হিংসা ও হাসাদ: মুক্তির উপায়
সলিমুদ্দিন মাহদি
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
প্রারম্ভিক
হাসাদ ভয়ানক মন্দ ব্যাধি। মানবসমাজ ব্যাপকহারে এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও যখন এর ব্যাপকতা পরিলক্ষিত হয়, তখন দুঃখিত হতে হয়! নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বের সঙ্গে এর চিকিৎসা করা জরুরি। এ বিষয়ে সময়ের আদর্শ ব্যক্তিত্ব আল্লামা মুফতি তকী উসমানী (হাফি.) ছাত্রদের উদ্দেশ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বক্তব্য প্রদান করেন। যা ‘ইসলাম আওর হামারী জিন্দেগি’ কিতাবে সংকলন করা হয়েছে। সেই বক্তব্যকে সামনে রেখে নিম্নের প্রবন্ধ প্রস্তুত করা হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের উপকার্থে প্রকাশ করা হলো।
হাসাদ বা হিংসা কাকে বলে?
‘হাসাদ’ আরবি শব্দ। অর্থ হিংসা, পরশ্রীকাতরতা। পরিভাষায় অন্যের ভালো কিছু দেখে তা নষ্ট হওয়ার কামনা করাকে হাসাদ বলে। কেউ ভালো পথে চলতে থাকলে কিংবা ভালো কোনো কাজ করতে গেলে সেখান থেকে সে যেন ফিরে আসে বা বাধাগ্রস্ত হয় কিংবা ব্যর্থ হয়; এমন কামনা করা। এসব হচ্ছে হিংসার প্রথম ধাপ। এটি মানুষের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। অনেকটাই সৃষ্টিগত ও স্বভাবজাত।
হাসাদের একটি উদাহরণ
ছাত্রদের বুঝার সুবিধার্থে হাসাদের একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। যেমন, আমার একজন সহপাঠী আছে। সে পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে। এতে আমার মনটা জ্বলতে লাগল এবং আমি ভাবতে লাগলাম, সে কেন বেশি নম্বর পেল? কেন সে আমার চেয়ে অগ্রসর হয়ে গেল? এরপর আকাঙ্ক্ষা করতে লাগলাম, তার পরীক্ষা খারাপ হোক! নম্বর কম পাক! আগামী পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার না করুক। আমি প্রথম হতে পারি আর নাই পারি, সে যেন প্রথম স্থান অধিকার না করে। এই যে অকল্যাণ কামনা এটির নামই হল ‘হাসাদ।’
কিংবা এক ব্যক্তি বেশ সম্পদশালী। তার উন্নতি দেখে আপনার অর্ন্তজ্বালা সৃষ্টি হল এবং আপনি আকাঙ্ক্ষা করতে লাগলেন, তার সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাক। উপার্জন কমে যাক। মনের এই মন্দ আকাঙ্ক্ষার নামই ‘হাসাদ’ কিংবা মনে করুন, সমাজে কারও বেশ সুনাম-সুখ্যাতি রয়েছে। লোকেরা তাকে ইজ্জত-সম্মান করে এবং যেকোনো পরামর্শ সহযোগিতার জন্য তার শরণাপন্ন হয়। এখন কারও মর্মপীড়া শুরু হল যে, কেন লোকেরা তার কাছে যায়! কেন তাকে ইজ্জত-সম্মান করে। এরপর এই আকাঙ্ক্ষাও জাগতে লাগল যে, তার মান-সম্মান নষ্ট হয়ে যাক। এটিকেই ‘হাসাদ’ বলে।
ঈর্ষা করা জায়েয
আরবিতে একটি শব্দ আছে, الغبطة, উর্দু ভাষায় একে رشک বলা হয়। এর বাংলা অর্থ হল, ‘ঈর্ষা করা’ বা অন্যের ন্যায় সুখ কামনা করা। অর্থাৎ কারও উন্নতি দেখে এই আকাঙ্ক্ষা করা যে, এই নেয়ামত আল্লাহ আমাকেও দান করুন। এখানে নিজের উন্নতির আগ্রহ আছে তবে অন্যের অকল্যাণ কামনা নেই। যেমন অমুকের স্বাস্থ্য ভালো। আল্লাহ আমাকেও সুস্বাস্থ্য দান করুন। অমুকের কাছে সম্পদ আছে। আল্লাহ তাআলা আমাকেও সম্পদশালী করুন। কিংবা অমুক আলেম, বিশাল ইলমের অধিকারী, আল্লাহ তাআলা আমাকেও এমন ইলম দান করুন। একে ‘গিবতা’ বা ঈর্ষা বলে। এটি নিষিদ্ধ নয়, বরং বৈধ। অন্যদিকে ‘হাসাদ’ নিষিদ্ধ, যার অর্থ হল, ওই নেয়ামত আমার অর্জিত হোক বা নাই হোক তারটা যেন নষ্ট হয়ে যায়।
শুধু অন্তরে জ্বালা সৃষ্টি হওয়ার কারণে গোনাহ হয় না:
‘হাসাদ’ মানব অন্তরের খুবই নিকৃষ্ট ও দুষ্টু প্রবণতা। কিন্তু যদি অন্তরের এ জ্বালা অন্তরের মধ্যেই চেপে রাখা যায়, কথায় বা কাজে এর কোনো প্রভাব না পড়ে তাহলে কেবলমাত্র এই জ্বালা অন্তরে সৃষ্টি হওয়ার কারণে কেউ অপরাধী হবে না। কেননা এটি মানবজাতির ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। এ সম্পর্কে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, এখানে তিনটি বিষয় রয়েছে।
প্রথম বিষয় হলো, অন্যের উন্নতিতে অন্তরে জ্বালা তৈরি হওয়া। এটি মানব স্বভাবের একটি প্রবণতা। মানুষ এক্ষেত্রে নিরুপায় ও অপারগ বলে সাব্যস্ত হবে। তবে শর্ত হলো, বিষয়টি অন্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কথায় বা কাজে তা প্রকাশিত হতে দেবে না। আর অন্তরে যে ইচ্ছাগুলো উদিত ও জাগ্রত হচ্ছে তা পূরণ করবে না। এমনটি হলে কারও উন্নতিতে শুধু অন্তরে কষ্ট সৃষ্টি হওয়ার কারণে কোনো গোনাহ হবে না।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, সেই প্রবণতার বশবর্তী হয়ে কাজ করা। একে বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে মানুষ গোনাহগার হয়। আর তৃতীয়টি হল, সেই প্রেরণার বিপরীত কাজ করা। এক্ষেত্রে মানুষ সওয়াবপ্রাপ্ত হয়। যেমন হিংসা-হাসাদের কারণে কারও নিন্দা করতে ইচ্ছা হলে তার প্রশংসা করা। মুখ ফিরিয়ে থাকতে ইচ্ছে হলে মেলামেশা করা এবং ইজ্জত-সম্মান করা। তাকে সালাম দেওয়া এবং তার প্রতি দয়া-অনুগ্রহ করা।’ (আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৭৩)
প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী কাজ করা গোনাহ
এ অন্তর্জ্বালা যদি কারও কোনো ক্ষতি করে, তাহলে তা গোনাহ হবে। কারণ প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী কাজ করা গোনাহ। যেমন সমালোচনার মাধ্যমে তার মর্যাদা বিনষ্ট করা এবং অপমান-অপদস্থ করার চেষ্টা করা, দেখা-সাক্ষাতের সময় মুখ ফিরিয়ে নেওয়া কিংবা এমন কোনো কৌশল অবলম্বন করা, যার দ্বারা তার উপার্জন কমে যায়, স্বাস্থ্য বিনষ্ট হয়, ইলম হ্রাস পায়, মানুষের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায় ইত্যাদি। কিংবা তার জন্য বদদোয়া করা, হে আল্লাহ! তার ওই গুণটা নষ্ট করে দাও। এভাবে হিংসা- বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে যখন এই কাজগুলো করা হবে তখন তা গোনাহ ও পাপাচারে পরিণত হবে। এর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ শুধু মর্মপীড়া অন্তরেই চেপে রাখা হলে তা গোনাহ হিসেবে গণ্য হবে না। কেননা এটি সৃষ্টির পেছনে মানুষ অপারগ ও নিরুপায়।
তবে মনের কল্পনাও ভয়ংকর
ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, অন্যের সফলতা দেখে অন্তরে জ্বালা সৃষ্টি হলে তা অনিচ্ছায় হওয়ার কারণে যদিও সে অপরাধী সাব্যস্ত হবে না, কিন্তু অন্তরের এই অবস্থা সৃষ্টি হওয়াও চরম ক্ষতিকর। কেননা এটি বিদ্যমান থাকলে এক সময় তা মানুষকে গোনাহে জড়িয়ে ফেলে। এই ব্যক্তির কোনো না কোনো অনিষ্ট ও ক্ষতির চেষ্টা সে করেই বসবে। এজন্য অনিচ্ছায় সৃষ্টি হলেও তা অন্তরে জমিয়ে রাখা মোটেই উচিত নয়। এটি খুবই ভয়ংকর, ক্ষতিকর।
কল্পনার চিকিৎসায় তিনটি কাজ করা
আল্লামা মুফতি তকী উসমানী (হাফি.) বলেন, কল্পনার চিকিৎসায় তিনটি কাজ করতে থাকুন।
- গভীর মনোযোগসহ ভাবুন যে, এই চিন্তাটা খুবই মন্দ। কোনো মুসলিমের ব্যাপারে এ জাতীয় মানসিকতা পোষণ করা কল্যাণকর নয়। এভাবে চিন্তা করাটা যে মন্দ তা স্মরণ করুন।
- দ্বিতীয় কাজ এই যে, যার প্রতি হিংসা হচ্ছে তার উত্তম গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যরাজি বর্ণনা করুন। বিশেষত যে বিষয়গুলো আপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যেমন তার মাধ্যমে যদি কখনো আপনার কোনো ফায়দা-উপকার হয়ে থাকে তাহলে তা স্মরণ করুন। ভাবুন! আমার তো তার প্রতি কৃতজ্ঞতাপূর্ণ মন-মানসিকতা থাকা উচিত।
- তৃতীয় কাজ এই যে, যদিও তার প্রতি আপনার হিংসা হচ্ছে, যার কারণে আপনার ইচ্ছে হচ্ছে তাকে কষ্ট দিতে, অপমান করতে কিংবা অন্য কোনোভাবে তার ক্ষতি করতে, কিন্তু মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কষ্ট করে হলেও তার জন্য এই দোয়া করুন যে, হে আল্লাহ! তাকে আরও উন্নতি দাও। এটা অত্যন্ত তিক্ত ওষুধ। মন তার ক্ষতির জন্য উদগ্রীব, সে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হোক, তার গ্রহণযোগ্যতা শেষ হয়ে যাক, তার উন্নতি-অগ্রগতি ও সাফল্য থেমে যাক, কিন্তু অন্তরের সব অশুভ ইচ্ছার বিপরীতে আপনি দোয়া করছেন, হে আল্লাহ! তাকে আরও উন্নতি-অগ্রগতি দাও। তার ইলম ও আন বাড়িয়ে দাও, তার সহায়-সম্পদে বরকত দাও, সুস্থতা দাও। এতে আপনার অন্তরের চিকিৎসা হবে। যখন তার সঙ্গে সাক্ষাত হবে, ইচ্ছার বিপরীতে হলেও আগে সালাম দেবেন। তাকে সম্মান করবেন এবং মানুষের সামনে তার প্রশংসা করবেন। বলাবাহুল্য এই কাজগুলো করতে গিয়ে আপনার অন্তর কষ্টের সীমা অতিক্রম করবে, তবুও করুন। এটাই হাসাদের বড় চিকিৎসা।
হিংসুক নিজেই হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে
এ জগতের মাশায়েখগণ হাসাদকে আগুনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেননা হাসাদের কারণে মানুষের অন্তরে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি হয়। কারও কোনো অগ্রগতি-উন্নতি চোখে পড়ল, কাউকে অগ্রগামী হয়ে যেতে দেখলে অন্তরে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যায়। এক আরব কবি বলেন,
النار تأكُل بَعْضهَا إِن لَـم تَجِد ما تأكل.
আগুন যেমন জ্বালানোর কিছু পেলে তা সে জ্বালাবেই। যেমন শুকনা কাঠে আগুন লাগলে আগুন তা জ্বালিয়ে ভস্ম করে ফেলবে। হাসাদের প্রকৃতি হল আগুনের মত। কিন্তু জ্বালানোর মতো কিছু না পেলে সে নিজেকেই গ্রাস করতে থাকে এবং এক সময় সে নিঃশেষ হয়ে যায়। (আল-বালাগাতুত তারবিয়া: ১/৬১৮ ও আল-ইকদুল ফরীদ: ১/১৫৪)
অনুরূপ হিংসুক প্রথমে অপরের ক্ষতির চেষ্টা করতে থাকে; কিন্তু এতে সফলকাম না হলে নিজেই ওই আগুনে জ্বলতে থাকে এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে। এভাবে অসংখ্য মানুষ হিংসার অনলে জ্বলে নিঃশেষ হয়ে গেছে।
হিংসুক তাকদীরী ফয়সলার প্রতি থাকে অসন্তুষ্ট
ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, হিংসা মারাত্মক বড় গোনাহ। কেননা লক্ষ করলে দেখা যায় যে, হিংসুক আল্লাহ তাআলার ফয়সলায় থাকে অসন্তুষ্ট। কারও উন্নতি ও অগ্রগতি দেখলে তার অন্তরে খটকা জাগে যে, কেন সে আমার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে গেল। অমুককে আল্লাহ কেন এসব নেয়ামত দান করলেন? অথচ আল্লাহ যাকে যা দিয়েছেন এবং যে পরিমাণ দিয়েছেন সবই তাঁর হেকমত ও কুদরতের ফয়সলা। সুতরাং এতে প্রশ্ন তোলার অর্থ হল, আল্লাহ তাআলার ফয়সলায় প্রশ্ন উত্থাপন করা। কুরআনুল করীমে ইরশাদ হয়েছে,
وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللّٰهُ بِهٖ بَعْضَكُمْ عَلٰى بَعْضٍؕ ۰۰۳۲
‘আল্লাহ তোমাদের একের ওপর অন্যকে যেসব বিষয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার আকাঙ্ক্ষা করো না।’ (সূরা নিসা: ৩২)
কেননা এগুলো অর্জনের বিষয় নয়। সুতরাং এমন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবে না যে, এই শ্রেষ্ঠত্ব তাকে কেন দেওয়া হল, আমাকে দেওয়া হল না কেন?
এটি আল্লাহ তাআলার নিয়ম ও পদ্ধতি
এটাতো আল্লাহ তাআলার নিয়ম ও পদ্ধতি। তিনি কাউকে সুস্থতা দিয়েছেন, কিন্তু সম্পদ দেননি। কাউকে দিয়েছেন অর্থ-বিত্ত কিন্তু সুস্থতা দেননি। কাউকে দিয়েছেন ইলম কিন্তু মাল-দৌলত দেননি। কাউকে দিয়েছেন মর্যাদা ও প্রসিদ্ধি কিন্তু সন্তান-সন্ততি দেননি। এগুলো আল্লাহ তাআলার ফয়সলা। এখানে বান্দার প্রশ্ন উত্থাপন করার কোনো অধিকার নেই।
আল্লাহর অনুগ্রহগুলো দেখুন
হিংসুটের প্রতি আল্লাহর যে নেয়ামত রয়েছে সে তা মোটেও লক্ষ করে না। অন্যের নেয়ামতগুলো বিনষ্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। সে যদি এভাবে চিন্তা করে যে, অমুককে আল্লাহ ওই নেয়ামত দান করেছেন, কিন্তু আমাকেও তো ভিন্ন এই নেয়ামত দান করেছেন তাহলে তার অন্তর থেকে হিংসা-হাসাদ দূর হয়ে যাবে। যেমন অমুক ব্যক্তিকে আল্লাহ অর্থ-বিত্তের নেয়ামত দান করেছেন আর আমাকে দান করেছেন ইলম। এক কবি বলেন,
رَضِينَا قِسْمَةِ الْـجَبَارِ فِيْنَا: لَنَا عِلمُ وَلِلجُهَالِ مَالٌ.
‘আল্লাহ তাআলা আমাদের মধ্যে যেভাবে বণ্টন করেছেন আমরা তাতে রাজি ও সন্তুষ্ট। আল্লাহ মূর্খদেরকে দিয়েছেন সম্পদ আর আমাদেরকে দান করেছেন ইলম।’ (রওযাতুল আদব: পৃ. ১২)
আরবি সাহিত্যের আরও বহু গ্রন্থে প্রায় একই অর্থে এ জাতীয় কাব্য দৃষ্টিগোচর হয়।
رَضِينَا قِسْمَةَ الرَّحْمٰنِ فِيْنَا: لَنَا حَسَبُ وَلِلثَّقَفِيْ مَال.
‘পরম দয়ালু আল্লাহ তাআলা আমাদের মাঝে যেভাবে (সুষম বণ্টন করেছেন, তাতে আমরা রাজি আমরা সন্তুষ্ট; আমাদের জন্য দিয়েছেন সম্ভ্রান্ত বংশ আর সাকাফীদের দিয়েছেন সম্পদ।’ (দেখুন: তাবাকাতুস শুআরা: ১/৩-৫; রাহাতুল মাজালিস ওয়া উনসুল মাজালিস: ১/৩৯; আশ-শিরু ওয়াশ শুআরা: ১/১৯২)
সুতরাং মানুষ কেন দুঃখিত হবে। সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার ফয়সলায় সন্তুষ্ট থাকাই মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। মোটকথা হাসাদের সবচাইতে গুরুতর দিক এই যে, এতে আল্লাহ তাআলার কায়সালা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন ও অসন্তুষ্টি বিদ্যমান রয়েছে। এজন্য এটি পরিহার করা উচিত।
চোরের পা চুম্বন করলেন হযরত
জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.)
প্রত্যেক মানুষেরই কোনো না কোনো গুণ রয়েছে। প্রত্যেক মানুষের মাঝেই কোনো না কোনো গুণ রয়েছে। আল্লামা ইকবাল কখনো কখনো বেশ প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা বলেছেন। শিশুদের কবিতায় অত্যন্ত সুন্দর কথা বলেছেন,
نہیں ہے چیز نکمی کوئی زمانے میں
کوئی برا نہیں قدرت کے کار خانے میں
জমানার কোনো কিছুই মূল্যহীন নয়। কুদরতের সৃষ্টি কোনোটিই মন্দ নয়। যা কিছু আছে, সব আল্লাহ নিজ হেকমত অনুযায়ী সৃষ্টি করেছেন।
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) লিখেছেন, হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.) একবার কোথায় যাচ্ছিলেন। দেখলেন যে, এক লোককে শূলে চড়ানো হয়েছে। তার ডান হাত ও বাম পা কর্তিত। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.) উপস্থিত লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, এর এই অবস্থা কেন? লোকেরা জানাল, সে যখন প্রথমবার চুরি করেছে, তখন তার ডান হাত কেটে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়বার চুরি করার পর বাম পা কেটে দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও সে চুরি পরিত্যাগ করেনি। আবারও চুরি করার কারণে তাকে শূলে চড়ানো হয়েছে। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.) তার কাছে গেলেন এবং তার ঝুলন্ত পায়ে চুম্বন করলেন। এ দৃশ্য দেখে লোকেরা অবাক হয়ে বলল, হযরত! আপনার মত একজন। আল্লাহওয়ালা মানুষ এত বড় চোর ও ডাকাতের পায়ে চুম্বন করলেন? আমাদের এটিতো বুঝে আসল না, কেন এ কাজটি আপনি করলেন? হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.) বললেন, এর মধ্যে একটি মূল্যবান গুণ আছে। তা হচ্ছে কাজে দৃঢ়তা ও অবিচলতা। আমি তার ওই গুণটিকে চুম্বন করেছি। যদিও সে এই গুণটি মন্দ কাজে ব্যবহার করেছে, এটি তার ভুল। কিন্তু এই গুণটি বড় মূল্যবান। যদি সে এটি ভালো কাজে লাগাতে পারত তাহলে তার মর্তবা কোথায় পৌঁছে যেত!
হাসাদ থেকে মুক্তির উপায়-উপকরণ
- যার প্রতি হিংসা তার প্রশংসা করুন: যার প্রতি অন্তরে হিংসা সৃষ্টি হয়েছে তার ভালো গুণগুলো অনুসন্ধান করুন এবং মানুষের কাছে তা আলোচনা করুন। এতে আপনার অন্তর ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকবে কিন্তু তা হতে দিন। এই ব্যাধির চিকিৎসাই হল অন্তরকে ক্ষত-বিক্ষত করা। এজন্য হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেছেন, ‘গীবত-শেকায়েতের পরিবর্তে তার প্রশংসা করতে থাকুন। যদিও তা অন্তরের জন্য কষ্টকর কিন্তু আপনার মুখের ওপর তো আপনার কর্তৃত্ব রয়েছে।’ এটি হল প্রথম কাজ।
- বিনয়ের সঙ্গে মেলামেশা করুন: হাসাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দ্বিতীয় কাজ হলো, তার সাথে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলুন ও মেলামেশা করুন। যেমন যদিও ইচ্ছে হচ্ছে, তার চেহারা থেকে গোশত তুলে নিয়ে আসার; কিন্তু তার সঙ্গে সাক্ষাত হলে বিনয়ী আচরণ করুন এবং নম্রস্বরে কথা বলুন।
- তার দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি প্রকাশ করুন: হাসাদ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হলো, যার প্রতি হাসাদ হয় তার কষ্টে সহানুভূতি প্রকাশ করুন। অর্থাৎ তার দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদে সহানুভূতি প্রকাশ করুন। তার সামনেও করুন এবং অন্যদের সামনেও করুন।
- তাকে সম্মান প্রদর্শন করুন: আর চতুর্থ কাজ করবে যে, যখন সে আপনার সামনে চলে আসবে তখন তাকে ইজ্জত-সম্মান করুন।
- তাকে হাদিয়া প্রদান করুন: পঞ্চম কাজ এই যে, মাঝে মধ্যে তাকে হাদিয়া প্রদান করুন। তাহলে তার অন্তরেও আপনার প্রতি মহব্বত সৃষ্টি হবে এবং আপনার অন্তরেও তার প্রতি মহব্বত সৃষ্টি হবে। কিছু মানুষ এমন আছে যাদের পক্ষে সব কাজ করা সহজ, কিন্তু পয়সা খরচ করা অত্যন্ত কঠিন। যেন ‘জীবন চাইলে তাও হাযির, কিন্তু অর্থ চাইলে কথা আছে।’ সুতরাং পকেট থেকে পয়সা বের করা খুব কঠিন কাজ। কিন্তু এই তিক্ত ওষুধটাও সেবন করুন। আপনি যখন তাকে হাদিয়া দিলেন তখন বিষয়টি এই দাঁড়ায় যে, পকেট থেকে পয়সা বের হল এবং এমন লোকের কাছে পৌঁছল যার প্রতি আপনার অন্তরে বিদ্বেষ রয়েছে। মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনি যখন এই কাজটি করবেন, তখন এর মাধ্যমে হাসাদের ব্যাধি থেকে নিষ্কৃতি পাবেন।
এ কাজ বারবার করলে হিংসা শেষ হয়ে যাবে
এরপর হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেছেন, ‘একটি উল্লেখযোগ্য সময় পর্যন্ত এই কাজগুলো করতে হবে। এতে করে ‘হাসাদ’ দূর হয়ে যাবে। অন্তত বিশবার এই কাজগুলো করবে।’ এক ব্যক্তি হযরত থানভী (রহ.)-এর কাছে চিঠি লিখল যে, অমুকের প্রতি আমার মনে ‘হাসাদ’ রয়েছে। জবাবে হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী (রহ.) বললেন যে, তার প্রশংসা কর, সম্মান কর এবং হাদিয়া দাও। অন্তত বিশবার যদি এই কাজগুলো কর তাহলে ইনশাআল্লাহ হাসাদ দূর হয়ে যাবে।
‘হাসাদ’ আর ‘হিকদ’-এর মধ্যে পার্থক্য
আরেক চিঠির জবাবে হযরত থানভী (রহ.) লিখেন, ‘কারও ক্ষতি বা অবনতির সংবাদ শুনে যদি অন্তরে আনন্দ জাগে তাহলে তা হচ্ছে ‘হাসাদ।’ আর যদি তার পক্ষ থেকে কষ্ট পেয়ে থাক তাহলে তা ‘হিকদ।’ কিন্তু শুধু অন্তরের এই অবস্থার ওপর শাস্তি হবে না। যদি অন্তরের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করা হয় তাহলে শাস্তি হবে। যেহেতু কাজটি ইচ্ছাধীন তাই তা না করাও ইচ্ছাধীন। তবে ওই দুষ্টু প্রবণতা দুর্বল করা সবার নিজ নিজ কর্তব্য, যেন তা প্রবল হয়ে না ওঠে। এর উপায় এই যে, মনে মনে লজ্জিত হবে এবং আল্লাহর দরবারে দোয়া করবে, আল্লাহ যেন তা দূর করে দেন। ওই ব্যক্তির সহযোগিতা করবে, কাজকর্মের দ্বারা হোক, অর্থের দ্বারা হোক কিংবা দোয়ার মাধ্যমে হোক। এভাবে এই মন্দ প্রবণতা দূর হয়ে যাবে।’ (আনফাসে ঈসা: পৃ. ১৭৪)
এই চিঠিতে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) হাসাদ ও হিকদের পার্থক্য আলোচনা করেছেন। ‘হাসাদ’ সম্পর্কে বলেছেন, ‘কারও ক্ষতির সংবাদ শুনে যদি অন্তর খুশি হয়। যেমন কারও ঘরে চুরি বা ডাকাতি হওয়ার খবর শুনে মনে হল যে, ভালো হয়েছে কিছুটা হলেও তো তার সম্পদ কমেছে। কারও ব্যবসায়ে লোকসান হল, এটি শুনে খুব আনন্দ লাগল যে, খুব ভালো হয়েছে। অনেক বেড়েছিল এখন কিছুটা ঠান্ডা হবে। এগুলো হচ্ছে অন্যের নেয়ামত ধ্বংস হওয়ার আনন্দ। এটিও হাসাদের একটি প্রকার। এভাবে কারও বিপদ ও ক্ষতিতে খুশি হওয়া ‘হাসাদ।’
কেন এতো বিদ্বেষ?
কারও দ্বারা যদি তুমি কষ্ট পেয়ে থাক এবং এ কারণে তার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়, আর এই ঘৃণার কারণে তার ক্ষতিতে তোমার অন্তরে আনন্দ জাগে, তাহলে একে ‘হিকদ’ বলা হয়। অর্থাৎ তোমার মনে কীনা রয়েছে। কীনার ব্যাখ্যা এই যে, কোনো ব্যক্তি তোমাকে কষ্ট দিয়েছে, যার কারণে তোমার অন্তরে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগ্রত হয়েছে, কিন্তু যেমন প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা ছিল তা নেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই তোমার অন্তরে চাপা ক্রোধ ও ঘৃণা সৃষ্টি হল। এখন তার কোনো ক্ষতির সংবাদ তোমাকে আনন্দিত করছে। তুমি তার ক্ষতি কামনা করছ। এই অবস্থাটাকে ‘কীনা’ বলা হয়। হযরত থানভী (রহ.) এখানে শুধু ‘হিকদ’ ও ‘হাসাদে’র পার্থক্য উল্লেখ করেছেন। যার সারকথা এই যে, কারও ক্ষতির কারণে অন্তরে আনন্দ জাগলে একে ‘হাসাদ’ বলে। আর কারও দ্বারা কষ্ট পাওয়ার কারণে এই অবস্থাটা সৃষ্টি হলে একে ‘হিকদ’ ও ‘কীনা’ বলে।
এই প্রবৃত্তিকে দুর্বল করা জরুরি
এরপর হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, তবে শুধু মানসিক প্রবণতার ওপর শাস্তি হবে না। অর্থাৎ অন্তরে স্বভাবজাতভাবে যে আনন্দ সৃষ্টি হয়েছে, এটি যেহেতু ব্যক্তির কাজ নয় তাই এর ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি দেওয়া হবে না। কিন্তু যদি এই প্রবণতার বশবর্তী হয়ে এমন কোনো কাজ করে যার দ্বারা তার কষ্ট হয় তাহলে শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর এই কাজটি যেমন ব্যক্তির নিজের কাজ তেমনি তা না করাও তার ইচ্ছাধীন।
তবে ওই মানসিক প্রবণতাও দূর করা অপরিহার্য, যাতে তা শক্তিশালী না হয়ে যায়। এর উপায় এই যে, অন্তরের এই প্রবণতার ওপর লজ্জিত ও অনুতপ্ত হবে এবং আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করবে। আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করবে, আল্লাহ যেন তা দূর করে দেন এবং ওই ব্যক্তির সাহায্য করবে, কাজ-কর্মের মাধ্যমে হোক কিংবা অর্থের মাধ্যমে হোক অথবা দোয়ার মাধ্যমে হোক। এভাবে এটি স্তিমিত ও মৃতপ্রায় হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা হেফাজত করুন। হাসাদ খুবই মন্দ প্রবণতা। সবচাইতে ভয়ের বিষয় এই যে, এই প্রবণতা আলেম-ওলামাদের মধ্যে খুব বেশি পাওয়া যায়। কেননা ইলম এমন এক দৌলত যার প্রকৃতি ঊর্ধ্বগামিতা। এজন্য অন্য কাউকে ইলম ও মকবুলিয়াতের দিক থেকে অগ্রগামী হতে দেখলে অন্তরে হাসাদ সৃষ্টি হয়ে যায়।
শয়তানের গল্প
আল্লামা মুফতী তকী উসমানী (হাফি.) বলেন, আমার মুহতারাম আব্বাজান (রহ.)-এর যবান থেকে শুনেছি যে, এক ব্যক্তি স্বপ্নে শয়তানকে ফেরিওয়ালার সুরতে দেখল। তার কাঁধে বেশ কয়েকটি পুঁটলি। কিন্তু সেগুলো বড়ই আজব ও বিচিত্র জিনিসে পরিপূর্ণ। কোনোটাতে পায়খানা কোনোটাতে পেশাব, কোনোটাতে পুঁজ- এভাবে সারা দুনিয়ার সব নাপাকি তার কাছে বিদ্যমান। আবার সব পুঁটলিতেই বিভিন্ন লেবেল লাগানো রয়েছে। যেমন হাসাদ, কীনা, সম্পদের মোহ, পদ ও পদবির মোহ ইত্যাদি। রাস্তায় কোনো এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এগুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? শয়তান বলল, এগুলো আমার ব্যবসার পণ্যসামগ্রী। এগুলো বিক্রি করতে যাচ্ছি। লোকটি বলল, এই ময়লা-আবর্জনা আবার কে কিনবে? শয়তান বলল, এগুলো কোথায় বিক্রি হয় তা আমার জানা আছে। ‘সম্পদের মোহ’ লেবেল আঁটা যে পুঁটলিটা দেখছ, এটি বিক্রি হবে ব্যবসায়ীদের কাছে। তারা এর ক্রেতা। আর এই যে ‘পদমর্যাদার মোহ’ ও ‘হাসাদ’ লেবেল আটা পুঁটলিটি দেখছ, এগুলো বিক্রি হবে আলেম-ওলামাদের কাছে। তারাই এর গ্রাহক। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই! আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। আমীন!
ইলম দ্বারা হিংসা ও দুনিয়ার মোহ সৃষ্টি হয়
ইলমের পাশাপাশি যদি ইখলাস না থাকে তাহলে ওই ইলম দ্বারা ‘পদের মোহ’ সৃষ্টি হয়। আর তা থেকেই সৃষ্টি হয় ‘হাসাদ।’ কেননা যখন অন্যকে ইলমের দিক দিয়ে অগ্রগামী হতে দেখবে তখন তার অর্ন্তজ্বালা সৃষ্টি হবে যে, সে কেন আমার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে গেল? কেন তার এত প্রসিদ্ধি ও খ্যাতি-সুনাম কেন তার এত গ্রহণযোগ্যতা? অন্যদিকে যদি ইলমের সঙ্গে ইখলাস থাকে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য হয় তাহলে তো হাসাদ ও ‘হুব্বে জাহ’ সৃষ্টি হওয়ার প্রশ্নই আসে না; বরং অন্যকে ইলমের দিক থেকে অগ্রগামী হতে দেখলে খুশি ও আনন্দিত হবে। আল্লাহ তাআলা নিজ রহমতে আমাদের সবাইকে ইখলাস দান করুন। আমীন!
ইলমের সঙ্গে ইখলাস ও সেবক
হওয়ার মনোভাব থাকতে হবে
ইলমের সঙ্গে ইখলাসও থাকা জরুরি। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য ইলম অর্জন করা উচিত। ইলমের দ্বারা অন্যের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশেষত্ব প্রকাশ করা কোনোমতেই উচিত নয়। মুফতী তকী উসমানী (হাফি.) বলেন, আমাদের শায়খ হযরত ডা. আবদুল হাই আরেফী (রহ.) অনেক সুন্দর কথা বলতেন, আল্লাহ তাআলা কি এই ইলম অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়োত্ব জাহির করার জন্য প্রদান করেছেন? ভাই। আল্লাহ তোমাকে একটি নেয়ামত দান করেছেন, একে যথাযথ স্থানে ব্যবহার কর। ইলমের সঠিক ব্যবহার হল, এর দ্বারা মানুষের ফায়দা ও উপকার করা। তোমরা হলে সেবক আর সব সৃষ্টি তোমাদের সেবাস্থল। তাই ইলমের মাধ্যমে অন্যের ওপর বড়োত্ব জাহির নয় সেবার প্রেরণা সৃষ্টি হওয়া উচিত। যখন ইখলাস সৃষ্টি হবে তখন এ ইলমের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে অগ্রগামী হতে দেখলে এবং তার দ্বারা মানুষের ফায়দা-উপকার হতে দেখলে অন্তরে এই অনুভূতি সৃষ্টি হবে যে, তার মাধ্যমে তো আমার উদ্দেশ্যই পূরণ হচ্ছে। অতএব তিনি মনোক্ষুণ্ণ ও দুঃখিত হওয়ার পরিবর্তে খুশি ও আনন্দিত হবেন।
খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি বড়ই মন্দ জিনিস
মুফতী তকী উসমানী (হাফি.) বলেন, প্রসিদ্ধি-খ্যাতি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তা ভালো বিষয় নয়ই; বাস্তব কথা এই যে, দুনিয়ার শান্তি ও আরাম-আয়েশের দিক থেকেও অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও মন্দ বিষয়। এর ফলে মানুষ কোনো কাজের যোগ্য থাকে না। এ ধরনের অর্থহীন ও অবাঞ্ছিত বিষয়ের জন্য কেন মানুষ লালায়িত হয় এবং কেন অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ করে? বাস্তবতা হল, মানুষ যদি নিজের পরিবর্তে অন্যের দিকে অধিক আকৃষ্ট হয় তবে তো নিজের আনন্দিত হওয়া উচিত। কেননা সে আপনার অর্ধেকেরও বেশি। কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য ওই ব্যক্তির প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ না করে আল্লাহ তাআলার শোকরিয়া আদায় করুন।
মোদ্দাকথা অন্তরে ইখলাস থাকলে হিংসা-হাসাদ নির্মূল হয়ে যায়। সুতরাং হিংসা-হাসাদ থেকে রক্ষা পাওয়ার বড় হাতিয়ার অন্তরে ইখলাস সৃষ্টি করা। যতই ইখলাস সৃষ্টি হতে থাকবে ততই অন্তর থেকে হিংসা-হাসাদ দূর হতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাকে ও আপনাদের সবাইকে আমল করার তওফিক প্রদান করুন। আমীন!