সালাত-নামাজ
সমস্যা: আমরা জানি, আমাদের হানাফী মাযহাবে তারাবীহের নামাজ ২০ রাকআত সুন্নাতে মুআক্কাদা। প্রথমত আমার জানার বিষয় হল, তারাবীহের নামাজ কত রাকআত? তার স্বপক্ষে সহিহ কোনো হাদীস আছে কি? দ্বিতীয়ত, রসূল ঊ কি রমজানের প্রতিদিন তারাবীহ আদায় করতেন? না হয় তা সুন্নতে মুআক্কাদা কীভাবে প্রমাণিত হয়? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
আবদুল কুদ্দুস
সোনাগাজী, ফেনী
শরয়ী সমাধান: রসূল ঊ তারাবীহের নামাজ কত রাকআত আদায় করতেন এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়নি। তবে মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বায় একটি বর্ণনা আছে যে, রসূল + তারাবীহের নামাজ ২০ রাকআত পড়েছেন কিন্তু মুহাদ্দিসগণ উক্ত বর্ণনাকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম G ও পরবর্তী ইমামগণের বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। সহীহ হাদীসে আছে হযরত ওমর D-এর আদেশে হযরত উবাই ইবনে কা’ব D মসজিদে নববীতে ২০ রাকআত আদায় করেছেন। হযরত ওমর, হযরত আলী ইবনে আব্বাস G-এর মতো সাহাবীগণ বলেছেন, তারাবীহের নামাজ ২০ রাকআত। ইমাম তিরমিযী p বলেন, এটি (তারাবীহের নামাজ ২০ রাকআত) অধিকাংশ আলেমদের অভিমত। ইবনে আবদুল বার p বলেছেন, এটি (তারাবীহের নামাজ ২০ রাকআত) সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মত; বিশেষ করে কুফানগরির ইমামগণ, ইমাম শাফিয়ী p ও অধিকাংশ ফুকাহায়ে কেরামর মত। তিরমিযী শরীফের টীকায় উল্লেখ আছে ইমাম আবু হানিফা p বলেছেন, ওমর D ২০ রাকআত তারাবীহের যে আদেশ দিযয়েছেন, তিনি এর আবিষ্কারক নন। বরং হতে পারে, তিনি এ ব্যাপারে রসূল +-এর কাছ থেকে কোন হাদীস শুনেছেন বা রসূল +-এর কর্ম দেখেছেন। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমগণ বলেছেন, তারাবীহের নামায ২০ রাকআত।
দ্বিতীয় বিষয় হল রসূল + তারাবীহের নামায কোন কোন সময় ছেড়ে দিয়েছেন এবং কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, আমি যদি প্রতিদিন তারাবীহের নামায পড়তে থাকি সম্ভবত আল্লাহপাক তোমাদের ওপর তারাবীহ করে দেবেন। এ কারণে আমি তারাবীহের নামাজ মাঝে মাঝে ছেড়ে দিই। রসূল + বিভিন্ন হাদীসে তারাবীহের ওপর উৎসাহ দিয়েছেন এবং সাহাবাগণ উজরবিহীন তারাবীহ ছাড়েননি। একারণে ফুকাহায়ে কেরাম তারাবীহের নামায সুন্নাতে মুআক্কাদা হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিরমিযী ১/১৬৬, ফতহুল বারি: ৪/২৫২, ফয়যুল বারি: ৪/১২৭ ও রদ্দুল মুহতার: ২/৪৬
সমস্যা: সফর অবস্থায় বিমানে নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেলে নামায আদায় করার পদ্ধতি কী হবে? বিশেষ করে এক্ষেত্রে কেবলা নির্ণয়করণ-পদ্ধতি জানিয়ে বাধিত করবেন।
কুতুবউদ্দিন
টেকনাফ, কক্সবাজার
শরয়ী সমাধান: সফর অবস্থায় বিমানে নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেলে নামায আদায় করে নিতে হবে। কিবলামুখীতা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ বিমানের মোড় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুসল্লিকেও কিবলার দিকে ঘুরে যেতে হবে এবং নামায আপন গতিতে চলতে থাকবে। কিবলা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিমানকর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জেনে নিবে অথবা বিমানের স্ক্রিনে দেওয়া মানচিত্র দেখে কিবলা নির্ধারণ করতে হবে। আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৯৫, বাদায়েউস সানায়ে: ১/২৯১, হিদায়া ১/১৬২, কুদুরী: ৬৯ ও রদ্দুল মুহতার: ১/১০১
সমস্যা: ১. কোনো ব্যক্তি তাহাজ্জুদের সময় শেষ হয়ে গেছে মনে করে ফজরের সুন্নাতের নিয়তে নমায আদায় করে নেয়। অথচ তখন ও ফজরের সময় হয়নি।
এখন এই নফল নামায পড়লে তার সুন্নাত আদায় হবে নাকি ওয়াক্ত হওয়ার পরে আবার ফজরের সুন্নাত পড়তে হবে?
তাহাজ্জুদের সময় পড়া সেই দুই রাকআত নামায নফল হবে নাকি অন্য কিছু?
তাহাজ্জুদের সময় সুন্নতের নিয়ত করে ছেড়ে দিয়ে আবার নফলের নিয়ত করলে। এক্ষেত্রে করনীয় কী?
২. যোহরের ওয়াক্ত মুসাফির ইমাম কসর হিসেবে নামায দুই রাকআত পড়লেন। মুক্তাদী দ্বিতীয় রাকআতে শুধু তাশাহুদ পড়ে ইমাম সাহেবের সালাম ফেরানোর পর তাকবীর বলে উঠে দাড়াঁল। তারপর সানা পড়ে শুধু সূরা ফাতেহা পড়ল। পরের রাকআতেও ফাতেহা পড়ল। চার রাকআতের শেষে তাশাহুদ, দুরুদ, দোয়া মাসূরা পড়ে নামায শেষ করল।
এখন প্রশ্ন হলো নামায সঠিক হল কি না? না হলে করনীয় কী?
নবাব সিরাজ উদদৌলা
হেলেনাবাদ, রাজশাহী
শরয়ী সমাধান: ক. আদায় হবে না। বরং সুবহে সাদেক হওয়ার পর ফজরের সুন্নাত পুনরায় আদায় করতে হবে। নফলই হবে। সুন্নাত এবং নফল প্রায় এক। তাই সুন্নাতের নিয়ত করে নামায ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। তবে আদায়কৃত নামায শুদ্ব হয়ে গেছে, আর কিছু করতে হবে না।
২. মুসাফির ইমামের পেঁছনে যে ব্যক্তি এক্তেদা করেছে সে ইমামের নামাযের পর তার ছুটে যাওয়া রাকআতগুলো আদায় করার সময় লাহেক হিসেবে মুক্তাদির মতো হবে। তাই তার জন্য সুরা ফাতেহা বা অন্য কোনো কেরাত পড়ার প্রয়োজন নেই।
সুতরাং ছুটে যাওয়া যে নামাযগুলো সূরা ফাতেহা ইত্যাদির সাথে পড়েছে, তা প্রয়োজন ছিল না। বাকি নামায শুদ্ধ হয়ে গেছে। ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া: ২/৩০৬, ফতওয়ায়ে আলমগীরী: ১/৯২ ও ১/১৪২, তাবয়ীনুল হকায়েক: ১/৫১৬
সমস্যা: সবিনয় নিবেদন এই যে, আমাদের মহল্লার ইমাম সাহেব যার পিছনে আমরা সবাই নামাজ পড়ে থাকি, তার কেরাতে কিছু ভুল হয়। যা লাহনে জলী (স্পষ্ট ভুল)-এর পর্যায়ে পড়ে। যেমন ذ-এর স্থানে ز পড়েন। ص-এর স্থানে س পড়ে থাকে। এমন আরো কিছু ভুল হয়, যা আমি নিজে বুঝতে পারলেও মহল্লার আমজনসাধারণ বুঝতে পারে না। মুহতারম, এখন আমার জানার বিষয় হলো উক্ত ইমামের পিছনে আমার এবং মহল্লাবাসীর নামাজ পড়া সহীহ হবে কি না?
মুহা. মাসুম বিল্লাহ
কচুয়া, চাঁদপুর
শরয়ী সমাধান: প্রশ্নের বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম সাহেবের কেরাতের মধ্যে যে লাহনে জলীর কথা বলা হয়েছে, তার দ্বারা অনেক সময় কুরআন মজীদের অর্থ বিকৃত হয়ে নামাজ ফাসেদ হয়ে যায়। সে জন্য মুতাওয়াল্লী বা মসজিদ কমিটির দ্বীনী দায়িত্ব হলো উক্ত ইমামকে ইমামতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে যথাশীঘ্র অব্যাহতি দিয়ে তদস্থলে একজন সহিহ-শুদ্ধ কুরআন পাঠকারী দীনদার আলেমকে ইমাম নিযুক্ত করা। অন্যথায় তাদেরকে মুসল্লিদের নামাজ নষ্ট করার কারণে আল্লাহ তাআলার নিকট কঠোর জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে এবং শাস্তি ভোগ করতে হবে। ফতওয়ায়ে আলমগীরী: ১/৬৮ ও রদ্দুল মুহতার: ১/৬৩৩
সমস্যা: বর্তমানে গাইরে মুকাল্লিদগণ তারাবীহের নামায আট রাকআত বলে দাবি করে। আমাদের বিশ রাকআত পড়াকে সহীহ নয় বলে আখ্যায়িত করে বেড়ায়। এক্ষেত্রে আমার প্রথম জানার বিষয় হলো, তারাবীহ আট রাকআতের প্রবক্তা কোনো সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী, মুজতাহিদ, ইমাম, বা মুহাদ্দিস আছে কি? থাকলে তিনি কে বা তারা কারা? দ্বিতীয়ত, আমরা যে বিশ রাকআত আদায় করি তার ভিত্তি কী? দলিলের আলোকে জানিয়ে বাধিত করবেন।
আবুল কালাম
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম
শরয়ী সমাধান: আমাদের জানামতে সাহাবাদের যুগে বিশ রাকআত তারাবীহের ওপর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বারো শতাব্দী অবধি কোনো সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী, মুজতাহিদ, ইমাম ও মুহাদ্দিস আট রাকআত তারাবীহের প্রবক্তা ছিলেন না। গত দুই শতাব্দী থেকে শায়খ আলবানী জসহ তথাকাথিত আহলে হাদীসদের মাধ্যমে আট রাকআত তারাবীহ মতবাদের উদ্ভব হয়। অথচ, তারাবীহ বিশ রাকআত হওয়ার ওপর হযরত ওমর গ-এর যুগে সাহাবাদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুআত্তা মালেক: ৪০ মুসান্নেফে ইবনে আবি শায়বা ২/২৮৬
নিকাহ-তালাক
সমস্যা: জনাব বর্তমান ফিতনার যুগে পরকীয়া প্রেমের কারণে একজনের স্ত্রী (প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদ ব্যতীত) অন্য জনের সাথে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং ঘর-সংসারও করতে থাকে। আমার জানার বিষয় হল এই ধরনের অবৈধ বিয়ের পর যে সমস্ত সন্তান জন্মগ্রহণ করে এদের হুকুম কী? বিশেষ করে মিরাছর ক্ষেত্রে ওয়ারিশ হবে কি? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
আবুল ফজল
রামগতি, লক্ষীপুর
শরয়ী সমাধান: এই ধরনের অবৈধ বিয়ের পর যে সমস্ত সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তারা প্রথম স্বামীর সন্তান হিসেবে গণ্য হবে। কেননা প্রথম স্বামীর কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্তা না হওয়ায় শরীয়তের দৃষ্টিতে এখনো সে প্রথম স্বামীর স্ত্রী হিসেবে বহাল আছে। তাই সন্তান নসব বা বংশপরিচয় তার প্রথম স্বামী থেকে সাবস্ত্য হবে এবং মিরাছ বা তর্কাপাপ্তির ক্ষেত্রেও প্রথম স্বামীর সন্তান হিসাবে গণ্য হবে। তবে প্রথম স্বামী যদি অস্বীকার করে যে, এটা আমার সন্তান নয় এবং সাথে সাথে ‘লিআন’ অর্থাৎ সাক্ষ্য সহকারে শপথ করে তখন তার নসব বা বংশপরিচয় প্রথম স্বামী থেকে ধরা হবে না বরং তার নসবের নিসবত বা বংশপরিচয়ের যোগসূত্র তার মায়ের দিকে হবে এবং সে শুধুমাত্র তার মায়ের ওয়ারিশ হিসেবে তার মায়ের অংশ থেকে মিরাছ বা তর্কা পাবে। কোনো অবস্থায় দ্বীতিয় স্বামীর সাথে নসব প্রমাণিত হবে না এবং তার ওয়ারিসও হবে না। মুসলিম শরীফ: ১/৪৭০, আল-ফিকহুল ইসলামী: ৭/১১২, ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া ৫/২৬০ ও ইযাহুল মিশকাত: ৩/১৭৫
সমস্যা: একটি মেয়ের সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে। কথা প্রায় চূড়ান্ত। এমতাবস্থায় আমার বড় বোন বলে যে, ‘ছোটবেলায় মেয়েটি আমার (আমার বোনের) দুধ পান করেছে। কিন্তু তার স্বপক্ষে কোনো দলিল নেই। এমনকি আমাদের উভয় পক্ষের কেউ এ বিষয়ে অবগতও নয়। এখন ওই মেয়েটাকে বিয়ে করা আমার জন্য বৈধ হবে কি?
জসিম উদ্দীন
সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ
শরয়ী সমাধান: দুধ সম্পর্কীয় বন্ধন সাব্যস্ত হওয়ার জন্য কমপক্ষে দুইজন স্বাক্ষীর প্রয়োজন। তম্মধ্যে উভয়জন পুরুষ বা একজন পুরুষ দুইজন নারী হতে হবে। একক নারীর স্বাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আপনাদের পরস্পরের বিয়ের মধ্যে কোনো সমস্যা হবে না। কেননা, আপনার বোনের দাবির পক্ষে কোনো স্বাক্ষী নেই। এমনকি আপনারা উভয় পক্ষের কেউই এ বিষয়ে অবগতও নন। তাই ওই মেয়েকে বিয়ে করা আপনার জন্য বৈধ হবে। ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/৩৪৮ ও বায়হাকী ১১/৪৬৯
সমস্যা: একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও একজন প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলা তাদের উভয়ের মধ্যে গোপনে সম্পর্ক হয়। এক পর্যায়ে তারা উভয়ে তাদের বন্ধুদের উপস্থিতে মোহরে ফাতেমির ওপর বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয় বলে দাবি করে। পরে উভয়ের পরিবারের মধ্যে জানাজানি হলে কনেপক্ষ তাদের মেয়ের কাছ থেকে স্টাম্পের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি নিলে, মেয়ে কাউকে বিয়ে করেনি মর্মে স্বীকারোক্তি প্রদান করে এবং তার কাছে যাবে না বলে স্টাম্পে স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে মেয়ে দাবি করে যে, আমি যে বিয়ে করেনি বলে স্বীকারোক্ত দিয়েছি তা পরিবারের চাপের মুখে পড়ে দিয়েছিলাম।
উল্লেখ্য, বিয়ের সময় ছেলে জমাতে হাস্তুমে অধ্যায়ণরত ছিল এবং তার সমস্ত ভরণ-পোষণের দয়িত্ব তার পিতামাতা বহণ করত। বিয়ের সময় লেখাপড়া ব্যতীত অন্যকোনো চাকরি বা ব্যবসার সাথে জড়িতও ছিলো না। কিন্তু মেয়ে এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত পবিারের সদস্য। এখন আমার জানার বিষয় হল।
তারা যে বিয়ে করেছে বলে দাবি করছে তাদের দাবিমতে বিয়ে সহীহ হয়েছে কি? পরবর্তীতে মেয়ের অস্বীকৃতি এবং তাকে চাইবে না বলে যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে তার দ্বারা বিয়ে বিচ্ছেদ হবে কিনা?
মাওলানা মাহমুদুল হাসান
মাতার বাড়ি, মহেশখলী
শরয়ী সমাধান: লিখিত বর্ননা অনুযায়ী বিয়ের সময় স্বামীর কাছে স্ত্রীর মোহর ও ভরণ-পোষণ দেওয়ার আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তাদের বিয়ে সহীহ হয়নি। তাই তাদের স্বামী-স্ত্রী সুলভ সকল আচরণ না জায়েয ও হারাম। তাই মেয়েকে অন্যত্রে বিয়ে দিতে পারবেন। রদ্দুল মুহতার: ৪/২০৬, হিন্দিয়া: ২/২৯১ ও আহসানুল ফাতাওয়া: ৫/৯৬
নজর-মান্নত
সমস্যা: আমি মান্নত করেছি যে, বার্ষিক পরীক্ষায় এক নম্বর হলে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করবো। আমার উক্ত মান্নত সহিহ হয়েছে কি? এবং পূর্ণ করা ওয়াজিব হবে কি? জানিয়ে বাধিত করবেন।
আয়েশা আক্তার
কুতুবদিয়া, কক্সবাজার
শরয়ী সমাধান: নজরের ক্ষেত্রে শরীয়তের মূল নীতি হলো যে, منظور به তথা মান্নতকৃত বিষয়টি ইবাদতে মাকছুদা (স্বয়ং সম্পূর্ণ ইবাদত) হতে হবে। সেই সাথে ইবাদত টি ফরজ বা ওয়াজিব ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। অতএব, আপনার মান্নতটি সহিহ হয়নি। কেননা, কুরআন তেলাওয়াত যদিও ইবাদতে মাকছুদা কিন্তু ওয়াজিব বা ফরজ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত নয়। উল্লেখ্য যে, মান্নতকে কোনো জায়গা বা সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করলে তা নির্দিষ্ট হয় না। ফতওয়ায়ে শামী ৫/ ৫১৫ ও বাদায়ে সানায়ে ৪/২৫৪
বিবিধ
মুহতারাম, সবিনয় নিবেদন এই যে, পৃথিবী থেকে ইসলামকে চিরতরে বিদায় করার জন্য পৃথিবীর ইসলামবিদ্বেষী সকল সম্প্রদায় সর্বদা নানা প্রকার ষড়যন্ত্র করে আসছে, সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সময়ে নতুন এক ফিতনার আবির্ভাব হয়েছে, যেটিকে তারা নাম দিয়েছে ইন্টারফেইথ (Interfaith) বা وحدة الأديان (বাংলায় আন্তঃধর্ম বলা হয়)। সংস্থাটির উদ্দেশ্য হলো, এই মতবাদ বাস্তবায়ন করা যে, পৃথিবীর সকল ধর্ম মর্যাদার দিক থেকে সমান। এক ধর্মের ওপর অন্য ধর্মের শ্রেষ্ঠ্যত্ব বা বিশেষ কোনো মর্যাদা নেই। এমনকি ইসলাম ধর্মেরও না, বরং ইসলাম ধর্মও অন্য সব ধর্মের মতো একটি ধর্ম মাত্র। তাই সংস্থাটি তাদের এই মতবাদ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সব ধর্মের কিছু কিছু মানুষকে এই মতবাদের দাওয়াত দিয়ে নতুন দল গঠন করছে; বলতে গেলে, নতুন এক ধর্মের রূপ দিচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে আমাদের ইসলাম ধর্মের কিছু কিছু মানুষ তাদের দাওয়াত গ্রহণ করে উক্ত দলে প্রবেশ করছে। এখন আমার জানার বিষয় হলো, কোনো মুসলমান যদি এই ইন্টারফেইথ বা وحدة الأديان-এর উক্ত মতবাদকে বিশ্বাস করে কিংবা ভালো হিসেবে সমর্থন করে, তখন তার ঈমান থাকবে কি? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
এস. এম আবু তাহের
ইসলামি স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শরয়ী সমাধান: প্রশ্নে বর্ণিত কথাগুলো পরিষ্কার শরীয়তের পরিপন্থী। কেননা ইসলামের আবির্ভাবের পর পৃথিবীর সকল ধর্ম রহিত হয়ে গেছে। কিয়ামত পর্যন্ত ইসলাম ধর্মই একমাত্র আল্লাহ তাআলার মনোনীত ধর্ম ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে বহাল থাকবে। তাই ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্য কোনো ধর্মের তুলনা হতে পারে না। অন্য সব ধর্ম মুষ্টিমেয় আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তাই ইন্টারফেইথ (Interfaith) বা وحدة الأديان নামক সংস্থা বা গোষ্ঠির উল্লিখিত কথাগুলো পরিষ্কার কুফরি মতবাদ। অতএব যারা এই মতবাদে বিশ্বাস করবে তারা মুসলমান থাকবে না। তাদের সাথে মুসলমানদের কোনো বিয়ে-শাদি ইত্যাদি জায়েয হবে না। সূরা আলে-ইমরান: ১৯, ৮৫, ১৩৯ সূরা মায়েদা: ৩, সহিহ মুসলিম: ১৭১৮ মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৩৪৫৩৯, সুনানে বায়হাকী: ১২৫১৬ মুসনদে আহমদ: ১৫১৫২, সূরা বাকারা: ২২১, হিদায়া: ২/৩৪৫ ও বাদায়ে সানায়ে: ৩/৪৪০
সমস্যা: আমরা জানি কসমের শব্দ হলো ‘আল্লাহ’, ‘বিল্লাহ’ ও ‘তাল্লাহ’। কিন্তু আমাদের সমাজে এই শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় না বরং আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ শপথ করে থাকে, ‘খোদার কসম’ ‘শপথ করে বলাছি’ ইত্যাদি শব্দ দ্বারা। এখানে আল্লাহর নাম মোটেও উল্লেখ করা হয় না। এরূপ বলার দ্বারা শপথ সংঘটিত হয়ে যাবে কি?
মাহমুদ রাগেব
পেকুয়া, কক্সবাজার
শরয়ী সমাধান: আমাদের দেশে কসমের প্রচলিত শব্দ তথা খোদার কসম, বা আল্লাহর নাম উল্লেখ না করে ‘শপথ করে বলছি’ এই জাতীয় শব্দ দ্বারা শপথকরীর ওপর শপথ পূরণ করা আবশ্যক হয়ে যাবে। কেননা, এ ধরনের শব্দগুলো দ্বরা আমাদের দেশে শপথ করাই বুঝানো হয়। আর কসমের ক্ষেত্রে শরীয়তে ওরফ তথা সমাজের প্রচলন ধর্তব্য। হিদায়া ২/৪৭৬ ও ফতহুল কদির ৪ /৩৫৭
সমস্যা: মুহতারাম, সবিনয় নিবেদন এই যে, আমি পেশাগত একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বিগত ২০১৫ সালে হাফেজ মুহাম্মদ ফারুক নামে আমাদের পাড়ার একজন প্রতিবেশী যিনি ওমানে থাকেন। তিনি আমাকে একদিন হঠাৎ ফোন দিয়ে বলেন যে, তারা চট্টগ্রাম চাঁদগাও আবাসিক এলাকায় একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান করতে যাচ্ছে। এতে ছয়জন শেয়ার হোল্ডার আছেন। কিন্তু বিধি মোতাবেক আরো একজন শেয়ারের প্রয়োজন। সে জন্য আমাকে বারবার ফোন করে বলেন, আমি যেন শেয়ার হোল্ডার হই এবং তারা প্রতিজন ২ লক্ষ টাকা করে দিয়েছেন। আমি একসাথে ২ লক্ষ টাকা দিতে না পারলেও ১ লক্ষ টাকা নগদ দিয়ে বাকিগুলো কিস্তিতে আদায় করতে পারবো। যেহেতু তিনি একজন হাফেজ এবং তার বাবাও একজন হাফেজ ও আলেমে দীন। তাই বিশ্বাস করে ঐ প্রতিষ্ঠানের অফিসে গিয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের হাতে ঐ প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে ১ লক্ষ টাকা প্রদান করি। এসময় তার ছোট ভাই আমার সাথে ছিল। এরপর দুই-তিন মাস পর আরও দশ হাজার টাকা কিস্তি হিসাবে প্রদান করি। কিস্তি প্রদানের একমাস কি দুইমাস পরে হঠাৎ একদিন ওই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল সাহেব আমাকে ফোন করে বলেন, ওনি নাকি মারাত্মক সমস্যায় পড়েছেন। কারণ শিক্ষকগণ তাঁদের মাসিক বেতন দাবি করছেন এবং জমিদার ঘর ভাড়া দাবি করছেন। প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের কাছ থেকে যা টাকা আদায় হয়, তাতে ঘর-ভাড়া ও শিক্ষকদের বেতনও যতেষ্ট হচ্ছে না এবং ওমান প্রবাসী বারবার ফোনের লাইন কেটে দিচ্ছেন। তখন প্রিন্সিপাল সাহেব অনন্যোপায় হয়ে আমাকে এসব বিষয় জানান। তখন প্রিন্সিপাল সাহেবের কথা শুনে রাত্রে ওমান প্রবাসীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমি প্রিন্সিপাল সাহেবকে শাস্তি দিচ্ছি। তখন আমি বললাম, আমাকে কেন এ কাজে ভেড়ালেন? প্রিন্সিপাল সাহেবের পক্ষে তো লেখা-পড়ার আঞ্জাম দিতে গেলে টাকা পয়সা যোগাড় করা সম্ভব নয়। এমতাবস্তায় আমার টাকাগুলোর অবস্থা কী হবে? তখন তিনি বললেন- আমি দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলেও আপনার টাকা কোথাও যেতে পারবে না। অতএব আপনি টাকার কোন টেনশন করবেন না। কিন্তু এখন প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেছে এবং টাকাগুলোও নিংশেষ হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, ওমান প্রবাসীর এই প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে আমার টাকাগুলো আদায় করার জন্য তিনি বাধ্য থাকবেন কি-না? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম
সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম
শরয়ী সমাধান: প্রশ্নে উল্লিখিত ঘটনায় আপনার সাথে ওমান প্রবাসীর যে প্রতিশ্রুতি এবং ওয়াদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার ওপর যদি শরীয়তসম্মত কোন সাক্ষী-প্রমাণ থাকে তখন সে উক্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে বাধ্য থাকবে। আর যদি সে ব্যপারে শরীয়তসম্মত সাক্ষী-প্রমাণ না থাকে, তখন তার এ কথাটি ওয়াদা হিসেবে গণ্য হবে। যা পুরণ করা ঈমানদারি ও তাকওয়া হিসেবে জরুরি। নতুবা আল্লাহ তাআলার কাছে ওয়াদা পূরণ না করার কারণে গুনাহগার হবে। কিন্তু ফতওয়া হিসেবে আপনার দাবি শরীয়তসম্মত সাক্ষী না থাকলে গহণযোগ্য হবে না। সূরা বাকারা: ২৮৬, সূরা নাহল: ৯১, সহীহ আল-বুখারী: ১/২৩ ও হিদায়া: ৩/১৫৪
সমস্যা: মুহতারাম! সবিনয় নিবেদন এই যে, কোন ব্যক্তি পঁচিশ লাখ টাকায় তিন বছরের জন্য একটি মার্কেট ভাড়া নিল এই চুক্তিতে যে, মেয়াদ শেষে উক্ত পঁচিশ লাখ টাকা তাকে আবার ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে। এই তিন বছরের মধ্যে অন্য কোন ভাড়া মার্কেটের মালিককে দেবে না এবং এই তিন বছর পর্যন্ত মার্কেটের আয় সে ভোগ করবে। মুহতারাম! আমার জানার বিষয় হলো, এধরণের লেনদেন শরীয়তসম্মত কিনা? যদি না হয়; তাহলে শরীয়তসম্মত কোন বিকল্প পদ্ধতি থাকলে জানিয়ে বাধিত করবেন।
আখতার হুসাইন
পটিয়া, চট্টগ্রাম
শরয়ী সমাধান: শরীয়তমতে প্রশ্নে বর্ণিত বিনিয়োগ পদ্ধতি ইজারা হয়নি। বরং কর্জের বিনিময়ে বন্ধক রাখা হয়েছে। আর শরীয়তে কর্জের বিনিময়ে কোন জিনিস বন্ধক রাখা হলে সে বন্দকী বস্তুর মোনাফা ভোগ করা সুদ ও হারাম হয়ে যায়। সুতরাং উক্ত বিনিয়োগ পদ্ধতিটি শরীয়তসম্মত হয়নি এবং কর্জদাতা যা মোনাফা ভোগ করেছে সব সুদ ও হারাম হয়েছে। তাই প্রতি মাসের ভাড়ায় বন্দকদাতাকে ফেরত দিতে হবে। আর শরীয়তসম্মত বিকল্প সহজ পদ্ধতি হচ্ছে; بيع بالوفاء অর্থাৎ যার থেকে পঁচিশ লাখ টাকা কর্জ নিয়ে মার্কেটটি বন্ধক রাখা হলো, তার কাছে কোন শর্ত ছাড়া সাধারণভাবে বিক্রয় চুক্তি করা। কিন্তু তা সরকারি স্ট্যাম্পের মধ্যে সরকারি রেজিস্ট্রি করা ব্যতিত কাঁচা কবলার মধ্যে পরিস্কারভাবে সাফ-বিক্রির কথা উল্লেখ থাকতে হবে। সে কবলার মধ্যে টাকা ফেরত দিলে মার্কেট বিক্রেতার নিকট ফেরত দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকতে পারবে না। কেননা শরীয়তের দৃষ্টিতে বিক্রিত বস্তু ফেরত দেওয়ার শতর্টি, শর্তে ফাসেদ (চুক্তি বিনষ্টকারী শর্ত) হিসেবে গণ্য হয়; যার দ্বারা বাঈ (বিক্রয়) ফাসেদ তথা নাজায়েয হয়ে যায়। অতঃপর পৃথকভাবে আরেকটি সরকারি স্ট্যাম্পের মধ্যে ক্রেতার পক্ষ থেকে একটি অ্যাগ্রিমেন্ট তথা চুক্তিপত্র লিখিতভাবে বিক্রেতাকে দিতে হবে যে, বিক্রেতা যেকোনো সময় বা মেয়াদচুক্তি মত বিক্রিত মূল্য ফেরত দিলে তখন ক্রেতা উক্ত মার্কেট বিক্রেতার নিকট ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। সেটা সরকারি স্ট্যাম্পের মধ্যে হলে ভাল, কিন্তু সরকারি রেজিস্ট্রি হবে না। যাতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই আশংকামুক্ত থাকে। তবে বিষয়টি কোনো বিজ্ঞ মুফতি সাহেবের সাথে মাধ্যমে সম্পাদন করলে ভালো হয়। সূরা বাকারা: ২৮২, বায়হাকী: ৫/৭৪১, তাবয়ীনুল হাকায়েক: ৫/১৮৩ ও ফিকহুল বুয়ু: ১/৪১৫
(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সংখ্যা)