরা মানুষকে শাসন করে আর আলেমরা শাসকদের শাসন করেন।’[4]
পাকিস্তানের বিননুরী টাউনের জনৈক আলেমের কাছে এক ছাত্র এসে বলল, হুযুর! এত কষ্ট করে কী লাভ? সমাজে তো আলেমের কোন কদর নেই। তখন তিনি বললেন, বাবা! তুমি আলেম হয়ে দেখো, আলেমের মর্যাদা আছে, প্রকৃত আলেমের দাম আছে। আমরা প্রকৃত আলেম হতে পারছি না, হয়তো এজন্য মর্যাদা পাচ্ছি না। কাজেই আমরা মহব্বত নিয়ে ইলম শিখব। বড়রা বলে গেছেন,
دین جو بھی ہے علمائے کرام کی مہربانی سے، اور جوبھی نہیں ہیں وہ بھی ان کی سستی سے۔
‘সারা দুনিয়াতে যেটুকু দীন চোখে পড়ে, সেটা এই সকল দীনী দরসেগাহর উসিলায় আছে। আর যেটুকু চোখে পড়ে না, সেটাও আমাদের অবহেলা ও অলসতার কারণে।’
অন্তরে ইলমের মুহব্বত ও ভালোবাসা পয়দা করা
আল্লাহ পাক আমাদেরকে মাদরাসায় এনেছেন অনেক বড় দৌলত দেওয়ার জন্য। আমরা অনেক দূরদুরান্ত থেকে আরাম-আয়েশ ছেড়ে, মায়ের হাতের রান্না ছেড়ে, ইলমের মহব্বত ও ভালোবাসা নিয়ে ত্যাগ ও পরিশ্রম করার জন্য ইলমের সফরে এসেছি। আল্লাহ পাক যেন আমাদের এই সফরকে কবুল করেন। আমি এর আগেও এই জায়গায় বসে বলেছিলাম, কোন বিষয়ে মহব্বত ও মনের আকর্ষণ না থাকলে, তার জন্য কোরবানি দেওয়া অনেক কষ্টকর হয়। কোনো জিনিসের প্রতি যদি মহব্বত থাকে, তার জন্য কোরবানি দেওয়া অনেক সহজ হয়। এটা একটা সুপ্রসিদ্ধ কথা। সুতরাং যার ভিতরে এলেমের মহাব্বত যত বেশি সেই এলেমের জন্য তত কোরবানি দিতে পারবে।
কাজেই এলেমের প্রতি আমাদের মহব্বত সৃষ্টি হওয়ার জন্য আমাদেরকে আমাদের অবস্থান ও মর্যাদা জানতে হবে। কোন জিনিসের কারণে আমরা মর্যাদাবান? নিঃসন্দেহে তা হল আম্বিয়ায়ে কেরামের মীরাস বা ইলমে অহীর উত্তরাধিকার। কাজেই আল্লাহ তাআলার মহব্বত ও আম্বিয়ায়ে কেরামের ভালোবাসা যদি আমাদের অন্তরে থাকে, তাহলে আম্বিয়ায়ে কেরামের মিরাসের প্রতিও আমাদের মহব্বত তৈরি হবে।
এ মীরাস হল ইলমে অহী। আর ইলমে অহী আমাদের থেকে ত্যাগ ও কুরবানি চায়। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর কথা খুবই প্রসিদ্ধ:
الْعِلْمُ لَا يُعْطِيْكَ بَعْضَهُ حَتَّىٰ تُعْطِيْهِ كُلَّكَ.
‘ইলম তার সামান্য অংশও তোমাকে দেবে না, যতক্ষণ না তুমি তোমার সম্পূর্ণটা তাকে দিয়ে দাও।’[5]
কাজেই ইলম পেতে হলে নিজের সম্পূর্ণটাই বিসর্জন দিতে হয়।
ইলমের প্রতি বড়দের বিরল মনোনিবেশ
আমাদের বড়রা এই ইলমের জন্য যে কষ্ট করে গেছেন, তা ইতিহাসে বিরল! তাদের কষ্টের কথা তাদের জীবনী পড়লে পাওয়া যায়। আমরা যত বেশি তাদের জীবনী পড়ব, তত বেশি অনুপ্রাণিত হব। আমরাও তাদের মত হওয়ার চেষ্টা করব। আল্লাহ পাক বলেন, যত বেশি আমার আলোচনা হবে তত মহব্বত বৃদ্ধি পাবে। এমনিভাবে বড়দের আলোচনা যত বেশি হয় তাদের মহব্বতও তত বেশি হয়। আর তখনই তাদেরকে অনুসরণ করার কৌতুহল সৃষ্টি হয়। কিন্তু আফসোস! দূরবর্তী আকাবির তো দূরের কথা, আমরা নিকটবর্তী আকাবিরকেও চিনি না। এমনকি এখন যদি কোন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করা হয় ২০ বছর আগে পটিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদীস কে ছিলেন? ৩০ বছর আগে কে ছিলেন? এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা কে? আমরা ক’জন তাঁর জীবনী পড়েছি? আমরা এই জামিয়ার ছাত্র হয়ে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাকে না জানি, আর না তাঁর জীবনী পড়ি; এটা খুবই দুঃখজনক।
আমরা দুনিয়াতে দেখি, প্রত্যেক দল তাদের দলনেতা, দলনেত্রীকে সারা বিশ্বে তুলে ধরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। পোস্টার, মিছিল-মিটিং এবং নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদেরকে পেশ করা হয়। আমরা কতটুকু আমাদের বড়দেরকে পেশ করতে পেরেছি? কাজেই আমাদের আখলাকি ও ইলমী দায়িত্ব হল, অন্ততপক্ষে এই জামিয়ায় যাঁরা খেদমত করে গেছেন, তাদেরকে জানার চেষ্টা করা। আমরা আজ এই জামিয়ার ছাত্র। তারাও একদিন জামিয়ার ছাত্র ছিলেন। পড়ালেখায় তাঁদের মনোযোগ কেমন ছিল? আর আমাদের মনোযোগ কতটুকু আছে?
জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা শাহ মুফতি আজীজুল হক (রহ.)-এর জীবনী পড়লে দেখা যায়, তিনি তখন জিরি মাদরাসায় পড়তেন। হঠাৎ একদিন হেলিকপ্টার বা বিমান আকাশে উড়ে যাচ্ছিল। ছাত্ররা হুড়োহুড়ি করে সবাই বেরিয়ে পড়ল বিমান দেখার জন্য। কিন্তু মুফতি সাহেব (রহ.) উস্তাদের সামনেই বসা ছিলেন। তিনি পরে বলেন, মনে মনে ভাবলাম আমি তো কিতাব দেখার জন্য এসেছি, বিমান দেখার জন্য নয়। বিমান দেখার কী প্রয়াজন? এটি হয়ত একটা মুরগি কিংবা পাখির মত হবে; এর ডানা আছে, যা দ্বারা সে আকাশে উড়ে বেড়ায়। আল্লাহ পাক এজন্যই ওনাকে একজন যুগশ্রেষ্ঠ আলেম বানিয়েছেন।
ইমাম মালেক (রহ.)-এর শিষ্য আল্লামা ইয়াহইয়া আন্দুলুসী (রহ.)-এর হাতি দেখতে না যাওয়ার ঘটনা খুব প্রসিদ্ধ। মদীনায় হাতি ছিল না। হঠাৎ একদিন মদীনায় হাতি এলো, ইমাম মালেক (রহ.) দরস দিচ্ছেন। সকল ছাত্র দৌঁড়ে বের হয়ে গেলো হাতি দেখার জন্য। কিন্তু একজন ছাত্র বের হল না। তখন ইমাম মালেক (রহ.) তাকে বললেন, সবাই হাতি দেখতে বের হয়ে গেল, তুমি বসে আছো কেন? তিনি বললেন, উস্তাদজি আমি এখানে ইলম শিখতে এসেছি, হাতি দেখতে আসিনি। তখন ইমাম মালেক (রহ.) বলেছিলেন, هذا أعقل الأندلس এ হল আন্দুলুসের সেরা বুদ্ধিমান! তিনি ছিলেন, আল্লামা ইয়াহইয়া আন্দুলুসী (রহ.)।
কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, আমাদের অনেককে দেখা যায়, যেন এখানে এসেছি পৌরসভা দেখার জন্য, বাজারে ঘোরাফেরা করার জন্য, বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন জায়গায় ঘোরাফেরা করার জন্য! আমরা তো এখানে এসেছি কিতাব শিখতে, ইলম শিখতে, দীন শিখতে। তাই আমাদের উচিত হবে, ইলমের জন্য একটু কষ্ট, ত্যাগ, মুজাহাদা করা। প্রিয় ছাত্ররা, তোমরা আর গাফেল হয়ো না, কারণ ইতিপূর্বে অনেক মুল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে। দুনিয়াতে যেটা যত বেশি দামি হয় তার জন্য তত বেশি কষ্ট করতে হয়। আমাদের বড়দের ইতিহাস এটাই।
হযরত রায়পুরী (রহ.)-এর ছাত্র জীবনে সারা বছর চিঠি-পত্র না খোলা
হযরত রায়পুরী (রহ.)-এর ছাত্র জীবনে যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি-পত্র। বর্তমানের মত তথ্যপ্রযুক্তি ছিল না। তো উনার কাছে সারা বছর বিভিন্ন ধরনের চিঠি-পত্র আসতো। কোনোটাতে সুখের খবর। আবার কোনটাতে দুঃখের খবর। কোনটাতে কারো বিয়ে, কোনটাতে কারো মৃত্যুর সংবাদ ইত্যাদি থাকত। তিনি সারা বছর কোন চিঠিই খুলতেন না। বছরের শেষে তিনি সব খুলে ডায়েরিতে নোট করতেন। যাদের খুশির সংবাদ ছিল, সেগুলোকে আলাদা করতেন। আর যাদের দুঃখের সংবাদ ছিলো, সেগুলোকে আলাদা করতেন। তারপর তিনি তাদের বাড়িতে গিয়ে যাদের সুখের সংবাদ ছিলো, তাদেরকে শুভেচ্ছা জানাতেন। আর যাদের দুঃখের খবর ছিলো তাদেরকে সান্ত্বনা দিতেন। তখন তারা মনে করত যে ইনি আমাদেরকে সারা বছর মনে রেখেছেন। আসলে তিনি সারা বছর তাদের কথা মনে রাখেননি। তিনি সারা বছর কোন চিঠি দেখতেন না। আর আমরা প্রতিমুহূর্তে মোবাইল চেক করি যে, কে আমাকে মিসড কল দিল? কে আমাকে মেসেজ করল? এটা মনোযোগ নষ্ট করে। আমি সবসময় বলি, পড়াশুনা একাগ্রতা, একক ধ্যান ও ইনহিমাক ছাড়া হয় না। কাজেই আমরা মনোযোগ হারাবো না। আর মাদরাসায় মোবাইল ব্যবহার করা বহিষ্কারযোগ্য অপরাধ। যারা এটা করে তারা শুধু নিজেদেরকেই দোষারোপ করতে পারে। আজ সারা বিশ্বে; ইউরোপ-আমেরিকা ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বড় বড় কলেজ ভার্সিটির শিক্ষকরা মোবাইলের বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করছে। সকলের অভিজ্ঞতা হল, মোবাইল মনোযোগ নষ্ট করে। তারা যেখানে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি ও ম্যাথমেটিক্স পড়ান, তাদের জন্য যদি মোবাইল মনোযোগ নষ্টের কারণ হয়, তাহলে আমাদের এখানে এলমে নববী শিখব, এখানে তো আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। (চলবে ইনশাআল্লাহ)
[1] ইবনুল মুকরী, আল-মু’জাম, মাকতাবাতুর রাশাদ লিন-নাশর ওয়াত তাওযী’, রিয়াদ, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৯ হি. = ১৯৯৮ খ্রি., পৃ. ৭৫, হাদীস: ১৪২
[2] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৪ হি. = ১৯৫৫ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ২০৭৪, হাদীস: ২৬৯৯
[3] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৬, পৃ. ১৯২, হাদীস: ৫০২৭
[4] ইবনে আবিদীন, রদ্দুল মুহতার আলাদ দুররিল, দারুল ফিকর লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪১২ হি. = ১৯৯২ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ৪১
[5] আল-খতীবুল বাগদাদী, আল-জামি’ লি-আখলাকির রাওয়ী ওয়া আদাবিস সামি’, মাকতাবতুল মা‘আরিফ, রিয়াদ, সৌদি আরব, খ. ২, পৃ. 174, হাদীস: 1523