নিধিরাম সরদার ও ঢাল-তলোয়ারের গল্প
খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সংখ্যা)
‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার।’ এটি বাংলা ভাষায় ব্যবহারবহুল একটি প্রবাদ। এর প্রচলনের পেছনে একটা ঘটনা আছে বলে জানা যায়। সেই ঘটনা বা গল্পের কথা না-হয় বলা যাবে; তার আগে প্রবাদটির অন্তর্নিহিত বক্তব্যটি খোলাসা হোক। যদি কোনো মানুষ অকারণেই নিজের ক্ষমতার চেয়ে নিজের যোগ্যতা বেশি বলে মনে করে তবে তাকে উদ্দেশ করে এটি বলা হয়।
প্রবাদের ‘শানে নুযুলটা’ এরকম: কথিত আছে, নিধিরাম বা অরিন্দম নামের একজন লোক কোনো এক গ্রামে বাস করতো। সে নিজের সাহস এবং শক্তির কথা জাহির করতে খুবই ভালোবাসতো। গ্রামের লোকও ভাবতো এতোই যখন বলে হয়তো-বা সে আসলেই অনেক বলশালী ও সাহসী। তার কথা বিশ্বাস করে সবাই বরং এই ভরসায় থাকতো যে কখনও যদি গ্রামে ডাকাত-টাকাত পরে তাহলে আর চিন্তা নেই, নিধিরাম তো আছেই।
একদিন গ্রামে সত্যিই ডাকাত পড়লো। ডাকাত পড়লে যা হয় আর কি, একদম গ্রামসুদ্ধ লুটে নিয়ে গেলো। গ্রামের লোকেরাও নিধিরামের ভরসায় কিছুটা বেখেয়ালই ছিলো তাই তারা কোনো রকমেই তাদের কিছু বাঁচাতে পারলো না। এতো বড় ঘটনা যখন ঘটছিলো তখন কিন্তু নিধিরামের ছায়াও কেউ দেখতে পায়নি। মোটকথা নিধিরাম ডাকাতদের সঙ্গে যুদ্ধ করা তো দূরে থাক ডাকাতদের সামনেও পড়েনি।
ডাকাতির এই ঘটনায় গ্রামের মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিলো এই যে নিধিরাম এত বড় বড় কথা বলতো আজ সে কোথায়? নিধিরামকে তারা প্রশ্ন করল, তোমার মতো একজন সরদার থাকতে এ ঘটনা ঘটলোকীভাবে? নিধিরাম তার কাজের জন্য লজ্জিত হবে কী ! উল্টো সবাইকে রাগ দেখিয়ে বলতে লাগলো, আমার কাছে কি কোনো ঢাল-তরোয়াল আছে নাকি যে আমি ডাকাত বধ করবো? যদি ঢাল-তরোয়াল থাকতো তবে দেখিয়ে দিতাম না এক হাত?
নিধিরামের এহেন মন্তব্য শুনে গ্রামবাসীরা পরিষ্কার বুঝে যায় ব্যাটা নিধিরামের মুখে বড় বড় কথা বলা ছাড়া আর কিছু করার যোগ্যতা নাই। তার মোটেই ডাকাত তাড়ানোর ক্ষমতা নাই ইচ্ছা তো নাইই, তাই এইসব আজগুবি অজুহাত দেখাচ্ছে।
সেদিন থেকে লোকে নিধিরামকে নিয়ে এক প্রবাদে বেঁধে ফেলল, ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সরদার। ঢাল তলোয়ার ছাড়া সে এমনিতেই কিছু পারবে না শুধু মুখে মুখে আলাপ করা ছাড়া। তাই আমরা যখন আমাদের ক্ষমতার থেকে বেশি কিছু বলে ফেলি বা করতে চাই তখন অন্যেরা আমাদের নিজ ক্ষমতা বা সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করার জন্য এই প্রবাদটি বলে থাকে।
সরলীকরণ ও পরিমিতিবোধ
সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু তরুণ আলেম, মাদরাসাপড়ুয়া ‘তালেবে ইলমদের’ একটি অংশ ও সাধারণ তরুণদের কারও কারও মাঝে এক বিশেষ ধরনের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ও যথাযথ সমীহবোধ রেখেই আজকের লেখার শুরু তে আমাদের কিছু বিনীত জিজ্ঞাসা তুলে ধরতে চাই। পাঠকদের সকলকে আগাম নিশ্চিত করছি, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু বানানো বা বিতর্ক উসকে দেওয়ার সামান্যতম উদ্দেশ্যও আমার নেই। তারা কারা, কী তাদের প্রবণতা আমার প্রশ্নগুলো থেকেই তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। তাদের কাছ থেকে আমার জানার বিষয়গুলো এরূপ:
- পবিত্র কুরআন মজীদ ও রাসুলের হাদীসে কাফির মুশরিক ও তাগুতি শক্তির মোকাবেলায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য কোনোরূপ প্রস্তুতির স্পষ্ট নির্দেশনা আছে কিনা? থাকলে সেই প্রস্তুতির ধরন ও প্রকৃতি কী?
- শত্রুর মোকাবেলার জন্য কি কেবল ঈমানের দৃঢ়তা, সঠিক চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিক প্রস্তুতিই যথেষ্ট?
- গোটা বিশ্বে, যে কোনো সময়ে ও যেকোনো পরিস্থিতিতে কিতাল ফি সাবিলিল্লাহর হুকুম কী একই রকম?
- সশস্ত্র জিহাদ কার বিরুদ্ধে হবে, কার সিদ্ধান্তে ও কার নেতৃত্বে হবে- এ বিষয়গুলোর সুরাহা করার সঠিক পন্থা কী? এ জায়গাটাতে কেউ যেন ভুল ধারণায় উপনীত না হন যে, সউদী আরবের এমবিএস ও মধ্যপ্রাচ্যের মদদপুষ্ট রাজতান্ত্রিক ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বৃত্তিভোগী একটি মহল ঢালাওভাবে অত্যাচারী ও ইসলামবিদ্বেষী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে যে কোনো তৎপরতাকে হারাম ও অবৈধ বলে থাকে-এ লেখায় উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তাদেরকে সমর্থন করা হচ্ছে- বিষয়টি আদৌ এমন নয়। আমাদের জানতে চাওয়ার পয়েন্ট হলো ইসলামি শরীয়ার উসুল বা মূলনীতি এ ব্যাপারে কী বলে?
- বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, কওমি মাদরাসার মুফতি-মুহাদ্দিস-মুফাসসির-মুহতামিম অন্যভাবে বললে, বর্তমান প্রজন্মের তালিবে ইলমদের উস্তাদ, তাদের শিক্ষক ও শাইখদের উস্তাদ সকলেই রাতারাতি তাগুত, মোদী ও শেখ হাসিনার দালাল কীভাবে হয়ে গেলেন?
- বিগত একশ’ বছরের ইতিহাসে কওমি মাদরাসায় বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি ঘটনা বাদে শিক্ষক ও দায়িত্বশীলদের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে ক্যাম্পাস থেকে ‘দলে বলে’ বেরিয়ে পড়া। বাধা দিলে তাঁদের সঙ্গে চরম অশ্রদ্ধাপূর্ণ ও অশোভন আচরণ এবং মাদরাসার মসজিদের মাইক থেকে নিজেদের ইচ্ছে মতো সরাসরি জিহাদের আহ্বান (মুখোমুখি সর্বাত্মক সশস্ত্র লড়াই অর্থে) কি খারাপ নজির নয়। এর পরিণতিতে কওমি মাদরাসার গৌরবমণ্ডিত সোনালি ঐতিহ্যের পাশাপাশিএর নিরাপত্তাও কি বড়সড় হুমকির মুখে পড়ে যায় নি?
লেখাটি এতদূর পড়ার পর পাঠকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে। একটি অংশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় লেখাটি শেষ পর্যন্ত না পড়েই উঠে পড়বেন। আরেক অংশ পুরো লেখাটি ধৈর্যসহ পড়লেও মনে মনে ধরে নেবেন, লেখক ঘুরেফিরে ‘জিহাদবিমুখ গণতন্ত্রপন্থীদের পক্ষে ওকালতি করছেন; এমনকি সরকারের দালালির পথ ধরেছেন। কাজেই তাকে চেনা হয়ে গেলো।’ আমি বলি, যে কারও ব্যাপারেই এমন ধারণাবস্তুত, অতি সরলীকরণ যা আপনার পরিমিতবোধের ঘাটতিকেই নির্দেশ করবে। তবে একজন পাঠক হিসেবে যে- কারও দ্বিমত, প্রশ্ন, ক্রিকিট ও শালীন সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে একটি বিষয়ের ওপর একাধিক বিশ্লেষণ ও বিতর্ক হতে পারে। জ্ঞান ও যুক্তিসিদ্ধ বিতর্কে ব্যক্তিগত আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ থাকতে পারে না।
তৃতীয় অংশের কথায় আসি। যারা লেখাটিকে মোটামুটি যুক্তিগ্রাহ্য, জিজ্ঞাসাগুলোকে বাস্তবানুগ এবং আমার ভাবনায় অল্পবিস্তর সারবত্তা আছে বলে মনে করছেন তাদেরকেও দুভাগে আলাদা করা যায়। একটি অংশ কথিত উগ্রপন্থীদের ওপর আগে থেকে ক্ষুব্ধ থাকায় তারা মনে মনে হাততালি দেবেন আর আরেকটি অংশ প্রকৃতপক্ষেই সামগ্রিক বিষয়ে গভীর চিন্তা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণেরসক্ষমতা রাখেন। তারা দীন, উম্মাহ, দেশ ও কওমি মাদরাসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দূরদৃষ্টির আলোয় লেখাটির বিচার করবেন। তবে এই লেখায় ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত সংযোজনের যেভাবে অবকাশ নেই তেমনি বিরাজিত পারিপার্শ্বিকতার আবহে সব কথা একসঙ্গে সোজাসাপ্টা বলার সুযোগ অনেকটাই সংকুচিত।
জুলুম, নিপীড়ন, শোষণ, অত্যাচার, স্বাধীনতা ও অধিকারহরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, আন্দোলন-সংগ্রামের ন্যায্যতা ও প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। ইসলামের ওপর আঘাত ও ঝড়-ঝাপটা এলে মুসলমানদের বালিতে মুখগুঁজে বসা থাকার কথার নসিহতও করছি না। তোষামোদী, তেলবাজি ও পদলেহনের পক্ষে কখনও একটি শব্দও লিখি; লিখবোও না। কাজেই আত্মসমর্পণ নয়; কখনও দুই কদম সামনে যাবার স্বার্থে এককদম পিছিয়ে আসতে হয়। সেটুকুই বলতে চাইছি।
পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রশ্নের জবাব এককথায় দেওয়ার মতো। লেখা থেকে প্রচ্ছন্নভাবে যদিও প্রতিভাত হচ্ছে তবুও আমি পষ্ট করে বলতে চাই, এই লেখকের মতে এ দুটি প্রশ্নের জবাব নেতিবাচক। পান থেকে চুন খসলেই আলেমসমাজকে চট করে তাগুত বা অমুক-তমুকের দালাল অভিধিত করা কেবল অগ্রহণযোগ্যই নয় বরং রীতিমতো ধৃষ্টতা। আর নিদেনপক্ষে বাংলাদেশের পঞ্চাংশ বছরের ইতিহাসেও কওমি মাদরাসায় উস্তাদদের প্রতি শিক্ষার্থীদের অসামান্য শ্রদ্ধা ও মান্যতার ইতিহাস ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই হতে দেওয়া যায় না। তা না হলে এই ধারাবাহিকতার আগামীদিনেও থামানো যাবে না। ফলে একসময় কওমি মাদরাসায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতিবাচক ও লজ্জানজক প্রবণতাই কেবল সংক্রমিত হবে না বরং আজকের তালেবে ইলম ও তরুণ প্রজন্ম আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে নিজেদের অপ্রীতিকর ও অপ্রত্যাশিত পাওনা বুঝে নিতে বাধ্য হবেন। এটা আল্লাহর সাধারণ ও চিরায়ত রীতি। কুরআন মজীদের সুরা আলে ইমরানের ১৪০ আয়াতে সে কথা ধ্বনিত হয়েছে এভাবে: আর এইসব দিন আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন করি।
এক, দুই ও তিন প্রশ্নের জবাব সংশ্লিষ্ট ভাইদের কাছ থেকে আজ হোক, কাল হোক আসবে সেই অপেক্ষায় আজকের ক্ষুদ্র লেখাটির যতি টেনে দিলাম। যদি কুরআন সুন্নাহর আলোকে প্রশ্নগুলোর জবাবে তবে আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞত থাকবো এবং আমাদের বিশ্বাস, এতে জাতি উপকৃত হবে ইনশাআল্লাহ। আর যদি কোনো জায়গা থেকেই সন্তোষজনক জবাব না মেলে তবে বিনয়ের সঙ্গে বলে বলবো, সুরা আনফালের ৬০ আয়াতের (ওয়া আয়িদ্দু লাহুম মাসতাতাতুম মিন কুওয়াহ) নির্দেশনা মেনে চলুন; তার আগে ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার সাজতে যাবেন না এবং আল্লাহর ওয়াস্তে মুসলমানদের জন্য পূর্বসূরিদের জ্বালানো প্রদীপগুলো ধপ করে নিভিয়ে দেবেন না। আল্লাহ সকলকে সিরাতুল মুস্তাকিম বোঝার ও অনুসরণের তাওফিক দান করুন।
পুনশ্চ, ইসলামের সোনালি যুগে মুজিযার ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদে জাগতিক প্রস্তুতি ছাড়া সেই প্রস্তুতি শত্রুপক্ষের তুলনায় অর্ধেক, এক দশমাংশ কিংবা আরও কম কখনও যুদ্ধে যাওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে অবৈধ রাষ্ট্র হানাদার ইসরাঈলের শক্তির ব্যাপক তারতম্য থাকলেও সেখানকার স্বাধীনতাকামী মানুষ ট্যাংকের মোকাবেলায় যে স্রেফ পাথরের ওপর নির্ভর করে হাত গুঁটিয়ে থাকেনি, বিভিন্ন সময় গোটা দুনিয়া সেটা দেখেছে এখনও দেখছে। প্রস্তুতি ছাড়া লড়াইয়ের হুংকার ও অসমযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ফতোয়া হঠকারিতা ছাড়া আর কী?