মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম
তানভীর সিরাজ
(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সংখ্যা)
ইসলামী আইন-কানুন (Islamic law) সবসময় মানবতার কথা বলে। মানবাধিকার বাস্তবায়নের পক্ষে ইসলামী শরিয়ত জোর তাকিদ দিয়ে আসছে। আর মানবতার মুক্তির দূত (Messenger of the liberation of humanity) অন্ধকার যুগে মানবতার মুক্তির সনদপ্রাপ্ত আখেরি নবী জনাব মুহাম্মদ ঊ-এর মাধ্যমেই মৌলিক অধিকার পাওয়া ও আদায়ের ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে। আইয়ামে জাহেলিয়াতে যখন মানুষ অধিকার (Rights) শব্দটি প্রায় সবাই ভুলতে বসেছে ঠিক তখন ই তিনি মানবাধিকার (Human rights) শব্দের বাস্তব প্রয়োগ হাতেকলমে শিখিয়েছেন।
যাকাত কোরআনের একটি শব্দ। তার বিধান বাস্তবসম্মত ও পরোপকারী। যাকাত শব্দই যথেষ্ট ‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম’ কথাটি বুঝতে। ইসলামী স্কলারগণ বলেন, ‘দারিদ্র বিমোচনে যাকাত ইসলামের এক অতুলনীয় বিধান।’ যাকাত শরিয়তের এমন এক অকাট্য বিধান, যে সম্পর্কে প্রমাণের আলোচনা নিস্প্রয়োজন। এটি মানুষের মৌলিক অধিকার। যাকাত আদায়হওয়ার জন্য শর্ত হল, উপযুক্ত ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া। আত্মীয়-স্বজন যদি যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়তাহলে তাদেরকে যাকাত দেওয়াই উত্তম। ভাই, বোন, ভাতিজা, ভাগনে, চাচা, মামা, ফুফু, খালা এবং অন্যান্য আত্মীয়দেরকে যাকাত দেওয়া যাবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক: ৭১৬০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৬/৫৪২-৫৪৬)
পারিশ্রমিক হিসাবে যাকাত দিলে আদায় হবে না। শুধু মুসলমানকে যাকাত দেওয়া। অমুসলিম দের যাকাত দেওয়ার বিধান অবশ্য ইসলামের শুরুর যুগে ছিলো। এখন এটিকে ধর্মীয় অধিকার বলা যায়। সুতরাং চিন্তা করলে যাকাত শব্দেই মানবাধিকারের যুগোপযুগী ব্যাখ্যা খুঁজে পাই।
মানবাধিকারের পরিচয়
কুয়েত ইউনিভার্সিটির তত্ত্বাবধানে ‘ইসলামে মানবাধিকার’ বিষয়ে অনুষ্ঠিত ছয় দিনব্যাপী ওয়ার্কশপের উদ্বোধনী প্রবন্ধে জনাব আইকে রুহি বলেন, মানবাধিকারই হচ্ছে ইসলামী আইনের মূল ভিত্তি। প্রবন্ধে জনাব আইকে রুহি নবীজী +-এর বিদায় হজের ভাষণকে মানবাধিকারের সর্বপ্রথম ঘোষণা হিসাবে উল্লেখ করেন। (দৈনিক জঙ্গ ১৫ ডিসেম্বর ১৯৮০; ইসলাম ও মানবাধিকার, হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী, ভাষান্তর: শাহাদাত ছাকিব, মাসিক আল–কাউসার, সংখ্যা: ৫)
ইসলামী এক পণ্ডিত বলেন, ‘সৃষ্টিতে ও মৌলিক গুণাবলিতে সব মানুষ যেসব অধিকার ধারণ করে, তাকেই বলে মানবাধিকার বা মানুষের মৌলিক অধিকার।’ যেমন স্বাভাবিক জন্মের অধিকার; বেঁচে থাকার বা স্বাভাবিক জীবনধারণের অধিকার; মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তু ও বিষয় তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা পাওয়ার অধিকার এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার। এসব অধিকার মহান আল্লাহ তাআলাই মানুষকে দিয়েছেন।
আধুনিক যুগে মানবাধিকার
পাশ্চাত্য সভ্যতায় মানবাধিকারের ধারণাটি প্রথম জন্ম হয় ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এর ফলে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে সর্বপ্রথম ঘোষিত হয় Declaration of the People’s Right এবং 1791 খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সংযোজিত হয় The Bill of Rights। এর পর থেকে মানবাধিকারের ধারণাটি সমগ্র পাশ্চাত্য দেশে বিকশিত হয় এবং ধীরে ধীরে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবাধিকার প্রসঙ্গটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকে। এর ফলে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ৩০টি ধারাসংবলিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয়। এ ঘোষণায় বিশ্ববাসীর মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদটি কোনো রাষ্ট্রের ওপর বাধ্যতামূলক করা না হলেও ক্রমান্বয়ে তা বিভিন্ন দেশে অনুসৃত হতে থাকে। আজ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গঠিত হয়েছে মানবাধিকার কমিশন। এসব কমিশন নিজ নিজ দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি আজ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্র ক্রমাগত ঘটেই চলছে। আজকের আধুনিক সভ্য যুগে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারকে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে মহানবী + অজ্ঞতা ও অন্ধকার যুগে কলুষিত সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় শতভাগ সফল হয়েছিলেন। (কালের কণ্ঠ 22 এপ্রিল ২০১৬)
মানবাধিকার চার প্রকার
ইসলাম মানবাধিকারকে চারভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় জীবনে মানবাধিকার শব্দের প্রয়োগ খুঁজে পাই।
ব্যক্তি জীবনে মানবাধিকার
প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ সত্তার সাথেই মানবাধিকারের সর্ম্পক। বিশেষ করে নিজের প্রতি জুলুম করা। এই জুলুম মানুষ বিভিন্নভাবে করে। কেউ রাতের আঁধারে, কেউ দিবালোকে, আবার কেউবা করে জনসম্মুখে। এককথায় পাপ কাজে নিজেকে যেকোনোভাবে সম্পৃক্ত করাই হলো নিজের প্রতি জুলুম বা অন্যায় করা। অথচ আল্লাহ পাক সব দেখেন এবং শুনেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না…, সূরা তাওবা ৯:৩৬। আল্লাহ পাক আরও বলেন, জালিম ব্যক্তি সেদিন নিজের হস্তদ্বয়, দংশন করতে করতে বলবে, হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! হায়! দুর্ভোগ আমার; আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার কাছে উপদেশ পৌঁছার পর। শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক। (সূরা ফুরকান ২৫:২৭-২৯) সুতরাং পাপ কাজ করে নিজের সাথে প্রতারিত করার নামই হলো ব্যক্তি জীবনে মানবাধিকার লঙ্ঘন।
পারিবারিক জীবনে মানবাধিকার
ছেলে পিতা-মাতার আর পিতা-মাতা ছেলের আদায় করা, ভাই বোনের এবং বোন ভাইয়ের হক আদায় করা, স্বামী স্ত্রীর ও স্ত্রী স্বামীর হক আদায় করা, কুধারণা না দেওয়া, অপবাদনা দেওয়াআর কারও জান-মাল ও ইজ্জত-সম্মানের ওপর হামলা না করা, খাবারের ভয়ে সন্তান নষ্ট করা সহ পারিবারিক জীবনে সমূহ হক আছে, যার প্রতি আমরা যথেষ্ট উদাসিন। পারিবারিক জীবনে বিষয়সমূহ অত্যন্ত জরুরি।
অসচেতন সন্তানের কাছে পিতামাথা আজ বড়ই অসহায়। পারিবারিক জীবনে মানবাধিকারের কথা চিন্তা করে পিতামাথার হকের দিকে নজর দিতে পারি। অখণ্ড ভারতের প্রথম শাইখুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া রহ. লিখেছেন, বৈধ বিষয়ে তাদের আদেশ মানা জরুরি, পিতামাথার সাথে বেআদবি করবে না, তাদের সাথে অহংকার করবে না, যদিও তারা মুশরিক হয়। নিজের আওয়াজ তাদের আওয়াজের চেয়ে বড় করবে না, তাদের নাম ধরে ডাকবে না, কোনো কাজে তাদের চেয়ে আগে বাড়বে না, ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের ক্ষেত্রেও তাদের সাথে নম্রতা বজায় রাখবে। যদি তারা না মানে তবে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে থাকবে এবং তাদের হেদায়তের জন্য দোআ করতে থাকা। মোটকথা, প্রত্যেক বিষয়ে তাদের সম্মানের প্রতি খেয়াল রাখা। (ফজায়েলে আমল, পৃ. ৯০৬-৭)
পারিবারিক জীবনে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বিদায় হজের ভাষণে আল্লাহর নবী বলেছেন, হে ভক্তগণ! তোমাদের সহধর্মিণীদের ওপর তোমাদের যেরূপ অধিকার রয়েছে, তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার তদ্রূপ। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ এবং তাঁর আদেশমতো তাদের তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছ। তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে।
দান-খয়রাত আগে, না পরিবারের হক? মৃত্যুর আশঙ্কায় থাকা সাহাবি সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস D-কে দেখতে গেলে তিনি রাসূলুল্লাহ +-এর কাছে তার সম্পদ সাদাকা করে দিতে চাইলে উত্তরে আল্লাহর নবী বলেছেন, ‘সন্দেহ নেই, তোমার ওয়ারিসদেরকে তুমি যদি এমন অভাবীরূপে রেখে যাও, যার ফলে তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে, এ অবস্থার তুলনায় তাদেরকে তুমি সচ্ছলরূপে রেখে যাওয়া অনেক ভালো। আর আল্লাহ্র সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় তুমি যা কিছুই ব্যয় করবে, তোমাকে এর প্রতিফল দেয়া হবে, এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে লোকমাটি তুলে দাও সেজন্যেও তুমি পুরস্কার পাবে।’ (সহীহ বুখারী: ৪৪০৯)
সামাজিক জীবনে মানবাধিকার
আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখা, প্রতিবেশীর হক, এতিমের হক, অপবাদ, বিধবার হক, ভালো কাজের আদেশ, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ, সৎ উপদেশ, ধার-র্র্কজ দেওয়া, অসুস্থ হলে সেবা করা, বিপদে এগিয়ে আসা, জানাযায় উপস্থিত হওয়া, কেউ দাওয়াত দিলে তা গ্রহণ করা, যদি নিশ্চিত হারাম না জানা যায় আর রাস্তার হক হলো তাতে বসে অন্যজনকে কষ্ট না দেওয়া। এ ছাড়া ন্যায় বিচার পাওয়া সহ আরও অনেক সামাজিক মানবাধিকার আছে। সামাজিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বিদায় হজের ভাষণে আল্লাহর নবী বলেছেন,
- সর্বদা অন্যের আমানত হেফাজত করবে ও পাপকার্য এড়িয়ে চলবে।
- স্মরণ রেখো, বাসভূমি ও বর্ণনির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমান সমপর্যায়ভুক্ত। আজ থেকে বংশগত কৌলীন্যপ্রথা বিলু্প্ত হলো। সে-ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন, যে স্বীয় আমলের দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে।
বংশগত কৌলীন্যপ্রথা বিলু্প্ত করে এবং শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি সর্ম্পকেআল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত হলো সেই ব্যক্তি যে আল্লাহভীতিতে অগ্রে।’ এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের অধিকার নিয়ে রাসূলুল্লাহ + বলেছেন, পাঁচটি বিষয় এক মুসলমানের ওপর আরেক মুসলমানের অধিকার, সালামের উত্তর দেওয়া, অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া, জানাযায় শরিক হওয়া, নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা এবং হাঁচি দিয়ে আল-হামদু লিল্লাহ বললে এর উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা। (সহীহ বুখারী: ১২৪০)
সামাজিক জীবনে রাস্তা আমাদের অন্যতম পাথেয়। তার হকের প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসূলুল্লাহ + বলেছেন, তোমরা পথে বসা থেকে বিরত থেকো। সাহাবিগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কথাবার্তা বলার জন্যে যে আমরা পথে না বসে পারি না। রাসূলুল্লাহ + বললেন, যদি তোমাদের পথে বসতেই হয় তাহলে পথের হক আদায় করো। তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পথের হক কী? তিনি বললেন, ‘দৃষ্টি অবনত রাখা, কাউকে কষ্ট না দেওয়া, সালামের উত্তর দেয়া, সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা। (সহীহ বুখারী: ৬২২৯) আজ যদি কেবল রাস্তার এই পাঁচটি আদায় করা হয় তাহলে আমাদের মা-বোনরা সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। হবে না ন্যক্কারজনক কোনো অঘটন।
রাষ্ট্রীয় জীবনে মানবাধিকার
নাগরিক অধিকার, নিরাপদ জীবন ব্যবস্থা, বৈদেশিক হামলা থেকে নিরাপদ থাকা, গুম, হত্যা, রাহাজানি, হয়রানি, অতিরিক্ত টেক্স আরোপ করা, উপযুক্ত ব্যক্তিরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, অগ্রগণ্য ব্যক্তিকে পশ্চাদে ফেলে রাখা, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া সহ আরও অনেক আছে রাষ্ট্রীয় জীবনে গণমানুষের অধিকারের ইমলাম বলে।
একজন মুসলমানের প্রাণ, সম্পদ, সম্ভ্রম; সবকিছুই সম্মানের পাত্র। অন্যায়ভাবে কারও জান-মাল ও ইজ্জত-সম্মানের ওপর হামলা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। অন্যায়ভাবে কাউকে কোনোরূপ কষ্ট দেয়া যাবে না, চাই সেটা শারীরিক হোক বা মানসিক, ধন-সম্পদের বিষয়ে হোক বা মান-সম্মানের ওপরই হোক। জান-মালের হেফাজত, ইজ্জত-সম্মানের ওপর না হামলা করা-এসব বিষয় পারিবারিক, সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় জীবনে সমানভাবেই প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে কুরআনে করীমের সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যারা মুমিন নারী-পুরুষদের পীড়া দেয়, এমন কোনো অপরাধের বিষয়ে যা তারা করেনি, তারা তাহলে অপবাদ ও সুস্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে নিল।’ (সূরা আহযাব: ৫৮)
রাষ্ট্রীয় জীবনে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বিদায় হজের ভাষণে আল্লাহর নবী বলেছেন,
- আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব জাতির ‘রক্তের বদলে রক্ত’ নীতি এখন থেকে নিষিদ্ধ হলো।
- আইয়ামে জাহেলিয়াতের কুসিদপ্রথা বা সুদ নেওয়া রহিত হলো।
- সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না। এ বাড়াবাড়ির ফলে অতীতে বহু জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
- হুঁশিয়ার! নেতৃত্বের আদেশ কখনো লঙ্ঘন কোরো না। যদি কোনো ক্রীতদাসকেও তোমাদের আমির করে দেওয়া হয় এবং সে যদি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের চালনা করে, তবে অবনত মস্তকে তার আদেশ মেনে চলবে।
মানবাধিকার সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত:
- নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল। (সুরা মায়েদা: ৩২)
- তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না। (সুরা বাকারা: ১২৮)
- তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে করবে। (সুরা নিসা: ৫৮)
- নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে, যেমনি আছে তাদের পুরুষদের। (সুরা বাকারা: ২২৮)
মানবাধিকারের সীমা কতটুকু?
হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী p বলেছেন, ‘ইসলামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইসলাম মানবাধিকারের সীমাকে এত প্রশস্ত করেছে যে, পুরো জীবন এর মাঝে এসে পড়ে।’
জনাব আইকে রুহি বলেন, পশ্চিমাদের সমালোচনা করে বলেন, তারা মানবাধিকারকে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন। এর বিপরীতে ইসলাম শুধু মানবাধিকারের রূপরেখাই পেশ করেনি, আল্লাহ তাআলার হুকুম এবং রাসূলুল্লাহ ঊ-এর তরীকা হিসাবে ঘোষণা দিয়ে তা মানার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে এবং সেসকল অধিকার পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করেছে। (দৈনিক জঙ্গ ১৫ ডিসেম্বর ১৯৮০) (ইসলাম ও মানবাধিকার, হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী, ভাষান্তর: শাহাদাত ছাকিব, মাসিক আল–কাউসার, সংখ্যা: ৫)
ইসলামের মূল লক্ষ্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা: মানবতার সুরক্ষা বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল লক্ষ্য ও মুখ্য উদ্দেশ্য। অজ্ঞানতা, পাপাচার, যুদ্ধবিগ্রহ, সহিংসতা, শিশুহত্যা ও কন্যাশিশুকে জীবন্ত মাটিচাপা দেওয়ার মতো অমানবিক প্রথার প্রচলন ছিল। এসব সহ ইসলম মানবতাবিরোধীসমস্ত কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইসলাম মানুষকে অধিকার আদায়ের চেয়ে অধিকার প্রদানের বিষয়ে বেশি উৎসাহিত করেছে। অথচ আজ আমরা নিজের অধিকারে আদায়ে ব্যস্ত, আর অধিকার প্রদানের বিষয়ে বেশ গাফেল বা উদাসিন। হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী বলেন, অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে শতভাগ সরব কিন্তু অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নীরব, সমাজের এ দৃশ্য ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দায়িত্ব ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ইসলাম শুধুই আইন ব্যবহার করে না; বরং মানুষের হৃদয়ে এমন বোধ ও চেতনা জাগ্রত করে, যা ব্যক্তির মাঝে দায়িত্ব পালনের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি সৃষ্টি করে। (ইসলাম ও মানবাধিকার, হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী, ভাষান্তর: শাহাদাত ছাকিব, মাসিক আল–কাউসার, সংখ্যা: ৫)
শায়খ উসমান গনী সুন্দর বলেছেন, ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম। ইসলাম প্রতিষ্ঠা মানে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও অর্জন এবং ইসলাম সুরক্ষা মানে হলো মানবাধিকারের সুরক্ষা ও বাস্তবায়ন। নারী ও শিশু, বিশেষত কন্যাশিশু এবং অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মানবাধিকার সুরক্ষা করা সচেতন ও সামর্থ্যবান সব নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। জাতি, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন তার নাম ইসলাম।
শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ +
অজ্ঞানতা, পাপাচার, যুদ্ধবিগ্রহ, সহিংসতা, শিশুহত্যা ও কন্যাশিশুকে জীবন্ত মাটিচাপা সহ মানবাধিকার বিরোধী সকল কর্মকাণ্ড মুহাম্মদ + নিষেধ করেছেন এবং তিনি ছিলেন সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব যিনি অতি শৈশবে বিস্ময়করভাবে সমবণ্টন নীতিতে তার দুধ মা হালিমার ঘরে দুধ মাতার একটি মাত্র স্তন পান করতেন আর একটি রেখে দিতেন হালিমার নিজের সন্তানের জন্যে। (অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম, শাস্তির দুত হযরত + সীরাত স্মরণিকা, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৪১৫, পৃ. ৩৮)
অধীনস্থদের অধিকার
অন্যদিকে শ্রমিক, অধীনস্থ কর্মচারী ও চাকর-চাকরানীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা, তাদেরকে নিজেদের অনুরূপ, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, বিশ্রাম ইত্যাদির ব্যবস্থা করতেও তিনি বার বার তাগিদ দিয়েছেন। বস্তুত বিশ্বনবী + শ্রমিকদের সব প্রকার বঞ্চনা, অত্যাচার, নিপীড়ন আর গ্লানির অবসান করে এমন সব শ্রমনীতির প্রবর্তন করে গেছেন যার সিকি শতাংশও জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রসংস্থা (আইএলও) বিগত ১১৮ বছর ধরে মে দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। (হোসেন, মুহাম্মদ ফরহাদ, মে দিবস, শ্রমিক শ্রেণি এবং ইসলাম, দৈনিক যুগান্তর, ৩০ এপ্রিল, ২০০৪, পৃ. ১২)
আমাদের নবীজী +-এর শিক্ষা ও দীক্ষাপ্রাপ্ত সাহাবায়ে কেরাম G মানুষের অধিকার আদায়ে ছিলেন শতভাগ সচেতন। তাই তাঁদের যুগে সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তার যে দৃশ্য পৃথিবী দেখেছে মানবেতিহাস এর নমুনা পেশ করতে অক্ষম।