জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৭ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-১১ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৬শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাদীসবিষয়ক জরুরি কিছু কথা

হাদীসবিষয়ক জরুরি কিছু কথা

মাহফুয আহমদ

(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সংখ্যা)

এক. লক্ষ লক্ষ সেই হাদীসগুলো এখন কোথায়?

সালাফে সালিহীন তথা পুণ্যবান পূর্বসূরিদের জীবনীগ্রন্থে অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে, অমুক মুহাদ্দিস এতো লক্ষ হাদীস মুখস্থ জানতেন। কারো কারো স্মৃতিতে তিন লক্ষ, চার লক্ষ বা পাঁচ লক্ষ হাদীস সংরক্ষিত ছিলো। এইসব তথ্য কাল্পনিক নয়, বরং পুরো বাস্তব এবং বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ।

কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। সেটা হলো, আমাদের সামনে হাদীসের যেসব গ্রন্থ ও সংকলন রয়েছে সেগুলো একত্রিত করেও হাদীস সংখ্যা লাখে পৌঁছাবে না। কুতুবে সিত্তাহ বা হাদীসের জগদ্বিখ্যাত ছয় কিতাবে বিবৃত হাদীসের সংখ্যা (মুকাররার/রিপিটেড বা পুনরাবৃত্তি ব্যতীত) মাত্র কয়েক হাজার৷ প্রাচীন হাদীস সংকলনের মধ্যে আমাদের নিকট বড় যেসব কিতাব পৌঁছেছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো মুসনদে আহমদ। এতে আনুমানিক ত্রিশ হাজার হাদীস উল্লিখিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ের হাদীস সংকলনগুলোর মাঝে বৃহৎ একটি গ্রন্থ হলো আলী আল মুত্তাকী আল হিনদী (রহি:)-এর কানযুল উম্মাল। এতেও হাদীসের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের চেয়ে কম। তার মানে আমাদের নিকট হাজার কয়েক হাদীস পৌঁছেছে এবং বাকিগুলো অরক্ষিত থেকে গেছে?!

নির্দ্বিধায় বলা যায়, না। হাদীসসমূহ অরক্ষিত থেকে যায় নি কিংবা হারিয়ে যায়নি। বস্তুত মুহাদ্দিসগণ যখন লক্ষ লক্ষ হাদীসের কথা বলেন, তখন তাঁরা একই হাদীসের একাধিক সনদ বা বর্ণনাসূত্রকেও পৃথক পৃথক হাদীস হিসেবে পরিগণিত করে থাকতেন। যেমন ধরুন! একজন মুহাদ্দিস কোনো একটা হাদীস তাঁর কয়েকজন শায়খ ও উসতায থেকে শুনেছেন এবং সেই শায়খগণ আবার একই হাদীস একাধিক বর্ণনাসূত্রে পেয়েছেন। তাহলে এই একটা হাদীসই এখন সংখ্যায় অনেক হয়ে যাবে। আর সেই মুহাদ্দিসগণ যখন হাদীসের গ্রন্থ সংকলন করেছেন তখন সেই সনদগুলো থেকে বাছাই করে কিছু সনদে হাদীসগুলো নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন।

অথবা সমার্থক শব্দের কিছু ভিন্নতা। একজন এক শব্দে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আরেকজন সেই একই হাদীস ভিন্ন একটি সমার্থক শব্দে বর্ণনা করেছেন। তো গণনার ক্ষেত্রে এই একটা হাদীস এখন একাধিক হাদীস বলে পরিগণিত হবে৷

তাছাড়া পূর্বসূরি উলামায়ে কেরাম ‘হাদীস’ শব্দটিকে অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করে থাকতেন। সেক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবিয়িদের কথা ও ফতোয়াকেও তাঁরা হাদীস নামে অভিহিত করতেন। (পরবর্তী সময়ে এইসবের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিভাষা নির্ধারিত ও প্রচলিত হয়েছে।) তো হাদীসের ওই ব্যাপকতার ভেতরে যেহেতু সাহাবা ও তাবিয়িদের কথাবার্তা এবং তাঁদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও অন্তর্ভুক্ত ছিলো; সেজন্যই সালাফের নিকট হাদীসের এই বিশাল সংখ্যা দাঁড়িয়েছে।

খুব সহজ ও সরল কয়েকটি কথা বলা হলো এখানে। হাদীস বিশারদ আলেমগণ বিষয়টি সবিস্তারে বিশ্লেষণ করে গেছেন এ-বিষয়ক গ্রন্থাদিতে।

দুই. আবু হুরায়রা (রাদি:) কি মুয়াবিয়া (রাদি:) -এর দস্তরখানায় খেতেন আর আলী (রাদি:)-এর পেছনে নামাজ পড়তেন?

কারো কারো মুখে এই কথা শুনতে পাওয়া যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর প্রিয়তম সাহাবী, সর্বাধিক হাদীসের বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা (রাদি:) নাকি মুয়াবিয়া (রাদি:) -এর দস্তরখানায় খাবার গ্রহণ করতেন আর আলী ইবনে আবু তালিব (রাদি:) -এর পেছনে নামাজ পড়তেন! কারণ হিসেবে আবু হুরায়রা নাকি বলতেন, মুয়াবিয়ার দস্তরখানা উন্নত আর আলীর পেছনে নামাজ পড়া উত্তম!!

অথচ এমন কোনো তথ্য বা বর্ণনা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কোনো প্রাচীন গ্রন্থে বিবৃত হয়নি। আর না এই তথ্যের কোনো সনদ বা বর্ণনাসূত্র উল্লিখিত হয়েছে কোথাও! তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর কয়েকবছরের সার্বক্ষণিক সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মহান এই সাহাবী আবু হুরায়রা (রাদি:)-এর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এমন কল্পকাহিনী মোটেই মানানসই নয়। এমন নির্বোধ কর্মপন্থা তাঁর থেকে প্রকাশ পাওয়ার চিন্তাও করা যায় না।

উপরন্তু ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এমনটা হওয়ার কথা নয়। কেননা মুয়াবিয়া (রাদি:) ছিলেন সিরিয়ায়, আলী (রাদি:) ছিলেন ইরাকে আর আবু হুরায়রা (রাদি:) ছিলেন হিজাযে! বাহরাইনের গভর্নরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির পর আবু হুরায়রা মদিনায় ফিরে আসেন এবং আমৃত্যু সেখানেই অবস্থান করেন।

এ বিষয়ে শায়খ মুহাম্মদ আবু শাহবা তদীয় দিফা আনিস সুন্নাহ বইয়ে (পৃ. ১১৫) এবং শায়খ আবদুল মুনয়িম সালিহ তাঁরদিফা আন আব হুরায়রা (পৃ. ১৫০) গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত অথচ বলিষ্ঠ ও প্রামাণিক খণ্ডন পেশ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে তাঁদের উদ্ধৃতিতে আল-মাদখাল ইলা কিতাবিল হিদায়ার একটি তা’লীক বা টীকায় (পৃ. ২৩৫-২৩৬) অধমও বিষয়টির প্রতি কিছুটা আলোকপাত করেছি।

মোটকথা সর্বাধিক নাম্বার হাদীসের বর্ণনাকারী এই মহান সাহাবীর ব্যাপারে এমন অদ্ভুত কাহিনী শুধু তাঁর ব্যক্তিত্বকে কলুষিত করার জন্য নয়, বরং তাঁর সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলো অস্বীকার করার এবং সেগুলোকে অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত করার জন্য একদল মুসতাশরিক (ওরিয়েন্টালিস্ট/প্রাচ্যবিদ) এবং তাদের অনুগামীরা এ জাতীয় কল্পকাহিনী খুব যত্নসহকারে পেশ করে থাকে। বলতে চায়, এরকম একজন নীচু(?) মানুষের সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলোর ওপর কীভাবে আস্থা রাখা যায়; যিনি সামান্য একটু সুস্বাদু খাবারের জন্য নীতিগত কোনো অবস্থানে অটল থাকতে পারেননি! মিসরের আবু রাইয়া তো আবু হুরায়রা গ-কে তাচ্ছিল্য করে ‘শায়খুল মাদ্বিরা’ উপাধি দিয়ে বই পর্যন্ত লিখেছে! সুতরাং আমাদের ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত। এমন অসার গল্প বলে আমরা তাদের জন্য সন্দেহ-সংশয় বিস্তারের পথ সুগম করে দিচ্ছি না তো?

তিন. হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে কোনো কোনো রাবী (বর্ণনাকারী) কিছু বিশেষণে বিশেষায়িত হয়ে থাকেন। সেই বিশেষণটি আবার হয়ে থাকে বিচিত্র। যেমন- নির্দিষ্ট কোনো ব্যাপারে বিশেষ কোনো সাহাবী বা পরবর্তী রাবীর বর্ণনাকে মূল ও প্রধান গণ্য করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ আযানের সূচনার বেলায় সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে যায়দ ইবনে আবদে রাব্বিহ গ-এর বর্ণনা।

তেমনি বিশেষ কোনো সাহাবী থেকে অথবা পরবর্তী কোনো রাবী থেকে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রেও কোনো কোনো রাবী স্পেশালিষ্ট হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। যেমন আয়িশা গ থেকে তাঁর বোনপো উরওয়া, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ গ থেকে আসওয়াদ-আল-কামাহ, আবদুল্লাহ ইবনে উমর ঘ থেকে নাফি প্রমুখ। তেমনি পরবর্তী রাবীগণের বেলায়ও এমন দৃষ্টান্ত খোঁজে পাওয়া যায়।

এ জাতীয় আরও অনেক ক্ষেত্র ও বিশেষণ রয়েছে। হাদীসের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ধরনের বিশেষণে বিশেষায়িত সনদগুলো মুখস্থ বা হৃদয়ঙ্গম করে রাখতে পারলে খুবই ভালো হয়। ফলত একই সঙ্গে প্রচুর হাদীসের সনদ নিজের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে।

চার. হাদীস বিশেষজ্ঞ আলেমগণ বলেন, মুহাদ্দিসগণ কর্তৃক সংকলিত হাদীসগ্রন্থের শারহগুলো বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। যেমন-

ক. বিশদ শারহ। যেমন আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (মৃ. ৮৫৫ হি.)-এর উমদাতুল কারী

খ. সংক্ষিপ্ত শারহ। যেমন আল্লামা খাত্তাবী (মৃ. ৩৮৮ হি.)-এর আ’লামুল হাদীস (বুখারী) এবং মাআলিমুস সুনান (আবু দাউদ)।

গ. শাস্ত্রীয় শারহ। যেমন আল্লামা নাওয়াওয়ী (মৃ. ৬৭৬ হি.)-এর মুসলিমের শারহ (আল-মিনহাজ)।

ঘ. সমন্বিত শারহ। যেমন আল্লামা কাসতাল্লানী (মৃ. ৯২৩ হি.)-এর ইরশাদুস সারী।

উল্লেখ্য যে, এই স্তরবিন্যাস আধিক্যের ভিত্তিতে। নতুবা বিশদ শারহেও কখনও সংক্ষিপ্ততা থাকতে পারে আর সংক্ষিপ্ত শারহে বিশদতা পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া শারহগুলোকে আরও বিভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত করা যাবে।

পাঁচ. মুহাদ্দিসগণ বলেন, হাদীস বিষয়ক সংকলনগুলো মৌলিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত:

এক. সংকলকগণ নির্দিষ্ট সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করবার পরিকল্পনা করেন নি। এটা আবার দু’ধরনের:

১. সর্বোচ্চ সংখ্যায় হাদীসগুলো একত্রিত করার প্ল্যান ছিলো। যেমন মুসনদে আহমদ, মুসনদে বাক্বী ইবনে মাখলাদ, তাবারানীর আল-মু’জামুল কাবীর প্রভৃতি।

২. বিশেষ কিছু শর্তানুযায়ী সীমিত সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করার ইচ্ছা। যেমন সহীহ আল-বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ প্রভৃতি।

দুই. নির্ধারিত সংখ্যার হাদীস সমবেত করা। যেমন- এক হাজার হাদীসের সংকলন, শত হাদীসের সংকলন, চল্লিশ হাদীসের সংকলন প্রভৃতি। এর মধ্যে চল্লিশ সংখ্যাটি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে; এবিষয়ক একটি হাদীসের কারণে। (সেই হাদীস নিয়ে পর্যালোচনা করা এখানে প্রতিপাদ্য নয়।)

উল্লেখ্য যে, হাদীস সংকলনগুলোর উপর্যুক্ত প্রকারভেদ কেবল সংখ্যার বিবেচনায়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে হাদীসের কিতাবগুলোকে আরও একাধিক বিন্যাসে বিন্যস্ত করা যায়। সে বিষয়টি এখানে মূখ্য নয়।

ছয়. সুনানে আবু দাউদ। হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি হাদীস সংকলন। সনদ সহকারে সুনানে আবু দাউদ পড়র সময় কেউ কেউ একটি নাম নিয়ে বিপাকে পড়েন। নামটি হলো মুহাম্মদ ইবনে ঈসা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থ সুনানে তিরমিযীর সংকলক ইমাম তিরমিযীর নাম হলো মুহাম্মদ ইবনে ঈসা। তার মানে কি এই, ইমাম আবু দাউদ (রহি:) (মৃ. ২৭৫ হি.) ইমাম তিরমিযী (রহি:) (মৃ. ২৭৯ হি.)-এর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করছেন?

না, বিষয়টা এমন নয়। সচেতন পাঠকদের তা জানাই আছে। তারপরও শুধু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি৷ বস্তুত সুনানে আবু দাউদে উল্লিখিত সেই মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইমাম তিরমিযী নন। তিনি হলেন মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে নাজিহ, আবু জাফর ইবনুত তাব্বা (মৃ. ২২৪ হি.) (রহি:)। ইমাম আবু দাউদ নিজের এই শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ঈসা থেকে প্রচুর হাদীস বর্ণনা করেছেন তদীয় সুনানে। মুহাম্মদ ইবনে ঈসার সূত্রে বর্ণিত প্রথম হাদীসটি দেখুন সুনানে আবু দাউদের ২৪ (শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ প্রদত্ত নাম্বার হিসেবে ২৫) নং হাদীসে। মুহাদ্দিসগণ পরিষ্কারভাবে বিষয়টি আলোচনা করেছেন শারহগুলোতে। বস্তুত এই মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ছিলেন বাগদাদের। ইমাম আবু দাউদ বাগদাদ আসার পর এই শায়খের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর সূত্রে হাদীস শিখেন। শেষবয়সে মুহাম্মদ ইবনে ঈসা সিরিয়ার উপকূল অঞ্চল তারসুস চলে গিয়েছিলেন। ইমাম বুখারী প্রমুখ মুহাদ্দিসও তাঁর শাগরেদ ছিলেন।

অন্যদিকে মুহাম্মদ ইবনে ঈসা তথা ইমাম তিরমিযী ইমাম আবু দাউদের শায়খ নন, বরং শাগরেদ। ইমাম আবু দাউদ তিরমিযীর সূত্রে কোনো হাদীসও বর্ণনা করেন নি। উপরন্তু ইমাম তিরমিযী তদীয় গ্রন্থে স্বীয় উসতায ইমাম আবু দাউদের সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

সকলের জানা এই বিষয়টি নিয়ে লিখলাম এই জন্য যে, গত কয়েকদিন পূর্বে একজন মুহাক্কিককে দেখলাম তিনি আবু দাউদের সেই মুহাম্মদ ইবনে ঈসাকে ইমাম তিরমিযী বলে চালিয়ে দিচ্ছেন; যা স্পষ্টত ভুল। অতএব ছোট্ট এই তথ্যটি আমাদের জেনে রাখা ভালো।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, হাদীসের কোনো রাবী বা বর্ণনাকারীর আসল পরিচয় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু সন এবং তাঁর শায়খ ও শাগরেদদের তালিকা দেখা যেতে পারে। সেখান থেকে বিষয়টা অনেকাংশেই নির্ধারিত হয়ে যাবে। অবশ্য এসবের পূর্বে এই শাস্ত্রের সঙ্গে আপনার গভীর সম্পর্ক, শাস্ত্রজ্ঞদের দীর্ঘ সাহচর্য এবং প্রচুর অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই।

সাত. ছাত্রজীবনে যখন মিশকাতের সঙ্গে মোল্লা আলী কারী (রদি:)-এর মিরকাত পড়তাম, তখন প্রথম প্রথম একটা প্রশ্ন মনে জাগতো। পরে তার সমাধানও পেয়েছিলাম।

যারা মিরকাত পড়েছেন তারা অবশ্যই দেখেছেন যে, মোল্লা আলী কারী প্রায়শই ইবনে হাজার বলেছেন লিখে অনেক উক্তি ও মন্তব্য উদ্ধৃত করে থাকেন। তো প্রশ্ন হলো এই ইবনে হাজার কে? তিনি কি সহীহ আল-বুখারীর কালজয়ী আরবি ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারির রচয়িতা আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহি:)?

সহজ উত্তর হলো, না। মোল্লা আলী কারী সাধারণত ইবনে হাজার বলে ইবনে হাজার হায়তামী আল-মক্কী (রহি:)-এর প্রতি ইঙ্গিত করেন। বস্তুত ইবনে হাজার হাইতামি আল মাক্কি মিশকাতের একটি আরবি শারহ সংকলন করেছিলেন। ফাতহুল ইলাহ ফী শারহিল মিশকাহ নামে সেটি প্রসিদ্ধ। দারুল কুতুবিল ইলমিয়া থেকে ইতোমধ্যে তা ছাপাও হয়ে গেছে। আর যেহেতু মোল্লা আলী কারী (মৃ. ১০১৪ হি.) এবং ইবনে হাজার হাইতামী আল মাক্কী (মৃ. ৯৭৪ হি.) উভয়জনই ছিলেন কাছাকাছি সময়ের; সেজন্য মোল্লা আলী কারী সঙ্গতকারণেই ইবনে হাজারের মন্তব্য ও বক্তব্যগুলো উদ্ধৃত করে সেগুলোর পর্যালোচনা করেছেন। এজন্য মাঝেমধ্যে তিনি ‘আমাদের শায়খ ইবনে হাজার’ বলেও তাঁর কথা উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে মোল্লা আলী কারী যখন ইবনে হাজার আসকালানী (রহি:) (মৃ. ৮৫২ হি.)-এর কথা বলেন, তখন তিনি আসকালানী সম্বন্ধটি যুক্ত করেই বলেন। তাছাড়া ইবনে হাজার আসকালানী মোল্লা আলী কারী এর শায়খও নন এবং ইবনে হাজার আসকালানী মিশকাতের কোনো শারহও লিখেন নি। (অবশ্য মিশকাতের হাদীস সংক্রান্ত একটি গ্রন্থ ইবনে হাজার লিখে গেছেন; সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।)

মোটকথা মোল্লা আলী কারী (রহি:) যখন শুধু ইবনে হাজার বলেন তখন তিনি ইবনে হাজার হায়তামী আল-মক্কী (রহি:) বুঝিয়ে থাকেন আর ইবনে হাজার আসকালানী (রহি:)-এর কথা বললে তিনি সম্বন্ধ যুক্ত করে (কিংবা ফাতহুল বারীর উদ্ধৃতি পেশ করে এবং কখনও শায়খুল ইসলাম অভিধা যুক্ত করে) বলে থাকেন। এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে আল-মাদখাল ইলা মিশকাতিল মাসাবিহ গ্রন্থে ইনশাআল্লাহ।

আট. আতা ইবনে আবী রাবাহ (রহি:) হাদীসের একজন বিখ্যাত রাবী (বর্ণনাকারী)। হাদীসের প্রসিদ্ধ প্রায় সবকটি গ্রন্থেই তাঁর সূত্রে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হাজার হাজার নয়, লক্ষ-কোটি মুসলমান আজ তাঁর সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলো পাঠ করে যাচ্ছে হাদীসের বিশুদ্ধ গ্রন্থসমূহে।

কিন্তু আপনি কি জানেন ওই মহান মুহাদ্দিস তাঁর জীবনে এমন মুহূর্তও অতিক্রম করেছেন, যখন তাঁর দারসে হাদীসে বা ইলমী মাজলিসে মাত্র আট-নয়জন ছাত্র উপস্থিত হতো! (দেখুন: সিয়ারু আলামিন নুবালা; যাহাব, ৫/৮৪)

বর্তমান সময়ের খ্যাতিমান একজন লেকচারার (পশ্চিমে) সম্পর্কে আমাকে একজন বিশ্বস্ত আলেম জানিয়েছেন যে, ওই আলোচক নাকি মাত্র কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে তাঁদের উসতায থেকে কুরআন শিখেছিলেন। কিন্তু মাত্র এই কয়েক শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি সারা বিশ্বে আজ ব্যাপকভাবে কুরআনের শিক্ষা প্রচারের কাজ করে যাচ্ছেন। সুতরাং তরুণ আলেমদের এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। কোনো কোনো তরুণ আলেম বন্ধু মনে করেন, ছাত্রজীবনে পড়েছিলাম বিরাট সংখ্যক সহপাঠীদের নিয়ে। আর শিক্ষকতা জীবনে পড়াচ্ছি গুটিকয়েক ছাত্রকে।

স্মরণ করুন এই সব তথ্য। সংখ্যা কখনও মূখ্য নয়। আপনি আপনার কাজ ও শ্রম দিয়ে যান; একসময় তার ফসল ভোগ করতে পারে পুরো উম্মাহ৷ দীনী কাজে ইখলাস ও ইতকানই হলো মূল প্রাণ।

নয়. আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (রহি:)। হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্রের পণ্ডিত এই মহান ইমামের জন্ম হয় ৭৬২ হিজরীতে, তুরস্কের গাজিয়ানটেপ (عينتاب) শহরে। কিছুকাল তিনি সিরিয়ার আলেপ্পো অঞ্চলেও বসবাস করেন। অবশেষে মিসরে চলে আসেন এবং এখানে আমৃত্যু অবস্থান করেন। একসময় মিসরের ওয়াকফ-সম্পত্তি এবং বিচার-বিভাগের দায়িত্বেও ছিলেন। ৮৫৫ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

জগদ্বিখ্যাত এই হানাফী মুহাদ্দিস জ্ঞান ও গবেষণার ময়দানে ছিলেন অতুলনীয় একজন মনীষী। রচনা করেছেন কালজয়ী অনেক ইলমী কিতাব। এখানে তাঁর জীবনালেখ্য কিংবা তাঁর অনবদ্য গ্রন্থসমূহ নিয়ে আলোচনা মূখ্য নয়। কেবল দেখাতে চাচ্ছি, হানাফী এই মুহাদ্দিস কীভাবে একইসঙ্গে হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্রে বিশাল অবদান রেখে গেছেন। বস্তুত উভয় শাস্ত্রের বহুল প্রচারিত কয়েকটি গ্রন্থের তিনি বিশ্লেষণমূলক শারহ লিখেছেন।

হাদীসশাস্ত্র:

  • সহীহ আল-বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ উমদাতুল কারী (২৫ খণ্ড)
  • সুনানে আবু দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ (৭ খণ্ড)
  • শারহু মায়ানিল আসারের ব্যাখ্যাগ্রন্থ নুখাবুল আফকার (২০ খণ্ড)
  • আল কালিমুত তাইয়িবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আল-ইলমুল হাইয়িব (১ খণ্ড)

ফিকহশাস্ত্র:

  • আল-হিদায়ার ব্যাখ্যাগ্রন্থ আল-বিনায়া (১২ খণ্ড)
  • কানযুদ দাকায়িকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ রামযুল হাকায়িক (বৃহৎ কলেবরের ১ খণ্ড)
  • তুহফাতুল মুলূলের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মিনহাতুস সুলূক (১ খণ্ড)

উদাহরণস্বরূপ আল্লামা আইনি সংকলিত মাত্র কয়েকটি ব্যাখ্যাগ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো গ্রন্থ রচনার পেছনে রয়েছে শিক্ষণীয় কিছু ঘটনা বা প্রেক্ষাপট; ইনশাআল্লাহ পরবর্তী সুযোগে সেবিষয়ে লেখা যেতে পারে।

দশ. সহীহ আল-বুখারীতে হানাফী মুহাদ্দিসগণের সূত্রে বর্ণিত হাদীস

সাধারণ পাঠকদের জন্য শিরোনামটি কিছুটা অদ্ভুত মনে হতে পারে৷ কিন্তু বিজ্ঞজন অবশ্যই অবগত আছেন যে, ইমাম বুখারী (রহি:) -এর শায়খদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ছিলেন ফিকহে হানাফীর অনুসারী। বুখারীর সেই শায়খদের মধ্যে কেউ কেউ তো ছিলেন স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা (রহি:)-এর সরাসরি ছাত্র। বরং সহীহ আল-বুখারীতে সুলাসিয়াত (মাত্র তিন বর্ণনাকারীর মধ্যস্থতায় বর্ণিত হাদীস) রয়েছে। হাদীস বিশেষজ্ঞদের নিকট এই সুলাসিয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। মোট ২২টি সুলাসি হাদীসের ২০টিই হানাফী মুহাদ্দিসের (ইমাম আবু হানিফার শাগরেদ কিংবা শাগরেদের শাগরেদ) সূত্রে বিবৃত হয়েছে। তাঁরা হলেন, মাক্কি ইবনে ইবরাহিম হানাফী (১১টি), আবু আসিম নাবিল যাহহাক ইবনে মাখলাদ হানাফী (৬টি), মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী হানাফী (৩টি)। বাকি দুটো সুলাসীহাদীস বর্ণিত হয়েছে অপরাপর মুহাদ্দিস থেকে। (এবিষয়ে অধম কর্তৃক সংকলিত এবং সিলেটের নিউ মাদানিয়া কুতুবখানা থেকে প্রকাশিত ইমাম বুখারী ও হানাফী মাযহাব বইটি দেখা যেতে পারে।)

এর বাইরেও সহীহ আল-বুখারীতে অনেক হাদীস উল্লিখিত হয়েছে হানাফী মুহাদ্দিসের মধ্যস্থতায়।

সুখের কথা হলো, বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞ আলেম সেই প্রসঙ্গে বিশদ একটি রচনাকর্ম উপস্থাপন করেছেন। তিনি হলেন মাওলানা মুহাম্মদ মুফীযুর রহমান চাটগামী সাহেব হাফিযাহুল্লাহ। দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করে তিনি চলে যান পাকিস্তানের বিন্নুরী টাউন মাদরাসায়। সেখানে একাধারে ফিকহ ও হাদীসের ওপর তাখাসসুস (স্পেশাল কোর্স) করেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানেই তিনি রচনা ও গবেষণা কর্মে আত্মনিয়োগ করেন বলে জানা যায়। বিদগ্ধ এই লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ এখনও আমার হয়ে উঠেনি৷ তাঁর বাবাও ছিলেন একজন আলেম, মাওলানা আহমদ হোসাইন (রহি:)।

১৪২২ সালে মাওলানা মুফীযুর রাহমান সাহেব তাঁর এই গ্রন্থটি সংকলন করেন। ১৪২৩/২০০২ সালে বইটির প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়। এতে তিনি ১১৫ জন হানাফী মুহাদ্দিসের জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন; যাদের সূত্রে সহীহ আল-বুখারীতে প্রচুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাদের কারো কারো সূত্রে ইমাম বুখারী শতাধিক হাদীস উল্লেখ করেছেন। বিজ্ঞ লেখক সেই হানাফী মুহাদ্দিস কর্তৃক বর্ণিত হাদীসগুলোর সূত্র নির্দেশ করে দিয়েছেন; যাতে পাঠকরা সহজেই হাদীসগুলো সহীহ আল-বুখারী থেকে অনুসন্ধান করে নিতে পারেন।

৪৮০ পৃষ্ঠার এ চমৎকার গ্রন্থের সপ্রশংস অভিমত লিখে দিয়েছেন প্রখ্যাত দুজন ব্যক্তিত্ব। আল্লামা আবদুল হালীম চিশতী (রহি:) এবং খ্যাতিমান মুহাক্কিক ড. বাশশার আওয়াদ মারুফ হাফিযাহুল্লাহ। পাকিস্তানের জমজম পাবলিকেশন্স থেকে বইটির একাধিক সংস্করণ বের হয়েছে।

লেখক: উসতাযুল হাদীস, মাদানি মাদরাসা, লন্ডন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ