মুফতী সাঈদ আহমাদ পালনপুরী
সাবেক শাইখুল হাদীস ও সদরুল মুদাররিসীন, দারুল উলূম দেওবন্দ, ভারত।
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَۚ﴿ۖ۲﴾ الَّذِیْنَ یُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ ؕ﴿۳﴾ اُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُوْنَ حَقًّا ؕ لَهُمْ دَرَجٰتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَۃٌ وَّ رِزْقٌ کَرِیْمٌ ۚ﴿۴﴾
তরজমা : “বিশ্বাসী (মুমিন) তো তারাই যাদের হৃদয় আল্লাহকে স্মরণ করার সময় কম্পিত হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের বিশ্বাস (ঈমান) বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের ওপরই ভরসা রাখে।
সে সমস্ত লোক যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।
তারাই হল সত্যিকার ঈমানদার! তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় পরওয়ারদেগারের নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রিজিক।”
বদর যুদ্ধে গনিমতের মাল নিয়ে ঝগড়া করতে নিষেধ করা হয়েছে প্রথম আয়াতে। কারণ, এর দ্বারা পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়। আদেশ করা হয়েছে, রাসূল ﷺ যেভাবে ভাগ করে দেন সেভাবে খুশি মনে মেনে নিতে হবে। এটাই ঈমানের দাবি। এখন এই আয়াতগুলোতে ঈমানের আরো পাঁচটি গুণের কথা বলা হয়েছে। আর এ পাঁচ গুণের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর অনুগত হয়ে থাকে এবং খাঁটি মুমিন হয়।
প্রথম গুণ : একজন বিশ্বাসী মুমিন যখন আল্লাহর নির্দেশের সামনে আসে, তখন সে আল্লাহর মহত্বের আহ্বানে সাড়া দেয়। সে ভাবে, যেনতেন কেউ এই নির্দেশ দেয়নি; বরং এটা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ। যাবতীয় সফলতা তাঁর আনুগত্যের মধ্যে।
দ্বিতীয় গুণ : যখন মুমিনের সামনে আল্লাহর আয়াত পাঠ করা হয় কিংবা তাকে আল্লাহর হুকুম বর্ণনা করা হয়, তখন সেই আয়াতগুলো তার ঈমান আরো বাড়িয়ে দেয়। তার ঈমান শক্তিশালী হয়ে যায় এবং সে তৎক্ষণাৎ আল্লাহর নির্দেশ পালনে প্রস্তুত থাকে।
ফায়েদা : ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং হ্রাসও পায়। সব মুমিনের ঈমান সমান নয়। ঈমানে কম-বেশি হয়ে থাকে। তবে ঈমান আনার দিক দিয়ে সবাই বরাবর। অর্থাৎ, যেসব বিষয়ে ঈমান আনলে ব্যক্তি মুমিন হয় (ঈমানে মুফাসসালের মধ্যে এগুলো উল্লেখ আছে) সেসব বিষয়ে সব মুমিনের ঈমান আনা অপরিহার্য।
ঈমানের অনেক শাখা-প্রশাখাও আছে। এতে পাতা ও ফুল ফুটে। অর্থাৎ, ব্যক্তি থেকে বিভিন্ন আমল প্রকাশ পেতে থাকে। আর এভাবে ঈমান অনুযায়ী মুমিনও হয়ে থাকে বিভিন্ন স্তরের।
এটি একটি উদাহরণ হিসাবে নিন। একটি উদ্ভিদ আরেকটি উদ্ভিদ বীজ থেকে বৃদ্ধি পায়। এরপর তা থেকে ছোট ছোট শাখা বের হতে থাকে। এতে ফুটতে থাকে পাতা ও ফুল। আর এভাবেই হয়ে থাকে পূর্ণ গাছ। চারাটা তো নামের গাছ, কিন্তু কাজের গাছ তো আরেকটা। মনে করুন, এ চারাটাই হচ্ছে আসল ঈমান যা আমল দ্বারা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। যেমন চারা ফুল পাতা দ্বারা শক্তিশালী হয়ে উঠে। আল্লাহর আয়াত মুমিনের বিশ্বাস বাড়ায়। মুমিন আল্লাহর হুকুম পালন করলে তার ঈমান আরো বৃদ্ধি পায়।
এখানে জেনে রাখা চাই, আসল ঈমান থাকলে মুক্তি মিলবে। আর কামেল ঈমান দ্বারা প্রথম স্তরের নাজাত পাওয়া যাবে। যা বান্দাকে জান্নাতে উঁচু মর্যাদায় বসাবে।
তৃতীয় গুণ : মুমিন এমন চিন্তা ছাড়াই আল্লাহর হুকুম পালন করে যে, এর বিনিময়ে আমি কী পাবো। সে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর নির্ভর করে। আমার এই চেষ্টার বিনিময়ে আল্লাহ যে প্রতিদান-ই দেবেন তা উত্তম—এটা তার বিশ্বাস। বান্দার কাজ হলো গোলামি করা।
ফায়েদা : তাওয়াক্কুল বলা হয়, উপকরণ অবলম্বন করে প্রতিদান আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়াকে। অনুরূপভাবে রিজিকের উপকরণ অবলম্বন করে রিজিকের পুরো বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়ার নামই তাওয়াক্কুল। মুজাহিদকেও যে নির্দেশ দেয়া হয়, তা পূর্ণ করে। যুদ্ধের ফলাফল কী হবে? তা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়।
চতুর্থ গুণ : মুমিন শারীরিক সমস্ত ইবাদত যত্ন সহকারে সম্পন্ন করে থাকে। নামায হলো শারীরিক ইবাদতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। তাই মুমিন নামাযের প্রতি যত্নবান হয়। যুদ্ধের সময় নামাযের সময় হলেও মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়। অন্যান্য শারীরিক ইবাদতেও সচেষ্ট থাকে।
পঞ্চম গুণ : মুমিন অর্থনৈতিক ইবাদতের ব্যাপারেও সচেতন থাকে। যাকাত হলো অর্থনৈতিক ইবাদতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বান্দাদের যেসব সম্পদ দান করেছেন তা কোনো রকম প্রয়োজন পূরণের জন্য দিয়েছেন। পুরোপুরি মালিক বানিয়ে দেন নি। এ সম্পদে নিজের প্রতিনিধি করে দিয়েছেন। সূরা হাদীদে (আয়াত : ৭) এসেছে : “যেসব সম্পদে আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতিনিধি বানিয়েছেন সেসব সম্পদ থেকে তোমরা অল্প আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো।”
সুতরাং সম্পদের মালিক যখন তার ম্যানেজারকে মাল খরচ করার নির্দেশ দিয়েছেন, তো ম্যানেজারের দুঃখের কোনো কারণ নেই। তাই মুমিন তো কোনো অর্থনৈতিক ইবাদতে খরচ করে দুঃখ পায় না। যখন মুমিনের মধ্যে নেয়ার নয় বরং দেয়ার চেতনা জাগ্রত হবে, তখন গনিমতের সম্পদে ঝগড়াও হবে না। সে কামনা করবে আমার অন্য ভাই পেয়ে যাক।
–তাফসীরে হেদায়াতুল কুরআন অবলম্বনে