ফজরের বাতাসে আযানের ধ্বনি মিশে যায়, কিন্তু ফিলিস্তিনের আকাশে সেই ধ্বনি এখন প্রতিধ্বনিত হয় ব্যথার অনুরণন হয়ে। যে শহর একদিন সহস্র মসজিদের মিনার ছুঁয়ে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করত, আজ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মুআযযিনের কণ্ঠ যেন নিষ্পেষিত এক জাতির মর্মস্পর্শী আহাজারি। সেখানকার আজান কেবল নামাযের আহ্বান নয়, এটি এক নিরপরাধ জাতির আর্তনাদ, এক মাজলুম ভূমির কান্না।
যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা উপেক্ষা করে গাযায় নজিরবিহীন বর্বরতা চালাচ্ছে ইসরাইল। পনেরো মাসের লাগাতার হামলায় গাযাকে পরিণত করা হয় ধ্বংসস্তূপে। প্রায় ৫০ হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে জায়নবাদী হায়েনারা! আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপে জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলেও উগ্রবাদী ইহুদিরা এটিকে কৌশলগত পরাজয় হিসেবে দেখে ফের হামলা শুরু করে।
ইসরাইলের নিষ্ঠুরতায় রেহাই পাচ্ছে না শিশু ও নারীরাও। গেল মাসের কেবল দুই দিনেই সহস্রাধিক মানুষ হত্যার পর নেতানিয়াহু বলেছে, ‘হামলা কেবল শুরু’। গণহত্যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মদত স্পষ্ট। ট্রাম্প-নেতানিয়াহু জুটি গাযাকে জনশূন্য করে দখল করতে চায়।
প্রতিদিনই নতুন করে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায় ফিলিস্তিনের স্বপ্ন। নতুন কোনো শিশুর শৈশব শেষ হয়ে যায় আগ্রাসনের নিষ্ঠুরতায়। রাতভর বৃষ্টির মতো ঝরে পড়া বোমারু বিমানের বারুদ মিশে যায় বাতাসে। পোড়া মাটির গন্ধ ঢেকে দেয় দিগন্ত। অথচ সেই শূন্যতার মাঝেও মুআযযিন দাঁড়িয়ে যান—তার দায়িত্ব তিনি ছাড়তে পারেন না। কিন্তু যখন ‘আল্লাহু আকবার’ উচ্চারণ করতে যান, তখন বুকের গভীর থেকে উঠে আসে এক অব্যক্ত কাঁপন। কারণ, যে মিনার থেকে এই ডাক প্রতিধ্বনিত হতো, তা আজ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। যে মুসল্লিরা একসঙ্গে কাতারবদ্ধ হয়ে নামাযে দাঁড়াতেন, তারা কেউই নেই আর।
এই পৃথিবীতে এমন বিষাদময় সকাল কি আর কখনো এসেছে? হয়তো আসেনি। কিন্তু আমাদের নীরবতা, আমাদের নির্লিপ্ততা এই নিষ্ঠুরতাকে স্বাভাবিক করে তুলছে। প্রতিটি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে মানবতা। চাপা পড়ে আছে বিশ্ব বিবেক। আমরা কি কেবল দর্শকের ভূমিকায় থাকব? আমরা কি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব না?
ফিলিস্তিনের মাটিতে রক্ত ঝরছে। কিন্তু সেই রক্তের ওপর দিয়ে গড়ে উঠছে এক অদম্য প্রতিরোধ। আযানের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়নি। কাঁপছে ঠিকই, কিন্তু থামেনি। এটাই ফিলিস্তিনের শক্তি। এটাই তাদের অবিচলতা। আমাদের দায়িত্ব হলো এই আওয়াজের পাশে দাঁড়ানো, আমাদের কণ্ঠকে তাদের সঙ্গে একাত্ম করা।
মেনে নিতে দ্বিধা নেই—বিশ্ব সম্প্রদায়ের নীরবতা এই হত্যাযজ্ঞকে আরও উৎসাহিত করছে। জাতিসংঘ, ওআইসি, আরব লীগ নিষ্ক্রিয়, অথচ ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মার্কিন ইহুদিরাও রাজপথে নেমেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সম্মিলিত সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিলে ইসরাইলের পক্ষে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হতো।
মানবতাবিরোধী এই ইসরাইলি আগ্রাসন রুখতে বিশ্বকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং গাযায় মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
রমজানের শিক্ষা জীবনে বাস্তবায়ন
মাহে রমজান মুমিনের আত্মগঠনের এক মহান প্রশিক্ষণকাল। এই মাসে আমরা আত্মসংযম, তাকওয়া ও নেক আমলের চর্চা করি। কিন্তু রমজান শেষে যদি আমরা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাই, তবে এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। তাই রমজানের পরও এর শিক্ষাকে জীবনে ধরে রাখা জরুরি।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করো মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত।” (সুরা : হিজর, আয়াত : ৯৯)। অর্থাৎ ইবাদত শুধু রমজানের জন্য নয়; বরং সারা জীবনের জন্য। রাসূল ﷺ এমন আমলকে পছন্দ করতেন, যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা কম হয়। তাই আমাদের উচিত নিয়মিত নামায আদায় করা, কুরআনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা, নফল রোজা রাখা ও উত্তম চরিত্র রক্ষা করা।
রমজান আমাদের যে তাকওয়া ও সংযমের শিক্ষা দিয়েছে, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করাই আসল সাফল্য। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের শিক্ষাকে জীবনে অব্যাহত রাখার তাওফীক দান করুন। আমীন।
—কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক