আসুন! তলাবায়ে জামিয়া পটিয়ার
একটি তাহাজ্জুদের গল্প শুনি
মুহাম্মদ আবিদ সিদ্দিকী
লেখক: শিক্ষার্থী, দাওরায়ে হাদীস, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
জামিয়ার নিয়ম অনুসারে রাত ঠিক দশটায় শুয়ে পড়ি। আবার এটি আমার সময়সূচির নিয়মও। ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় শুতে দেরি ঘুমুতে দেরি নেই। শোয়ামাত্র যেন ঘুমপাড়ানি এসে গান শুনাতে শুনাতে ঘুম পড়িয়ে দিলো। আর আমি যেহেতু এমনিতেই নিয়ম অনুযায়ী রাত দশটায় ঘুমিয়ে যাই, আজ আরও একটু ক্লান্তও, ঘুম আসতে দেরি না হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাক, ঘুমিয়ে গেলাম। একদম অঘোর ঘুম। ঘুমে কী যেন দেখলাম। ভয়ে জর্জরিত হয়ে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। শরীরে কাঁপুনি চলে আসছে। শরীর একদম থরথর করে কাঁপছে। কতরকমের চেষ্টা করেও শরীরের কাঁপুনি বন্ধ করতে পারছি না। শত চেষ্টা করেও আঁখিদ্বয়ে আর নিদ্রা আনতে পারছি না।তখন রাত দুইটা ছুঁইছুঁই।
কী করবো! চিন্তা করছি বিছানা থেকে উঠে এদিক-সেদিক একটু হেঁটে আসি, শরীরের থরথরানি কেটে উঠলে এরপর শুইলে হয়ত ঘুম আসবে। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে উঠেছি। উঠে রুম থেকে বের হতেই দেখি চতুর্দিকে ঘুটঘুটে আঁধার। পুরো জামিয়ার চারদিকে সুনসান নীরব ও নিস্তব্ধ।
তবুও উঠেছি। যখন চিন্তা করলাম খানেক সময় হাঁটাহাঁটি করবো, তাই উঠে হাঁটতে শুরু করলাম। জামিয়ার আঙিনায় খানেক সময় হাঁটতে হাঁটতে মসজিদের কিনারায় চলে আসছি। এমনিতে আমার রুমও মসজিদের পূর্বের নয়া ভবন জদিদ মঞ্জিলে।
ভাবছি, মসজিদের পাশেই যখন চলে আসছি, আজ হলেও কিছু ইবাদত-সেবাদত করি, যা সাধারণত হয় না। নিয়ত করেছি, অজু করে দুচার রকআত তাহাজ্জুদ পড়ে নীরব-নিস্তব্ধ এই সময়ে রবের সান্নিধ্যে গিয়ে কিছু চাইবো, দেশ-দুনিয়া ও উম্মাহর জন্য এবং নিজের জন্য ফরিয়াদ করবো। হাত দু-খানা উঁচু করে আস্তিনখানা বিছিয়ে দিয়ে রব থেকে নিজের জন্য কিছু নেবো।
মসজিদের পাশেই হাউজ। হাউজের বৈঠক স্থানে অজু করতে বসেছি। অজু এখনও শুরু করিনি। অজু শুরু করবো ঠিক তখনই কোনোদিক থেকে যেন কানে ভেসে এলো, হু হু কান্নার তীব্র আওয়াজ।
ভাবলাম! রজনির এই গভীর অংশে এ আওয়াজ কোত্থেকে? ঘুমের ঘরে ভয়ে চমকিয়ে দেওয়া সেই আওয়াজ নয়তো? না, নিশ্চয়ই নয়! এটি তো দরদ মাখা ভিন্ন আরেকটি সূর! আহা, ইশরে! তাহলে কাদের কণ্ঠে বাজছে এ দরদমাখা আওয়াজে কান্নাজনিত এই ভিন্ন সূরটি?
ভাবনা রেখে অজু করা শুরু করলাম। অজু শেষ করে মসজিদের যাবো।যাচ্ছি! একটু সামনে যেতে না যেতেই বুঝতে পারলাম, হ্যাঁ! আর কোথায় থেকে হবে এই হৃদয়বিদারী আওয়াজ? জামিয়ার মসজিদ থেকেও তো! তারা কে হবে আর? জামিয়ার কিছু নেককার দীনদার সালেহীন মুখলিসীন তলাবায়ে কেরামই তো! আসলেই ত! তা-ই হলো।
কান্নায় ভেঙে পড়া লোকগুলো জামিয়ার মুখলিস দীনদার কিছু যাকিরীন শাকিরীন তলাবা। যাদের কেউ তাহাজ্জুদে মত্ত। আর কেউ যিকির-আযকার ও বিভিন্ন আমলে মশগুল।
তাদের দেখে, কিছুদিন পূর্বে আমাদের এতিম করে দিয়ে যাওয়া জামিয়ার মুহতামিম জগৎকুলের শিরোমণি হাকীমুল ইসলাম শায়খুল হাদীস আল্লামা বুখারী সাহেব হুযুর (রহ.)-এর একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা মনে পড়ে যায়। ঘটনাটি যতদূর সম্ভব আমাদের শায়খে মুয়াত্তা মুহাম্মদ আল্লামা কাজী আখতার হোসাইন আনোয়ারী (হাফি.)-এর মোবারক জবানে কোনো এক বয়ানে শুনেছিলাম।
ঘটনাটি এভাবে
হযরত (রহ.)-এর জীবদ্দশায় সরকারি কোনো অডিটরিয়াম এসে হযরত (রহ.)-এর কাছ থেকে হিসাব তলব করলে বা আয়ের উৎসের খোঁজ তলব করতে চাইলে হযরত (রহ.) তাদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আমাদের হিসাব নিকাশ প্রায়ই তাআল্লুক মা‘আল্লাহ ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকের সাথে। যেই ব্যাংক খোলা হয় নিশি রাতে, আবার রজনীর শেষাংশেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই সময়ে দরখাস্ত করলে সকালে সকালে ব্যাংকঅলা আমাদের যতদূর প্রয়োজন ততদূর বা তারও বেশি ব্যবস্থা করে দেয়।’ অডিটররা বিস্ময় চোখে অবাক চিত্তে তাকিয়ে রইলেন, আর বললেন হুযুর! ‘এটি কেমন কথা?’
হযরত (রহ.) বললেন, ‘হ্যাঁ, এটিই বাস্তবতা। আর সেই বাস্তবতা দেখতে হলো নিশিরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করো।’
যখন রাত নিশি ভোর হলো, তারা দেখতে পেলো মসজিদে ছাত্ররা হু হু করে কাঁদছে, কেউ তাহাজ্জুদে মশগুল। কেউ যিকির-আযকার ও দোয়া-আদইয়ায় মশগুল। সবাই একে একে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করে করে দোয়া করছেন।
এসব দেখার পর অডিটরদের আর বুঝতে বাকি হাকীমুল ইসলাম (রহ.) কোন ব্যাংকের কথা বলেছেন। তারা এসবকিছু নিয়ে ভাবতে ভাবতে প্রায় সকাল হয়ে এলো। সূর্য কিরণ ছড়াতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে এক দানবীর এসে নাম উল্লেখ না করে বিশাল অঙ্কের ছাঁদা দিয়ে যেতে দেখলো অডিটরগণ আরও হতভম্ব হয়ে গেলো। মানে তারা একদম যারপরনাই অবাক!
তো, খাইর। ঘটনাটি বলা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো, গভীর রজনীর সুনিদ্রার মায়া ত্যাগ করে রবের সমীপে দরখাস্ত মঞ্জুর করানোর মতো সৌভাগ্যবান লোক পার্থিব জীবনে এখনও আছে। যাদের মধ্যে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার তালেবানে ইলমে নবুওয়তরা অন্যতম।
সেদিন রাতে তাদের দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তবে বেশ অবাকও হইনি। কারণ সেসব মাদারিসে কওমিয়ার স্বকীয়তা ও পুরোনো ঐতিহ্য। এতে বেশ আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে আফসোস হলো আমরা জাহিলদের জন্য।
নাদানরা নাদান রয়েই গেলাম! আর আমাদের সহপাঠীরা কত সৌভাগ্যবান, যাদের উসিলায় পৃথিবী টিকে আছে, আমরা বেঁচে আছি! তারা এই যৌবনের সময়েই মহান রবকে চিনে ফেলেছে। রবের সান্নিধ্যের জন্য হামাগুড়ি খেয়ে যাচ্ছে। আর আমরা আছি দুনিয়ায় রং-তামাশা ও রঙ-রঙিনায়।
সত্যিই, তারা আছে বলেই আমরা এখনও পৃথিবীতে বেঁচে আছি। পৃথিবীটাও টিকে আছে। না হয় মহান আল্লাহ কত আগে এই নিষ্ঠুরতম দুনিয়াকে গুটিয়ে নিতো।
যাক, সে রাতে সেই সময় তড়িঘড়ি করে তাহাজ্জুদ দুচার রকআত পড়ে আমি তাদের কাতারে শামিল হলাম। মহান আল্লাহর দিকে তারা নিমগ্ন হয়ে মুখে কান্নার হাউমাউ ধ্বনি রেখে অন্তরের গহিন সূরে রব তাআলাকে ডাকছিলেন।
আমি তাদের সাথে হাত উঠিয়ে তাদের বলা প্রতিধ্বনি ‘আল্লাহ কবুল করুন’, ‘আল্লাহ কবুল করুন’ এ বাক্যগুলোর সাথে সূর মিলিয়ে আমিও বলছিলাম, ‘আমীন ইয়া আল্লাহ’, ‘আমীন ইয়া আল্লাহ’।
আমার সুধারণা তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারিত ‘আমীন, আমীন’ আহাজারিগুলো রব নিশ্চয়ই কবুল করেছেন। কারণ ওই যে শরীর কাঁপতে ছিল, শরীরের কাঁপুনি বন্ধ হয়ে গেলো। ভয় দূর হয়ে গেলো। মনেপ্রাণে সুকুনত মিললো। দেহে আলাদা একটা প্রশান্তি কাজ করতে শুরু করলো।
আচ্ছা তাদের দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করবেনই না কেন? আমি না হয় নাদান কিন্তু নিঃসন্দেহে তারা তো মুখলিস। তারা তো মুত্তাকী, দীনদার; পরহেজগার।
চলুন না, আমরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। আজ থেকে আমরাও শেষ রাতে জাগ্রত হবো। দুচার রকআত তাহাজ্জুদ পড়বো। দেশ-জাতি, জামিয়া ও নিজের কল্যাণের জন্য রবের প্রতি হাত দু-খানা বাড়িয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে ফরিয়াদ করবো। করবো তো ইনশা আল্লাহ? মহান আল্লাহ তাওফিক দিক। আমীন।
আল্লাহ! ওহে আল্লাহ! সুনিদ্রার ঘুম ত্যাগ করে রবের তরে রোনাজারিতে ভেঙে পড়ার মতো লোকসংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিন। সে সৌভাগ্যবানদের সারিতে এ নাদানকেও কবুল করে নিন। বরং সবাইকে কবুল করে নিন। আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন।