আল্লামা আবদুল খালেক সাম্ভলী (রহ:) জীবন ও কর্ম
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
প্রিয় শায়খ আল্লামা আবদুল খালেক সাম্ভলী (রহ:)। দারুল উলুম দেওবন্দের নায়েবে মুহতামিম ও হাদীস বিশারদ। তাঁর কাছ থেকে সিহাহ সিত্তার অন্যতম কিতাব সুনানে ইবনে মাজাহর দরস ও ইজাযত লাভ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সহজ-সরল ভাষায় হাদীসের ব্যাখ্যা, প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠ উপস্থাপন, রসাত্মক কাহিনির মাধ্যমে দরসেগাহকে আনন্দমুখর করা এবং উর্দু ও ফারসি কবিতার মাধ্যমে বক্তব্যকে শ্রুতিমধুর করে তোলা, সর্বোপরি আকাবিরের স্মৃতিচারণের মাধ্যমে জটিল বিষয়কে সহজলভ্য করে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন আল্লাম আবদুল খালেক সাম্ভলী (রহ:)।
তিনি যেমন ছিলেন একজন দক্ষ শিক্ষক, তেমন ছিলেন একজন ক্ষুরদার লেখক। তাঁর বক্তব্য যেমনি ছিলো শ্রুতিমধুর, তেমনি তাঁর লিখনি ছিলো অনেক প্রবাহমান। ফতওয়ায়ে আলমগীরের কিছু খণ্ড তিনি উর্দু ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এছাড়াও তিনি মুখতাসারুল মাআনীসহ দরসে নেজামীর অনেক জটিল কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থও রচনা করেছেন। ছাত্রদের প্রতি তাঁর বিশেষ দয়ার দৃষ্টি ছিলো। কোন ছাত্র কোন সমস্যা নিয়ে গিলে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। তাঁর কাছ থেকে সকলেই উৎসাহ-উদ্দীপনা পেতেন। কেউ ছোট একটি রেসালা-পুস্তিকা নিয়ে গেলে তিনি তা পড়তেন। ভূমিকা ও অভিমত লিখে দিতেন।
দেওবন্দ থেকে আসার পর হযরতের কথা অনেক মনে পড়তো। কিন্তু যোগাযোগের সুযোগ ছিলো না। ২০২০ সালে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলনে তিনি তাশরীফ আনেন। হযরতের খেদমতের যিম্মাদারি ছিলো অধমের ওপর। নিকটে থেকে সুহবত-সংশ্রবে সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল। জামিয়ায় এসে তিনি অনেক মুগ্ধ হয়েছিলেন। অধমকে অনেক পরামর্শ ও দুআ দিয়েছিলেন। শায়খের সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম আলোচনা করা হলো।
জন্ম তারিখ ও স্থান
আল্লামা আবদুল খালেক সাম্ভলী (রহ:) ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ জেলার ‘সম্ভল’ এলাকায় ৪ঠা জানুয়ারি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে এক সম্ভান্ত পরিবারে জন্মলাভ করেন। তাঁর পিতার নাম নসীর আহমদ। তাঁর পিতা একজন নম্র-ভদ্র, সরল-কোমল অন্তরের অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সদা প্রফুল্ল ও সাদাসিধে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তেমনি তিনি একজন সাহিত্যিক ও সুললিত কণ্ঠের অধিকারী কবিও ছিলেন।
পড়া-লেখা ও শিক্ষা-দীক্ষা
আল্লামা আবদুল খালেক সাম্ভলী (রহ:) প্রাথমিক পড়াশোনা নিজ গ্রামের প্রতিষ্ঠান খায়রুল মাদারিসে আরম্ভ করেন। সেখানে তিনি মুফতি মুহাম্মদ আফতাব আলী (রহ:)-এর কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করতেন। কিছুদিন পর তাঁর শিক্ষক মুফতি মুহাম্মদ আফতাব আলী (রহ:) যখন শামসুল উলুম মাদরাসায় যোগদান করেন, তখন তিনিও সেখানে চলে যান। সেখানে তিনি হাফেয ফরিদুদ্দিন সাহেবের নিকট হিফয সমাপ্ত করেন এবং ফারসি ও প্রাথমিক আরবী জামায়াত থেকে নিয়ে শরহে জামি পর্যন্ত মুফতি মাহাম্মদ আফতাব (রহ:)-এর নিকটেই পড়েন।
অতঃপর ১৯৬৮ ইংরেজিতে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। তিনি যেহেতু শিশুকাল থেকেই মেধাবী ও প্রতিভাবান ছিলেন, তাই দারুল উলুম দেওবন্দে এসে তাঁর মেধা আরও বিকশিত হতে লাগলো। তিনি দারুল উলুমে পড়া-লেখায় তাঁর সাথীদের ওপর এগিয়ে যেতে লাগলেন। প্রায় পাঁচ বছর যাবত তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়ন করেন। এই পাঁচ বছরের অধ্যয়নকালে তিনি তার সমস্ত সময় একাডেমিক পড়াশোনায় ব্যয় করতেন। নিয়মিত দরসে উপস্থিত থাকা, পড়া-লেখায় মনোনিবেশ করা, শিক্ষকমণ্ডলী ও ইলমের সরঞ্জামগুলোর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং সুশৃঙ্খলভাবে কাজ সম্পাদন করা ইত্যাদি ছিলো তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
শায়খ আল্লামা আবদুল খালেক সাম্ভলী p। দারুল উলুম দেওবন্দের নায়েবে মুহতামিম ও হাদীস বিশারদ। তাঁর কাছ থেকে সিহাহ সিত্তার অন্যতম কিতাব সুনানে ইবনে মাজাহর দরস ও ইজাযত লাভ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সহজ-সরল ভাষায় হাদীসের ব্যাখ্যা, প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠ উপস্থাপন, রসাত্মক কাহিনির মাধ্যমে দরসেগাহকে আনন্দমুখর করা এবং উর্দু ও ফারসি কবিতার মাধ্যমে বক্তব্যকে শ্রুতিমধুর করে তোলা, সর্বোপরি আকাবিরের স্মৃতিচারণের মাধ্যমে জটিল বিষয়কে সহজলভ্য করে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন আল্লাম আবদুল খালেক সাম্ভলী (রহ:)।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে দাওরায়ে হাদীস সমাপনী পরীক্ষায় তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। অতঃপর তিনি আরবি সাহিত্যে দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে দারুল উলুম দেওবন্দে তাকমীলে আদবে ভর্তি হন। সেখানে আল্লামা ওয়াহীদুযযামান কিরানভী (রহ:)-এর বিশেষ সান্নিধ্যে থেকে আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের শীর্ষ শায়খগণের কাছ থেকে জ্ঞান অহরণ করেন। শায়খুল হিন্দ (রহ:)-এর প্রসিদ্ধ শিষ্য আল্লামা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী (রহ:)-এর কাছ থেকে তিনি বোখারী শরীফ পড়ছেন। হাকীমুল ইসলাম আল্লামা কারী তৈয়ব (রহ:), মুফতি মাহমূদুল হাসান (রহ:), আল্লামা শরীফুল হাসান (রহ:) এবং আল্লামা নসীর আহমদ খান (রহ:) প্রমুখের কাছ থেকেও তিনি হাদীসের সনদ অর্জন করেন।
শিক্ষাকতা ও কর্মজীবন
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয়। তিনি সর্বপ্রথাম হাপুড়ের খাদেমুল ইসলাম মাদরাসায় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে ছয় বছর পর্যন্ত সুনামের সাথে অধ্যাপনার কাজ চালিয়ে যান। অতঃপর ১৯৭৯ সালে মুরাদাবাদের জামিউল হুদা মাদরাসায় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে তাঁর দরস-তাদরীসের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিন বছর যাবত সেখানে তিনি জ্ঞান বিতরণ করতে থাকেন।
অবশেষে ১৯৮২ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ১৯৮২ ইংরেজি থেকে মৃত্যু অবধি প্রায় ৩৯ বছর যাবত তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের খাদেম ছিলেন। দারুল উলুম দেওবন্দের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। তিনি ছিলেন আমানতদারী ও সততার মূর্তপ্রতীক। অনেকদিন যাবৎ তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন। পরিশেষে ২০০৮ সাল থেকে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের সহকারী পরিচালকের গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছেন।
বিগত ৩০ জুলাই ২০২১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ২০ জিলহজ ১৪৪২ হিজরী (জুমাবার) তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রাত ১১টায় দারুল উলুম দেওবন্দের ঐতিহাসিক মুলসরী ময়দানে তাঁর নামাযে জানাযা শেষে মাকবারায়ে কাসেমীতে তাঁকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাঁর কবরকে রিয়াযুল জান্নাতে পরিণত করুন, আমীন।
রব্বে কারীম!
দয়া করে আমাদের শায়খকে রহম করুন। তাঁর খেদমতগুলো কবুল করুন। দারুল উলুমের জন্য তাঁর উত্তম স্থলাভিষিক্ত দান করুন। তাঁর কবরকে জান্নাতে রূপান্তর করুন। জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চু মাকাম দান করুন, আমীন।
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম