জামেয়া ওয়েবসাইট

শনিবার-৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভুল করেছেন বলে হাল ছেড়ে দেবেন না;  মুফতি ড. ইসমাইল মেনক

(ডক্টর ইসমাইল ইবনে মুসা মেনক, যিনি মুফতি মেনক নামে অধিক পরিচিত। একজন মুসলিম শিক্ষাবিদ, ইসলাম প্রচারক ও বক্তা। তিনি বর্তমানে জিম্বাবুয়ের প্রধান মুফতি। ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৭ সালে তিনি জর্ডানের রয়্যাল আল-বায়ত ইনস্টিটিউট ফর ইসলামিক থট দ্বারা বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাবশালী ৫০০ মুসলমানদের মধ্যে একজন হিসেবে ঘোষিত হন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়ালেখা করেন। মেনক সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করেন এবং মালদ্বীপে ধর্মীয় উগ্রবাদ দমনে তার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। ৩১ মার্চ ২০১৮-এ, তিনি লাইবেরিয়ার মুসলমানদেরকে মুসলিম-খ্রিস্টান সহিংসতা এড়াতে আহ্বান জানিয়েছিলেন, এই যুক্তিতে যে মুসলিম এবং খ্রিস্টানরা এক পিতা, নবী আদমের ভাই ও বোন। মুসলমানদের সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য পশ্চিমা মিডিয়াকে দায়ী করেন তিনি। গালফ নিউজ অনুসারে, মেনক বলেছিলেন যে এই পৃথিবীতে প্রত্যেকেই একটি পরিবারের একটি অংশ এবং একজন নির্মাতা রয়েছেন, তাই, কারোর ওপর কোনো বিশ্বাস ও মতাদর্শ জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার নেইসম্পাদক)

ভুল করেছেন বলে হাল ছেড়ে দেবেন না

 

 

 মুফতি ড. ইসমাইল মেনক

        লেখক: জিম্বাবুয়ে, আফ্রিকা

 

এক. আমরা সবাই ভুল করি। ভুল করেছেন বলে আপনি হাল ছেড়ে দেবেন না। এটা ঘটার আগেই সর্বশক্তিমান ভুল পথ জানতেন। দুঃখিত ও বিষন্নবোধ করার পরিবর্তে, প্রার্থনা করুন। আপনার বিষয় সহজ করার জন্য তাঁকে বলুন। অতীতের ওপর ফোকাস করা বন্ধ করুন এবং এগিয়ে যেতে থাকুন।

দুই. সর্বশক্তিমান। এই বরকতময় দিনে, আমরা আপনার কাছে আমাদের সরল পথে রাখতে মুনাজাত করি। আমাদেরকে এই দুনিয়ার মিথ্যা ও প্রতারণার দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করুন। আমাদের সত্যকে সত্য হিসেবে দেখান এবং আমাদেরকে তা অনুসরণ করার সুযোগ দিন। আমাদের ভুলকে ভুল দেখান এবং তা এড়াতে আমাদের সাহায্য করুন। আমীন।

তিন. তর্কের পরিবর্তে আলোচনা এবং যুক্তি উপস্থাপনকে অগ্রাধিকার দিন কারণ আপনি যখন তর্ক করেন তখন কে সঠিক এবং কে ভুল তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন আপনি, অন্যদিকে আলোচনার দ্বারা সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যতদূর সম্ভব, শান্তিপূর্ণ সমাধান অনুসন্ধান করুন এবং যদি আপনি তা না করতে পারেন তবে বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণে সম্মত হন।

পুনশ্চ

এক. আপনার হৃদয় প্রতিদিন অনেক কিছু পেতে চায়। তার অনেক কিছু আপনার প্রার্থনায় আসে না। কিন্তু তাঁকে বিশ্বাস করুন। তিনি জানেন আপনার কী প্রয়োজন এবং তিনি শেষ পর্যন্ত নিরাশ করবেন না।

দুই. ভালো কাজ করতে গিয়ে, এমনকি সেটি ছোট কাজ হলেও তা করতে ক্লান্ত হবেন না। আমরা প্রায়ই লোকেদের বলতে শুনি যে তারা যে ভালো কাজ করে তা কেউ লক্ষ করে না। কিন্তু সর্বশক্তিমান লক্ষ করেন। তিনি সর্বজ্ঞ। তাই চলতে থাকুন এবং যতটা সম্ভব তা করুন। ভালো কাজগুলি প্রায়শই বড় হয় এবং পুরস্কারগুলি বহুগুণ বেড়ে যায়।

তিন. অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে উঠবেন না এবং জিনিসগুলি ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না। অনেক সময়, লোকেরা তাদের বোঝা বহন করছে এমনভাবে আচরণ করে। দয়াশীল হন, চেষ্টা করুন এবং তাদের অবস্থায় নিজেকে রেখে ভাবুন আর সহানুভূতিশীল হোন। আপনি যদি না পারেন তবে ভালো ব্যবহার করুন এবং তাদের আঘাত করবেন না। আপনার জীবন আরও শান্তির হবে!

চার. আপনি যদি সর্বশক্তিমানের অপছন্দকৃত কিছু পোস্ট করে মিলিয়ন মিলিয়ন লাইক অর্জন করেন তবে আপনি হেরে গেছেন! যেদিন আপনি আপনার নির্মাতার সাথে সাক্ষাৎ করেন সেদিন আপনি গর্বিত হবেন এমন একটি উত্তরাধিকার রেখে যান! দায়িত্ববান হোন। অনৈতিক বা পাপযুক্ত সব কিছু এড়িয়ে চলুন। আপনি যদি দায়বদ্ধ না হতে পারেন তবে কিছু অ্যাপস আনইনস্টল করার সময় এখনই আপনার সামনে।

পাঁচ. নিজের প্রতি একটি অনুগ্রহ করুন। আপনি যদি কিছু দেখানোর জন্য করে থাকেন তবে তা করবেন না। সত্যিই এটি নিরর্থক। আপনি ক্ষণিকের গৌরব অর্জন করতে পারেন এবং লোকেরা আপনাকে প্রশংসা ইত্যাদি করবে কিন্তু সত্যি বলতে কি, এটি সর্বশক্তিমানের কাছে কিছুই নয়! তাঁর অনুমোদনই আপনার জন্য প্রয়োজন। এটাই একমাত্র বিষয় যা মূল্য রাখে!

ছয়. সর্বশক্তিমান যে জানেন আপনার হৃদয় ও অন্তর কতটা ক্লান্ত—এ বিষয়ে কখনও সন্দেহ করবেন না। অবশ্যই যদি কাঁদতে হয়, কাঁদুন। আপনার প্রয়োজন হলে অবশ্যই হৃদয়ের কান্না ঝেড়ে ফেলুন। আর যখন প্রয়োজন হয় তখন সময় নিন। আর যখন সমস্ত কিছু বলা এবং করা হয়ে যায়, তখন উঠে দাঁড়ান এবং সাহসের সাথে আবার হাঁটুন। তিনি যে সর্বদা আপনার সাথে আছেন তা জেনে রেখে দৃঢ় থাকুন। চলতে থাকুন!

সাত. বিরাম দিন! তিনি আমাকেসহ আমার সব কিছু নিয়ে নিতে পারেন যেকোনো সময়। খ্যাতির পেছনে দৌড়াবেন না। এটি মনোযোগ আকর্ষণের লোভ সৃষ্টি করে। যদি এর প্রতি আসক্ত হন, তবে আপনার মনে হবে সবার দ্বারা স্বীকৃত না হলে আপনি প্রকৃত কিছু হতে পারেননি। আর আপনার কামনা বাসনার ব্যাপারে সাবধান হোন। এটি আপনাকে বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দিতে পারে। এর অনুসরণ করে আপনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন তার জন্য আপনাকে অনুতপ্ত হতে হবে।

আট. সর্বশক্তিমানের কাছে ফিরে যাবার পথে কোনো দুর্যোগ বা রোগ সৃষ্টি করতে দেবেন না। ব্যস্ততা সত্ত্বেও সর্বশক্তিমানকে সব সময় স্মরণ করুন। আর. এই দুনিয়ার আনন্দ উপভোগে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে আপনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট এবং খুশি হতে পারবেন এমন বোকার মতো ভাববেন না। আপনি পারবেন না এবং আপনি সক্ষম হবেন না।

নয়. আমরা সর্বশক্তিমানের ইবাদত বন্ধ রাখি এবং বিলম্ব করি। অনেকেই তা করেন। আমাদের পার্থিব কাজগুলো তখন অগ্রাধিকার পেয়ে যায়। মনে রাখবেন শেষ পর্যন্ত আপনি ব্যর্থ হবেন। আপনি আবারো ব্যর্থ হবেন। আপনি সেই আশার ঝলকানি হারাতে শুরু করবেন যার জন্য শয়তান আমাদের প্ররোচিত করে, সর্বশক্তিমান থেকে যা দূরে নিয়ে যায়।

দ্রষ্টব্য

হযরত আবু হুরায়রা (রযি.) থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এমন তিনজন ব্যক্তির আলোচনা এসেছে, ‘যারা পৃথিবীতে অনেক ভালো কাজ করেও পরকালে তাদের প্রাপ্তি ছিল শূন্য। এই তিন ব্যক্তির প্রথমজন খ্যাতির মোহে জিহাদ করে শহীদ হয়েছিল, দ্বিতীয়জন খ্যাতির মোহে জ্ঞানার্জন করেছিল এবং তৃতীয়জন খ্যাতির মোহে দান করেছিল। তাদের আল্লাহ বলেছিলেন, তোমাদের প্রত্যাশা ছিল মানুষের কাছে খ্যাতি আর তোমরা তা পেয়েছ। সুতরাং আজ আমার কাছে তোমাদের প্রাপ্তি শূন্য।’ (সুনানে নাসায়ী: ৩১৩৭)

সমালোচকরাও বদলে যেতে পারে

আপনার নিরাপত্তাহীনতার ভালোভাবে মোকাবেলা করুন। যদি কর্তৃপক্ষের কেউ আপনাকে সমালোচনা করেন, তবে এটি শনাক্ত করুন এবং উপলব্ধি করুন যে সময়ের সাথে সাথে লোকেরা পরিবর্তিত হয়। অতীতকে ভুলে যান। তা না হলে, নিরাপত্তাহীনতা আপনাকে সর্বদা সংশয়ী করে রাখবে। আপনার মনে হবে যে সবাই আপনার সম্পর্কে কথা বলছেন!

পুনশ্চ

এক. সবচেয়ে বরকতময় দিনগুলো নষ্ট করবেন না। সর্বশক্তিমান আমাদের সারা বছর ধরে আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির জন্য এই সময় দেন। তাই আপনার উদ্দেশ্যকে পরিশুদ্ধ করুন, একটি পরিকল্পনা করুন এবং আপনি অনেক কিছু অর্জনের পথে আছেন।

দুই. আপনার অতীতকে মনে গেঁথে রাখবেন না। কী ঘটেছে তার স্বীকৃতি দিন এবং আপনার জন্য সেখানে যেসব পাঠ রয়েছে তা থেকে শিক্ষা নিন। সর্বশক্তিমান কোনো এক কারণেই সেটি করেছিলেন। অতীতকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে সাহস লাগে। অন্ধকার সময় থেকে বেরিয়ে আসুন এবং নতুন আলো আর আরও ভালো দিনের দিকে এগিয়ে যান!

তিন. আপনি এমন লোকদের সাথে দেখা করবেন, যাদের কাছে আপনার মধ্যে সবচেয়ে খারাপটি নিয়ে আসার সামর্থ্য রয়েছে। তারা আপনাকে উসকে দিয়ে এমন জিনিস বলতে প্ররোচিত করতে পারে অথবা আপনাকে এমন কিছু করার জন্য চাপ দিতে পারে সাধারণভাবে যা আপনি করার কথা নয়। সুতরাং আপনার মূল্যবোধের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থাকুন এবং অন্যকে আপনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে কোনোভাবেই দেবেন না!

চার. অন্যের ভুলের দিকে নজর দেওয়ার জন্য সময় নষ্ট করবেন না, নিশ্চয়ই আমাদের নিজস্ব অনেক বিচ্যুতি রয়েছে। আর কোনোভাবেই মানুষের অতীত দিয়ে বিচার করবেন না। কেন? কারণ লোকেরা তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। মানুষ নিজেকে পরিবর্তন করে। মানুষ এগিয়ে যায়। সুতরাং আপনার মনের পূর্ব ধারণার মধ্যে আটকে থাকবেন না আর লোকেদের সম্পর্কে আপনি আগে কী জানতেন তার ওপর ভিত্তি করে অবমূল্যায়ন করতে যাবেন না।

পাঁচ. আপনার পদক্ষেপের গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করে নিন। প্রায়শই, মুহূর্তের উত্তাপে আমরা ডিফেন্সিভ হয়ে পড়ি অথবা এমনকি রাগান্বিতও হয়ে থাকি। এটি করবেন না! যখন কিছু বলা হয় তা শুনুন, আপনার দুর্বলতা চিহ্নিত করুন এবং এটিকে আপনার কল্যাণের জন্য কাজে লাগান। তা না হলে আপনি কীভাবে নিজেকে উন্নতির পথে নিয়ে যাবেন?

দ্রষ্টব্য

لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ١ؕ۬ وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ شَيْءٍ فَاِنَّ اللّٰهَ بِهٖ عَلِيْمٌ۰۰۹۲

‘তোমার প্রিয় ও পছন্দের জিনিস থেকে (আল্লাহর রাস্তায়) দান করতে না পারলে তুমি কখনো সত্যিকারের ধার্মিক হতে পারবে না। অন্যের জন্যে তুমি যা-কিছু ব্যয় বা দান করো, আল্লাহ তা ভালোভাবেই জানেন।’ (সূরা আলে ইমরান: ৯২)

যিনি আপনার জন্য ভালো তার জন্য আপনার পক্ষে ভালো হওয়া সহজ। আসল পরীক্ষাটি আসে, যে আপনার সাথে ভুল ব্যবহার করেছে তার সাথে আপনি যখন ভালো ব্যবহার করতে পারেন তখন। এটাই হলো পরিপক্বতা। আর ধন্য তিনি, অনেক বেশি ভেঙে পড়ার পরও অন্যের প্রতি বিনয়ী ও সদয় হওয়ার সাহস যার হৃদয়ে রয়েছে। এ ধরনের লোকদের লালন করুন। তাদের কাছ থেকে শিখুন।

অনুবাদ: মাসুমুর রহমান খলিলী

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ