বুধবার-২১শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মুসলিম পরিচয় স্বাতন্ত্র্য বনাম ইহুদি-খ্রিস্টানের অনুকরণ

হাফেজ মুহাম্মাদ জাফর সাদেক :

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ شِبْرًا شِبْرًا وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ دَخَلُوا جُحْرَ ضَبٍّ تَبِعْتُمُوهُمْ. قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ، الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى؟ قَالَ: فَمَنْ.
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) রাসূল ﷺ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নিশ্চয় তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের আচার-আচরণকে বিঘতে-বিঘতে ও হাতে-হাতে (হুবহু) অনুকরণ করবে। এমনকি তারা যদি ‘দব’ (ষান্ডা) এর গর্তেও প্রবেশ করে থাকে, তাহলে তোমরাও এতে তাদের অনুকরণ করবে। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, এরা কি ইহুদি-নাসারা? তিনি বললেন, আর কারা?
শাব্দিক বিশ্লেষণ: ضَبّ (দব) আরবের মরুভূমির একটি প্রাণী। প্রসিদ্ধ আরবি অভিধান ‘আল মুজামুল ওয়াসীত’-এ ‘দব’ এর পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে,
الضب حيوان من جنس الزواحف من رتبة العظاء، غليظ الجسم خشنة، و له ذنب عريض حرش أعقد، يكثر في صحراء الأقطار العربية.
‘দব’ হলো সরীসৃপজাতীয় বুকে ভর দিয়ে চলা একটি প্রাণী। যার শরীরের চামড়া পুরু ও অমসৃণ। তার লেজ চওড়া, রুক্ষ, খসখসে ও অতি গিটবিশিষ্ট। আরবের মরুভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। (আল মুজামুল ওয়াসিত পৃ. ৫৩২)
তবে আমাদের দেশে সাধারণত ضَبّ অর্থ গুইসাপ করা হয়ে থাকে এবং আরবি থেকে বাংলা বা উর্দু থেকে বাংলা ডিকশনারিগুলোতেও দব অর্থ গুইসাপ লেখা হয়েছে। অথচ ضَبّ এর বর্ণিত পরিচয়ের সাথে গুইসাপ এর সাথে তেমন মিল পাওয়া যায় না; তবে আমাদের দেশে ষান্ডা নামক একটি প্রাণী দেখা যায়, যা দবের বর্ণনার সাথে অনেকটা মিলে যায়, তাই আমরা ضَبّ অর্থ ষান্ডা বলতে পারি।
হাঁ, আমাদের দেশের গুইসাপ আরবির ورل (ওয়ারাল) নামক প্রাণীর বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যায়। তাই আমরা আরবি অভিধানের ‘ওয়ারাল’ এর পরিচয় দেখে নিই,
الورل حيوان من الزحفات طويل الأنف والذنب دقيق الخصر، لا عقد في ذنبه كذنب الضب، و هو أطول من الضب أقصر من التمساح، يكون في البر و الماء، يأكل العقارب و الحيات و الحرابي و الخنافس، و العرب تستخبثه و تستقذره فلا تأكله.
ওয়ারাল হল সরীসৃপজাতীয় একটি প্রাণী, যার নাক ও লেজ সুদীর্ঘ। কোমর সরু ও চিকন। দবের লেজের মতো তার লেজে কোনো গিট নেই। তার দেহের দৈর্ঘ্য দবের চেয়ে বড়, কুমিরের চেয়ে ছোট। এরা জল ও স্থল উভয়স্থানে চলাচল করে (উভচর প্রাণী)। এরা বিচ্ছু, বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ, সাপ, গিরগিটি, গোবরপোকা ইত্যাদি আহার করে থাকে। আরবরা ওয়ারালকে ঘৃণা করে এবং নিকৃষ্ট মনে করে খায় না। (আল মুজামুল ওয়াসীত পৃ. ১০২৭)
ব্যাখ্যা: মুসলিম জাতির একটি স্বতন্ত্র পরিচয় রয়েছে, যা তাকে অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায় থেকে অনন্য ও স্বতন্ত্র করে তোলে। আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের এমন একটি পূত-পবিত্র শরীয়ত দান করেছেন, যা তাদের সমগ্র বিশ্বের ওপর মর্যাদাবান করেছে। এই বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নবী ﷺ অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। তাই তিনি সবসময় মুসলমানদের সতর্ক করেছেন, যাতে তারা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অনুসরণ না করে এবং তাদের জীবনধারার অনুকরণ ও সাদৃশ্য গ্রহণ না করে।
এই হাদীসে নবী ﷺ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, এমন এক সময় আসবে, যখন মুসলমানরা পূর্ববর্তী জাতিদের পথ অবলম্বন করবে। মুসলমানরা ইহুদি-খ্রিস্টানদের আচার-আচরণ, সংস্কৃতি ও জীবনধারা এতটাই অন্ধভাবে অনুসরণ করবে যে, তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে; ক্ষেত্রবিশেষ ঈমান থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে; কিন্তু নিজেদের বড় ইসলামী স্কলার দাবি করবে।
এই অনুসরণের চরম মাত্রা বর্ণনা করতে গিয়ে নবী ﷺ বলেন, “তারা এক বিঘত এক বিঘত করে অনুসরণ করবে, এক হাত এক হাত করে অনুসরণ করবে।” অর্থাৎ মুসলমানরা ইহুদি-খ্রিস্টানদের অভ্যাস, রীতি ও সংস্কৃতির প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়বে যে, তারা তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে হুবহু তাদের মতো চলার চেষ্টা করবে। এমনকি তারা যদি কোনো সংকীর্ণ, অন্ধকার ও দুর্গন্ধময় গর্তেও প্রবেশ করে, তবুও মুসলমানরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সেই পথেই তাদের অনুসরণ করবে এবং এটি নিজেরা গর্ব করে প্রচার করবে। নবী ﷺ এখানে দবের গর্তের উদাহরণ দিয়েছেন, যা অত্যন্ত সংকীর্ণ, অন্ধকার ও দুর্গন্ধযুক্ত। এই উপমার মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, মুসলমানরা যদি ইহুদি-খ্রিস্টানদের এমন কিছু অভ্যাস ও রীতিনীতিও অনুসরণ করে, যা তাদের জন্য ক্ষতিকর ও লজ্জাজনক, তবুও তারা সেসব থেকে বিরত থাকবে না।
এই হাদীস নবী ﷺ-এর একটি অলৌকিক ভবিষ্যদ্বাণী, যা বাস্তবেও ঘটেছে এবং ঘটেই চলছে। বিশেষ করে বর্তমান যুগে আমরা এ হাদীসের বাস্তব রূপ দেখতে পাচ্ছি।
বহু মুসলমান তাদের প্রকাশ্য ও চির শত্রুদের জীবনধারা, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, শিক্ষা-দীক্ষা, ওয়ার্ল্ডভিউ, রাজনীতি, সমরনীতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি প্রভৃতিকে অনুকরণ করছে।
তারা তাদের ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করছে, আর শ্লোগান দিচ্ছে ও বিশ্বাস করছে, “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”। তাদের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে, এমনকি তাদের চারিত্রিক দুর্বলতা ও কুসংস্কারও গ্রহণ করছে। রঙে-ডঙয়ে মুসলিম হলেও রক্তে-মাংসে খ্রিস্টীয়। ইসলামকে সেকেলে মনে করে যুগের সাথে মিলিয়ে ইসলামের আপডেট ভার্সন বের করছে। ইসলামকে পশ্চিমা ইহুদি-খ্রিস্টানদের ওয়ার্ল্ডভিউ দিয়ে মডিফাই করে মডারেট ইসলামের ধারক-বাহক হচ্ছে। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে নিজেদের ইসলামিক স্কলার দাবি করছে।
এ হাদীস আমাদের সতর্ক করে দেয়, যাতে আমরা ইহুদি-খ্রিস্টানদের চাকচিক্যময় সভ্যতা ও সাংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত না হই এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ী থাকি। মনে রাখতে হবে, ইসলামের সৌন্দর্য তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যের মধ্যেই নিহিত এবং এই স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করাই আমাদের প্রকৃত দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা আমাদের হেফাজত করুক।

-লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ