রবিবার-১৬ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি-৯ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ওয়াকফ : এক হারানো ঐতিহ্যের সন্ধানে

ইসামুদ্দীন মাহমুদ

ইসলামে ওয়াকফ একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় স্থায়ীভাবে দান করে দেন। এটি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় কল্যাণ অর্জনের একটি উত্তম উপায়। ওয়াকফ শুধু ইবাদতের মাধ্যম নয়, বরং সমাজের দরিদ্র, অসহায় ও শিক্ষার্থীদের সহায়তায়ও এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রাচীনকাল থেকেই মুসলিম সমাজে ওয়াকফ ছিল শিক্ষা, চিকিৎসা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের এক শক্তিশালী ভিত্তি। এই প্রবন্ধে ওয়াকফের ধারণা, এর শরঈ বিধান, ইতিহাস, কার্যকারিতা এবং বর্তমান সময়ে এর প্রয়োগ ও চ্যালেঞ্জসমূহ ধারাবাহিকভাবে আলোচিত হবে।

ওয়াকফের সংজ্ঞা: ‘ওয়াকফ’ একটি আরবী শব্দ। অর্থ হলো ‘রোধ করা’ বা ‘বন্ধ করা’। এজন্য কিয়ামতের মাঠকে ‘موقف’ বলা হয়, কারণ সেখানে মানুষদের বিচার-হিসাবের জন্য দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। আল্লামা জুবাইদী (রহ.) বলেন: وقف الدار على المساكين كما في العياب وفي الصحاح للمساكين إذا حبسه যখন কোনো বাড়িকে দান করে দিয়ে দরিদ্রদের জন্য বিশেষ করে দেওয়া হয়, তখন তাকে ‘ওয়াকফুদ্দার আলাল মাসাকীন’ বলা হয়।
ওয়াকফের পরিভাষাগত সংজ্ঞা: বড় বড় ইসলামী ফকীহরা (আইনবিদরা) ওয়াকফের অনেক ধরনের সংজ্ঞা দিয়েছেন۔ তাদের মাঝে কিছু মতপার্থক্যও আছে। যেমন:
ওয়াকফ একবার করলে তা চির¯’ায়ী হয় কিনা?
ওয়াকফ করার পর সেই জিনিসের মালিক কে থাকে?
ওয়াকফ মানে তামলীক তথা সম্পদের কাউকে মালিক বানিয়ে দেয়া , নাকি ইসকাত তথা শুধু নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া। এসব মৌলিক বিষয়ে পরে আমরা ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত আলোচনা করব। এখানে ফকীহদের বর্ণনাকৃত সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো:
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে ওয়াকফের সংজ্ঞা: حبس العين على ملك الواقف والتصدق بالمنفعة তিনি বলেন: কোনো ব¯‘ নিজের মালিকানায় রেখে তার منفعة তথা মূল ব¯‘র লভ্যাংশকে দান করে দেওয়া। এই সংজ্ঞার ফলাফল হল: ওয়াকফের পরও জিনিসটি ওয়াকফদাতার মালিকানায় থাকে, কিš‘ মূল ব¯‘র লভ্যাংশ দান করা বাধ্যতামূলক হয়।
সাহেবাইন (ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ রহ.)-এর মতে ওয়াকফের সংজ্ঞা: حبس العين على حكم ملك الله تعالى على وجه تعود منفعته إلى العباد তাঁরা বলেন: কোনো জিনিসকে আল্লাহ তাআলার নামে এভাবে বিশেষ করে দেওয়া, যাতে তার উপকার সাধারণ মানুষের কাজে লাগে। তাঁদের মতে, ওয়াকফের পর সেই জিনিস আল্লাহর মালিকানায় চলে যায়।
শাফেয়ী মাযহাব মতে ওয়াকফের সংজ্ঞা: حبس مال يمكن الانتفاع به مع بقاء عينه بقطع التصرف في رقبته وتصرف منافعه إلى البر تقرباً إلى الله تعالى আল্লামা মুনাওয়ী (রহ.) ইমাম নববী (রহ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: ব্যবহারযোগ্য সম্পদ যা নষ্ট হয় না, সেটিকে আল্লাহর সš‘ষ্টির জন্য বিশেষ করে দেওয়া। তবে তার লভ্যাংশ বা আয় শুধু ভালো কাজে খরচ করা যাবে। শাফেয়ীদের বর্ণনাকৃত সংজ্ঞাটি সাহেবাইনদের মতের কাছাকাছি।
মালিকী মাযহাবের মতে ওয়াকফের সংজ্ঞা: وهو (الوقف) جعل منفعة مملوك ولو بأجرة أو غلته لمستحق بصيغة مدة ما يراه المحبس আল্লামা দারদির (রহ.) বলেন: ব্যক্তিগত কোনো সম্পত্তির আয় বা লভ্যাংশকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো প্রাপকের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া। তাছাড়া মেয়াদ নির্ধারনীর ইখতিয়ার ওয়াকফকারীর হাতে থাকবে। মালিকী মাযহাবের মতে, ওয়াকফ চির¯’ায়ী হওয়া বাধ্যতামূলক নয়; নির্দিষ্ট সময়ের জন্যও ওয়াকফ করা যায়।
হাম্বলী মাযহাবের মতে ওয়াকফের সংজ্ঞা: تحبيس الأصل وتسبيل الثمرة আল্লামা ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন: মূল ব¯‘টিকে ধরে রেখে এর উপকার (ফল-আয়) গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা। এই সংজ্ঞা সরাসরি হাদীসের ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে। নবী কারিম ﷺ হযরত উমর (রা.)-কে বলেছিলেন: “মূল জিনিসটি আটকে রাখো এবং তার ফল সদকা করো।”
সর্বোত্তম (নির্ভরযোগ্য) সংজ্ঞা: উল্লেখিত সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে হাম্বলী মাযহাবের সংজ্ঞা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে হয়, কারণ: (১) এটি সরাসরি হাদীসের শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। (২) এখানে ওয়াকফের হাকীকত তথা মূল প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কেবল আহকাম তথা বিধিবিধান নিয়ে আলোচনা করা হয়নি।
নির্ভরযোগ্য সংজ্ঞার খোলাসা: কেউ নিজের মালিকানাধীন কোনো জিনিসের মূল অংশ ব্যবহার করবে না এবং সেটিকে সংরক্ষণ করবে। তবে তার লাভ বা আয় কোনো ভালো কাজে ব্যয় করবে। যেমন: কেউ একটি বাড়ি ওয়াকফ করল, বাড়িটি ঠিকঠাক থাকবে, তবে এর ভাড়া বা ব্যবহার গরিবদের বা অন্য ভালো কাজে লাগানো হবে।

ওয়াকফের বিধিবদ্ধতা:
আলেমদের মতে, ওয়াকফ বৈধ এবং প্রায় সকল ফকীহ এর বৈধতার ওপর একমত। তবে এর কিছু উপধারায় মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম তিরমিজী (রহ.) বলেন: “আমরা জানি না যে, সাহাবায়ে কিরাম বা পূর্ববর্তী আলেমদের মধ্যে ভূমির ওয়াকফের বৈধতার ব্যাপারে কোনো মতভেদ ছিল।”
কাজী শুরাইহ এবং ইমাম শাবী ওয়াকফের বৈধতা মেনে নেননি। শামসুল আইম্মা সরখসী (রহ.) বলেন: “শাবী (রহ.)-কে ওয়াকফ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, মুহাম্মদ ﷺ ওয়াকফ বিক্রি করার জন্য এসেছিলেন।”
কতিপয় লোক ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর দিকে এই অভিযোগ তুলেছেন যে, তিনি ওয়াকফের বৈধতা মেনে নেননি। কিš‘ অধিকাংশ হানাফী ফকীহরা এই দাবি কঠোরভাবে খণ্ডন করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ওয়াকফ সম্পর্কে অব¯’ান কী ছিল, তা নিয়ে আমরা শেষে বিস্তারিত আলোচনা করব। আপাতত, আমরা শরঈ নীতির আলোকে ওয়াকফের বৈধতা পর্যালোচনা করব।

ওয়াকফের প্রমাণ কুরআন থেকে:
কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে দান-সদকার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আর ওয়াকফও দানেরই একটি ধরন, তাই এসব আয়াতের সাধারণ নির্দেশনায় ‘ওয়াকফ’ আওতাভুক্ত হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: “لن تنالوا البر حتى تنفقوا مما تحبون” অর্থাৎ, “তোমরা পূর্ণ কল্যাণ (ভালো কাজের সর্বো”চ স্তর) অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় জিনিসগুলো আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর।” এই আয়াতে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার বড় ফজিলতের কথা বলা হয়েছে, আর ওয়াকফ করাও আসলে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার একটি মাধ্যম। সুনানে নাসাঈ হাদীস গ্রšে’ হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে: তিনি বলেন:
যখন এই আয়াত “لن تنالوا البر حتى تنفقوا مما تحبون” নাযিল হলো, তখন হযরত আবু তালহা (রা.) বললেন: “আমাদের প্রতিপালক নিশ্চয় আমাদের ধনসম্পদ চা”েছন। হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে সাক্ষী রাখছি যে, আমি আমার জমি আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করলাম।” রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: “তুমি এ জমি তোমার আত্মীয়দের মধ্যে হাসসান বিন সাবিত এবং উবাই ইবনে কাবের জন্য নির্ধারণ করে দাও।” এই হাদীসের বিস্তারিত আলোচনা ওয়াকফের ইতিহাসের প্রসঙ্গে আসবে। এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো—সাহাবায়ে কেরাম কেবল সাধারণ দান নয়, বরং এই আয়াত থেকে ওয়াকফের ফজিলতও বুঝেছিলেন এবং সাথে সাথে তার ওপর আমলও করেছেন।

ওয়াকফের প্রমাণ হাদীস থেকে:
(১) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি আমল বন্ধ হয় না (১) সদাকায়ে জারিয়া (২) এমন ইলম (জ্ঞান) যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে (৩) নেককার সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।” (মৃত ব্যক্তিকে এই তিন আমলের সওয়াব কবরের জীবনেও পৌঁছাতে থাকে।) এ হাদীসে ‘সদকায়ে জারিয়া’ উল্লেখ করা হয়েছে, আর ওয়াকফ সদাকায়ে জারিয়ারই একটি অন্যতম রূপ, যেখানে আসল সম্পত্তি অক্ষুণ্ন রেখে তার উপকার ভোগ করা হয়। ওয়াকফকারীকে জীবিত অব¯’ায়ও এবং মৃত্যুর পরও যতদিন ওয়াকফকৃত সম্পদ থাকবে, ততদিন সওয়াব পৌঁছাতে থাকবে। সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকারী ইমাম নববী (রহ.) বলেন: “সদাকায়ে জারিয়া বলতে ওয়াকফকেই বোঝানো হয়েছে। এ হাদীস থেকে ওয়াকফের বৈধতা ও এর বিপুল সওয়াবের প্রমাণ মেলে।”
(২) রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেও নিজের কিছু জমি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। হযরত আমর ইবনে হারিস (রা.) থেকে বর্ণিত: “রাসূলুল্লাহ ﷺ মৃত্যুকালে কোনো ধন-সম্পদ, দাস-দাসী রেখে যাননি। হ্যাঁ শুধু একটি সাদা খ”চর, কিছু অস্ত্র এবং একটি জমি রেখে গিয়েছিলেন, যেটি তিনি সদকা (ওয়াকফ) করে দিয়েছিলেন।”
(৩) হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন: “রাসূলুল্লাহ ﷺ মদিনায় নিজের সাতটি বাগান বনী মুত্তালিব ও বনী হাশিমের জন্য সদাকা (ওয়াকফ) করে দিয়েছিলেন।” (রাসূলুল্লাহ ﷺ- এর ওয়াকফকৃত সম্পত্তির বিস্তারিত আলোচনা ওয়াকফের ইতিহাসের আলোচনায় আসবে।)
(৪) রাসূলুল্লাহ ﷺ- এর অনুসরণ করে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) -এরাও অনেক জমি ও বাগান আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দেন। ইমাম বায়হাকী (রহ.) বলেন: “আমার জানা মতে, নবীজির আশি জনেরও বেশি আনসারী সাহাবি তাদের সম্পদ ওয়াকফ করেছিলেন।”
(৫) ওয়াকফ একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সুন্নত, যার ওপর নবীজী ﷺ ও পরে মুসলিম উম্মাহ আমল করেছেন। ইমাম মালিক রহ.-কে বলা হল: যে কাজী শুরাইহ ওয়াকফের বৈধতা দেন না, তাঁর দাবি হল: আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত অংশগুলোকে এভাবে বন্ধ করে রাখা জায়েয নেই। ইমাম মালিক রহ. প্রতুত্তরে বললেন: ‘কাজী শুরাইহ তার নিজ এলাকার ভিত্তিতে এ কথা বলেছিলেন। তিনি মদিনায় আসেননি। যদি আসতেন তবে নবীজির স্ত্রীগণ, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনদের ওয়াকফকৃত জমিজমার চিহ্ন দেখে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতেন, কারণ এসব মনীষা নিজেদের সম্পদ-সম্পত্তি ওয়াকফ করেছেন এবং কেউ এতে আপত্তি করেনি। নবীজির সাতটি ওয়াকফকৃত বাগান আজও বিদ্যমান। সুতরাং প্রত্যেক ব্যাক্তির উচিত সে যেন নিজের জানাশোনা বিষয় নিয়েই আলোচনা করে।’
এই দলিলটি ইমাম মালিক রহ. ওয়াকফের বৈধতা নিয়ে ইমাম আবু ইউসুফের সাথে বাদশাহ হারুনুর রশিদের দরবারে মুনাযারা করার সময় উপ¯’াপন করেছিলেন। তিনি বলেন: ‘দেখুন, রাসূলুল্লাহ ﷺ- এর ওয়াকফ এবং সদাকাগুলো এখনো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে।’ এ কথা শুনে ইমাম আবু ইউসুফ বললেন: ‘আমার উস্তাদ ইমাম আবু হানিফা আগে ওয়াকফকে অবৈধ মনে করতেন। কিš‘ এখন আমি বলছি, ওয়াকফ বৈধ।’ এভাবে তিনি ওয়াকফের বৈধতা মেনে নেন।” এবং ইমাম আবু হানিফা রহ: র মত থেকে ফিরে আসেন।

ওয়াকফের প্রমাণ ইজমা (সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত) থেকে:
ইমাম নববী (রহ.) ওয়াকফের বৈধতার ওপর ইজমা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন:
“ওয়াকফের মূল স্বীকৃতি এই হাদীস (হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস) দ্বারা প্রমাণিত, এবং এটা জাহেলি যুগের ভুল রীতিনীতির বিপরীত। এটাই আমাদের এবং অধিকাংশ আলিমের মতামত। এছাড়াও, মুসলিম উম্মাহর মসজিদ এবং পানি পানের ¯’ানের (সিকায়াত) ওয়াকফের বৈধতার ওপর ইজমা রয়েছে।”
ইবনে কুদামা (রহ.) সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক ইজমা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন: “হযরত জাবির (রা.) বলেন:
নবীজি ﷺ-এর সাহাবীদের মধ্যে যাদের সক্ষমতা ছিল, তাদের কেউ ওয়াকফ করা থেকে বিরত থাকেননি। এই ব্যাপক আমল থেকেই সাহাবায়ে কেরামের ইজমা সাব্যস্ত হয়, কারণ যার সামর্থ্য ছিল, সে ওয়াকফ করেছে, এবং এই ব্যাপারটি প্রসিদ্ধ হয়েছিল, কেউ এতে আপত্তিও করেননি। তাই এটা সাহাবীদের ইজমা (সর্বসম্মতি) হিসেবে বৈধ সাব্যস্ত হয়।
“ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে বলা হয়, যে তিনি ওয়াকফের বৈধতার পক্ষে ছিলেন না”এই ধারণা ঠিক নয়। ইনশাআল্লাহ আমরা সামনে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব।

ওয়াকফের প্রমাণ কিয়াস (যুক্তি) দ্বারা:
ক্স মসজিদের ওয়াকফ সর্বসম্মতিক্রমে বৈধ, মসজিদের জন্য ওয়াকফ করা ভূমি ওয়াকেফের (দানকারীর) মালিকানা থেকে বের হয়ে যায়। সুতরাং মসজিদের ওয়াকফ যেহেতু বৈধ, তাই অন্যান্য ওয়াকফও বৈধ হওয়া উচিত।
ক্স একইভাবে ওয়াকফকে ‘আতিক’ (দাস মুক্তি) এর সঙ্গে তুলনা করা যায়: যেমন দাস মুক্তির সময় মালিকানা দাসের ওপর থেকে উঠে যায়, কিš‘ সে আর অন্য কারো মালিকানায় প্রবেশ করে না, ঠিক তেমনি ওয়াকফেও সম্পত্তি ওয়াকেফের মালিকানা থেকে উঠে যায়, তবে কারো ব্যক্তিগত মালিকানায় যায় না।
আল্লামা কাসানী (রহ.) বলেন:
“ওয়াকফ হলো কোনো জিনিসের মালিকানা সরিয়ে তা একান্তভাবে আল্লাহর জন্য করে দেওয়া, এটা দাস মুক্তির (আতিক) এবং মসজিদ বানানোর (ভূমির ওয়াকফ) মতো।”

ওয়াকফের ইতিহাস এবং এর বিকাশ
ওয়াকফের মূল ধারণা আমরা শুধুমাত্র ইসলামেই নয়, অন্যান্য ধর্ম ও মতবাদেও দেখতে পাই, যেখানে কোনো কিছু নিজের মালিকানা থেকে মুক্ত করে তার উপার্জন নির্দিষ্ট একটি উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য নির্ধারণ করা হয়। তবে ইসলামী ওয়াকফের জন্য যে নীতিমালা এবং শর্তাবলী নির্ধারণ করা হয়েছে, তার উদ্দেশ্য এবং পদ্ধতি যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং যেভাবে ওয়াকফকে সুশৃঙ্খলভাবে সংগঠিত করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষ ইসলামী সিস্টেম। অন্য ধর্ম বা মতবাদে ওয়াকফের ধারণায় এমন বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায় না। এই কারণেই ইমাম শাফেয়ী (রহ.) তার “কিতাবুল উম” এ বলেন:
“জাহেলি যুগের লোকেরা কোনো বাড়ি বা জমি ওয়াকফ করেনি, ওয়াকফ তো ইসলামী জনগণের কাজ।”
ইমাম ইবনে হাযম (রহ.) বলেন:
“আরবরা তাদের জাহেলি যুগে ওয়াকফের এই ধারণা জানত না যা আমাদের শরীয়তে আলোচিত, বরং এটি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর আনিত শরীয়তের একটি পরিভাষা, ঠিক যেমন নামায, রোযা এবং অন্যান্য ফরয বিধান নিয়ে এসেছেন। যদি তিনি ﷺ না আসতেন, তাহলে আমরা এসব বিধানের বিষয়ে কিছুই জানতাম না।”
আল্লামা সাবী (রহ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে:
” কাবার পুনর্নির্মাণ এবং যমযম কূপের খনন ইত্যাদি জাহেলি যুগের যে সব বিষয়কে আমরা ওয়াকফ মনে করে থাকি তা কেবল গর্বের জন্য ছিল, নেকির উদ্দেশ্যে নয়।” তবে যেহেতু ইসলাম আসার আগে কিছুটা হলেও ওয়াকফের ধারণা অবশ্যই ছিল, তাই প্রাথমিকভাবে এর আলোচনা করা প্রয়োজন।

ইসলামের আগে ওয়াকফের ধারণা
বিক্রি, ভাড়া এবং অন্যান্য চুক্তিগুলোর ধারণা ইসলাম আসার আগে যেমন ছিল, তেমনি ওয়াকফের ধারণাও বিভিন্নভাবে ইসলাম আসার আগে বিদ্যমান ছিল। নিচে এর কিছু উদাহরণ দেওয়া হল:
(১) হযরত ইবরাহীম (আ.) এর ওয়াকফ:
হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর ওয়াকফ যেমন কাবা শরিফ ইত্যাদি, ইসলাম পূর্বক ওয়াকফের প্রমাণ হিসেবে স্পষ্ট উদাহরণ। আল্লামা ত্বরাবলিসী (রহ.) লিখেছেন:
وابراهيم الخليل عليه السلام وقف أوقافاً، وهي باقية إلى يومنا هذا
“হযরত ইব্রাহিম (আ.) বেশ কিছু ওয়াকফ করেছিলেন, যা আজও টিকে রয়েছে।”
আল্লামা ক্বাযী খান (রহ.) বলেন:
والناس لم يأخذوا بقول أبي حنيفة رحمة الله عليه للآثار المشهورة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم والصحابة رضوان الله عليهم أجمعين وتعامل الناس باتخاذ الرباطات والخانات، أولها وقف الخليل صلوات الله عليه
“লোকেরা ইমাম আবু হানিফার মতামত অনুসরণ করেনি, বরং রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং সাহাবায়ে কেরামের দ্বারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ওয়াকফের পবিত্র ধারাকে অনুসরণ করেছে, যার মধ্যে প্রথম ওয়াকফ হযরত ইব্রাহিম (আ.) করেছিলেন।”
আরবদের কাছে কাবা শরীফের মর্যাদা এবং শ্রদ্ধা অজানা ছিল না, এটি ছিল সব আরব গোত্রের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ, তারা এখানে তাওয়াফ করত , প্রতি বছর হজের জন্য এখানে সমবেত হতো এবং তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। ইসলামও কাবা শরীফের শ্রদ্ধা এবং মর্যাদা বজায় রেখেছে এবং এটিকে মুসলিমদের কিবলা হিসেবে ঘোষণা করেছে, তবে এখানে যে শিরকি কাজগুলো হত, মক্কা বিজয়ের পর রাসূল ﷺ সেগুলো নিষিদ্ধ করেন এবং নিজের হাতে যেসব মূর্তি সেখানে রাখা হয়েছিল সেগুলো ভেঙে দেন। ফলে নবীজি ﷺ কাবা শরিফের প্রাচীন মর্যাদা বজায় রাখেন এবং এতে যে শিরক ও অপবিত্র কর্মকাণ্ডের সিলসিলা চলমান ছিল তা চিরতরে বন্ধ করে দেন।
(২) মসজিদ আল-আকসা’র ওয়াকফ:
মসজিদ আল-আকসা’র অস্তিত্ব ছিল হযরত সুলাইমান (আ.) এর যুগ থেকে, এবং এটি কোনো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল না, বরং এর অব¯’া ওয়াকফের মতো ছিল।
(৩) যমযম কুপ:
যমযম কুপ এবং অন্যান্য কুপ যা ইসলামের আগমনের পূর্বে খোঁড়া হয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশ সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য ছিল, এবং আজ পর্যন্ত মানুষ সেগুলোর উপকারিতার সুবিধা পেয়ে আসছে।
(৪) বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়:
সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত জাতি কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করে আসছে এবং তাদের উপাসনালয়ের জন্য জমি নির্ধারণ করে দিয়েছে যাতে ওই উপাসনালয়ের খরচ পূর্ণ করা যায়। এই উপাসনালয় এবং এর জন্য নির্ধারিত জমি কোনো ব্যক্তির মালিকানাধীন ছিল না, বরং এগুলো ওয়াকফের আওতাধীন একটি সুস্পষ্ট রূপ ছিল। শায়খ আবু যাহরা (রহ.) লিখেছেন:
“ওয়াকফের ধারণা ইসলাম থেকে পূর্বে ছিল, যদিও এই নামে ছিল না, কারণ ইসলামের পূর্বেও উপাসনালয় এবং তাদের জন্য নির্ধারিত জমি ছিল যা তাদের ব্যব¯’াপকদের ওপর খরচ করা হতো, এবং এটি আসলে ওয়াকফ বা ওয়াকফের মতো ছিল। সেজন্য যখন ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ওয়াকফের শারঈ সত্তা অস্বীকার করেছিলেন, তখনও তিনি মসজিদের ওয়াকফ এবং এর অপরিহার্যতা অস্বীকার করতে পারেননি, কারণ মসজিদগুলো ইসলামের পূর্বেও ছিল, যেমন মসজিদ আল-হারাম এবং মসজিদ আল-আকসা। তদ্রƒপ অন্যান্য উপাসনালয় যেমন গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় ইত্যাদি পূর্বেই ছিল। এটি সম্ভব ছিল না যে এগুলো কারো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হয়ে সেসবের আয়ের ব্যবহার উপাসনা করতে আসা ব্যক্তিদের ওপর খরচ করা হতো।”
(৫) জাহিলিয়াতের যুগে ওয়াকফের অনুরূপ রূপ:
জাহিলিয়াতের যুগে আরবদের মধ্যে তাদের দেবতার জন্য পশুদের বিশেষভাবে নির্ধারণ করার রেওয়াজ ছিল, যেমন বাহীরা, সাইবা, ওয়াসিলা এবং হাম। এসব পশুর দুধ ব্যবহার করা যেত না এবং এসবের ওপর যাত্রা করা যেত না, তাদের সম্মান ও মর্যাদার সাথে দেখা হত এবং তারা দেবতার জন্য উৎসর্গ করা হত। এটি ওয়াকফের অনুরূপ ছিল, তবে যেহেতু এটি শিরকী আচার-আচরণ ছিল, তাই ইসলাম এটি নিষিদ্ধ করে দেয় এবং আল্লাহ তাআলা এর নিষেধাজ্ঞার জন্য এই আয়াত নাযিল করেন:
অর্থাৎ: “আল্লাহ তাআলা না বাহীরা নির্ধারণ করেছেন, না সাইবা, না ওয়াসিলা, না হাম, কিš‘ যারা কুফরী করেছে তারা আল্লাহর ওপর মিথ্যাচার করছে।”
হযরত মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.) “মাআরিফুল কুরআন”-এ হযরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব (রহ.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন: বাহীরা: সেই পশু যার দুধ দেবতার নামে ওয়াকফ করা হত, এবং কেউ এর থেকে কোনো লাভ নিতে পারত না। সাইবা: সেই পশু যা দেবতার নামে ছেড়ে দেওয়া হত, যেমন আজকের সাঁড়। হামি: সেই পুরুষ উট যে নির্দিষ্ট সংখ্যক গাভীর সাথে মিলন করেছে, তাকে দেবতার নামে ছেড়ে দেওয়া হত। ওয়াসিলা: সেই উটনী যে ধারাবাহিকভাবে মেয়ে বা”চা জন্মাত, মাঝে কোনো পুরুষ বা”চা জন্মাত না, তাকে দেবতার নামে ছেড়ে দেওয়া হত।
এই সব উদাহরণ ইসলাম থেকে পূর্বের সাদৃশ্য ছিল, তবে যেহেতু এগুলি শিরকী আচার-আচরণ ছিল, ইসলাম এগুলো নিষিদ্ধ করে এবং এসবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
[চলবে]

লেখক : শিক্ষার্থী, ইফতা (২য় বর্ষ),
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ