জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আত্মহত্যা: প্রবণতা ও পরিণতি

আত্মহত্যা: প্রবণতা ও পরিণতি

 মুহাম্মদ জাহেদুল ইসলাম

লেখক: দাওরায়ে হাদীস, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম

আত্মহত্যা বর্তমান সমাজে সংঘটিত জঘন্যতম পাপকাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ কারণেই ইসলামে আত্মহত্যা করা কবীরা গুনাহ। নিজেই নিজের জীবনকে চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়ার নাম আত্মহত্যা। Suicide হচ্ছে আত্মহত্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ। লাতিন ভাষা Sui Sediur থেকে মূলত Suicide শব্দের উৎপত্তি। আল্লাহ রব্বুল আলামীন মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মানবকে জীবন দিয়েছেন, মরণও তাঁরই ইচ্ছাধীন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,

تَبٰرَكَ الَّذِيْ بِيَدِهِ الْمُلْكُ١ٞ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرُۙ۰۰۱ ا۟لَّذِيْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيٰوةَ لِيَبْلُوَكُمْ اَيُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلًا١ؕ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْغَفُوْرُۙ۰۰۲

‘বরকতময় তিনি (আল্লাহ) যাঁর হাতে রাজত্ব, তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে পরীক্ষা করবেন তোমাদের, কে তোমাদের কর্মে উত্তম। তিনি পরাক্রমশালী স্নেহশীল ক্ষমাময়।’[1]

মানুষের জীবনের মালিক আল্লাহ; তিনি মানুষকে মৃত্যু দান করেন। মানুষ তার জীবন ও সম্পদের রক্ষক। মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল আল্লাহর দেওয়া জীবন, আল্লাহর দেওয়া সময় বা আয়ু, আল্লাহর দেওয়া সম্পদ, আল্লাহর দেওয়া মেধা, আল্লাহর দেওয়া সুযোগ ও সামর্থ্য; আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় পরিচালনা, প্রয়োগ ও ব্যবহার করা বা পরিচালনা করা। কুরআনুল করীমে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন,

كُلُّ نَفْسٍ ذَآىِٕقَةُ الْمَوْتِ١۫ ثُمَّ اِلَيْنَا تُرْجَعُوْنَ۰۰۵۷

‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী, অতঃপর তোমরা আমারই কাছে ফিরে আসবে।’[2]

এক্ষেত্রে আত্মহত্যা হচ্ছে এমন মৃত্যু; যা বান্দা কর্তৃক আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বাভাবিক মৃত্যু উপেক্ষা করে নিজেই নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়া, যা ইসলামে মারাত্মক অপরাধ ও হারাম কাজ। আর পরকালে এর পরিণামও ভয়াবহ।

ইসলাম কখনও আত্মহত্যার মতো কোনো অপরাধকেই সমর্থন করে না। এমন কর্ম থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব প্রদান করে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনুল করীমের একাধিক আয়াতে ঘোষণা করেন,

وَلَا تَقْتُلُوْۤا اَنْفُسَكُمْ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيْمًا۰۰۲۹

‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল।’[3]

وَلَا تُلْقُوْا بِاَيْدِيْكُمْ اِلَى التَّهْلُكَةِ١ۛۖۚ ۰۰۱۹۵

‘তোমরা নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।’[4]

আত্মহত্যা সম্পর্কে নবীজি বলেন,

«الَّذِي يَخْنُقُ نَفْسَهُ يَخْنُقُهَا فِي النَّارِ، وَالَّذِيْ يَطْعَنُهَا يَطْعُنُهَا فِي النَّارِ».

‘হযরত আবু হুরায়রা (রযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামেও তার সেই যন্ত্রণাকে অব্যাহত রাখা হবে। আর যে ব্যক্তি ধারালো কোনো কিছু দিয়ে আত্মহত্যা করবে, তার সেই যন্ত্রণাকেও জাহান্নামে অব্যাহত রাখা হবে।”[5]

যেসব কাজে বাড়ে আত্মহত্যার প্রবণতা

বর্তমান সময়ে সমাজে নানা শ্রেণির নানা পেশার মানুষের মাঝে আত্মহত্যার ব্যাপক প্রবণতা লক্ষণীয়। সম্প্রতি গবেষকরা আত্মহত্যার পেছনে কিছু মুখ্য কারণ উদ্ঘাটন করেছেন। তা হচ্ছে,

  1. পারিবারিক কলহ,
  2. জীবন সংগ্রামে বিভিন্ন কাজে ব্যর্থতা ও হতাশা,
  3. স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য,
  4. মানসিক অবসাদ ও যন্ত্রণা উল্লেখযোগ্য।

বিশেষ করে আত্মহত্যার এ প্রবণতা খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় উঠতি বয়সি তরুণ ও তরুণীদের মাঝে। এদের অনেকেই যেসব কারণে এ অপরাধে জড়িত হয়:

  1. পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া কিংবা ভালো ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হওয়া। একদিন একটি মেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়াতে সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে৷ এরকম আরও অনেক ঘটনা যা আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখতে পায়৷
  2. যখন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে কপালে চাকরি ঝুটে না এদিকে পরিবার ও সমাজের যখন তিরস্কারের পাত্র হতে হয়৷ এরকম অনেক ঘটনা পাওয়া যায়৷ তার মধ্যে এখানে একটা তোলে ধরা হল:

গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে মালিহা (ছদ্মনাম) ঢাকার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করেছেন ২০১৮ সালে। অনার্স শেষ করার পর মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে পরিবারের কথা চিন্তা করে চাকরি খোঁজার সিদ্ধান্ত নেন। বিসিএস পরীক্ষার পাশাপাশি আরও কয়েকটি জায়গায় নিয়োগ পরীক্ষাও দেন তিনি। কিন্তু কোথাও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এর মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় প্রায় সব নিয়োগ পরীক্ষা। মালিহা গ্রামে পরিবারের কাছে ফিরে যান। সেখানে কয়েকমাস থেকে উপলব্ধি করেন যে তার কাছ থেকে তার পরিবারের একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। বৃদ্ধ বাবা-মা অনেকটা যেন অপেক্ষাই করে বসে আছেন যে, কবে মালিহা চাকরি পাবে আর সংসারের হাল ধরবে। শেষ পর্যন্ত গতবছর তৃতীয়বার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েও যখন প্রাথমিক পর্যায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি, তখন ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন মালিহা।

তিনি বলছিলেন, বাবা-মা একটা সময়ে আর ধৈর্য ধরতে না পেরে কটু কথাই শোনাতে শুরু করেছিলেন। তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। তাদের তো অনেক আশা ছিল যে, মেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে ভালো চাকরি পাবে, ছোট ভাইগুলোর খরচ বহন করবে। সেটা তো হয়ইনি, বরং আমিই বাবা-মার ঘাড়ে গিয়ে বসি। প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও তখন তাদের নানা ধরনের খোঁটা শুনতে হতো। সেরকমই একদিন আর সহ্য করতে পারিনি।

মালিহা বলেন, পরিবারের সদস্যরা ছাড়া চাকরি না পাওয়ায় বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকেও সেসময় অপ্রত্যাশিতভাবে খারাপ ব্যবহারের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিতদের সফলতার খবর দেখেও বিষণ্নতার মাত্রা বাড়তে থাকে তার। ‘আমি যখন হতাশ, হয়ে, বিষণ্নভাবে ঘরে বসে থাকতাম আর অনলাইনে চাকরি খুঁজতাম, তখন ফেসবুকে দেখতাম আমার বন্ধুদের অধিকাংশই সফলভাবে কিছু না কিছু করছে। সেগুলো দেখে মনে হতো, তাহলে বোধহয় আমিই কিছু পারি না, বাকিরা তো ঠিকই আছে, বলছিলেন মালিহা।

একদিন একটি কিতাবে পড়ছিলাম তাতে লেখা, জনাব! আত্মহত্যার বিধান কী? তাকে বললাম, দুঃখিত! আমি তোমার প্রশ্নটি বুঝতে পারিনি। প্রশ্নটি আবার করো। সে খুব বিরক্তির সঙ্গে বলল, প্রশ্ন তো একেবারে সুস্পষ্ট। আমি জানতে চাচ্ছি, আত্মহত্যার বিধান কী? আচানক অপ্রত্যাশিত উত্তর দিয়ে আমি তাকে চমকে দিতে চাচ্ছিলাম। তাই মুচকি হেসে উত্তর দিলাম, মুস্তাহাব। ছেলেটি এমন উত্তর শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে উচ্চ স্বরে জিজ্ঞাসা করল, কী বললেন? আমি বললাম, ‘ঠিকই বলেছি। তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমার সঙ্গে আত্মহত্যার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবো? যুবকটি চুপ করে রইলো।

আমি জানতে চাইলাম, তুমি আত্মহত্যা করতে চাচ্ছো কেন? আমি বেকার, আমার চাকরি নেই, কোনো কাজও খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। আসলে আমি ব্যর্থ ও অকর্মণ্য একজন মানুষ! যুবকটি এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো।

এরপর সে নিজের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার এক দীর্ঘ দস্তান আমাকে শোনাতে লাগলো। বর্তমানে অধিকাংশ লোকের এটা একটা বড় সমস্যা। কিছু লোক সবসময় নিজের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। নিজেকে সর্বদা তুচ্ছজ্ঞান করে। মর্যাদার শীর্ষ চূড়ায় উপনীত ব্যক্তিদের দিকে তাকিয়ে সেভাবে, সবার জন্য সম্ভব হলেও অন্তত আমার পক্ষে এমন মর্যাদা অর্জন করা সম্ভব নয়। জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশা করা অন্তত আমার জন্য শোভা পায় না। আমার স্বভাব ও প্রকৃতির মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটবে। এভাবেই চলতে হবে আমাকে। এ সম্পর্কেই কবি বলেছেন, ‘পর্বত-চূড়ায় পৌঁছুতে যার মনে ভয়-কম্পন ভূমির অতল গহ্বরে সে রয়ে যায় আমরণ।’

  1. প্রেম-ভালোবাসায় ব্যর্থতা বা প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি থেকে অনেকেই নিজেদের প্রতি আত্মঘাতী হয়ে আত্মহত্যা করছে। অথচ শরীয়তে একজন তরুণ ও তরুণীর মাঝে বিয়েপূর্ব প্রেম কিংবা ভালোবাসা স্থাপন সম্পূর্ণভাবে হারাম তথা নিষিদ্ধ। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থায় যথাযথভাবে ইসলামি শিক্ষা পদ্ধতি চালু না থাকায় অসংখ্য ব্যক্তি ইসলামের এই সত্য বিধানকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে না। ফলে দিন দিন আত্মহত্যার মাধ্যমে সমাজে মেধা শূন্যের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্কুল বা কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অসংখ্য মেধাবী শিক্ষর্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।  বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকে এই ধরনের বিষণ্নতার মধ্যে দিয়ে কখনো না কখনো দিন যাপন করেন। তাদের অনেকেই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছেন বা আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করেছেন। অলাভজনক একটি বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৭৯ জন। (বিবিসি নিউজ, ২৯ শে জানোয়ারি ২০২২)

এ পর্যন্ত কোনো পত্র-পত্রিকায় বা সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা পাইনি যে, একজন কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে৷ হ্যাঁ, কেন পাওয়া যাবে? তাদের কাছে তো ইসলামের জ্ঞান আছে৷ এ থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই কাজে জড়িত ইসলামিক জ্ঞান শূন্যতার দরুন৷ কেন এই আত্মহত্যা? কেউ কেউ নিজের জীবনের প্রতি এতই বিরক্ত হয় যে, ভাবে এই বুঝি আত্মহত্যা করে ফেলবো! হয়ত আত্মহত্যাই হতে পারে হাজারো ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির পথ। পরক্ষণেই আবার ভাবনায় আসে, আমার মতো আর কতজন এভাবে আত্মহত্যা করে মুক্তি পেতে পারবে? আত্মহত্যা কি সত্যিই সব সমস্যার সমাধান?

সম্ভবত দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি লাভের উপায় ‘আত্মহত্যা’ হতে পারে না। কেননা আত্মহত্যা যদি সব সমস্যার সমাধান হতো, তবে পৃথিবীতে মধ্যবিত্ত বলে কোনো পরিবার থাকতো না। সবগুলো পরিবার-ই আত্মহত্যা করে দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্ত করে নিতো নিজেকে। যেমন কিছু দিন আগে এক ভদ্রলোক মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছে৷ সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব ভাইরাল হয়েছে৷ আমরা সবাই তো দেখেছি৷ সে হয়ত ভেবেছে, আত্মহত্যাই সব সমস্যার সমাধান৷ কিন্তু, না৷ তার যথাযথ ইসলামের জ্ঞান না থাকার কারণে এরকম ঘৃণিত কাজ সে করতে পারল৷ সে হয়ত ভাবতে পারে, এক সেকেন্ডে আত্মহত্যা করে মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে! কিন্তু সে তো জানে না সাকরাত কাকে বলে৷ বরং সে ১০ দিনের কষ্টকে এক সেকেন্ডের মধ্যে নিজের ওপর আরোপ করেছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে তাকে বীরপুরুষ বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, যে ব্যক্তি সামান্য একটু কষ্ট স্বীকার করতে পারেনি সে আবার বীরপুরুষ হয় কেমনে?

আসলে চাইলেই এ সুন্দর জীবনটাকে নষ্ট করে দেওয়া যায় না। জীবনের মায়া, বড় মায়া। এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কেউ সহজে যেতে চায় না। সবাই চায় আরও কদিন বেশি বাঁচতে। তাহলে কতটা বিভীষিকার কাতারে দাঁড়ালে একজন মানুষ তার নিজের জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে? একবারও কি একথা কারও মাথায় আসে? তুমি যখন ডিপ্রেশনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পরে আত্মহত্যার প্রিপারেশন নিচ্ছো তখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া মানুষটা হয়ত আল্লাহর কাছে আর দুটো দিন বেশি বাঁচার জন্য কাকুতি মিনতি করছে। আচ্ছা, এত শত করে কি হবে বল তো? মানুষ তো হাজার বছর বাঁচেনা। এই বড়জোর ৬০ কি ৭০ বছর, যেমন নবীজি (সা.) বলেছেন,

«أَعْمَارُ أُمَّتِي مَا بَيْنَ السِّتِّينَ إِلَى السَّبْعِينَ، وَأَقَلُّهُمْ مَنْ يَجُوزُ ذَلِكَ».

‘আমার উম্মতের বয়স হবে ষাট থেকে সত্তরের মাঝামাঝি, খুব অল্প সংখ্যক লোক তা থেকে বাড়বে৷’[6]

জীবনটাতো একদম ছোট। ফুঁস করে হাওয়ার মতো সময়টাও কোথা দিয়ে বেরিয়ে যাবে টেরই পাবে না। প্রবাদের আছে,

دنیا بقدر قسمت، عقبی بقدر محنت۔

দুনিয়া আপনি ততটুকু পাবেন যতটুক আপনার কিসমতে রয়েছে, আর আখিরাতের জন্য যত কষ্ট-ক্লেস করে আমল করবেন ততটুকু পাবেন৷ একজন কবি কতই না সুন্দর বলেছেন,

دنیاہے غم و حسرت کا قفس، آرام کا یہ گلزار نہیں
ایك خواب وتماشہ گاہ یہی، داءم کا ر ہنادار نہیں

‘দুনিয়া পুরোটাই হচ্ছে একটি দুঃখ কষ্টের পিঞ্জর, এখানে আরাম-আয়েশের প্রশ্নই আসে না। দুনিয়াটি একটি স্বপমাত্র কেউ এখানে চিরঞ্জীব না৷’

নবীজি (সা.) বলেছেন,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «الدُّنْيَا سِجْنُ الْـمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ».

‘হযরত আবু হুরায়রা (রযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা আর কাফেরের জন্য জান্নাতস্বরূপ।”[7]

দুনিয়ার মধ্যে চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশান থাকবেই৷ এর মাঝে আমাদের জীবন পাড়ি দিতে হবে৷ যদি কোনো ব্যক্তির চিন্তা না থাকে তাহলে সে উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছতে অক্ষম হবে৷

আত্মহত্যার পরিসংখ্যা

বিগত বছরগুলোতে আত্মহত্যা সংঘটিত হওয়ার পরিসংখ্যান অন্তত আমাদের তা-ই মনে করিয়ে দেয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বের অবস্থা একই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বছরে প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। তবে ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সি যুবক-যুবতীরা বেশি আত্মহত্যা করে বলে জানা গেছে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দশম। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩টি জাতীয় পত্রিকা, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণের জন্য ৩২২টি আত্মহত্যার ঘটনাকে বেছে নেওয়া হয়।

আঁচল ফাউন্ডেশন দাবি করছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। তারা তুলনা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গতবছরের এ সংক্রান্ত নিহতের সংখ্যার সঙ্গে। সংগঠনটির হিসেবে, এক বছরে আত্মহত্যা করার সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে, ২০১৯ সালে সারাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। এই এক বছরের ব্যবধানে আত্মহত্যার পরিমাণ বাড়াটা অশনিসংকেত।
বাংলাদেশ পুলিশ হেড কোয়ার্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৯৫টি। আর ২০১৬ সালে এর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৬০০, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৫০০ এবং ২০১৪ সালে তা ছিল ১০ হাজার ২০০টি। এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, প্রতি বছরই আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে এবং গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন করে আত্মহত্যা করছে। বড়দের সাথে শিশু ও কিশোররাও আত্মহত্যা করছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের মতে, শুধু ২০১৭ সালেই ৭৬ জন আত্মহত্যা করে, যা গত ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছিল ৫৩৪। আরও শঙ্কার বিষয় হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের এক রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থা কারওই কাম্য নয়। এটি মনে রাখা জরুরি যে, একটি আত্মহত্যা শুধু একটি জীবনকে শেষ করে দেয় না বরং একটি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি গোটা মানবজাতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি। কিন্তু কিভাবে? সে নিয়ে চিন্তা ও গবেষণার কোনো অন্ত নেই।  আত্মহত্যার ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সি রয়েছেন ৪৯ শতাংশ, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি ৩৫ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সি ১১ শতাংশ। সবচেয়ে কম আত্মহননকারী হচ্ছেন ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সিরা, ৫ শতাংশ। (প্রথম আলো, ১৩ মার্চ ২০২১)

একজন মুসলমান কোনো দিন সুসাইড করতে পারে না:
মুমিন ব্যক্তি কখনো হতাশাগ্রস্ত হন না। কারণ তাঁর জীবনের সব ভালো কাজের ফলাফল তিনি আল্লাহর কাছে পাবেন, এটা তাঁর ইমান ও বিশ্বাস। দুনিয়ায় ভালো কাজের সুফল বা স্বীকৃতি না পেলে তাতে ইমানদারের আফসোস বা অনুতাপ হয় না। মন্দ কাজের জন্য ক্ষমা পাওয়ার চূড়ান্ত পরম ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বাসী মুমিন ব্যক্তিকে চরমভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছে৷

قُلْ يٰعِبَادِيَ الَّذِيْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰۤى اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللّٰهِ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا١ؕ اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ۰۰۵۳

‘হে রসুল! আপনি বলুন, (মহান আল্লাহ ঘোষণা করছেন) হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের প্রতি (পাপ ও অপরাধ দ্বারা) অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সকল পাপ ক্ষমা করবেন; নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল দয়াময়।’[8]

তাই সে ভুল করলে তওবা করে পবিত্র হয়ে নতুন জীবন শুরু করে; নিরাশ বা হতাশ হয় না। আত্মহত্যাকারীর জন্য দোয়া করা ও তার জানাজা পড়া যাবে কিনা? প্রথম বিষয়টি হচ্ছে দোয়া করা যাবে কি না? আত্মহত্যাকারীর জন্য দোয়া করা যাবে। কেননা যত বড় গুনাহগারই হোক যদি সে ঈমান অবস্থায় মারা যায় তবে তার জন্য ইস্তিগফার করা জায়েয। তাই আত্মহত্যা কাবীরা গুনাহ হলেও ওই ব্যক্তির জন্য দোয়া করা যাবে। একটি হাদীসে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রযি.) বলেন,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: كُنَّا نُمْسِكُ عَنِ الْاسْتِغْفَارِ لأَهْلِ الْكَبَائِرِ، حَتَّىٰ سَمِعْنَا نَبِيَّنَا ﷺ يَقُوْلُ: [اِنَّ اللّٰهَ لَا يَغْفِرُ اَنْ يُّشْرَكَ بِهٖ وَ يَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ يَّشَآءُۚ ۰۰۴۸] {النساء: 48}، وَقَالَ: أَخَّرْتُ شَفَاعَتِيْ لأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِيْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

‘আমরা কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তিদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করতাম না। পরে রসুলুল্লাহ (সা.) থেকে যখন শুনলাম, ‘আল্লাহ তাআলা তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করবেন না। শিরক ছাড়া যেকোনো গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন।’[9] আর আমি উম্মতের মধ্যে কবীরা গুনাহে জড়িয়ে যাওয়া লোকদের জন্য আমার সুপারিশের ক্ষমতাকে জমা করে রেখেছি এরপর থেকে আমরা তাদের জন্য দোয়া করতাম।’[10]

অন্য এক হাদীসে এসেছে,

عَنْ جَابِرٍ، أَنَّ الطُّفَيْلَ بْنَ عَمْرٍو الدَّوْسِيَّ أَتَى النَّبِيَّ ﷺ، فَقَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، هَلْ لَكَ فِيْ حِصْنٍ حَصِينٍ وَمَنَعَةٍ؟ قَالَ: حِصْنٌ كَانَ لِدَوْسٍ فِي الْـجَاهِلِيَّةِ، فَأَبَى ذَلِكَ النَّبِيُّ ﷺ لِلَّذِيْ ذَخَرَ اللهُ لِلْأَنْصَارِ، فَلَمَّا هَاجَرَ النَّبِيُّ ﷺ إِلَى الْـمَدِيْنَةِ هَاجَرَ إِلَيْهِ الطُّفَيْلُ بْنُ عَمْرٍو، وَهَاجَرَ مَعَهُ رَجُلٌ مِنْ قَوْمِهِ، فَاجْتَوَوُا الْـمَدِيْنَةَ فَمَرِضَ فَجَزِعَ، فَأَخَذَ مَشَاقِصَ لَهُ فَقَطَعَ بِهَا بَرَاجِمَهُ، فَشَخَبَتْ يَدَاهُ حَتَّىٰ مَاتَ، فَرَآهُ الطُّفَيْلُ بْنُ عَمْرٍو فِي مَنَامِهِ، فَرَآهُ وَهَيْئَتُهُ حَسَنَةٌ وَرَآهُ مُغَطِّيًا يَدَيْهِ، فَقَالَ لَهُ: مَا صَنَعَ بِكَ رَبُّكَ؟ فَقَالَ: غَفَرَ لِي بِهِجْرَتِي إِلَىٰ نَبِيِّهِ ﷺ، فَقَالَ: مَا لِي أَرَاكَ مُغَطِّيًا يَدَيْكَ؟ قَالَ: قِيْلَ لِيْ: لَنْ نُصْلِحَ مِنْكَ مَا أَفْسَدْتَ، فَقَصَّهَا الطُّفَيْلُ عَلَىٰ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: «اللَّهُمَّ وَلِيَدَيْهِ فَاغْفِرْ ».

‘হযরত জাবির (রযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন নবী (সা.) মদীনায় হিযরত করলেন, তখন তুফাইল ইবনে আমর এবং তার গোত্রের একজন লোকও তাঁর সঙ্গে মদীনায় হিজরত করেন। কিন্তু মদীনার আবহাওয়া তাদের অনুকূল হয়নি। তুফাইল ইবনে আমর (রযি.)-এর সাথে আগত লোকটি অসুস্থ হয়ে পড়ল। রোগযন্ত্রণা বরদাশত করতে না পেরে তীর নিয়ে তার হাতের আঙুলগুলো কেটে ফেলল। এতে উভয় হাত থেকে রক্ত নির্গত হতে থাকে। অবশেষে সে মারা যায়। তুফাইল ইবনে আমর দাওসী (রযি.) স্বপ্নে তাকে ভালো অবস্থায় দেখতে পেলেন, কিন্তু তিনি তার উভয় হাত আবৃত দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার রব তোমার সাথে কীরূপ ব্যবহার করেছেন? সে বলল, আল্লাহর জন্য তাঁর নবী (সা.)-এর কাছে হিজরত করার কারণে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তুফাইল (রযি.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কী হয়েছে যে, আমি তোমার হাত দুটি আবৃত দেখছি? সে বলল, আমাকে বলা হয়েছে যে, আমি তা দুরস্ত করবো না, তুমি স্বেচ্ছায় যা নষ্ট করেছ। তুফাইল (রযি.) নবী (সা.)-এর কাছে ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। তখন রসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করলেন, ‘ইয়া আল্লাহ! আপনি তার হাত দুটিকেও ক্ষমা করে দিন।”[11]

দ্বিতীয়ত জানাজার হুকুম

কোনো মুসলিম ব্যক্তি যদি আত্মহত্যা করেন, তা হলে তার জানাজা পড়া হবে। তবে তার জানাজায় সমাজের অনুসৃত ও মান্যবর ব্যক্তিরা শরিক হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যাতে করে ‘আত্মহত্যা কবীরা গুনাহ’ হওয়ার অপরাধবোধ মানুষের অনুভূতিতে জাগ্রত থাকে।

عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ: أُتِيَ النَّبِيُّ ﷺ بِرَجُلٍ قَتَلَ نَفْسَهُ بِمَشَاقِصَ، فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْهِ.

‘হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে আত্মহত্যাকারী এক ব্যক্তির লাশ আনা হয়, রসুলুল্লাহ (সা.) তার জানাজা পড়েননি।’[12]

আত্মহত্যা থেকে পরিত্রাণের উপায়

আত্মহত্যার মতো মারাত্মক অপরাধ প্রবণতা থেকে সন্তানদের মুক্ত রাখতে প্রতিটি বাবা ও মায়ের উচিত নিজ সন্তানের প্রতি আরও যত্নবান হওয়া। কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিজ সন্তানকে প্রেমের বিধান সম্পর্কে অবহিত করা। সন্তানের সঙ্গে এমন সুসম্পর্ক গড়ে তোলা-যাতে অনায়াসেই সন্তান জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তার বাবা ও মাকে নির্ভয়ে জানাতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, আত্মহত্যার মাধ্যমে শুধুই একটি জীবন প্রদীপ নিভে যায় না; বরং অন্তরে লুকিয়ে থাকা হাজারো স্বপ্ন মাটির সঙ্গে মিশে ধুলোয় পরিণত হয়। পাশাপাশি কোনো কাজে ব্যর্থ হাওয়া মাত্রই আল্লাহর ওপর ভরসা না করে অনেকেই হতাশায় ভুগে আত্মহত্যা করেন। অথচ আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন বিপদ-আপদের সম্মুখীন হলে কর্তব্য কী হবে, সে সম্পর্কেও রয়েছে কুরআনের ঘোষণা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلٰوةِ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِيْنَ۰۰۱۵۳

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলগণের সঙ্গে আছেন।’[13]

সকলের স্মরণে থাকা উচিত, আত্মহত্যার মারাত্মক অপরাধ প্রবণতা থেকে বাঁচতে জীবন পথে চলতে গিয়ে বহু বিপদের সম্মুখীন হতে হবে এবং অর্জিত হবে নানান অভিজ্ঞতা। শত বিপদের মাঝেও সর্বদা হাসিমুখে থাকার চেষ্টা করতে হবে। নিজের মাঝে পরিবর্তনের চেষ্টা ও জীবনকে নতুন করে সাজানোর প্রচেষ্টা করতে হবে।

এই প্রবণতা নিরসনে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে নৈতিক আচরণ করতে হবে। সর্বোপরি সামাজিক শৃঙ্খলা ও পারিবারিক বন্ধন মজবুত করতে হবে। নিরাপদ জীবন ও অপরাধমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র ও প্রশাসন ন্যায়ভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হতে হবে।

এই জীবন যুদ্ধে যিনি প্রতিটি মুহূর্ত ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করবেন, দিন শেষে তিনিই সফলতার মুখ দেখতে পাবেন। বাংলা ভাষার সেই প্রবাদ বাক্যই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যে ‘সবুরে মেওয়া ফলে।’ আর এসবর বা ধৈর্যশীলতাই মহান আল্লাহর কাছে একান্ত পছন্দনীয়। তিনি ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।  আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই ঘৃণিত কাজ থেকে বাঁচার তওফিক দান করুন৷ আমীন।

[1] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-মুলক, ৬৭:১-২

[2] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আনকাবূত, ২৯:৫৭

[3] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নিসা, ৪:২৯

[4] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-বাকারা, ২:১৯৫

[5] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ৯৬, হাদীস: ১৩৬৫

[6] (ক) আত-তিরমিযী, আল-জামিউস সহীহ = আস-সুনান, মুস্তফা মুস্তফা আল-বাবী আল-হালাবী অ্যান্ড সন্স লাইব্রেরি অ্যান্ড প্রিন্টিং কোম্পানি, কায়রো, মিসর (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৩৯৫ হি. = ১৯৭৫ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ৫৫৩, হাদীস: ৩৫৫০; (খ) ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭১ হি. = ১৯৫২ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ১৪১৫, হাদীস: ৪২৩৬

[7] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৪ হি. = ১৯৫৫ খ্রি.), খ. ৮, পৃ. ২১০, হাদীস: ২৯৫৬

[8] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আয-যুমার, ৩৯:৫৩

[9] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নিসা, ৪:৪৮ ও ১১৬

[10] আল-বাযযার, আল-মুসনাদ = আল-বাহরুয যাখ্খার, মাকতবাতুল উলুম ওয়াল হাকাম, মদীনা মুনাওয়ারা, সৌদি আরব (১৪০৪-১৪২৯ হি. = ১৯৮৮-২০০৯ খ্রি.), খ. ১২, পৃ. ১৮৬, হাদীস: ৫৮৪০

[11] মুসলিম, আস-সহীহ, খ. ১, পৃ. ১০৮-১০৯, হাদীস: ১১৬

[12] মুসলিম, আস-সহীহ, খ. ২, পৃ. ৬৭২, হাদীস: ৯৭৮

[13] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-বাকারা, ২:১৫৩

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ