জামেয়া ওয়েবসাইট

শনিবার-৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আত্মিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান

আত্মিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান

মূল: হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভী (রহি:)

অনুবাদ: মুহাম্মদ আবদুল আলিম

(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সংখ্যা)

হামদ ও সালাতের পর, আমার ভাই ও বন্ধুরা! খুবই দুঃখজনক যে, আজ আমাদেরই ভুলের দরুন, ইহ-পরকালের সর্ববিষয়ে আমাদের চেতনা কেবল আত্মকেন্দ্রিক সমস্যার সমাধানের বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দুনিয়া আখেরাতের সমস্যার সমাধান ও তার মুক্তি এভাবেই সম্ভব বলে মনে করি! অথচ কেবল ব্যক্তিক বিষয়াদির সমস্যার সমাধানে নিমগ্নতার ফলে বাড়তে থাকে নতুন বলা-মসিবত। কারণ যতোক্ষণ না সামাজিক সমস্যাদির সমাধান করা হবে, ততক্ষণ ব্যক্তিক সমস্যার সমাধান করা খুবই কঠিন হবে। ফলশ্রুতিতে সামাজিক জীবনের ভুলের ফল স্বরূপ পতিত মসিবত সামাজিক ক্ষতিসাধনের সাথে সাথে সকলের ব্যক্তিক জীবনকেও চরমভাবে বিপর্যস্ত করে ছাড়বে। পক্ষান্তরে যখন সমস্যার সমাধান কল্পে কল্যাণকর সামাজিক জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হবে, সামাজিক সমস্যার সমাধানের সাথে সাথে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিক সমস্যারও সঠিক সমাধান হয়ে যাবে।

এ ক্ষেত্রে আমরা ভুল বুঝে বলে থাকি, ওমুক পন্থা-তদবির(?) অবলম্বন না করাতে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে? অথচ সমস্যার সৃষ্টি হওয়া এবং তার সমাধান লাভ করা সামাজিক সমস্যাদির ওপরই নির্ভরশীল, যদি সমাজের কোন এক শ্রেণির মানুষও সামাজিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে, তাহলে সমাজের সাথে সাথে সকলেই ব্যক্তিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ হবে, তখন আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। এমনকি সামাজিক সমস্যার সমাধান না করা অবস্থায় আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের নির্জন রাতের অশ্রুসিক্ত দোয়াও অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে না। বরং যদি আল্লাহর তরফ থেকে ফয়সালা হয়ে থাকে যে, কোনো দেশের মানুষ না খেয়ে মরবে ঠিক তা-ই হবে। তখন ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে যদি ব্যক্তিকভাবে প্রত্যেকে নিজের প্রাণও উৎসর্গ করে দেয় তবুও একে একে সবাই না খেয়ে মরবে। এভাবে ব্যক্তি কেন্দ্রিক যতই বাঁচার চেষ্টা করা হবে, ততই সামাজিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। আর মানুষ কেবল নিজের পায়ের তলার মাটিটুকুরই চিন্তা করবে, অন্যকে নিয়ে ভাবার সময় হবে না। এমন মানুষ, মানুষের অবয়বে আস্ত পশু বৈ কিছু নয়। এটাই পশুর মতো আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিক সমাধানে মজে থাকার অশুভ পরিণাম। ফলে অবস্থা এ পর্যায়ে পৌঁছাবে যে, হাদীসের ভাষায়; মানুষ কবরের পাশ অতিক্রম করার সময় আফসোস করে বলবে হায়! যদি এ কবরে আমি হতাম!! মানুষ মানুষের মাংস কেটে খাবে। এমন নাশকতার কারণ তো একটাই যে, যখন প্রয়োজন সকলকেই সামাজিক সমস্যার সমাধানে সমবেতভাবে আত্মবিলীন করার, তখন সবাই শুধুই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, নিজ কর্মব্যস্ততায় নির্লিপ্ত। অথচ আমাদের করণীয় হলো, নিজেকে সামাজিক সমস্যার সমাধানে সঁপে দিয়ে আল্লাহর মদদ তলব করতে থাকা, যেন তিনি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেন। কারণ একমাত্র তিনিই সমস্যার সমাধানকারী।

মেরে দোস্তু! এখন প্রয়োজন এ কথার পূর্ণ বিশ্বাস কলবে বদ্ধমূল করা যে, আল্লাহ তাআলার পসন্দনীয় যে কোন সৃষ্টির পিছে নিজেকে আত্মনিয়োজিত করলেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। আর তাঁর অপসন্দের কোন মাখলুকের পিছে আত্মবিলীন করাতে পতিত হয় তাঁর গজব, সৃষ্টি হয় ব্যক্তিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা। ফলে দেখা যায় সময়ের পরম সহমর্মি বন্ধুও পরিণত হয় পাষাণ প্রাণঘাতকে।

মেরে ভাইউঁ! প্রতিটি বস্তু যেমন আল্লাহর মাখলুক, তেমনি প্রতিটি হালাত তথা অবস্থাদিও আল্লাহর মাখলুক। সূর্য মাখলুক, চাঁদ মাখলুক, আসমান-জমিন মাখলুক, মাখলুক সকল প্রাণীও। হালাত তথা অবস্থাদি কোন মাখলুক থেকে সৃষ্ট নয় বরং আল্লাহর স্বয়ংসম্পূর্ণ মাখলুক। কেউ চাইলেই অশান্ত হালত শান্ত করে দিতে পারবে না, চাইলে ফাসাদও সৃষ্টি করতে পারবে না। বরং এসব অবস্থা আল্লাহর হুকুমের অনুগামী।

সূর্য যেমন আল্লাহর মাখলুক তার আলোও আল্লাহর মাখলুক, যখন ইচ্ছে দান করেন সূর্যের আলো, যখন ইচ্ছে ছিনিয়ে নেন আলো। হাতিয়ার মানুষকে মারতে পারে না, বরং মানুষ যেমন আল্লাহর মাখলুক ঠিক মওতও আল্লাহর মাখলুক। আল্লাহ মারতে চায় তো মৃত্যু ঘটে। এমনিভাবে ইজ্জত বে ইজ্জত, ক্ষুধা, দরিদ্র সবই আল্লাহর মাখলুক। আমরা বাহ্যত খাবার দিয়ে পেট ভরে দেখি, বস্তুত আল্লাহই পেট ভরিয়ে দেন, এভাবে অন্য সকল কিছুতে ভুল করে বাহ্যিক অবস্থার বিচার করতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। এবং ভুল ভাবনা বুনতে থাকি যে, যেন বস্তুর বাহ্যিক অবস্থাই প্রকৃত প্রভাব বিস্তারক। অথচ কুরআনের পরিস্কার ঘোষণা, আল্লাহ ইরশাদ করেন, আমিই পানি বর্ষণ করি, ফসল উৎপাদন আমিই করি।

মেরে দোস্তু, মনে রেখো! একজন মহিলা যেমন আল্লাহর মাখলুক ঠিক তার গর্ভের বাচ্চাও আল্লাহর মাখলুক। মাখলুক খালিক হতে পারে না। যিনি প্রথম বস্তু সৃষ্টি করেছেন তিনিই দ্বিতীয় বস্তু সৃষ্টি করেন। মাখলুক থেকে মাখলুক সৃষ্ট হতে দেখে মাখলুকের পিছে পড়লে তৈরি হবে জটিল সমস্যা। রুটি খেলেই পেট ভরে তা কিন্তু নয় অর্থাৎ পেট ভরে দেয়া রুটির আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য নয়, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই পেট ভরান। হযরত মুআবিয়া D বলেন, কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে রুটি খেতে খেতে আমার চোয়ালে ব্যথা হয়ে গেছে এর পরও পেট ভরেনি।

শোনো হে প্রিয় বন্ধুরা! আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত যাই বর্তমানে আছে আর যা সামনে আসবে সবই আল্লাহর মাখলুক। এবং সকল ভালো কি মন্দ হালাত আল্লাহর মাখলুক। তাই যা কিছু গ্রহণ করবো আল্লাহর কাছ থেকেই গ্রহণ করার চেষ্টা করবো। এতে ভয়ের উদ্রেক হলে আল্লাহর জন্য তা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর সাথে নিসবত জোড়াবো, আল্লাহর জন্য ভয় ছাড়তে পারলে তার চির বিদায় অনিবার্য। যদি মাখলুকের কাছ থেকেই কেউ কিছু গ্রহণ করো, বস্তুত তা আল্লাহরই সৃষ্টি, তবুও, মাখলুকের মধ্যস্থতায় হওয়াতে তা নিশ্চিত ধ্বংসশীল। তাই যে আল্লাহ থেকে চেয়ে নেয় না বরং মাখলুক থেকে নেয় সে অনেক পস্তায়। কারণ যেই জিনিস মাখলুকের মধ্যস্থতায় আসে তার ধ্বংস অনিবার্য, যার ওপর শত আফসোস!! আর যা সরাসরি আল্লাহ হতে আসবে তা চিরস্থায়ী। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর মর্ম কথাও এ-ই যে, সকল সমস্যার সমাধান এক সত্ত্বা থেকেই করতে হবে। তাই সেই তদবির গ্রহণ করো যা দিয়ে আল্লাহ হতে নেয়া যাবে। যদি আল্লাহর কাছ থেকে নেয়ার তদবির অবলম্বন করতে পারো, তাহলে দুনিয়াতেও পাবা আখেরাতেও পাবা। গায়রুল্লাহর পিছু ছুটে আমরা যা বুঝি যে, বস্তু থেকে বস্তু পয়দা হচ্ছে, এতে শিরকের গন্ধ উত্থিত হয়।
আল্লাহর হুকুম ছাড়া মাখলুক কিছুই দিতে পারেনা। কুরআনের নানা জায়গায় বর্ণিত হয়েছে, মাখলুকের কাছে কিছুই নেই। বরং এই আকিদা পোষণ করবে যে, আল্লাহই সব করেন। একেই বলে তওহিদ। মাখলুক থেকে ফায়দা হাসিলের যেমন তদবির আছে তেমনি আল্লাহর থেকে নেওয়ারও তদবির আছে। এর কিছু নীতি এরূপ যে, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসী হওয়া, মানুষের কলবে তা পয়দা করার চেষ্টা করা। এর জন্য দুনিয়ার সামান্য ভয় সইতে পারলে পরিণামে লাভ হবে চিরস্থায়ী ভয়মুক্তি। সামান্য ক্ষুধা পিপাসা সইতে পারলে মিলবে চিরমুক্তি। অল্প সময় বিবি বাচ্চার সঙ্গ ত্যাগ করতে পারলে নসিব হবে চির সঙ্গী। সাহাবায়ে কেরাম কিছুকাল ক্ষুধা পিপাসার কষ্ট সয়েছে তো, এ দুনিয়াতেই বড়ো বড়ো রাজ্যের গচ্ছিত খাযানা তাদের পদতলে এসে পড়েছে। প্রয়োজন শুধু কোন কিছুরই নিজস্ব প্রভাব গ্রহণ না করা। তবেই মাল মুলুকের ফেতনা থেকে মু্ক্তি লাভ হবে। সবার সাথে আল্লাহর জন্যই মোআমালা করা সহজ হবে। অর্থ না থাকলে বিচলিত হওয়া যাবে না, আবার থাকলে প্রভাবিত হওয়া যাবে না, এমন মানুষরাই তো ‘সালেহ’ তথা নেক ইনসান, যারা নিজেদের মাঝে মাখলুকের প্রভাব গ্রহণ করে না, বরং তার বিলুপ্তি সাধন করে।

মোদ্দা কথা, আজকের এই পরিবর্তিত বিকৃত অবস্থার জন্য আমরাই একমাত্র দায়ী, কারণ আমরা আল্লাহর জন্য জান উৎসর্গ করার বদলে মাখলুকের জন্য করছি, মাখলুক থেকে নেওয়ার ভুল কল্পনা করছি। অথচ আল্লাহর হুকুমের জন্য জান কুরবানি দেয়াতে আল্লাহর মদদ লাভের যত বেশি বিশ্বাস অর্জন হবে, তত বেশি গায়বের দরজা খুলে যাবে, আর যখন আল্লাহর দীনের জন্য জান উৎসর্গকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং এ ইয়াকিন ও বিশ্বাস পয়দা হবে যে, সকল মাখলুকের প্রকৃত বন্ধন আল্লাহরই সাথে, পসন্দের অপসন্দের সব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, তখন তোমরা সূর্যের আলোয় মাখলুকের মাঝে এ ইয়াকিন পয়দার মেহনত করবে, আর চাঁদের জ্যোৎসনায় রোনাজারি করে আল্লাহর সকাশে কবুলিয়্যাতের ভিক্ষা প্রার্থনা করবে, ইনশাআল্লাহ সবধরনের আত্মিক ও সামাজিক হালাত ঠিক হয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ