ফিকহশাস্ত্র পাঠদান: কিছু পরামর্শ ও কিছু প্রস্তাবনা
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এ জীবনব্যবস্থাকে বিন্যস্ত ও কাঠামোবদ্ধ করেছে ফিকহ। ফিকহ (الفقه) আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে উপলব্ধি করা, গভীরভাবে কিছু বুঝতে পারা, উন্মোচন করা, অনুধাবন করা, সূক্ষ্মদর্শিতা ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় ফিকহ হচ্ছে,
الْعِلْمُ بِالْأَحْكَامِ الشَّرْعِيَّةِ الْعَمَلِيَّةِ الْـمُكْتَسِبَةِ مِنْ أَدِلَّتِهَا التَّفْصِيْلِيَّةِ.
‘এমন শাস্ত্র যার মাধ্যমে ইসলামের উৎসসমূহ (কুরআন-হাদীস, ইজমা ও কিয়াস) থেকে বিস্তারিত প্রমাণসহ ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন বিধি-বিধান ও ইসলামি সমাধান জানা যায়।’[1]
মূলত ফিকহ কুরআন ও হাদীস থেকে ভিন্ন কিছু নয়। বরং কুরআন ও হাদীসের বিস্তারিত প্রমাণাদি থেকে উদ্ভাবিত শরীয়তের ব্যবহারিক বিধি-বিধানের নামই হচ্ছে ফিকহ। মাতা- পিতার সাথে সন্তানের যেমন সম্পর্ক, কুরআন-হাদীসের সাথেও ফিকহের সেই একই সম্পর্ক। কুরআন-হাদীস হচ্ছে শরীয়তের أصل বা মূল। আর ফিকহ হচ্ছে এর শাখাপ্রশাখা মাত্র। ইলাহী হিদায়েত ও নববী শরীয়তের বাস্তবরূপ হচ্ছে এ ফিকহ।
ফিকহ কুরআন-হাদীসেরই বাস্তবভিত্তিক ব্যাখ্যা। ফিকহ ব্যতিরেকে কুরআন ও হাদীসের মর্ম উপলব্ধি করা এবং তা বাস্তবায়িত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মাসায়িলে গায়রে মানসূসা (ﻣﺴﺎﺋﻞ غير ﻣﻨﺼﻮﺻﺔ) তথা যেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই, সেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে ফিকহের আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। এমনকি মাসায়িলে মানসূসা (ﻣﺴﺎﺋﻞ ﻣﻨﺼﻮﺻﺔ)-এর মধ্যেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফিকহের আশ্রয় গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বর্তমানে প্রচলিত ফিকহশাস্ত্রে মানবজীবনের পাঁচটি দিক নিয়ে আলোচনা করে। যথা-
- মুয়ামালাত (লেনদেন),
- মুয়াশারাত (সামাজিক শিষ্টাচার),
- ইবাদত (উপাসনা),
- আখলাক (নীতিবিদ্যা) ও
- সিয়াসাত (রাজনীতি)।
বস্তুত ফিকহ ইসলামী শরীয়তের সুবিন্যস্ত ও সুগ্রন্থিতরূপ। এর মাধ্যমে শরীয়তের মৌলিক উৎস ও দলীলগুলো থেকে ইসলামের সামগ্রিক বিধিবিধান জানা যায় এবং কালের বিবর্তনে উদ্ভূত নতুন নতুন বিভিন্ন সমস্যা ও প্রশ্নের শরীয়তসম্মত সমাধান ও উত্তর উদ্ভাবন করা যায়। ফিকহের প্রধান কাজ হচ্ছে শরীয়তের স্বীকৃত মূলনীতি ও দলীলগুলোর ভিত্তিতে প্রমাণ পেশ করে বিধান সাব্যস্ত করা। কুরআন-হাদীসেরই সহজ রূপায়ন হচ্ছে ফিকহ। কাজেই দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায় যে, ফিকহের ওপর আমল করা প্রকারান্তরে কুরআন ও হাদীসের ওপরই আমল করা। এ কারণেই ফিকহ হাসিল করার জন্য কুরআন ও হাদীসে বহু তাকিদ করা হয়েছে। আল্লাহপাক বলেন,
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُوْنَ لِيَنْفِرُوْا كَآفَّةً١ؕ فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآىِٕفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوْا فِي الدِّيْنِ وَلِيُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُوْنَؒ۰۰۱۲۲
‘তাদের (মুসলিমদের) একটি গোত্র থেকে একদল লোক কেন (রসুলের সঙ্গে) বের হয় না? যাতে তারা দীনের সঠিক বুঝ লাভ করতে পারে এবং ফিরে এসে নিজ গোত্রের লোকদেরকে সতর্ক করতে পারে। এতে তারাও হয়তো বেঁচে থাকতে পারবে।’[2]
তেমনি রসুল (সা.) বলেছেন,
«فَقِيهٌ وَاحِدٌ أَشَدُّ عَلَى الشَّيْطَانِ مِنْ أَلْفِ عَابِدٍ».
‘একজন ফকীহ শয়তানের মোকাবেলায় হাজারো আবিদ অপেক্ষা উত্তম।’[3]
আমাদের দরসে নিযামিতে ফিকহশাস্ত্রের অনেক কিতাবাদি সযত্নে পড়ানো হয়। (১) বেহেশতী জেওর, (২) মালা বুদ্দা মিনহু, (৩) নূরুল ঈযাহ, (৪) কুদুরী, (৫) কানযুদ দাকায়েক, (৬) শরহে বেকায়া, (৭) হিদায়া এবং (৮) রদ্দুল মুখতার ইত্যাদি কিতাবসমূহ কওমি মাদরাসা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এসব কিতাব পাঠদানের মূল উদ্দেশ্য ছাত্রদের মধ্যে ‘ফিকহি ইসতিদাদ’ তথা ইসলামি আইন শাস্ত্রে মৌলিক যোগ্যতা তৈরি করা। ‘ইসতিদাদ’ অর্থ মৌলিক যোগ্যতা অর্জন ও উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতিগ্রহণ, বিশেষজ্ঞ তৈরি করা এই পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য নয়। পাঠ্যভুক্ত কিতাবগুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যাবে, এখানে ভাষা, ব্যাখ্যা, যুক্তি ও দর্শনে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর সর্বত্রই এসব বিষয়ে জোর দেওয়া হত। কেননা তখন শিক্ষাদানের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কীভাবে ইলমি ভাষা পাঠ করতে হয়, পাঠ্যপুস্তকের জটিলতা সমাধান-হল করতে হয়, যুক্তি-প্রতিযুক্তি দিতে হয়, সেটা শেখানো; সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ শিক্ষাদান এখানে উদ্দেশ্য নয়।
পাঠ্যক্রমে সংক্ষিপ্তভাবে সকল বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য হল, যাতে মধ্যম ধরনের মেধাসম্পন্ন ছাত্রগণ ১৬-১৭ বছরে পড়ালেখা শেষ করতে পারে। উসূলে ফিকহ ও ফিকহের কিতাবাদি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য হল, এমন সব আলেম তৈরি করা, যাদের চিন্তাশক্তি প্রখর হবে এবং তারা এর মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় ব্যাপারে যেকোনো আক্রমণকে যুক্তি ও চিন্তার সাহায্যে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে।
দরসে নিযামিতে শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তক অনেক জরুরি বিষয়। শিক্ষক ছাত্রদেরকে অভিজ্ঞতা ও নৈতিকতা শিক্ষা দান করেন। শিক্ষক শিক্ষা দেন কীভাবে ধর্মীয়-নৈতিক জীবন যাপন করা যায়। পাঠ্যপুস্তকে সেই অভিজ্ঞতা সংরক্ষিত হয়। টিকা-ফুটনোটে সংযুক্ত হয় সংশ্লিষ্ট তর্ক-বিতর্ক। তাই শুধু পাঠ্যপুস্তকের মূলপাঠ নয়, এই টিকা-ফুটনোটগুলোও দরসে নিযামিতে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পাঠ্যপুস্তক শুধু পড়ে যাওয়া হয় না, প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্নে যাচাই ও নিশ্চিত করা হয় আলোচ্য তথ্য।
বর্তমানে আমাদের পাঠ্যক্রমে যে সকল ফিকহের কিতাবাদি রয়েছে, সেগুলোর পাঠদান কীভাবে আরো ফলপ্রসূ করা যায়? এ নিয়ে চিন্তা-গবেষণায় মগ্ন ছিলাম। ইত্যবসরে পাকিস্তানের নন্দিত ইসলামি ম্যাগাজিন মাহনামা আশ-শরীয়ার প্রধান সম্পাদক ও পাকিস্তানের বিশিষ্ট আলেমে দীন আল্লামা আবু আম্মার যাহেদ আর-রাশেদী (হাফি.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ পেলাম, যা তিনি বিগত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ ইংরেজি তারিখে পাকিস্তান বেফাকুল মাদারিস আল-আরাবিয়া কর্তৃক আয়োজিত জামিয়া উসমানিয়া নথিয়া রোড, পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত চার দিনব্যাপী শিক্ষকপ্রশিক্ষণ কোর্সে শিক্ষকদের উদ্দেশে প্রদান করে ছিলেন। নিম্নে এর চম্বুকাংশ পেশ করা হল:
ফিকহশাস্ত্র, সনাতন অর্থ ও চলমান উদ্দেশ্য
প্রথমত فقه (ফিকহ) শব্দের অর্থ এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতে চাই। প্রথম শতাব্দীতে যে অর্থ ও উদ্দেশ্যের জন্য فقه ও تفقهশব্দগুলি উচ্চারিত হয়েছিল, তা আজকের অর্থের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল। ফিকহের এ সংজ্ঞাটি আল-তাওযীহ ওয়াত তালভীহে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বরাতে বর্ণিত হয়েছে যে,
مَعْرِفَةُ النَّفْسِ مَا لَـهَا وَمَا عَلَيْهَا.
‘একজন মানুষ তার অধিকার ও কর্তব্যের জ্ঞান লাভ করাকে ফিকহ বলা হয়।’[4]
অধিকার ও কর্তব্যের এই পরিধিটি দীনের সমস্ত ক্ষেত্রকে জুড়ে। তাই সেই যুগে ফিকহ দীনের সামগ্রিক উপলব্ধিকে বলা হত। সুতরাং আল-তাওযীহ ওয়াত তালভীহের সম্মানিতে লেখক বলেছেন যে, ইমাম সাহেবের সময়ে ‘ইলমুল হাকীকাত’, ‘ইলমুত তরীকত’ ও ‘ইলমুশ শরীয়ত’; তিনটিই ফিকহের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এর সাথে শরীয়তের বিধি-বিধানের জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা চর্চা, উত্তম চরিত্র এবং ঈমানের বিষয়গুলোও ফিকহের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। তাই হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) আকীদাসংক্রান্ত গ্রন্থটির নাম দিয়েছেন আল-ফিকহুল আকবর। পরবর্তী কালের ফকীহগণ مَعْرِفَةُ النَّفْسِ مَا لَـهَا وَمَا عَلَيْهَا-এর সাথে عملًا (ব্যবহারিকভাবে) শব্দটি যোগ করে ফিকহকে বিধি-বিধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন।
ইমাম গাযালী (রহ.) ইয়াহইয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থে একই কথা বলেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন যে, ফিকহশাস্ত্র থেকে ঈমান বিষয়ক আলোচনা এবং আধ্যাত্মিকতাকে পৃথক করে, কেবলমাত্র ব্যবহারিক কিছু জ্ঞান অর্জন করাকে ফিকহ বলা হচ্ছে। অথচ পবিত্র কুরআনে فقه ও تفقه দ্বারা যে উদ্দেশ্য বুঝানো হয়েছে, তা এই অর্থ দ্বারা বোঝানো সম্ভব নয়।
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُوْنَ لِيَنْفِرُوْا كَآفَّةً١ؕ فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآىِٕفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوْا فِي الدِّيْنِ وَلِيُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُوْنَؒ۰۰۱۲۲
ইমাম আল-গাযালী (রহ.) বলেন যে, পবিত্র কুরআনে لِّيَتَفَقَّهُوْا فِي الدِّيْنِ ؒ۰۰۱۲۲-এর সাথে لِيُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ ؒ۰۰۱۲۲ উল্লেখ করে ফিকহের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে যে, জাতিকে আল্লাহর শাস্তি ও অসন্তুষ্টি থেকে সতর্ক করা। এটি স্পষ্ট যে এ সতর্কতার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র নিয়মতান্ত্রিক ফিকহ অর্জন করা দ্বারা হাসিল হয় না। বরং এর সাথে ঈমান ও বিশ্বাসের পরিপক্কতা এবং আত্মার পরিশুদ্ধিও আবশ্যক।
তাই ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, ফিকহকে প্রথম শতাব্দীতে যে ব্যাপক অর্থ ও পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার করা হতো বর্তমানেও সেই ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা উচিত এবং ফিকহের পাঠদানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) যে উদ্দেশ্যগুলি সামনে রেখেছিলেন, বর্তমানেও সেগুলোকে সামনে রাখা জরুরি। আমার মতো একজন ফিকহের ছাত্রের মতামতও তাই।
আল্লামা যাহেদ আর-রাশেদী (হাফি.) বলেন, আমি ‘ঈমানিয়াত’ ও ‘তাসাউফ’; এই দুটি বিষয়কে বর্তমান ফিকহের সিলেবাসে যোগ করতে বলছি না। কারণ তাড়াহুড়ো করে এমনটি করা অনেক কঠিন হবে। আমি অবশ্যই বলবো যে, ফিকহের এই বৃহত্তর অর্থ এবং এর সামগ্রিক উদ্দেশ্যগুলি শিক্ষকদের মনে উপস্থিত থাকতে হবে, যাতে তারা তাদের শিক্ষণশৈলীর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষিত করতে থাকেন। অতঃপর ফিকহের পাঠদান বিষয়ে দীনী মাদরাসার বর্তমান পরিবেশের প্রেক্ষাপটে ধাপে ধাপে কিছু বিষয় তুলে ধরছি, যা চলমান অবস্থা ও সময়ের দাবির আলোকে শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন মনে করি।
(১) ফিকহশাস্ত্র বুঝিয়ে বুঝিয়ে পাঠদান করা
প্রথম কথা হল ফিকহ শব্দটি নিজেই দাবি করে যে, শুধুমাত্র সমস্যার সমাধান জানা এবং বিধি-বিধান ও নিয়মনীতি মুখস্ত করাই একজন ছাত্রের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং ফিকহ বোঝার সাথে সম্পর্কিত। তাই একজন শিক্ষককে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তার সামনে বসা শিক্ষার্থীরা কিতাবে উল্লেখিত মাসআলা-মাসায়েল ও নিয়ম-কানুনই শুধু জানছে না, বরং তারা সেগুলি বুঝতেও পারছে এবং তাদের মনও তা গ্রহণ করছে।
(২) হানাফী ফিকহের পাশাপাশি
অন্য ফিকহ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে আমরা হানাফী এবং আমাদের মাদরাসায় হানাফী ফিকহ পড়ানো হয়। নীতিগতভাবে, আমাদের মাদরাসাসমূহে শুধুমাত্র হানাফী ফিকহই পড়ানো উচিত। তবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্যান্য ফিকহসমূহ, যেমন- শাফেয়ী ফিকহ, মালিকি ফিকহ, হাম্বলী ফিকহ এবং জাহরি ফিকহশাস্ত্রকে আমাদের পাঠদানে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা এবং এগুলোর সাথে ছাত্রদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
আমাদের ফিকহশাস্ত্রের পাঠ্যপুস্তকে, সেগুলি পাঠ্য হোক বা ব্যাখ্যা যেমন- কুদুরী, কানযুদ দাকায়েক, শরহে বেকায়া, হিদায়া, শরহে নিকায়া ইত্যাদি। লেখকরা সাজিয়েছেন যে, হানাফী ফিকহ অনুসারে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার সময়, যেখানে প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়েছে সেখানে অন্যান্য ফিকহশাস্ত্রের বিধানও উল্লেখ করেছেন।
আজকের যুগে যেহেতু পারস্পরিক মেলামেশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের ফাযেলদেরকে এমন জায়গায় দীনী খেদমাত আঞ্জাম দিতে হচ্ছে, যেখানে হানাফী ছাড়াও অন্যান্য ফিকহাবলম্বী মুসলমানদেরও উপস্থিতি রয়েছে। তাই এমন মিশ্রণ পরিবেশে ধর্মীয় খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার জন্য ইমাম, খতীব ও শিক্ষকমণ্ডলীকে নিজেদের ফিকহের পাশাপাশি অন্যান্য ফিকহের বিবরণের সাথে পরিচিত হওয়া জরুরি। যাতে তারা ইখতিলাফের কারণ মতপার্থক্যের স্তর এবং অগ্রাধিকার দেয়ার কারণগুলি সঠিকভাবে অনুধাবন করে মুসলমানদেরকে ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারেন।
আমি ফিকহশাস্ত্রের পাঠ্যক্রমে নতুন কোনো সংযোজনের কথা বলছি না, তবে আমি আহ্বান জানাচ্ছি যে পাঠ্য-পুস্তকগুলির পাঠ্য ও ব্যাখ্যায় আমাদের ফকীহগণ যে কাজটি সীমিত আকারে করেছেন, তা প্রয়োজনের পরিধি হিসেবে প্রসারিত করা উচিত। তবে এর জন্য শিক্ষককে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। বিভিন্ন মাযহাবের লোকদের সংমিশ্রিত পরিবেশে উত্থাপিত সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং ফিকহশাস্ত্রের কিতাবাদি পড়ানোর সময় যেখানে প্রয়োজন সেখানে তা শিক্ষার্থীদের মনে স্থানান্তর করতে হবে।
এর সাথে আমি এটাও পেশ করা জরুরি মনে করি যে, ফিকহশাস্ত্রীয় মাসআলা-মাসায়েল ও বিধানাবলিতে অন্যান্য মাযহাবের অবস্থান উল্লেখ করার সময় যদি তর্ক-বিতর্কের পরিবর্তে অনুধাবন, উপলব্ধি, বোঝানো এবং ব্রিফিং পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তবে তা আরও উপযোগী হবে। ব্রিফিং বলতে আমি যা বোঝাতে চাইছি তা হল, প্রাসঙ্গিক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য সরবরাহ করা। অতঃপর শিক্ষক নিজ শিল্প এবং দক্ষতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে এমনভাবে এবং ক্রমানুসারে তথ্য ব্যাখ্যা করবেন যে, তারা তাদের ফিকহ বা মাযহাব অগ্রাধিকার না হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো রকম প্রভাবিত হবে না।
(৩) ‘প্রথা ও রীতি’ পরিবর্তনের কারণে
বিধানও পরিবর্তন হয়: একথা বুঝিয়ে দেওয়া
তৃতীয় অনুরোধটি হল যে, ফিকহশাস্ত্রের বিধি-বিধানগুলির একটি বড় অংশ عرف وتعامل (প্রথা ও রীতি)-এর ওপর নির্ভরশীল। এটি মুসলমানদের স্বীকৃত বিষয় যে, عرف وتعامل (প্রথা ও রীতি) সম্পর্কিত বিধান ও বিষয়গুলি عرف وتعامل (প্রথা ও রীতি) পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়। এবং এর জন্যও কোনো যুক্তির প্রয়োজন নেই যে, সময় ও স্থান উভয়ের পরিপ্রেক্ষিতে عرف وتعامل (প্রথা ও রীতি) পরিবর্তন হয়। আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে একই প্রথা ও রীতি থাকা জরুরি নয় এবং এটাও জরুরি নয় যে, একশ বছর আগে আমাদের যে প্রথা ও রীতিনীতি ছিল, তা আজও একই রকম থাকবে।
অতএব যখন আমরা কুদুরী এবং হিদায়া পাঠদান করি, তখন দেখা যায় যে, সেখানে লেখকদের যুগের প্রথা ও রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে অনেক মাসআলার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখন যদি শিক্ষক তা ব্যাখ্যা না করেন, তাহলে ছাত্ররা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাবে, সঠিক উদ্দেশ্য বুঝতে সক্ষম হবে না। তাই, এই পার্থক্যটি শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করা এবং প্রথা ও রীতিনীতির পার্থক্যের কারণে মাসআলাটি কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তা তাদের ব্যাখ্যা করা শিক্ষকের দায়িত্ব।
একথা স্পষ্ট যে, এর জন্য শিক্ষককেও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং আমার মতে এর জন্য সর্বোত্তম পন্থা হল ফিকহশাস্ত্রের কোনো গ্রন্থের পাঠ বা ব্যাখ্যা পাঠদানের সময় হযরত মাওলানা মুফতি কেফায়াতুল্লাহ দেহলভী (রহ.), হযরত মাওলানা মুফতি আজিজুর রহমান (রহ.), হাকীমুল-উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) ও হযরত মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.) প্রমুখের ফতওয়া, বা ফতোয়ায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ ইত্যাদির যেকোনো একটি ফতোয়াও সামনে রাখবেন। যেখানে ফতোয়ায় কোনো পার্থক্য অনুভব করবেন, তার কারণ খুঁজে বের করে ছাত্রদের জানাবেন।
(৪) আজকের বৈজ্ঞানিক যুগের আধুনিক
সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এর সমাধান বের করা
চতুর্থত আমার অনুরোধ হচ্ছে যে, আজকের বৈজ্ঞানিক যুগে যে আধুনিক সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছে শিক্ষকমণ্ডলীকে তার দিকেও নজর দেওয়া উচিত এবং শিক্ষার্থীর অধিকার রয়েছে যে শিক্ষক তাকে আধুনিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবগত করবেন এবং সেগুলোর সমাধানের জন্য দিক নির্দেশনা দেবেন। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং প্রযুক্তির ক্রমাগত অগ্রগতি এমন অনেক সমস্যার সৃষ্টি করেছে যা আমরা এর আগে মুখোমুখি হইনি। এসব সমস্যার সমাধান শরয়ী নীতির আলোকে অনুসন্ধান করতে হয় এবং প্রতিটি যুগেই তা অনুসন্ধান করা হয়েছে। ফিকহশাস্ত্র অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের এই ধরনের সমস্যার সাথে মানসিকভাবে পরিচিত হওয়া উচিত, যাতে তারা ব্যবহারিক জীবনে হঠাৎ এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে তারা বিভ্রান্ত ও ভীত না হয়।
মহাকাশে নামাজ পড়ার পদ্ধতি কী হবে?
উদাহরণস্বরূপ আমি শুধুমাত্র একটি সমস্যা উল্লেখ করতে চাই। গত শাবান মাসে, আমি আমেরিকার হিউস্টন শহরে গিয়েছিলাম, যেখানে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র (NASA) অবস্থিত। সেখান থেকে মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করা হয়, মহাকাশচারীরা অনেক মাস মহাকাশে থাকেন। আমি এ সফরে নাসা পরিদর্শন করেছি এবং এটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছি। এখন মুসলিম মহাকাশচারীরাও মহাকাশে যেতে শুরু করেছেন এবং এ রমজানে মালয়েশিয়ার কিছু মুসলিম নভোচারী মহাকাশে গেছেন।
আমাদের সেখানে বলা হয়েছিল যে, স্পেস শাটল যখন পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে মহাকাশে প্রবেশ করে, তখন সূর্যের চারপাশে এর কক্ষপথ ২৪ ঘণ্টার পরিবর্তে ৯০ মিনিটে হয়ে যায়। প্রথমত এ ৯০ মিনিটে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে সমস্যা হয়। দ্বিতীয়ত সমস্যা হচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ শেষ হওয়ার কারণে পা কোথাও স্থির থাকে না, তাহলে এ অবস্থায় নামাজে দাঁড়ানো, রুকু-সিজদা করা ইত্যাদির বিধান কী হবে? তৃতীয় সমস্যা হচ্ছে, মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পানি ঢেলে অজু করা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় নামাজ আদায় করার পদ্ধতি কী হবে?
এ সমস্যাটি মালয়েশিয়ার মুসলিম মহাকাশচারীরা উপস্থাপন করেছেন এবং আমেরিকার একটি উর্দু পত্রিকা লিখেছেন যে, হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ইহুদি অধ্যাপক এ সম্পর্কে প্রথমে একটি মতামত দিয়েছেন যে, এ জাতীয় লোকদের নামাজের ধরন হবে সেই অপারগ ও অক্ষম ব্যক্তির ন্যায়, যাদের কথা মুসলিম ফকীহগণ বর্ণনা করেছেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলে আমি বললাম যে, আমি মনে করি এ ইহুদি প্রফেসর ঠিকই বলেছেন। কারণ এমন অবস্থায় একজন অক্ষম ব্যক্তির মতো নামাজ পড়তে হবে।
এখানে মাত্র একটি উদাহরণ দিয়েছি, এরকম বিশটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এবং আমি মনে করি এ ধরনের সমস্যাগুলির সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচিত করা গুরুত্বপূর্ণ। যাতে তারা এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে। এ কারণে আমি অনুরোধ করছি যে, শিক্ষক যারা আইনশাস্ত্র পড়ান তাদের একাডেমিক আলোচনার সাথে সাথে আধুনিক বিষয়গুলির ওপরও পরিচিত হতে হবে এবং যেখানে তারা উপযুক্ত মনে করেন, পাঠের সময় শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করবেন। এ বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্বের সর্বত্র গবেষণা হচ্ছে। বহু বই ও প্রবন্ধ রয়েছে। যেমন হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফী দেওবন্দী, হযরত মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমী, হযরত মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানী, হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ তাকী উসমানী, মাওলানা সৈয়দ নসীব আলী শাহ বনভী প্রমুখ এবং অন্যান্য আলেমদের এ বিষয়ে অনেক গবেষণালব্দ তথ্যের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে। আমাদের দীনী মাদরাসার ফিকহের উস্তাদগণের নিকট এসব কিতাব ও গবেষণা অধ্যয়নে থাকলে, সহজে ছাত্রদেরকে উপযুক্ত স্থানে এসব সমস্যায় পথ দেখাতে পারবেন।
(৫) ইসলামী বিধি-বিধানের ওপর আরোপিত সংশয়ের কারণ চিহ্নিত করে এর যথাযথ সমাধান বের করা
পঞ্চম অনুরোধ এই যে, আজকের যুগে ইসলামী বিধি-বিধান সম্পর্কে যেসব আপত্তি বা সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে, সে বিষয়ে আইনশাস্ত্রের শিক্ষকের সচেতন হওয়া জরুরি এবং এটাও জরুরি যে, তিনি তার ছাত্রদের যোগ্যতা অনুসারে তাদেরকে এ ধরনের আপত্তি সম্পর্কে সচেতন করবেন এবং এগুলোর উত্তরের দিকে পথ প্রদর্শন করবেন। আমি এ ধরনের ২০টি আপত্তির মধ্যে মাত্র একটি উদাহরণ উল্লেখ করতে চাই। অর্থাৎ ইসলামের দণ্ডবিধি অর্থাৎ হদ ও শাস্তিকে অত্যন্ত কঠোর ও সহিংস এবং মানব সম্মান ও অধিকারের পরিপন্থী বলা হয়। এ কারণে মুসলিম দেশগুলোতে এসব আইন বাস্তবায়নের বিরোধিতা করা হয়। এখন ফিকহশাস্ত্রের শিক্ষক ও ছাত্রদের এ আপত্তির প্রকৃতি ও এর পটভূমি সম্পর্কে অবগত হওয়া উচিত, কেন এমন বলা হল এবং যারা আপত্তি করেন তাদের যুক্তি কী?
এর কারণ হল যে, জাতিসংঘ কর্তৃক অনুমোদিত মানবাধিকার সনদ, যা বিশ্বের কমবেশি সকল দেশ স্বাক্ষর করেছে এবং এটি পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, অনুচ্ছেদ নং ৫-এ বলা হয়েছে যে, ‘কোনো ব্যক্তিকে শারীরিক নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি দেওয়া যাবে না।’
এর অর্থ হচ্ছে যেকোনো ব্যক্তির সাথে এমন আচরণ করা যাবে না, যাতে শারীরিক নির্যাতন এবং অপমান জড়িত থাকে এবং কোনো ব্যক্তিকে আচরণের সাথে সাথে এ ধরনের শাস্তিও দেওয়া যাবে না। যেকোনো শাস্তিই হতে হবে শারীরিক নির্যাতন ও অপমান থেকে মুক্ত।
জাতিসংঘের এ সনদের আলোকে ইসলামী শাস্তির বিধানসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, পাথর ছুঁড়ে মারা, হাত কেটে ফেলা, পা কেটে ফেলা, বেত্রাঘাত ও সাধারণ শাস্তি ইত্যাদি; এসব শাস্তির মধ্যে রয়েছে শারীরিক নির্যাতন ও অপমান। এ সনদের ভিত্তিতে ইসলামিক শাস্তি মানবাধিকারের পরিপন্থী ঘোষণা করা হয় এবং আন্তর্জাতিক ফোরামের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, মুসলিম দেশগুলো যেহেতু মানবাধিকারের এ সনদকে মেনে নিয়েছে এবং তা পালন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাই তাদের উচিত এমন কোনো আইন প্রয়োগ না করা, যা তা লঙ্ঘন করে।
মানবাধিকার সনদ বিষয়ক
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের রায়
কয়েক বছর আগে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে আমাদের আইনি ব্যবস্থায় এই মানবাধিকার সনদের অবস্থান নিয়ে আমরা বিশদ আলোচনা করেছি। তখন দেশের কয়েকজন প্রখ্যাত আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে এ অবস্থান ব্যক্ত করেন যে, পবিত্র কুরআন আমাদেরকে اَوْفُوْا بِالْعُقُوْدِ١ؕ۬ ۰۰۱-এর অধীনে চুক্তিগুলো মান্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং শরীয়ত অনেক ক্ষেত্রে প্রথা ও রীতি অনুযায়ী কাজ করতে বলা হয়েছে। অতএব উভয় ক্ষেত্রেই এ সনদ মেনে চলা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা আমরা মেনে নিয়েছি এবং এটি আজ একটি বৈশ্বিক প্রথা ও রীতি যা আমাদের অবশ্যই মেনে চলতে হবে। তাই পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিলো যে, মানবাধিকারের এ সনদটি আমাদের আইনি ব্যবস্থায় পালন করা জরুরি। এর ওপর ভিত্তি করে সুপ্রিম কোর্ট একজন অপরাধীকে উন্মুক্ত কারাগারে সাজা দেওয়ার বিচারিক সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে, যেহেতু এটা অপমানজনক শাস্তি। কেননা আমরা আন্তর্জাতিক চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে, শারীরিক নির্যাতন ও অপমানের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেবো না।
আমি একটি মাত্র উদাহরণ দিলাম, অন্যথায় জাতিসংঘের এ সনদ নিয়ে আমাদের বিশটি আইন ও অধ্যাদেশ নিয়ে এ ধরনের আপত্তি রয়েছে এবং তাদের কারণে আমাদের সমাজেই ইসলামী আইন প্রয়োগের বিরোধিতা করা হচ্ছে। যেখানে এসব আপত্তির জবাব দেওয়া আমাদের জন্য প্রয়োজন, সেখানে আমাদের শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে এ ধরনের আপত্তি ও সেগুলোর উত্তর অন্তর্ভুক্ত করাও আমাদের দায়িত্ব, যাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেগুলো সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন হতে পারে এবং জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।
শিক্ষকদের উদ্দেশে মাওলানা যাহেদ রাশেদী হাফিযাহুল্লাহ বলেন, প্রিয় শিক্ষকগণ! আমি সম্পূর্ণরূপে সচেতন যে, আমি যে সমস্ত অনুরোধ করছি, তা দ্বারা আপনাদের বোঝা ভারি করছি। স্পষ্টতই, আপনাকে অনেক পড়াশোনা করতে হবে, চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু আমি উল্লেখ করেছি যে, এই লক্ষ্যগুলি যদি প্রয়োজনীয় হয়, তবে সেগুলি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই এবং আমি নিশ্চিত যে শিক্ষকরা যদি নিবেদনগুলো এভাবে হৃদয়ে ধারণ করেন যে, এগুলো করা প্রয়োজন, তবে তারা পাঠ্যক্রমে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজন ছাড়াই এটির জন্য উপায় খুঁজে বের করবেন।
আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব রুচি আছে, কারো রাজনৈতিক মানসিকতা আছে, কারো তাবলীগী মানসিকতা আছে, কেউ জিহাদী পরিবেশে মানসিকভাবে প্রশিক্ষিত হয়েছি এবং কেউ সাহাবায়ে কেরামের সম্মান রক্ষাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। প্রত্যেকেরই নিজস্ব রুচি আছে। প্রত্যেকে সে হিসেবে বর্তমান পাঠ্যক্রমের মধ্যেই ছাত্রদের কাছে তার রুচি প্রেরণ করেন, এর জন্য তার একটি নতুন পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন হয় না। তবে একই পাঠ্যক্রমের উপাদানের মধ্যে যেখানে সে তার পয়েন্ট যোগ করার সুযোগ পায়, সেখানেই যোগ করে দেয়।
অতএব এ উদ্দেশ্যগুলি বাস্তবায়নে ফিকহশাস্ত্রের পাঠ্যক্রমের কোনো কিছু সংযোজন হওয়া উচিত কিনা তা বিতর্কিত আলোচনা এবং এটি বেফাকের বিষয়। তবে প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত না হলেও এটি কোনো বড় সমস্যা নয়। শিক্ষকরা তাদের ব্যক্তিগত অধ্যয়ন এবং কঠোর পরিশ্রম দিয়ে এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের গাইড করতে পারেন। আমরা যদি আইনশাস্ত্র শিক্ষা ও শেখার অপরিহার্য লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে আন্তরিক হই, তাহলে আমাদের অবশ্যই তা করতেই হবে। একই সাথে, আমি দোয়া করি যে, মহান আল্লাহ আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষাগত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করুন এবং আমাদেরকে কবুল ও সন্তুষ্টির সাথে বরকত দান করুন, আমিন ইয়া রব্বাল আলামীন।
[1] বদরুদ্দীন আল-আইনী, মিনহাতুস সুলূক ফী শারহি তুহফাতিল মুলূক, ওয়াযারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ূনিল ইসলামিয়া, দোহা, কাতার (প্রথম সংস্করণ: ১৪২৮ হি. = ২০০৭ খ্রি.), পৃ. ৩০
[2] আল-কুরআনুল করীম, ৯ (সূরা আত-তাওবা): ১২২
[3] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭১ হি. = ১৯৫২ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৮১, হাদীস: ২২২
[4] সদরুশ শরীয়া আল-আসগর, আত-তাওযীহ লি-হাল্লি গাওয়ামিযিত তানকীহ, মুহাম্মদ আলী সাবীহ অ্যান্ড সন্স প্রেস (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৭ হি. = ১৯৫৭ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১৬