জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-২৪শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি-২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলা ভাষার উন্নয়নে মুসলিম অবদান

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে,

خَلَقَ الْاِنْسَانَۙ۰۰۳ عَلَّمَهُ الْبَيَانَ۰۰۴

‘তিনি (আল্লাহ) মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তাকে মনের ভাব প্রকাশ করার শিক্ষা দিয়েছেন।’

وَمَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهٖ ؕ ۰۰۴

‘আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর নিজ কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি।’

وَمِنْ اٰيٰتِهٖ خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ وَاخْتِلَافُ اَلْسِنَتِكُمْ وَاَلْوَانِكُمْؕ ۰۰۲۲

‘আর তাঁর (আল্লাহর) নিদের্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশ ম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র।’

কুরআন মজীদের এসব নির্দেশনা মুসলিম মননে প্রত্যেক জাতি বা সম্প্রদায়ের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দানের স্পৃহা গেঁথে দেয় এবং ইসলাম যেখানেই গেছে সেখানকার অধিবাসীদের মাতৃভাষাকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছে।

বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের পূর্বে এখানকার অধিবাসীদের কথা বলার বুলি দারুণ অবহেলিত অবস্থায় ছিল। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, ‘মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুঠিরে বাস করিতেছিল। বাঙ্গালা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। পন্ডিতেরা নস্যাদার থেকে নস্য গ্রহণ করে শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করতে ছিলেন এবং ‘তৈলাধার পাত্র’ কিংবা ‘পত্রাধার তৈল’ এই লইয়া ঘোর বিচারের প্রবৃত্ত ছিলেন। সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পন্ডিতমন্ডলী দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের কাছে অপাঙক্তেয় ছিল তেমনি ঘৃণা, অনাদার ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোনো শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গালা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। বঙ্গ-সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না।’ (দ্র. শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন, বঙ্গভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব)

প্রাচীন বাংলার উৎস-স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ চর্যাপদকে চিহ্নিত করেছেন। এই চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়াদের মধ্যেই বন্দীদশায় ছিল, তাকে বাংলা ভাষা বলাও দুরূহ। বাংলা ভাষায় যখন থেকে আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ ভাষার তাগিদেই ব্যবহৃত হতে লাগল তখন থেকে এ ভাষা প্রাঞ্জল ও প্রাণবন্ত ভাষা হিসেবে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে লাগল। মুসলিম শাসনে এসে তা প্রাণচাঞ্চল্যে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। ডক্টর আহমদ শরীফ মধ্যযুগের সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, তুর্কি আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাংলা লেখ্য শালীন সাহিত্যের বাহন হলো।

এখানে উল্লেখ্য যে, ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির পর থেকে আরবের বাইরের ভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয়, যার ব্যাপকতা সঞ্চারিত হয় ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে বিদায় হজের পরবর্তীকালে। ওই সময় চীন-সুমাত্রাগামী আরব বাণিজ্য নৌজাহাজে করে প্রচুর পা-িত্যের অধিকারী কোনো কোনো সাহাবি বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে সফর বিরতি দিয়ে এখানে ইসলাম প্রচার করেন। তাঁরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেননি। তাঁদের কারও কারও মাযার শরীফ এখনো চীনের ক্যান্টন নগরীর ‘ম্যাসেঞ্জার মসজিদ’ প্রাঙ্গণে রয়েছে। অ্যানসেসটরস গ্রেভইয়ার্ড নামে তা পরিচিত।

বাংলাদেশে ব্যাপকহারে ইসলাম প্রচার শুরু হয় দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাযি.)-এর খিলাফতকালের মধ্যভাগ নাগাদ অর্থাৎ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। তারপর থেকে এখানে দলে দলে আরব, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, মিসর, ইয়েমেন, খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ইসলাম প্রচারকের আগমন ঘটে। তাঁরা বাংলাদেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে ইসলাম প্রচার করেন। এসব প্রচারক বাংলাদেশের মানুষের ভাষা শিখে সেই ভাষাতেই ইসলামের শিক্ষা, সৌকর্য সবার সামনে তুলে ধরেন। তখন থেকেই আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ বাংলা ভাষায় আত্তীভূত হয়ে এদেশের মানুষের মুখের ভাষার অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষা প্রকৃত অবয়ব লাভ করে এরই ফলে।

বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয় ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে। মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার আগে এখানে যেসব রাজার শাসন ছিল তারা বাংলা ভাষাকে নিষিদ্ধ ভাষা করে দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, অষ্টাদশ পুরাণাদি রামস্য চরিতানিচ/ভাষায়াং মানব : শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ-অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ, রামচরিত ইত্যাদি মানব ভাষায় (বাংলা) চর্চা করলে রৌরব নরকে যেতে হবে।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতেই (১২০১ খি.) বাংলাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার সুদূরপ্রসারী দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার আস্বাদনেও নিজেদের অভিষিক্ত করতে সমর্থ হন। বাংলার মুসলিম শাসকগণ বাংলার মানুষের খাদিম বা সেবক হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এসব শাসক সুলতান অভিধায় অভিহিত ছিলেন, তারা শাহে বাঙ্গালা, সুলতানে বাঙ্গালা খিতাবে ভূষিত ছিলেন এবং এ দেশের মানুষের জাতীয় পরিচয় ছিল বাঙ্গালিয়ান। এটাই সত্যি যে, স্বাধীন বাঙ্গালা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানি আমলেই।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আজকে যে সুবিস্তৃত দিগন্তব্যাপী ঔজ্জ্বল্য, এই যে জগৎজোড়া খ্যাতি ও সমৃদ্ধি-সৌরভে সমুজ্জ্বল তার স্থপতি নির্ণয়ে আমাদের যেতেই হয় বাংলার সুলতানি আমলে। আর সেই সুলতানি আমলই হচ্ছে বাংলার সোনালি যুগ। সে যুগে যেমন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সোনালি ছিল, তেমনি সামাজিক উন্নতির দিক দিয়েও সোনালি যুগ ছিল, শান্তি ও সমৃদ্ধির দিক দিয়েও সোনালি যুগ ছিল, শিক্ষা-দীক্ষার দিক দিয়েও যেমন সোনালি যুগ ছিল তেমনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেরও সোনালি যুগ ছিল। বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় সুলতানগণ বাংলার সব ধর্মের মানুষকে সমানভাবে উদ্বুদ্ধ ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণগণ বাংলা ভাষা চর্চার প্রবল স্রাতেকে রোধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় কূত্তিবাস রামায়ণ এবং কালিদাস মহাভারত অনুবাদ করলে ব্রাহ্মণ প-িতরা তাদের রৌরব নরকের অধিবাসী বলেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা একটি বচন বানিয়ে জনগণের মধ্যে তা ছড়িয়েও দেয়। আর তা হচ্ছে, কৃত্তিবেশে কালীদেসে আর বামুন ঘেঁষে/এই তিন সর্বনেশে।

মুসলিম লেখকগণ বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে পুঁথি সাহিত্যের বিরাট আঙিনা নির্মাণ করেন। সুলতান ইউসুফ শাহের দরবারে কবি জৈনুদ্দীন এবং শাহ বিরিদ খান পৃথক পৃথক রসূল বিজয় কাব্য রচনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে সৈয়দ সুলতান বাংলা ভাষায় মহাকাব্য রচনার সূত্রপাত ঘটান।

ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, সৈয়দ সুলতানের নবী বংশ নামক পুঁথিখানি হচ্ছে বাংলা মহাকাব্যের মহান আদর্শ। সৈয়দ সুলতান সূরা ইবরাহীমের ৪ নম্বর আয়াতে করীমার আলোকে বলেন,

আল্লায় কহিছে মোরে দেশের যে ভাব

সে দেশে সে ভাষে কৈলুম রছুল প্রকাশ

এক ভাষে পয়গম্বর আর ভাষে নর না পারিব বুঝিবারে উত্তর

সদুত্তর

যথেক রছুল নবী পয়গম্বর হৈছে

উম্মতের যে ভাষা সে ভাষে সৃজিয়াছে॥

সুলতানি আমলের প্রায় সব সুলতানই বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিশেষ করে সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। কবীন্দ্র পরমেশ্বর সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন,

কলিযুগ অবতার গুণের আধার

পৃথিবী ভরিয়া যাঁর যশের প্রসার॥

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হাজী শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ যে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করেন তা স্বাধীন ইলিয়াস শাহী সালতানাত নামে দীর্ঘ ২০০ বছরের অধিককাল স্থায়ী ছিল। এই সময়কালে বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক বিস্তার ঘটে। বাংলা সাহিত্যের এই বিস্তারের নব নব অধ্যায় পরবর্তীকালেও নির্মিত হয়। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ বলতে যে সময়কালকে বোঝানো হয় মূলত সেটাই হচ্ছে বাংলার সুলতানগণের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্য নির্মাণের যুগ। আর সেটাই হচ্ছে বাংলা ভাষার আলোকিত যুগ। সপ্তদশ শতাব্দীতে কবি আবদুল হাকিম, সৈয়দ আলাওলসহ বহু কবি অবদান রেখেছেন। কবি আবদুল হাকিম বাংলা ভাষার কদর সমুন্নত করতে গিয়ে লিখেছেন,

যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি

দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে নযুয়ায়

নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশে ন যায়।

সেকালের অন্যান্য কবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ হামজা, শেখ ফয়জুল্লাহ, শেখ চান্দ, দোভাষী পুঁথির উদ্ভাবক শাহ গরীবুল্লাহ প্রমুখ। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যখন বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায় তখন শাহ গরীবুল্লাহর বয়স ২৪ বছর। তার রচিত ছহি জৈগুন নামক পুঁথিতে তিনি বলেন,

আল্লাহকে একিন জান হইয়া মমিন

খুশিতে কবুল কর মোহাম্মদী দীন।

পলাশীর যুদ্ধের পর এদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুসলিমদের দমন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচশ বছর ধরে গড়ে ওঠা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাঞ্জলতার টুঁটি চেপে ধরে তাকে কটমটে ও দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দ যোগ করে কঠিন ভাষায় পরিণত করে। এ সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘যদি পলাশী ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানের ভাগ্য বিপর্যয় না ঘটিত, তবে হয়তো এই পুঁথির ভাষাই বাংলার হিন্দু মুসলমানের পুস্তকের ভাষা হইত।’ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে দুর্বার স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় এই নতুন দুর্বোধ্য সংস্কৃত বহুল বাংলায় মুসলিমগণ বাংলা সাহিত্য চর্চায় অনেকটা অমনোযোগী থাকে।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি-জনতার মহাবিপ্লবের পরে নতুন করে তারা আবার কলম ধরে। ওই শতাব্দীর আশির দশকে ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব কেবলা মুজাদ্দিদে যামানা মওলানা আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) বাংলায় সাহিত্য চর্চায় জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। তখন থেকেই নব উদ্যমে সাহিত্য চর্চায় লিপ্ত হন মুসলিম কবি-সাহিত্যিকগণ যাদের তালিকা সুদীর্ঘ। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম প্রামাণ্য বিস্তারিত ও মৌলিক তাসাউ গ্রন্থ ইরশাদে খালিকিয়া বা খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব। এ গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন যশোরের খড়কীর পীর মাওলানা শাহ মোহাম্মদ আবদুল করীম (রহ.)। ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল থেকেই মুসলিম কবি-সাহিত্যিক লেখকদের মধ্যে বিপুল উদ্যমের সৃষ্টি হয় কায়কোবাদ, মীর মশাররফ হোসেন, মুন্সী রিয়াজউদ্দীন আহমদ, রিয়াজউদ্দীন মাশহাদী, মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শেখ আবদুর রহীম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এয়াকুব আলী চৌধুরী, কাজী আবদুল ওদুদ, ড. লুৎফর রহমান, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, কাজী ইমদাদুল হক, নজিবর রহমান, কবি গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদসহ আরও অনেকে বাংলা সাহিত্যের নব নব অধ্যায় সৃষ্টি করেন। কাজী নজরুল ইসলাম বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে আবির্ভূত হয়ে বাংলা কাব্যে রীতিমতো বৈপ্লবিক অবদান রাখেন। রবীন্দ্র সুদৃঢ় বলয় ভেদ করে তিনি আর এক মজবুত বলয় সৃষ্টি করেন। যে বাংলা ভাষা মুসলিম আগমনের পূর্বে নিদারুণ অবহেলিত অবস্থায় ছিল, যে বাংলা ভাষা চর্চা করলে রৌরব নামক নরকে যাওয়ার ভয় দেখানো হতো, সেই বাংলা ভাষা মুসলিম সুলতানগণের একান্ত পৃষ্ঠপোষকতায় শাহী সম্মান লাভ করেছিল, তাকে আবার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অধিষ্ঠিত করার জন্য উনিশশো বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারিতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিক, সালাম প্রমুখ তরতাজা প্রাণ নিজেদের রক্ত ঝরিয়ে জান কোরবান করে দিয়ে বিশ্বমানব সভ্যতার ইতিহাসে মাতৃভাষার মর্যাদার নবঅধ্যায় রচিত করলেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা কায়েম হলো। আর সেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে সজ্ঞাত চেতনার রাজপথ ধরে ১৯৭১-এর দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করল। বাংলা ভাষার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে রক্ত ঝরেছিল তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এবং পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ও জাতির মধ্যে মাতৃভাষাপ্রীতি সঞ্চারিত করার জন্য অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে। এসবই বাংলা ভাষায় মুসলিম অবদানের ফসল।

এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে বাংলাভাষী জনসংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি, যার মধ্যে মুসলিম হচ্ছে ২৫ কোটি সে নিরিখে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

সূত্র:

  আল-কুরআন, সুরা আর-রহমান, ৫৫:৩-৪

  আল-কুরআন, সুরা ইবরাহীম, ১৪:৪

  আল-কুরআন, সুরা আর-রূম, ৩০:২২

লেখক : মুফাসসিরে কুরআন, গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

(মাসিক আত তাওহীদ, নভেম্বর ২০১৭)

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ