কওমিদের বাংলাচর্চা
মুহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ইসলামাবাদী
লেখক: আলেমে দীন ও কলামিস্ট
আমাদের কওমি মাদরাসার আলেম-ছাত্রদের বাংলা বলা-লিখার ব্যাপারটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কারণ তাঁদের শিক্ষার প্রধান ও মূল মাধ্যম প্রথমত ও প্রধানত আরবি এবং পরে উর্দু ও ফারসিতে। বাংলা যে তাঁরা একদম পড়েন না, তা নয়। কওমি মাদরাসায় পঠিত সিলেবাসের লক্ষ্য অর্জন ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে দেশীয় ভাষা বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক ইত্যাদি পাঠ্যভুক্ত আছে। এক সময় সেটা প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নত করা হয়েছে। একটা সময় ছিল, কওমি মাদরাসায় বাংলা পড়া বা বাংলা বইপত্র রাখা খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না। প্রয়োজনকে সামনে রেখে এখন সে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে মানসিকতারও। তাই দেখা যায়, কওমিদের মধ্যে বাংলাচর্চা এখন আগের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। বাংলা নিয়ে পশ্চাৎপদতার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে এবং এর জন্য কওমিদেরকে একতরফা দোষও দেওয়া যায় না। বিষয়টি বোঝা দরকার। বলাবাহুল্য, বাংলার সাথে সংস্কৃতভাষার আত্মীয়তা গভীর। বাংলায় অনেক শব্দ এসেছে সংস্কৃত থেকে। সেগুলো তৎসম ও অর্ধতৎসম শব্দ নামে পরিচিত। মোগল আমলে ভারতের সরকারি ভাষা ছিল ফারসি। পাশাপাশি আরবি ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা। ইংরেজ-আধিপত্যবাদের শুরুতে বিশেষত ১৮৫৭ সালের ব্যর্থ স্বাধীনতা-সংগ্রামের পর ব্রিটিশরা যখন রাতারাতি সরকারি ভাষা ফারসি পরিবর্তন করে মুসলিম সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলে, স্বভাবত ইংরেজদের সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে একটা ঘৃণার আবহ তৈরি হয়। স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইংরেজদের সহযোগিতা করার পথে এগিয়ে গেলে মুসলিম সম্প্রদায় আরও হতাশ হন। সে সময় যে বাংলা-সাহিত্য চর্চা হয় তা ছিল মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে এবং হিন্দু ধর্মপ্রভাবিত। ফলে ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে মুসলমানদের মাঝে তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনাগ্রহ দেয়। তাঁরা তাঁদের চর্চা হিসেবে ফারসি, আরবি ও উর্দুকে ব্যবহার করতে শুরু করে। এখানে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রত্যয় ছিল ন্যায়সংগত। ঠিক আমরা যেমন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে বাংলাচর্চাকে প্রাধান্য দিয়েছি এবং বাঙালিত্বের স্বতন্ত্রতাকে রক্ষার চেষ্টা করেছি। এখানকার কওমি মাদরাসায়ও সে প্রভাব পড়ে যুক্তিসংগতভাবে। বাংলা-সাহিত্যে নজরুল-যুগের সূচনা না হলে আজও হয়তো বাংলা সাহিত্যের প্রতি বিরাগের ধারা অব্যাহত থাকতো। কারণ আপন বিশ্বাস ও সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদের প্রেক্ষাপটে হিন্দু-বিশ্বাসপ্রভাবিত বাংলা-সাহিত্যকে মুসলিমরা কখনোই গ্রহণ করতে পারেনি। এর ওপর বঙ্কিমদের মতো উগ্রসাম্প্রদায়িক বাংলা-সাহিত্যচর্চা মুসলিম-সমাজে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করে। এসব কারণে ‘আদি বাল্যশিক্ষা’র পরিবর্তে ‘মুসলিম বাল্যশিক্ষা’ শিশুপাঠের গোড়াপত্তন ঘটে।
এতে বাংলা-সাহিত্য মূলত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর জন্য দায়ী হিন্দু সাহিত্যিকেরা যারা সচেতনভাবে মুসলিম উপাদানকে পরিহার করে গেছেন তাঁদের সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রও এর ব্যতিক্রম নন। মধ্যযুগে আরাকান রাজসভার সাহিত্যচর্চার ইতিহাস উন্মোচিত না হলে কেউ জানতো না: চট্টল-সন্তান মহাকবি আলাওল ও দৌলত কাজীরা মুসলিম-সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা-সাহিত্যও চর্চা করেছেন। সংগতকারণে, আমাদের বাংলাদেশের কওমি মাদরাসায়ও আরবি, ফারসি, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাচর্চা প্রাথমিক অবস্থায় প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পায়নি। এর আরও একটি কারণ হলো, কওমি মাদরাসা মূলত একটি ধর্মীয় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আরবি, ফারসি, উর্দুর মতো বাংলাতে যথেষ্ট পরিমাণ উপাদান না থাকা। এরপর আসে গতানুগতিক বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। এখানে সবাই কিন্তু দায়ী নয়। ক্ষুদ্র হলেও কওমিদের একটি সচেতন অংশ কওমি অঙ্গনে বাংলা ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাচর্চাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ—উভয় দিক থেকে গতিতে মন্থর হলেও কওমিদের মধ্যে বাংলাচর্চা অব্যাহত থাকে ব্রিটিশ আমল থেকে। পাকিস্তান আমলেও ছিল এমন প্রচেষ্টা। কেউ বাংলাতে কুরআন-হাদীসের অনুবাদগ্রন্থ করেছেন; কেউ তাফসীর, কেউ সীরাত, কেউ বা ইতিহাসগ্রন্থ করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও চলেছে উদ্যোগ। যেমন চট্টগ্রাম থেকে আঞ্জুমানে হেদায়তুল ইসলাম। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৬০ সালের দশকে প্রখ্যাত শায়খুল হাদীস মাওলানা ইসহাক আল গাযী (রহ.)-এর হাতে। সেখান থেকে বেশ কিছু প্রকাশনাও বের হয়। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া বিভিন্ন কওমি মাদরাসা থেকে স্মারক, পুস্তিকা ও মাসিক পত্রিকাও বের হতো যা আজও বর্ধিত আকারে অব্যাহত আছে। এসবের মধ্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.) কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত মাসিক মদীনার কথা না বললেই নয়। বলতে দ্বিধা নেই, কওমি অঙ্গনে বাংলাচর্চার উন্নয়নের পেছনে মাসিক মদীনার প্রভাব ছিল সর্বজনবিদিত। এরপর আসে চট্টগ্রামের দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী থেকে প্রকাশিত মাসিক মুঈনুল ইসলামের কথা। ১৯৩৪ সালে প্রখ্যাত বুযুর্গ আলেম ও দারুল উলুম হাটহাজারীর সাবেক পরিচালক মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব সাহেব (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে ‘ইসলাম প্রচার’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সাল থেকে সেটি ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম’ নামে আজও প্রকাশিত হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মুখপত্র মাসিক আত-তাওহীদ।
কওমিদের বাংলাচর্চা নিয়ে সাধারণ শিক্ষিতমহলে নেতিবাচক মানসিকতা আছে। তারা মনে করেন, কওমিরা মননে ও বলায় আধুনিক নন। বাংলা বলায় তাঁরা দুর্বল; লেখায় প্রাইমারি পর্যায়ের এবং চিন্তায় অনগ্রসর। যেহেতু কওমিমহল নির্দিষ্ট সীমানায় থাকে তাই তাঁরা হয়তো সমালোচনা সম্পর্কে যতদূর জানা দরকার ততদূর জানেন না বা অতোটা গায়ে মাখেন না। আসলেই কি কওমিদের সমালোচনা যথার্থ? আমার মনে হয়, সমালোচনার পুরোটা কওমিরা বহন করার কথা নয়। তবে দায়টা নিদেনপক্ষে অর্ধেক তো নিতেই হবে। কারণ মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার প্রতি কওমিদের দৃষ্টিভঙ্গি সিংহভাগ সুখকর নয়। একটা অজানা অবহেলার দূরত্ব অস্বীকার করা যায় না। ফলে ছাত্ররাও সে প্রভাবে প্রভাবিত হয়। ভালো আরবি, উর্দু বা ফারসি বললে বা লিখলে যে পরিমাণ বাহবা মিলে, বাংলার ভাগ্যে সে পরিমাণের সিকিভাগও জোটে না। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু ব্যাপারও আছে। যেহেতু শিক্ষার মূল মাধ্যম আরবি, উর্দু তাই বাংলা যে স্বাভাবিকভাবে অপুষ্টিতে ভুগবে—সে তো অবাঞ্ছনীয় নয়। এরপরও অবহেলার যুক্তি টিকবে বলে মনে হয় না। কারণ মাতৃভাষার প্রতি অগ্রহণযোগ্য অবহেলা। মনে রাখতে হবে, যে ভাষাতেই শিক্ষা গ্রহণ করুক না কেন, সবকিছু অন্তরে বিচরণ করে মাতৃভাষার আবরণেই। আমরা ভুলে যাই, ভালো সাহিত্যচর্চার বুনিয়াদ কিন্তু মাতৃভাষার ওপর ভালো দখলের ভিত্তিতে। আপনি ভালো আরবি সাহিত্যিক হবেন, তবে অবশ্যই আপনাকে মাতৃভাষায় ভালো সাহিত্যজ্ঞান রাখতে হবে। যে আপন মায়ের মমতা বুঝতে অক্ষম সে পুরো নারী জাতির মমতা কি করে বুঝবে? মাতৃভাষার প্রতি কওমিদের দূরত্বের মূল কারণ সংকীর্ণ মানসিকতা। এখান থেকে মুক্ত হতে না পারলে সে ক্ষত পুষবে বলে মনে হয় না। মানসিকতার মেরামত হলে চর্চার প্রসার হবে শুদ্ধ পথে।
এবার আসুন বলা নিয়ে। সমালোচকেরা বলেন, ওনাদের উচ্চারণ মানের নয়; শব্দের আমদানি যথার্থ নয়। ঠিক আছে ধরেই নিলাম, কওমিদের স্ক্রু টাইট নয়। যাঁরা বলেন তাদের কি অবস্থা? তাঁরা কি শুদ্ধ বলেন? আমাদের নাগরিকদের সবচেয়ে শিক্ষিত শ্রেণি বলে যাঁদের জানি, সেই তাঁরা নিশ্চয় ইউনিভার্সিটির শিক্ষক বা বিচারবিভাগের বিচারকবৃন্দ। বাংলা বলায় তাঁদের অবস্থা কী? প্রখ্যাত বিচারপতি জনাব শাহাবুদ্দীনের কথা মনে আছে? তিনি যখন ১৯৯০ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন, তাঁর দেয়া প্রথম ভাষণের কথার মনে আছে? আমার এখনও মনে আছে, প্রচুর ভুল উচ্চারণে তিনি সেদিন বাংলাতে ভাষণ দিয়েছিলেন। তখন খারাপ লাগেনি? টকশোতে বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটির সেরাসব জ্ঞানীদের আলোচনা তো হরহামেশা শুনছি। একে তো ভুল বাংলা উচ্চারণ, তার ওপর সাধু-চলিত রীতির মিশ্রণ ও আঞ্চলিক উচ্চারণ। এ-কি লঙ্কাকাণ্ড না দিল্লিকাণ্ড বোঝা মুশকিল। এখন আরেক আপদ হলো, আমাদের শিক্ষিতেরা যা বলেন, সে কোনো ভাষা প্রশ্ন করতে হয়। যদি কথা বলেন দুই মিনিট, সেখানে ‘বাট/সো’ মিলিয়ে ইংরেজি থাকে দেড় মিনিট। আচ্ছা, এ তো বাংলা-ইংরেজি মেশানো বিলকুল ‘বাংরেজি ভাষা’। তাই না! বিশিষ্ট প্রাগ্রসর রাজনীতিক বলে খ্যাত আন্দালিব রহমান পার্থ বা রেজা কিবরিয়ার কথা শুনেছেন? তাঁরা জ্ঞানী, স্বীকার করি। কিন্তু তাঁদের কথাগুলো তো শ্রুতিমধুর নয়ই, এদেশের সাধারণ মানুষের বোধগম্যও নয়। জনাব ওবায়দুল কাদের বা অন্য গতানুগতিক রাজনীতিকদের কথাগুলোকে ‘বাংলা’ না বলে, ‘দাঙ্গা’ বললে সমস্যা থাকার কথা নয়। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রদের ইংরেজি লেখার কায়দাটা একবার দেখুন! তখন কি কওমির সমালোচকদের জাতে লাগে না? আসলে কওমিদের প্রতি, মাদরাসায় পড়ুয়াদের প্রতি এক ধরনের অবৈধ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমালোচনাগুলো হয়। আমি বলছি না, কওমি-ঘাটতি তাই চলতে দেয়া দরকার। না, সে হবে কেন? অপরের ভুল কি আমার ভুলকে বৈধতা দেয়? বরঞ্চ অপরের ভুল থেকে সংশোধনের শিক্ষা নেয়া উচিত।
কওমিদের বাংলাচর্চার সংস্কৃতিটা সংস্কার করা প্রয়োজন। পাঠ্যক্রমে কেবল মাধ্যমিক পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষা রাখলেই বাংলাচর্চার দায়িত্ব আদায় হলো—সে কথা ভুল। প্রত্যেক মাদরাসায় একটি করে বাংলা বিভাগ থাকা দরকার। সেখানে প্রতিভাবান ও অভিজ্ঞ শিক্ষক থাকতে হবে। তিনি মাদরাসার পাঠ্যসূচি ও সময়ের সাথে সমন্বয় করে একটি পরিকল্পনা করবেন যেন সময়ের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে বিভিন্ন জামায়াতের ছাত্রদের বাংলাচর্চাকে বেগবান করা যায়। যেমন ধরুন, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়—এ রকম ধাপে কোন-কোন বিষয়কে আনা যায়। মনে করি, প্রথম ধাপে ধ্বনির বিশ্লেষণ ও উচ্চারণস্থান বা মাখরাজ, দ্বিতীয় ধাপে বর্ণের উৎস ও বিশ্লেষণ এবং মাখরাজ, তৃতীয় ধাপে শব্দের গঠন ও শব্দচয়ন ইত্যাদি। এমন পরিকল্পনা-প্রশিক্ষণের সময় সবার ক্ষেত্রে অভিন্ন নাও হতে পারে, প্রয়োজনে মূল শিক্ষার অগ্রাধিকার বিবেচনায় সময় বেছে নেয়া যেতে পারে। রমজান মাসে যেমন বন্ধের সময় আরবি ব্যাকরণ বা কিরাতের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় তেমনি অন্য বন্ধকেও কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠান যদি এসবে জড়িত না থাকে তবে তা সফল হবে বলে মনে হয় না। মাঝেমাঝে বাংলাচর্চা নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করলে ভালো ফল বেরুবে বলে আশা করা যায়। এর সবকিছু নির্ভর করবে প্রতিষ্ঠান-প্রশাসনের সদিচ্ছার ওপর। কারণ চাপ বিনে তাপ উৎপাদন হয় না।