হিলফুল ফুযুল হোক আমাদের চেতনা
সমগ্র পৃথিবী যখন পাপ-পাঙ্কিলতার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল, পাশবিকতার আস্ফালন ব্যাপকহারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, হত্যা-লুণ্ঠন মানুষের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, কন্যা সন্তান জন্ম নেওয়া ছিল মানহানির কারণ আর একারণে চালু করা হয়েছিল চরম বর্বরতাপূর্ণ এক প্রথা তা হলো কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা, তখন ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং সর্বশ্রেণির মানুষের অধিকার আদায় করার লক্ষ্যে একজন আপোষহীন মহামানবের আবির্ভাব অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল! এমনই এক ক্ষণে ভোরের সমীরণ নিয়ে স্নিগ্ধ প্রাতঃকালে আবির্ভূত হলেন প্রতিশ্রুত সেই মুক্তির দিশারী, সপ্তাহের মধ্যদিবস বরকতময় সোমবারে পদার্পণ করেন এই জগতে।
রবি মানে বসন্তকাল, আউয়াল অর্থ প্রথম; রবিউল আউয়াল হলো প্রথম বসন্ত বা বসন্তের প্রথম মাস। পাতায় সুসজ্জিত হয়ে মূলে সুশোভিত হয়ে দেখা মিলে এক অনুপমেয় প্রাকৃতিক পরিবেশ। পুবালি বাতাসে শান্তির পরশে দোল খায় প্রতিটি অন্তরাত্মা। এমনই এক মোহনীয় পরিবেশে অন্ধকার যুগের পশুসুলভ জীবনাচার ও সামাজিক অন্যায়–অবিচারের তমাসা থেকে মানবতাকে সভ্যতার আলোর দিকে এগিয়ে নিতে মুক্তির মহান বাণী নিয়ে আসেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অবিসংবাদিত মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)। সঙ্গে নিয়ে আসেন শান্তি, সাম্য, ঐক্য ও কল্যাণের শুভ সংবাদ।
ছোটবেলা হতে রসুল (সা.) মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অভিলাষী ছিলেন, অন্যায় অনাচার নির্যাতন ও শোষণ নির্মূলে ছিলেন সচেষ্ট। অসহায় মানুষকে পাশবিকতার আস্ফালন হতে রক্ষা করার জন্য নুবুওয়তের ১৫ বছর পূর্বে ২৫ বছর বয়সে গড়ে তুলেন হিলফুল ফুযুল নামে এক যুব সংঘ!
হিলফুল ফুযুল প্রতিষ্ঠা: রসুল (সা.) এমনি এক সময় আরব ভূখণ্ডে আগমন করেন যখন আরবে চরম বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা বিরাজ করছিল, ছিল না কোনো আইন বা কোনো শাসন, যুগ যুগ ধরে চলত গোত্রীয় কলহ, অনবরত যুদ্ধ-বিগ্রহের দরুন আরবের অনেকগুলো পরিবার ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছিল। সুদ, ঘুষ, জুয়া, মদ, হত্যা ও লুণ্ঠনের ন্যায় জঘন্য অপরাধ মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল, ঐতিহাসিকগণ আরবের এই সময়কে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ’ বলে অবহিত করেন। জাহেলি যুগের এ অবাঞ্চনীয় পরিস্থিতি বালক মুহাম্মদ (সা.)-এর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে, তিনি সমাজকে এমন পরিস্থিতি হতে রক্ষা করতে সর্বদা চিন্তায় মগ্ন থাকতেন, অবশেষে সকল চিন্তার অবসান ঘটিয়ে তাঁর তনু-মনে এক অভিনব চিন্তার উদ্রেক হয়, তিনি তাঁর সমবয়সী কতিপয় যুবককে নিয়ে ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে হিলফুল ফুযুল নামে এই যুবসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতন দমনের লক্ষ্যে এই সংঘঠনের গোড়াপত্তন হলেও ধরনা করা হয় যে, বিশেষ একটি যুদ্ধের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংঘঠন গঠিত হয়।
সংঘের কর্মসূচি: ১. আমরা দেশের অশান্তি দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো, ২. বিদেশি লোকদের ধন-প্রাণ ও মান-সম্মান রক্ষা করতে সদা সচেষ্ট থাকবো, ৩. বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সহানুভূতি ও সদ্ভাব স্থাপনে কুণ্ঠাবোধ করবো না, ৪. অত্যাচারী ও তার অত্যাচারের হাত হতে অত্যাচারিতকে রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করবো।
এভাবে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুযুল বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কল্যাণী সেবাসংঘের মর্যাদা লাভ করে এবং এর মধ্য দিয়ে মহানবী (সা.) নবী হওয়ার আগেই শান্তির অগ্রদূত হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করেন।
জাহেলি যুগে আরব সমাজের অন্যায় অনাচারের প্রতিরোধে হিলফুল ফুযুল গঠিত হলেও মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে গঠিত এ শান্তি সংগঠনটি সর্বকালের যুবকদের জন্য এক আদর্শ শিক্ষক ও পথনির্দেশক! বর্তমান যুগে জাহেলি যুগের মতো কলুষিত সমাজ পরিলক্ষিত না হলেও এখনো সমাজে বহু মানুষ অত্যাচার অনাচার ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এখনো সমাজে হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, সুদ, ঘুষ প্রভৃতি অসামাজিক কাজ কম-বেশি প্রচলিত রয়েছে। যদি আজও যুবসমাজ হিলফুল ফুযুলের আদর্শে লালিত হয়ে দেশ ও জাতি গঠনে সোচ্চার হয় এবং সমাজের সব অন্যায় অনাচার প্রতিরোধে শান্তি সংগঠন গড়ে তুলে, তবে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ও উন্নয়ন অনেকটাই নিশ্চিত হবে। মহানবী (সা.)-এর এ আদর্শ শিক্ষা প্রত্যেক যুবকের মনে প্রতিফলিত হোক। আমিন।
সাখাওয়াত হোসাইন
সদর নোয়াখালী