জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১০ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুরবানির হাট: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা, করণীয় ও বর্জনীয়

কুরবানির হাট: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা, করণীয় ও বর্জনীয়

আমরা ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা তথা মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রধান দুটি উৎসব রয়েছে, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ঈদুল ফিতর এটা রমজানের একমাস সিয়াম সাধনা শেষে শাওয়াল মাসের ১লা তারিখে উদ্‌যাপিত হয়। আর ঈদুল আযহা জিলহজ মাসের দশ তারিখে হয়। মূলত পশু কুরবানির পটভূমিতেই এই ঈদুল আযহা উদ্‌যাপিত হয়। এভাবে পশু কুরবানির জন্য ইসলামে গরু, ছাগল, খাসি, পাঠা, ভেড়া, দুম্বা, উট ও মহিষ ইত্যাদি জন্তু দিয়ে জবেহ ও কুরবানির বিধান রয়েছে। তাই এই কুরবানির পশু ক্রয় বিক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশে এবং অমুসলিম দেশে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় কুরবানির পশুর হাট আমরা দেখতে পাই। বাংলায় একে কুরবানির হাট, উর্দু ও হিন্দিতে কুরবানি মান্ডি, আরবিতে শাওক আল-উযহিয়া বলে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কুরবানির পশুর হাট দেখা যায়। ঢাকায় কুরবানির হাটের ইতিহাস অনেক পুরোনো। মোঘল ও ব্রিটিশ শাসনামলের সময়ে ঢাকায় রহমতগঞ্জ, গাবতলীসহ পাঁচটি এলাকায় কুরবানির হাট বসতো। তখন লোকসংখ্যা কম ছিল। পরে ১৯৪৭ সালের পরে পাকিস্তান আমলে ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আস্তে আস্তে কুরবানির হাটের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এখন বর্তমানে ঢাকায় কুরবানির হাটের সংখ্যাও শতাধিক। ১৯৪৭ সালের আগে পুরান ঢাকায় গেন্ডারিয়া, ধোলাইখাল, নয়াবাজার এসব এলাকায় কুরবানির পশুর হাট ছিল না। পরে এসব এলাকায় কুরবানির পশুর হাট এসেছে। ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর ইত্যাদি জেলার কুরবানির পশুর হাটের অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একেক কুরবানির হাটের কার্যক্রম ভিন্ন ভিন্ন দিনে শুরু হয়। অনেক হাট জিলহজ মাসের চাঁদ উঠার দুই-তিন সপ্তাহ আগেই শুরু হয়, আবার অনেক হাট জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার দুই-তিন দিন আগেই শুরু হয়। আবার অনেক হাট জিলহজ মাসের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়। মধ্যরাতে বিভিন্ন জাতের দেশি-বিদেশি কুরবানির পশু হাটে আসতে থাকে।

তবে কুরবানির হাটের ক্রেতাদের উপস্থিতিটা জিলহজ মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়। যারা কুরবানির হাটে গরু ছাগল সরবরাহ করে বিক্রি করেন তাদেরকে ব্যাপারী বলে। হাটে ক্রেতা সমাগম দেখা যায় ঈদুল আযহার চার পাঁচদিন আগে থেকে। কুরবানির হাটের প্রচারণার জন্য ঈদের ১৫ দিন আগে থেকে মাইকিং ও পোস্টারিং শুরু হয়। ‘হাট হাট হাট এক বিরাট কুরবানির হাট’ এই বাক্যে প্রচারণা চলে। পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, লেবানন, ইয়েমেন, জর্ডান, তুরস্ক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিসর, আলজেরিয়া, মরক্কো, আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিম দেশে কুরবানির হাট দেখা যায়। বাংলাদেশের ঢাকায় গেন্ডারিয়া-ধোলাইখাল হাট, নয়াবাজার-রহমতগঞ্জ হাট, মতিঝিলের আরামবাগে উটের হাট, রাজারবাগে সুন্নতী জামে মসজিদ সংলগ্ন এলাকার হাট, মেরাদিয়া হাট, গাবতলী হাট, কেরানিগঞ্জ, হাজারীবাগ ও ঠাটারিবাজার হাট ইত্যাদি ঢাকার জনপ্রিয় কুরবানির হাট।

প্রতিটি কুরবানির পশুর হাটে বেচাকেনা জমজমাট হয়ে উঠে। গত ছয়-সাত বছর আগে ই-কমার্সের মাধ্যমে অনলাইনে কুরবানির পশু ক্রয়েরও ব্যবস্থা হয়েছে। তবে কুরবানির হাট সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগেরও শেষ নেই। কয়েক বছর আগে অভিযোগ এসেছে অনেক হাটে মাইকে লাউড স্পিকারে মিউজিক বাজনাসহ গান ও মিউজিকসহ বিজ্ঞাপন বাজানোর। এগুলো খুবই দুঃখজনক। গত ২০১৬ সালে গেন্ডারিয়ার কুরবানির হাটসহ কয়েকটা হাটে এভাবে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য মাইকে মিউজিকসহ গান বাজানোর অভিযোগ এসেছিল (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন)

অধিকাংশ হকপন্থী আলেম ওলামাদের দৃষ্টিতে কুরবানির হাটে মিউজিকসহ গান বাজানো পবিত্রতা নষ্টের শামিল। আবার গতবছরও দুচারটি হাটে এমন অভিযোগ এসেছিল। পাশাপাশি ঈদের আগে দিন যত ঘনিয়ে আসে ততই পশুর দাম বাড়তে থাকে। গতবছর ২০২০ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগ নামের এক সংগঠন তাদের এক মানববন্ধনে কুরবানির পশুর হাটে মাইকে গান বাজানো বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।

তারা কুরবানির হাট একেবারে কমিয়ে ফেলার বিরোধিতাও করেছেন। তবে গত দুতিন বছর ধরে এগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা বিতর্ক হতে দেখা যাচ্ছে। গতবছর করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অনেক এলাকায় কুরবানির হাট বন্ধের দাবিতে কতিপয় লোকজন মানববন্ধন করেছিল, অনেক সুশীল দাবিদারকে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায় কুরবানির হাট এবং কুরবানি নিয়েও অনেক বিব্রতকর প্রোপাগান্ডা অপপ্রচার করতে দেখা যায়। এগুলো খুবই দুঃখজনক।

আমি প্রথম কুরবানির হাটে গিয়েছিলাম ২০১৩ সালে। গত ২০১৬ সালে পুরান ঢাকার ধূপখোলা গেন্ডারিয়া-ধোলাইখাল বানিয়ানগর কুরবানির হাটের মাইকে মিউজিক গান বাজানোর মতো বিব্রতকর কর্মকাণ্ড দেখা গেলেও পরে ২০১৭ থেকে এমনটা লক্ষ করিনি।

কুরবানির হাটে করণীয়, বর্জনীয় ও পরামর্শ

  1. কুরবানির হাটে নামাজের স্থান রাখা উচিত।
  2. দেশের সকল কুরবানির পশুর হাটে ক্রেতা আকর্ষণ বা এ জাতীয় অজুহাতে মাইকে বিজ্ঞাপন প্রচারণার আড়ালে অযথা মিউজিক গান-বাজনা বাজানো থেকে বিরত থাকা উচিত। তবে মাইকে বিরতি দিয়ে তিলাওয়াত, তাসবিহ ও তাকবীরাত (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার… ওয়া লিল্লাহিল হামদ), ইসলামী নাশিদ গজল বা হামদ-নাত কাসিদা বাজানো যেতে পারে।
  3. তাকওয়ার জন্য মহিলা মেয়েলোকদের কুরবানির পশুর হাটে যাওয়া থেকে বিরত থাকাই উত্তম বলে অনেকে মনে করেন।
  4. চোর, ডাকাত, চাঁদাবাজ, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টিদের প্রতিহত করার জন্য কুরবানির পশুর হাটের সকল ইজারাদার ও বিক্রেতাদের সজাগ হওয়া উচিত।
  5. অনলাইনে ওয়েবসাইটে কুরবানির পশু ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং তাদের কর্মকর্তাদের নজরদারি রাখা উচিত।
  6. কুরবানির পশুর হাটে তাকওয়া রক্ষার্থে অযথা ছবি তোলা ভিডিও রেকর্ড থেকে বিরত থাকা।
  7. কুরবানির পশুর হাট ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে হাত ধোয়ার কলের ব্যবস্থা ও এটিএম বুথ বসানো হোক।
  8. প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়া তথা সংবাদপত্র, রেডিও, টিভি টেলিভিশন, নিউজপোর্টাল, ওয়েবসাইট ও ব্লগসাইটগুলোতে নজরদারি রাখা উচিত যেন কুরবানির হাট, ঈদুল আযহা ও কুরবানি নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি বন্ধ হয়।

মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

শেখ আহসান উদ্দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ