তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের স্বপ্ন ভেঙে গেছে
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে রজব তাইয়েব এরদোগান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে তুরস্কের দ্বাদশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৩ থেকে ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। দেশি-বিদেশি প্রবল বিরোধিতার মুখে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন তুরস্কের সাত কোটি জনগণ তাঁকে ভালোবাসেন। তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ ও পরিকল্পনাসমূহকে তাঁরা পছন্দ করেন। তিনি আগের তুলনায় আগামীতে সাংবিধানিকভাবে আরও অধিকতর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন সূচিত হবে। এরদোগানের বিজয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোভুক্ত দেশসমূহ এরদোগানের বিজয়কে ভালো চোখে দেখেনি।
সামান্য একজন রুটি ও জুসবিক্রেতা থেকে মেধা, শ্রম, দৃঢ়তা ও সাহসিকতার ফলে তুরস্কের কর্ণধার হতে পেরেছেন তিনি। সামরিক অভ্যুত্থান প্রতিরোধ, বেকারত্বের হার হ্রাস, অর্থনৈতিক সূচকের প্রবৃদ্ধি, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তুরস্কের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি তাঁর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। হাফেযে কুরআন ও বিজনেস স্টাডিতে স্নাতক ডিগ্রিধারী এরদোগান ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। দেড় কোটি লোকের এ শহরকে যানজট ও বায়ুদূষণ থেকে মুক্ত করার কারণে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তুরস্কের সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুজুর্গ আলিম মাওলানা শায়খ মাহমুদ আফেন্দী নকশবন্দীর সাথে ইসলাহী সম্পর্কের কারণে এরদোগানের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা সজীব রয়েছে। কৈশোর থেকে তিনি কট্টর সেক্যুলার নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছেন।
মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক (১৯২৩-১৯৩৮ খ্রি.) প্রবর্তিত কট্টর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বা ধর্মবিদ্বেষী তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চরিত্রকে এরদোগান ধীরে ধীরে মুসলমানদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও সভ্যতায় প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস চালাচ্ছেন। তিনি তাঁর দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে আইডল ও আইকন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণীগণ হিজাব পড়তে ও পর্দা মেনে চলছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপিত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসমূহে ছাত্রছাত্রী সহাবস্থান নিষিদ্ধ করেন। ২০ বছরের শাসনকালে অসংখ্য রাস্তা-ঘাট, সেতু, স্কুল, হাসপাতাল তৈরি করে তুর্কি জনগণের জীবনকে বদলে দিয়েছেন এরদোগান। যে কারণে প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত।
মোস্তফা কামাল পাশা ছিলেন চরম ধর্মবিদ্বেষী। আধুনিকতার নামে ইসলামের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। সেনা, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী, শিক্ষক, পেশাজীবী, শ্রমিক-মজুর, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মগজ ধোলাই করে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। খিলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন, ধর্মীয় শিক্ষা বন্ধ করে ইউরোপীয় শিক্ষা চালু করেন, হিজাব-পর্দা নিষিদ্ধ করেন, ধর্মীয় পোষাক তথা জোব্বা, টুপি, পাগড়ি বন্ধ করে, শার্ট, প্যান্ট, টাই, স্যুট, নেকটাই ও পানামা হ্যাট চালু করেন, আরবি ভাষায় আযান বন্ধ করেন, তুর্কি ভাষার আরবি বর্ণমালা পরিবর্তন করে ল্যাটিন হরফ চালু করেন, সকল সুফি কার্যক্রম, খানকাহসমূহ বন্ধের আদেশ জারি করেন এবং খানকাহগুলোকে জাদুঘরে রূপান্তরের আদেশ দেন, শরীয়াহ আদালতগুলো বন্ধ করে দিয়ে ইতালীয় দণ্ডবিধির ওপর ভিত্তি করে নতুন আইন প্রবর্তন করেন। কামাল আতাতুর্ক প্রবর্তিত ধর্মদ্রোহিতা বহু বছর তুরস্কে কার্যকর ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দেরেসকে ফাঁসি দেওয়া হয় আযান পুনঃপ্রবর্তনের অভিযোগে। হজব্রত পালনেও বাধার সৃষ্টি করা হয়।
তুরস্ক একসময় ছিল ঐতিহ্যগতভাবে মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষত হাঙ্গেরি, ভিয়েনা, ক্রিমিয়া, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া, পোল্যান্ড, ভেনিস, আলবেনিয়া সাইপ্রাস ও ফ্রান্সে ইসলামের ক্রমবিকাশ ধারায় তুর্কি খলীফাদের অবদান অবিস্মরণীয়। দেশজয় ও আগ্রাসন প্রতিরোধে উসমানীয় খলীফাগণের মেধা, কুরবানি, শ্রম ও অর্থ ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তুর্কি সেনা ও জেনিসারিদের অপরিমেয় রক্তের নজরানায় ইউরোপে ইসলামের অগ্রযাত্রা সাধিত হয়। মুসলিম বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছেন তুর্কি খলীফাগণ। ছয়শ বছর ধরে মুসলমানদের অভিভাবক ছিলেন তাঁরা। ক্ষমতার ভারসাম্য থাকায় প্রতিপক্ষ শক্তি কোনো অঞ্চলে মুসলমানদের নির্যাতন করার দুঃসাহস দেখাতে পারেনি। ১৯২৪ সালের পর থেকে মুসলিম উম্মাহ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে।
আমাদের প্রত্যাশা প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও তাঁর দলের বিজয়ের মাধ্যমে তুরস্ক তাঁর হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরে পাবে। এ প্রত্যাশা সংগতভাবে করা যায় কারণ সিরিয়ার যুদ্ধ, শরণার্থী ইস্যু, রোহিঙ্গা সংকট, ফিলিস্তিন সমস্যা ও ওআইসি নিয়ে তাঁর সাহসী উচ্চারণ ও পদক্ষেপ দরদি মনের পরিচয় বহন করে। মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে তিনি আগামীতে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবেন। কারণ তিনি জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত নেতা।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন