মুবাশশির নাজির
হযরত হাসান (রাযি.)-এর অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য?
হযরত হাসান (রাযি.) রসুল (সা.) অত্যন্ত প্রিয় দৌহিত্র ছিলেন। যখন তিনি খলিফা হন তখন তাঁর বয়স মাত্র আটত্রিশ বছর। বিদ্রোহীরাও এই ভেবে তাঁর বায়আত গ্রহণ করেছিলো যে, তিনি অনভিজ্ঞ; তারা নিজেদের চাওয়া সহজেই হাসান (রাযি.)-এর মাধ্যমে উসুল করে নিতে পারবে। অপরদিকে সিরিয়াবাসীও তাঁকে সম্মান করতেন, কেননা তিনি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত হযরত ওসমান (রাযি.)-এর প্রতিরক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন এবং সিফফিন যুদ্ধেও তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন। এ কারণে তাঁর ব্যক্তিত্ব ঐক্যের এই মিশনে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো। তাঁর সম্পর্কে রসুল (সা.)। একটি ভবিষদ্বাণী করেছিলেন যা সহীহ আল-বুখারীতে উদ্ধৃত হয়েছে।
হযরত হাসান (রাযি.) ঐক্য গড়লেন যে কারণে
একথা স্পষ্ট যে, হযরত হাসান (রাযি.) নিজের শাসন ক্ষমতার মূল্য চুকিয়ে হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর সঙ্গে এজন্য ঐক্য গড়ে তুলেছেন। যাতে সাচ্চা মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং মুনাফিক বিদ্রোহীদের উৎখাত ও দমন করা যায়। এটা হযরত হাসান (রাযি.)-এর চূড়ান্ত ইখলাসের নিদর্শন ছিলো যে, তিনি নিজের স্বার্থের ওপর মুসলিম উম্মাহর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বিদ্রোহী বর্ণনাকারীরা হাসান (রাযি.)-এর এ ঐক্য হজম করতে পারেনি এবং তারা ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহে নিজেদের মনগড়া কথাবার্তা প্রবেশ করিয়ে এ ঐক্যকে (নাউজুবিল্লাহ) তাঁর লালসা, স্বার্থান্বেষণ, হীনমন্যতা ও দুর্বলতা বলে আখ্যায়িত করেছে।
একথা বাস্তবতার বিলকুল বিপরীত। তাবারীই এমনকিছু বর্ণনা উল্লেখ করেছেন যা দ্বারা ঘটনার আসল ও বাস্তব চিত্র সামনে আসে। হযরত আলী (রাযি.) ইরাকীদের সৈন্যবাহিনী গঠন করেছিলেন যা আজারবাইজান এবং ইস্পাহানের সাথে সম্পর্ক রাখতো। এছাড়া আরবদের একটি বিশেষ সৈন্যবাহিনী ছিলো যাদের মধ্যে চল্লিশ হাজার যোদ্ধা ছিলো এবং তারা হযরত আলী (রাযি.)-এর হাতে শাহাদাতের বায়আত গ্রহণ করেছিলো। হযরত আলী (রাযি.) হযরত কায়স ইবনে সাদ (রাযি.)-কে তাদের কমান্ডার বানিয়েছিলেন এবং কায়স প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কিছুটা দেরি করে ফেলেছেন। এদিকে হযরত আলী (রাযি.) শাহাদাত বরণ করেন এবং ইরাকবাসী হযরত হাসান (রাযি.)-কে খলিফা বানায়।
ইরাকীরা যখন হযরত হাসান (রাযি.)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করে তখন হাসান (রাযি.) তাদের কাছ থেকে শর্ত আরোপ করেন যে, আপনারা আমার কথা মানবেন এবং আমার আনুগত্য করবেন। আমি যার সাথে সন্ধি করবো আপনারাও তার সাথে সন্ধি করবেন; আর আমি যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো আপনারাও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। এই শর্ত শুনে ইরাকী বিদ্রোহীগোষ্ঠীর সমর্থকদের মনে সংশয় তৈরি হলো। তারা বললো, এই লোক তো আমাদের উদ্দেশ্য হাসিলে সহযোগী হবার লোক নয়, তার মনে তো লড়াইয়ের অভিপ্রায় আছে বলে মনে হয় না।
হযরত হাসান (রাযি.)-এর বায়আতের তখনও কিছুদিন অতিবাহিত হলো মাত্র, তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওপর বর্শা নিক্ষেপ করা হয় যা সফল হয়নি।ফলে ওদের ব্যাপারে হযরত হাসানের মনে ঘৃণা বেড়ে গেলো এবং তিনি তাদের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেলেন। তিনি মুআবিয়া (রাযি.)-কে চিঠিপত্র লিখে পাঠান এবং শর্তসমূহ লিখে পাঠিয়ে বলেন যে, আপনি যদি এসব শর্ত মঞ্জুর করে নেন তাহলে আমি আনুগত্য করবো এবং আপনার ওপর এ অঙ্গীকার পূরণ করা আবশ্যক হবে।
এ বিস্তারিত বিবরণ থেকে জানা গেলো, হযরত হাসান (রাযি.) নিজের নয় বরং মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর সঙ্গে ঐক্য গড়েছিলেন। যার কাছে চল্লিশ হাজার সৈনিক আছে এবং যারা জীবনবাজি রাখার বায়আত গ্রহণ করেছে, তার কী ভয় থাকতে পারে? স্পষ্ট যে, হযরত হাসান (রাযি.) বিদ্রোহীদের ঘৃণা করতেন এবং তাদেরকে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইতেন। অপরদিকে বিদ্রোহীরাও আঁচ করে নিয়েছে যে, হাসান (রাযি.) তাদের কোনো কাজে আসবে না; এ কারণে তারা তাঁর ওপর প্রাণঘাতী হামলাও করেছে এবং তাঁর তাঁবু লুটপাট করেছে এবং যে গালিচার ওপর হাসান (রাযি.) বসতেন তাও তছনছ করেছে।
এ হামলার পর হযরত হাসান (রাযি.) কুফা থেকে বের হয়ে মাদায়েনের উপকণ্ঠে মাকসুরাতুল বাইদা নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান নেন। সেখানেও তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এই হামলাকারী ছিলো মুখতার সাকাফী যে হরত হুসাইন (রাযি.)র প্রতিশোধের নাম করে নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন শুরু করেছিলো এবং পরে একসময় নবুওয়তের দাবিও করেছে। বর্ণনাটি এরূপ:
সাদ ইবনে মাসউদ যিনি মুখতার সাকাফীর চাচা ছিলেন এবং তিনি তখনও নওজোয়ান ছেলে। হযরত আলী (রাযি.) কর্তৃক মাদায়েনের গভর্নর ছিলেন তিনি। হযরত হাসান (রাযি.) খলিফা হওয়ার পর মাদায়েনে এলে মুখতার সাকাফী নিজের চাচার কাছ ‘আবদার’ পেশ করলো যে, হযরত হাসান (রাযি.)-কে বেঁধে হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর কাছে সোপর্দ করা হোক এবং তার বিনিময়ে নিরাপত্তার দাবি আদায় করা হোক। চাচা তাকে ধমক দিয়ে বললেন, আল্লাহ তোমার ওপর অভিসম্পাৎ করুন। আমি কি রসুল (সা.) দৌহিত্রের ওপর হামলা করে তাকে বেঁধে নেবো? তুমি তো অসভ্য! হযরত হাসান (রাযি.) যখন দেখলেন যে, তাঁর বিষয়ে বিভেদ তৈরি হতে শুরু হয়েছে তখন তিনি হযরত হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। হযরত মুআবিয়া (রাযি.) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের এবং আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রাযি.)-কে হাসান (রাযি.)-এর কাছে পাঠালেন। তাঁরা দুজন মাদায়েনে হযরত হাসান (রাযি.)-এর কাছে এলেন এবং হাসান (রাযি.) যেসব দাবি জানিয়েছেন তা মঞ্জুর করে নেন।১
সন্ধির বিষয়ে হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর অবদানও অসামান্য। বর্ণনা অনুযায়ী সমঝোতার চিন্তা প্রথমে হযরত মুআবিয়ার (রাযি.)- মাথায় উদয় হয়েছে যে, যদি যুদ্ধ ও লড়াইয়ের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, তাহলে মুসলমানদেরই লোকসান হবে। এ কারণে তিনি সন্ধির পদক্ষেপ সূচনা শুরু করেন এবং একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে এর ওপর মোহর অংকিত করে (সিল মেরে) হযরত হাসান (রাযি.)-এর পাঠিয়ে দেন। সহীহ আল-বুখারীর বর্ণনা,
আবু মুসা ইসরাইল বর্ণনা করছেন যে, তাকে স্বয়ং হযরত হাসান (রাযি.) বলেছেন যে, যখন মুআবিয়ার মোকাবিলায় হযরত হাসান ইবনে আলী (রাযি.) সৈন্যবাহিনী নিয়ে চলছে তখন হযরত আমর ইবনুল আস (রাযি.) হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-কে বললেন, আমি হাসানের নিকট যে সৈন্যবাহিনী দেখেছি তারা সেসময় পর্যন্ত পিছু হটবে না যতক্ষণ পর্যন্ত বিরোধী সেনাদের পালাতে বাধ্য না করবে। হযরত মুআবিয়া (রাযি.) বললেন, (যদি এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং উভয় দলের অনেক লোক মারা যায়, তাহলে) মুসলমানদের সন্তানদের লালনপালন কে করবে? আমর ইবনুল আস বললেন, আমরা তাঁর সাথে সন্ধির জন্য কথাবার্তা বলবো।
হাসান বসরী বলছেন যে, আমি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.)-কে বলতে শুনেছি, একটি কথা রসুল (সা.) বলেছিলেন যে, আমার এই বংশধর সরদার হবে এবং আশা আছে যে, আল্লাহ তায়ালা তার মাধ্যমে মুসলমানদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যকার সমঝোতা করাবেন।2
এ থেকে হযরত হাসান, হযরত মুআবিয়া ও হযরত আমর ইবনুল আস (রাযি.)-এর মধ্যে উম্মতের জন্য সাচ্ছা আন্তরিকতার ধারণা পাওয়া যায়। আত্মসম্মান ও মর্যাদার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী তো অনেকেই আছেন কিন্তু নিজের দীন ও বিশ্বাসের জন্য নিজের সম্মানকে বিলিয়ে দিতে-পারা খুব কমই পাওয়া যায়। হযরত হাসান (রাযি.)-এর কুরবানি এত উঁচুমাপের যে, মুসলমানদের কেয়ামত পর্যন্ত তা নিয়ে আনন্দ অনুভব করা উচিত এবং তাঁর আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত কিন্তু যেহেতু এই কোরবানি বিদ্রোহী আন্দোলনের স্বার্থের বিপরীত ছিলো কাজেই তারা এমন কথা (বর্ণনা) ছড়িয়ে দিয়েছে যে, হযরত হাসান (রাযি.) দুর্বল ব্যক্তি ছিলেন (নাউজুবিল্লাহ) এবং তিনি পরাজিত হয়ে সন্ধিচুক্তি করেছিলেন।
সহীহ আল-বুখারীর উল্লিখিত বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয়, হযরত হাসান (রাযি.) কোন পর্যায়ের শক্তিশালী ছিলেন।
এ বর্ণনায় হযরত আমর ইবনুল আস (রাযি.)-এর মতো ব্যাপক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সেনাপতির ছিলো যে, হযরত হাসান (রাযি.)-এর সঙ্গে বিশাল বাহিনী ছিলো তাদের উদ্দীপনা দেখেই বোঝা যায়, বিজয় ছিনিয়ে আনার আগে রণাঙ্গণ ছাড়বে না এ বাহিনী। হযরত কায়স ইবনে সাদ (রাযি.)-এর মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিক এবং যোদ্ধা ব্যক্তি সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাবারীর বর্ণনায় এই সৈন্যবাহিনীর জন্য ‘পাহাড়ের মতো সৈন্যরা’ এমন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরেও যদি বলা হয় যে, হযরত হাসান (রাযি.) পরাজিত হয়ে সন্ধিচুক্তি করেছিলেন, তাহলে সেটাকে গোড়ামি ও পক্ষপাত ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে।
পরে হযরত মুআবিয়া (রাযি.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.), হযরত কায়স ইবনে সাদ (রাযি.) এবং জিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান (রাযি.)-এর সঙ্গেও সন্ধি করে নেন। তিনি যুদ্ধ এড়াতে চাইতেন যে, কোনোভাবেই এটি তাঁর পছন্দের বিষয় ছিলো না । তাবারীর বর্ণনা:
হযরত মুআবিয়া (রাযি.) কায়স ইবনে সাদের কাছে দূত প্রেরণ করলেন, দূত যেন তাঁকে আল্লাহর ভয়ের পেশ করে এবং জিজ্ঞেস করে যে, কার নির্দেশে আপনারা লড়াই করার জন্য প্রস্তুত? যার নির্দেশের অধীনে আপনারা ছিলেন তিনি আমার হাতে বায়আত গ্রহণ করেছেন। কায়স মুআবিয়ার কথায় দমে যাওয়া পছন্দ করলেন না। মুআবিয়া একটি কাগজে মোহর মেরে তার কাছে এই মর্মে পাঠালো যে, আপনার যা মন চায় তা এই কাগজে লিখে দিন, আমার কাছে সব কিছু মঞ্জুর। হযরত আমর (রাযি.) বললেন, কায়সের ব্যাপারে এতো ছাড় না দেওয়া উচিত। হযরত মুআবিয়া (রাযি.) বললেন, হুঁশে ফিরে আসুন, এতোগুলো মানুষকে আমরা সে সময় পর্যন্ত হত্যা করতে পারি না যতক্ষণ পর্যন্ত সিরিয়াবাসীদের মধ্য থেকেও ততোগুলো মানুষ না মারা যায় এবং যেসবের পর জীবন হয়ে উঠবে বিষাদময়। আল্লাহর শপথ, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো উপায় বাকি থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কায়সের বিরুদ্ধে লড়াই করবো না।
হযরত মুআবিয়া (রাযি.) এই মোহর অংকিত কাগজ প্রেরণ করলে কায়স নিজের এবং হযরত আলী (রাযি.)-সমর্থকদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চাইলেন। এই বিষয়ে নিরাপত্তার দাবি ছিলো এরূপ: তাদের হাতে যেসব নিহত হয়েছে বা যেসব গনীমতের সম্পদ তাদের হস্তগত হয়েছে (তাদের কাছ থেকে এসবের কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না) এই চুক্তিপত্রে তিনি হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর কাছ থেকে সম্পদের উন্মুক্ত চাহিদা পেশ করেন নি এবং হযরত মুআবিয়া (রাযি.) তার প্রত্যেকটি শর্ত মেনে নেন। তার সকল সঙ্গী হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর আনুগত্যের অধীনে চলে আসে।
সেই ফিতনার যুগে পাঁচজন ব্যক্তি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য পরামর্শক এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিক বলে গণ্য হতেন। তাঁরা হলেন, মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান, আমর ইবনে আস, মুগীরা ইবনে শু’বা, কায়স ইবনে সাদ এবং মুহাজিরীনের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে বুদাইল খুযায়ী (রাযি.)। তাদের মধ্যে কায়স ও ইবনে বুদাইল আলী (রাযি.)-এর সাথে ছিলেন এবং মুগীরা ও আমর মুআবিয়া (রাযি.)-এর সাথে ছিলেন।3
ঐক্য ইস্যুতে হযরত হুসাইনের অবস্থান
বিদ্রোহী বর্ণনাকারীরা অপপ্রচারের মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছে যে, হযরত হুসাইন (রাযি.) এ ঐক্যের বিরোধী ছিলেন। বস্তুত, এটা ছিলো তাদের বিদ্রোহী অবস্থানকে বৈধতা দেওয়ার প্রয়াস। তবে বাস্তবতা ছিলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত। হযরত হুসাইনের মতো ব্যক্তিত্বের জন্য এ বিষয়টি সীমাহীন ভুল ধারণার ভিত্তিতে গড়া যে, তিনি মুসলমানদের মধ্যকার অত্যন্ত পবিত্র ঐক্য হতে দেখে দ্বিতীয়বার ফিতনা ও ফ্যাসাদের আগুন প্রজ্জ্বলিত করবেন। হযরত হুসাইন (রাযি.) হযরত মুআবিয়ার শাসনামলে যে কর্মনীতি অনুসরণ করেছেন তা থেকে অনুমিত হয় যে, তিনি হযরত মুআবিয়াকে মনেপ্রাণে সম্মান করতেন। আল আখবারুত তিওয়াল বর্ণনা থেকেও এটি প্রতিভাত হয়। উল্লেখ্য যে, আল আখবারুত তিওয়াল কোনো অজ্ঞাতপরিচয় শিয়া লেখকের বই এবং ভুলভাবে এই কিতাবটিকে আবু হানিফা আদ দীনূরীর রচনা বলে প্রচারিত আছে।
(সন্ধির পর) সর্বপ্রথম হযরত হাসান ইবনে আলী (রাযি.)-এর সঙ্গে হুজার ইবনে আদীর সাক্ষাৎ হয়। সে হযরত হাসান (রাযি.)-কে তাঁর এই কাজের (সন্ধির)-জন্য তিরস্কার করে। এবং তিনি যেন (হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর বিরুদ্ধে) পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ করার আহ্বান জানান। তিনি বললেন, হে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তরপুরুষ, আমি যদি এই ঘটনা দেখার আগে মৃত্যুবরণ করতাম। আপনি আমাদেরকে ন্যায্য অবস্থান থেকে বের করে এনে অন্যায়ে লিপ্ত করে দিয়েছেন। আমরা যে হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলাম তা আমরা ছেড়ে দিয়েছি এবং যে বাতিল থেকে পলায়ন করেছিলাম তাতে গিয়ে মিশে গিয়েছি। আমরা নিজেরা লাঞ্ছনা অবলম্বন করে নিয়েছি এবং এই হীনতাকে গ্রহণ করে নিয়েছি যা আমাদের উপযুক্ত ছিলো না।
হুজর ইবনে আদির একথাগুলো হযরত হাসান (রাযি.)-এর পছন্দ হয়নি এবং তিনি বললেন, আমি লক্ষ করছি, মানুষ সন্ধির প্রতি আগ্রহী এবং যুদ্ধ করাকে অপছন্দ করে। আপনি চাইছেন, আমি যেন মানুষের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেই; যা তারা অপছন্দ করে। আমি বিশেষ করে নিজের অনুগামীদের নিরাপত্তার জন্য এই সন্ধিচুক্তি করেছি। আমার মত হলো, যুদ্ধসংক্রান্ত বিষয়গুলো মৃত্যু পর্যন্ত মুলতবি করে দেওয়া হোক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সর্বদাই কোন না কোন কাজে রত আছেন।4
এবার হুজর হুসাইন (রাযি.)-এর কাছে গেলো, তার সাথে উবাইদাহ ইবনে আমরও ছিলো। এরা দুজন বলতে লাগলো, হে আবু আবদুল্লাহ (হযরত হুসাইনের উপনাম), আপনি তো ইজ্জতের বিপরীতে লাঞ্ছনা ক্রয় করে নিয়েছেন। মুনাফার বিপরীতে লোকসান গ্রহণ করেছেন। আজ আমাদের কথা মেনে নিন, পরে পুরো জীবনেই না মানতে পারেন। হাসানকে তার সন্ধির ওপর ছেড়ে দিন এবং কুফা ইত্যাদি অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্য থেকে নিজের অনুগামীদেরকে একত্রিত করে নিন। এই বিষয়টি আমাকে এবং আমার সাথীদেরকে সোপর্দ করে দিন। হিন্দের সন্তান (মুআবিয়া) আমাদের ব্যাপারে তখন জানতে পারবে যখন আমরা তরবারি দিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।
হযরত হুসাইন (রাযি.) উত্তর দিলেন, আমরা বায়আত গ্রহণ করে নিয়েছি এবং অঙ্গীকার করে নিয়েছি। এখন তা ভঙ্গ করার কোনো পথ নেই।
এ বর্ণনা দ্বারা অনুমিত হয় যে, হযরত হুসাইন (রাযি.)ও সন্ধি চাইতেন। পরবর্তী বিশ বছর হযরত মুআবিয়ার সাথে তাঁর সম্পর্কগুলো খুব ভালো ছিলো।
অনুবাদ: খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
টীকা
- প্রাগুক্ত, 4/1, 24
- বুখারী: ৬৬৯২
- তাবারী, ৪/১ ও ২৭
- সুরা আর রাহমান: ২৯