হাফেয মুহাম্মদ জাফর সাদেক
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক কুতবে যামান আল্লামা শাহ মুফতী আযীযুল হক (রহ.) এর জ্যেষ্ঠ পুত্র চন্দনাইশ থানার ঐতিহ্যবাহী ইসলামী বিদ্যাপীঠ দোহাজারী আযীযিয়া কাসেমুল উলূম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম, যুগের স্বীকৃত সাধক শাহ হাফেয মাওলানা মাহবুবুর রহমান (রহ.) দীর্ঘ ৫ বছর যাবৎ অচেতন ও অজ্ঞানাবস্থায় শয্যাশায়ী থেকে বিগত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইংরেজি মোতাবেক ৬ মুহাররম ১৪৩৯ হিজরী বুধবার বিকাল ২ ঘটিকার সময় মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। ওইদিন রাত ১০ ঘটিকার সময় জামিয়া পটিয়ার মসজিদসংলগ্ন মাঠে তাঁর নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। নামাযে জানাযার ইমামতি করেন চট্টগ্রাম জামিয়া দারুল মা‘আরিফের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, বিশিষ্ট আরবী সাহিত্যিক, ইত্তিহাদুল মাদারিসিল আহলিয়া বাংলাদেশের সভাপতি আল্লামা সুলতান যওক নদভী সাহেব হুযূর। বৃষ্টি বর্ষণের মাঝে, অল্প সময়ে নামাযে জানাযার আয়োজন করা সত্ত্বেও অজস্র ভক্ত-অনুরক্ত, ছাত্র-শিক্ষক ও ওলামা-মাশায়েখের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। আরো অনেকেই যানজটের কারণে নামাযে শরীক হতে পারেন নি। এই অসময়ে অনুষ্ঠিত তাঁর নামাযে জানাযায় তাওহীদী জনতার স্রোত ও তাঁর জনপ্রিয়তা দেখে উপস্থিত লোকেরা নির্বাক ও অবাক হয়ে যান। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি একজন কামিল বুযুর্গ ও নিভৃতচারী মুখলিস সাধক ছিলেন।
উল্লেখ্য মুসলমানের জিন্দেগির কামিয়াবির প্রথম কথা হলো ইখলাছ ও লিল্লাহিয়াত। বড় বড় বুযুর্গানে দীন, ইমাম ও মুজতাহিদীন এবং জ্ঞানসাধক ও যুগসংস্কারক, পৃথিবীতে যারা অমর হয়েছে, যদি তাঁদের জীবন চরিত অধ্যয়ন করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, ইখলাসই ছিলো তাদের জীবন বিনির্মাণের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। লিল্লাহিয়াত ও আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদনই তাঁদের প্রতিটি কর্ম ও কীর্তিকে এমন অমরত্ব দান করেছে। শাহ হাফেয মাওলানা মাহবুবুর রহমান (রহ.) ছিলেন তাঁদের মত আল্লাহ প্রেমিক একজন মুখলিছ আলিমে দীন, যিনি স্বীয় জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে উত্তম আদর্শের মূর্তপ্রতিক রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুসরণে ছিলেন অবিচল। প্রতিটি কাজে ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত এবং জীবনের আঁকে বাঁকে প্রিয় নবীর সুন্নাতের পাবন্দী ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ন্যায় ও হকের ওপর অটল থাকা এবং অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা তাঁর অন্যতম চরিত্র। আজীবন এ নীতির ওপর ইস্পাত কঠিন স্থির ছিলেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
আকাবির বুযুর্গদের থেকে বর্র্ণিত, আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা তাকে ওলী বা বুযুর্গ রূপে গড়ে তুলেন। যে বংশেরই হোক না কেন? কিন্তু গাউস, কুতুব ও আবদাল বানাতে চাইলে উচুঁ ও ঐতিহ্যবাহী বংশের কাউকে ঐ গুণে গুণান্বিত করেন। যেমন: সৈয়দ, সিদ্দীকী ও ফারুকী বংশ থেকেই গাউস, কুতুব ও আবদাল তৈরী করেন। তাই শাহ মুফতী আযীযুল হক (রহ.) ছিলেন কুতুবুল আকতাব, যেহেতু তিনি সিদ্দিকী বংশের সূর্য সন্তান। যেমন তিনি এক বার জনৈক লেখককে পত্রের মাধ্যমে তাঁর বংশ সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন যে, আমি বংশ হিসেবে সিদ্দীকী, আমরা আদিকাল থেকেই শায়খ সিদ্দকী হিসেবে খ্যাত।
হাফেয মাহবুবুর রহমান (রহ.)-এর বংশ পরিক্রমা হলো, মাহবুবুর রহমান ইবনে আযীযুল হক ইবনে নুর আহমদ ইবনে মুন্সী সুরত আলী ইবনে মুন্সী রমজান আলী ইবনে মুন্সী আবুল হাসান। তিনি ১৩৬০ হিজরী মোতাবেক ১৯৩৮ ইংরেজিতে জন্ম লাভ করেন।
শিক্ষা-দীক্ষা
হাফেয মাওলানা মাহবুবুর রহমান (রহ.) যখন ছয় বছর বয়সে উপনীত হয় তখন তার পিতা মুফতী আযীযুল হক (রহ.) জামিয়া পটিয়ার হিফজ বিভাগে হাফেয মাওলানা নুরুল হক (রহ.) এর তত্তা¡বধানে ভর্তি করিয়ে দেন। তথায় দীনী ইসলামের সর্বপ্রথম কিতাব নুরাণী কায়দা থেকে শুরু করে দীর্ঘ ৫ বছরে কুরআন মজীদের হেফয সমাপ্ত করেন। অর্থাৎ ১৯৪৪ ইংরেজি সালে ভর্তি হয়ে ১৯৪৯ সালে হিফযে কালামুল্লাহ শরীফ সমাপ্ত করেন। অতঃপর জামায়াতে ইয়াযদাহুমে ভর্তি হয়ে জামায়াতে পঞ্জুম পর্যন্ত খুব মনযোগ সহকারে দীনী ইলম হাসিল করেন। এরপর তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার নির্দেশে জিরি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে জামায়াতে ছাহারুম পড়েন। আবার পটিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে জামায়াতে ছাওম থেকে তাকমীল তথা দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন এবং বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
কর্মজীবন
শিক্ষা জীবন শেষ করার পর পরই হযরত মাওলানা মাহবুবুর রহমান (রহ.) স্বীয় জ্ঞান মাতৃক্রোড় জামিয়া পটিয়ার শিক্ষকতার সম্মানিত পদে নিযুক্ত হন। দীর্ঘ তিন বছর যাবৎ অত্যন্ত সুচারুরূপে পাঠদান করার পর এ মুখলিস সাধক পুরুষ স্বেচ্ছায় শিক্ষকতার পদ থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। অতঃপর কিছুদিন নিজ বাড়িতে অবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগি ও রিয়াযত-মুজাহাদায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। মুরব্বীদের সাথে বরাবরই যোগাযোগ ও তাদের সাথে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য পরামর্শ করেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন ডায়েরী মোতাবেক তিনি খাস ভাবে তৎকালীন জিরি মাদরাসার প্রধান মুহাদ্দিস আল্লামা আবদুল ওয়াদুদ (রহ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর স্বীয় পরিকল্পনা ও মনের ভাব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার মন চায় সকালে কোন ফোরকানিয়া বা মকতবে খেদমত করে বাকি সময় ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাই। এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ, অনুমতি ও দোয়ার জন্য এসেছি।’ তিনি তাঁকে কোন মাদরাসায় খেদমত করার পরামর্শ দিলেন। অনুরূপ পরামর্শ চেয়ে তিনি শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া (রহ.)-এর কাছেও পত্র প্রেরণ করেন। তিনি পরামর্শ দিলেন, দীনী খেদমতের জন্য পটিয়া মাদরাসায় থাকা তো জরুরী নয়। যে কোন দীনী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করলেই দীনী খেদমত আদায় হবে।
আধ্যাত্ম্য সাধনা
তাঁর রেখে যাওয়া সংক্ষিপ্ত জীবন ডায়েরীতে উল্লেখ আছে, তিনি নিজেই বলেন, ১৯৫৪ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি পীরে তরীকত আল্লামা আবদুল কাদের রায়পুরী (রহ.) বাংলাদেশে আগমন করেন। তখন আমার শ্রদ্ধেয় পিতা তাঁকে পটিয়া মাদরাসায় দাওয়াত করেন। হযরত চারজন সফরসঙ্গী নিয়ে পটিয়া মাদরাসায় তাশরীফ আনেন। তখন আমি জামায়াতে হাস্তুমের ছাত্র। আব্বা হযরতের এক সঙ্গীকে আমার কাছে পাঠিয়ে বলেন, মাহবুবকে হযরত রায়পুরীর নিকট বায়আত গ্রহণ করতে বলুন, লোকটি আমাকে ওই সুসংবাদ বলার পর আমি বললাম, আমি তো ছোট ছেলে, আমি কি এ বয়সে বায়আতের আহকাম আদায় করতে পারবো?। আব্বা আমার একথা শুনার পর ওই লোকটির মাধ্যমে আমার কাছে খবর পাঠান যে, সে (মাহবুব) আমার ছেলে আমি তার পিতা। সুতরাং পিতাই ভালো জানে সন্তানের কল্যাণ কোন পথে, কোন কাজে, কিভাবে হয়। আব্বার এ কথাগুলো শুনার পর আমি কোন ওযর ছাড়াই বায়আতের জন্য রাজি হয়ে যাই।
উল্লেখ্য, আবদুল কাদের রায়পুরী (রহ.) ছিলেন আল্লামা শাহ আবদুর রহিম রায়পুরী (রহ.)এর খলীফা, তিনি হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.)-এর খলীফা। আল্লামা আবদুল কাদের রায়পুরী (রহ.)-এর ইন্তিকালের পর শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া (রহ.)-এর কাছে বায়আত রুজু করেন। শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া (রহ.)-এর ইন্তিকালের পর শাহ আলী আহমদ বোয়ালভী (রহ.) এর কাছে বায়আত গ্রহণ করেন। হাফেয মাহবুবুর রহমান (রহ.) নিজেই বর্ণনা করেন যে, ‘আমার ছাত্রজীবনে একদিন আমার আব্বা আমার হাত ধরে হযরত বোয়ালভী সাহেব হুজুরের দিকে ইশারা করে বলেন, ঐ লোকটিকে তুমি কি চিন? তখন আমি বললাম হ্যাঁ চিনি তো, তিনি আলী আহমদ সাহেব হুযুর (তৎকালে তিনি আলী আহমদ সাহেব হুযুর হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন) তখন আব্বাজান আমাকে বললেন, মাহবুব তিনি শুধু আলী আহমদ সাহেব হুযুর নয়, বরং তিনি একজন আল্লাহর ওলী। তুমি তাঁর সাথে সম্পর্ক করার জন্য চেষ্টা করবে। এরপর থেকে আমি হযরত বোয়ালভী সাহেব হুযুর এর সাথে সম্পর্ক করার জন্য সদা তৎপর থাকতাম। অবশেষে ১৪১৫ বা ১৬ হিজরী সালে হযরত বোয়ালভী সা. হুযুর হাফেয মাহবুব (রহ.)-কে চার তরীকায় খেলাফত দান করেন।
বস্তুত অলিই অলিকে চিনে। এ প্রসংগে ফারসি ভাষায় একটি চমৎকার প্রবাদ বাক্য আছে যে, অলিরা অলি মি সেনাছদ অর্থাৎ অলিই অলির পরিচয় পায়।
তাকওয়া-পরহেযগারী
বলাবাহুল্য, হযরত হাফেয মাওলানা মাহবুবুর রহমান (রহ.) তা’লীম-তরবিয়তের মৌলিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তাঁর যোগ্য পিতা কুতবে যামান আল্লামা মুফতী আযীযুল হক (রহ.)-এর কাছে। যৌবন কালের প্রায় সময় অতিবাহিত হয়েছে তাঁর পিতার তত্ত্বাবধানে। তাই তিনি শৈশবকাল থেকেই একজন দীক্ষাপ্রাপ্ত খোদাভীরু আলিম হিসেবে সুপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছেন। তিনি যখন জামায়াতে শশুমে পড়েন তখন তাঁর আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়লে মুফতী সাহেব (রহ.) তাঁর নেকাহের ব্যবস্থা করেন। নেকাহের এক বছর পর তাঁর একটি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে তাঁর পিতা বেশ আনন্দিত হন। এমনকি তিনি একটি গরু যবেহ করে আকীকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কুদরতের ফয়সালা যে, মেয়েটি দেড় বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
হযরত মাহবুব সাহেব (রহ.) নিজেই বনর্ণা করেছেন যে, ষোল বছর বয়সে আমি যেদিন স্বীয় মুরশিদের কাছে ইলমে মারেফাতের দরস গ্রহণ করি সেদিন থেকেই আজ পর্যন্ত কোনদিন আমার তাহাজ্জুদের নামায কাজা হয়নি। এমনকি আমার দাম্পত্য জীবনের প্রথম রাতেও তাহাজ্জুদ কাযা হয়নি। সে রাতেও আব্বাজান আমাকে তাহাজ্জুদ নামাযের সময় ডাক দিয়ে বলেন, মাহবুব উঠ উঠ। তাহাজ্জুদ নামাযের সময় হয়েছে। তথাপি সেদিন বাদে ফজর মসজিদে তিনি ডাক দিয়ে জানতে চাইলেন মাহবুব মসজিদে এসেছে? আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে বললাম, আমি মসজিদে এসেছি।
সম্ভবত হাফেয মাহবুব সাহেব (রহ.) তাহাজ্জুদ নামাযসহ ইশরাক, আওয়াবীন ও চাশতের নামাযও কখনো ইচ্ছাকৃত ভাবে ত্যাগ করতেন না। আর কুরআন তেলাওয়াত ও নফল ইবাদত তো তাঁর মজ্জাগত অভ্যাসেই পরিণত হয়ে ছিল।
তাঁর তাকওয়া-পরহেযগারীমূলক বিস্ময়কর ঘটনা শুনলে আমাদের পূর্ব পুরুষ আকাবিরদের তাকওয়া-পরহেযগারীর স্মৃতি মনে পড়ে। যেমন ফকীহুননাফস আল্লামা রশীদ আহমদ গঙ্গুহী, আল্লামা আহমদ আলী সাহারানপুরী, দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার সাবেক মুহতামিম মাওলানা মুনীর আহমদ (রহ.) প্রমুখের জীবন চরিত অধ্যয়ন করলে প্রতীয়মান হয় যে, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের আল্লাহ ভীতি ও অধিক সর্তকতামূলক আচার আচরণ সত্যিই পরবর্তী জেনারেশনের জন্য আদর্শ।
হাফেয মাহবুব (রহ.) তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শিক্ষা নিকেতন দোহাজারী মাদরাসার জন্য ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর চাঁদা গ্রহণ করতেন না, যেহেতু তাদের আয়-রোযগারে সুদের সংমিশ্রণের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে, অনুরূপ কোন এয়াতীমের সম্পদ থেকে চাঁদা গ্রহণ করতেন না।
তিনি কখনো মাদরাসার আর্থিক স্বচ্ছলতার উদ্দেশ্যে বিদেশের চাঁদার প্রতি লালায়িত ছিলেন না। অথচ দোহাজারী মাদরাসার আর্থিক অভাব-অনটন সকলের কাছে প্রসিদ্ধ। কেউ তাঁকে বিদেশ যাবার ব্যাপারে পরামর্শ দিলে তিনি মসজিদে সকলের সামনে নির্দ্বিধায় বলতেন, যে আল্লাহ আরব দেশে বান্দাকে অর্থ দিতে পারেন সে আল্লাহ আমাদেরকে দেশেও অর্থ দিতে পারেন, তবে শর্ত হলো, আল্লাহকে ভয় করে দীনের কাজ যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে হবে এবং আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ভরসা করতে হবে। এতে বুঝা যায়, আল্লাহর ওপর পূর্ণ তাওক্কুল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
লেনদেনের ব্যাপারেও তিনি বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তিনি প্রায় সময় দোহাজারী মাদরাসার মসজিদে বলতেন যে, আমার জামায় দুটি পকেট নির্ধারণ করেছি, বাম পকেট মাদরাসার চাঁদার জন্য এবং ডান পকেটটি আমার ব্যক্তিগত টাকা রাখার জন্য। ব্যক্তিগত টাকার জন্য ডান পকেট নির্ধারণ করার কারণ হলো, মানুষের হাত সাধারণত ডান পকেটে রাখা হয় এবং ব্যক্তিগত খরচ তা থেকে করা হয় । টাকা খরচ করার ক্ষেত্রে ভুলেও যাতে মাদরাসার টাকা খরচ করতে না হয় এবং এর কারণে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিও করতে না হয়। এজন্য বাম পকেটটিই মাদরাসার চাঁদার জন্য নির্ধারণ করেছি। অনুরূপ আরও বহু ঘটনা বর্ণিত আছে, তিনি সদা প্রিয় নবী (সা.)-এর নিম্নল্লিখিত হাদীসের ওপর আমল করতেন,
الْـحَلَالُ بَيِّنٌ وَالْـحَرَامُ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ.
অর্থাৎ হালাল হারাম স্পষ্ট। এছাড়া বাকী যা রয়েছে তা হালাল-হারামের ক্ষেত্রে সন্দেহযুক্ত তথা এর হুকুম অস্পষ্ট (মেশকাত শরীফ, ১/২৪৯)।
তিনি স্বীয় পিতার আদর্শ অনুসরণ করত কোন শরীকী পুকুরের মাছ খেতেন না। অর্থাৎ কোন খাবারের দাওয়াতে তাঁর সামনে মাছ দিলে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, এটা কি শরীকী পুকুরের মাছ? শরীকী পুকুরের মাছ বললে তিনি তা থেকে বিরত থাকতেন।
মোটকথা, জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে তিনি পূর্ব পুরুষ মনীষীদের প্রতিচ্ছবি ছিলেন। তিনি আট বছর আগে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে, উন্নত চিকিৎসা-সেবার মাধ্যমে তিন বছর যাবৎ মোটামোটি চলা ফেরা করলেও অবশেষে দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবৎ অচেতন অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। তাঁর এ অবস্থাটা ব্যতিক্রম ও অস্বাভাবিক এবং সাধারণ মানুষের বিবেক-বুদ্ধির উর্ধে। যেহেতু প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তা’আলার হিকমতের সামনে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি অচল ও পরাজিত। তথাপি আল্লাহর অলি-বুযর্গগণ তাঁদের অন্তর দৃষ্টি দিয়ে এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করেন, যেমন একবার হযরত শাহ মাওলানা ইসহাক সাহেব (রহ.) (হ্নীলার সদর সাহেব হুযূর ও অন্যতম খলীফা, হযরত মুফতী আযীযুল হক (রহ.)) ২০১৩ সালে জামিয়া পটিয়ার বার্ষিক সভায় তাশরীফ আনেন। মাহফিলের পরের দিন তিনি হাফেয মাহবুব সাহেব হুযুরকে দেখতে গেলেন। সদর সাহেব (রহ.) তাঁকে দেখতেই তাঁর উঁচু মাকাম সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, মাহবুবকে আল্লাহ তাআলা বেহেস্তের যে উচ্চ স্থান দান করেছেন তা তার আমল দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ তা’আলা তাঁকে সে উঁচু স্থান প্রদান করার জন্য এই দীর্ঘ অসুস্থতা ও অচেতনতার মাধ্যমে গঠন করে নিচ্ছেন এবং এটি প্রিয় নবীর হাদীসের ভাষ্য।
পরিশেষে শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া (রহ.) কর্তৃক রচিত কবিতার একটি পংক্তি উল্লেখ করে লেখার ইতি টানছি, এ ধরনের মুখলিস বুযুর্গরাই যার বাস্তব দৃষ্টান্ত।
انہیں کے اتقاء پر ناز کرتی ہے مسلمانی
অর্থাৎ তাদেরই তাকওয়া ও খোদা ভীতি নিয়ে ইসলাম ও মুসলমানগণ গর্ববোধ করে থাকে।
আল্লাহ! হাফেয মাহবুবুর রহমান (রহ.)-এর সকল খেদমত কবুল করুন, তাঁর জীবনের ভুল-ত্রুটিগুলো মাফ করে তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকামে সমাসীন করুন,তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবার পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে সান্তনা দান করুন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ে আযীযিয়া কাসেমুল উলুমকে উত্তরোত্তর উন্নতি দান করুন। আমীন।
লেখক: শিক্ষক-আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম, সহকারী সম্পাদক, বালাগুশশারক (আরবী-ইংরেজী ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন), সম্পাদক, নবোদয় (বার্ষিক সীরাত প্রতিযোগিতা স্মারক, জামিয়া পটিয়া)
(মাসিক আত তাওহীদ, নভেম্বর ২০১৭)