জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি-২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ-১০ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আদব শিখি বড়দের কাছ থেকে

শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ বিভাগ… (নিয়মিত বিভাগ)

আদব শিখি বড়দের কাছ থেকে

সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী

[আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী (হাফিজাহুল্লাহ)একটি নাম, একটি সজীব আন্দোলনপূর্ব-পশ্চিমে এ নাম দীপ্যমান তাঁর কর্মগুণেবর্তমান বাংলাদেশের বর্ষীয়ান আলেমে দীন ও বরেণ্য ইসলামি ব্যক্তিত্ববহু যোগ্য আলেমের সুপ্রিয় উস্তাদজামিয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালকআন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থা রাবেতাতুল আদবিল আলমিল ইসলামির বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধানআরব বিশ্বে সমাদরের সঙ্গে পরিচিত এক বরেণ্য বাংলাদেশি মনীষী-আলেমবার্ধক্য ও অসুস্থতার মধ্যে এখনও তিনি দীনের, ইলমের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেনগোটা বাংলাদেশের পাশাপাশি বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর জ্ঞান-গবেষণার দ্যুতিআকাবির-আসলাফের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেন তিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেমানুষকে কাছে টানার এক অদ্ভুত যোগ্যতা রয়েছে তাঁরনানা মত-পথের মানুষ তাঁর সামনে অবনতমস্তক হয়ে পড়েনএ মহা মনীষী আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় প্রায় ২৩ বছর জীবন অতিবাহিত করেছেনছয় বছর পড়াশোনায় এবং সতের বছর শিক্ষকতায়বর্তমানে তিনি জামিয়া পটিয়ার প্রধান পৃষ্ঠপোষক

বিগত ১৯ রবিউস সানী ১৪৪৪ হিজরি মোতাবেক ১৫ নভেম্বর ২০২২ খ্রিস্টাব্দ (মঙ্গলবার) জামিয়ার শোবায়ে মুশায়ারা (কাব্য চর্চা বিভাগ)-এর তত্ত্বাবধানে উপমহাদেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সফল মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস আল্লামা শাহ মুফতি মুহাম্মদ আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)-এর স্মরণে একটি মরসিয়া অনুষ্ঠান ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আল্লামা সুলতান যওক নদভী (হাফি.)তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রের স্মরণে উর্দু ভাষায় একটি সারগর্ভ কবিতা রচনা করেনঅতঃপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা করেনএতে জামিয়া পটিয়ার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা যেমন প্রস্ফুটিত হয়েছে, তেমনি তাঁর এই ব্যক্তিত্ব গঠনের নিগূঢ় তত্ত্বও উদ্ভাসিত হয়েছেএসব কথা তিনি তাঁর আত্মজীবনী আমার জীবন কথা গ্রন্থেও লিখেছেনতাঁর বক্তব্য ও আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখিত তথ্যের আলোকে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হলোমহান আল্লাহ হযরতকে সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু দান করেন এবং তাঁর আদর্শ জীবন থেকে আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করার তওফিক দান করুন, আমীনবিভাগীয় সম্পাদক]

আমি আজিজি কাননের পুষ্প, এটিই আমার পরিচয়, এটিই আমার গর্ব!

বক্তব্যের প্রারম্ভে হযরত আল্লামা সুলতান যওক নদভী (হাফি.) বলেন, ‘আমি এই জামিয়ারই একজন ফাযেল, গ্র্যাজুয়েট। আমি আজিজি কাননের এক পুষ্প। এটিই আমার গর্ব। এটিই আমার পরম সৌভাগ্য। এই বাগানেই আমার জীবনের ২৩টি বছর অতিবাহিত হয়েছে। ছয় বছর ছাত্র হিসেবে। আর ১৭ বছর শিক্ষকতার খেদমতে। এই আজিজি কাননে, এই জামিয়ায় শিক্ষকতা করেছি বলে নয়; বরং এই মকবুল এদারার প্রতিষ্ঠাতাসহ সকল মুরব্বিদের সাথে গভীর সম্পর্কটাই আমার পরম সৌভাগ্যের, কাবেলে ফখর ও ই’তেজাজ। আমার নামের শেষে নদভী লেখা হয়। আমি নদভী হওয়ায় গর্ববোধ করি না; বরং এই জামিয়ার একজন ফাযেল হওয়াই আমার জন্য ‍সুখের ও গর্বের বিষয়।’

যেভাবে আমি নদভী হলাম

১৭-১৯ এপ্রিল ১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সেমিনারে অংশ গ্রহণের আমন্ত্রণ এলো। এর আগে জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক মুহতামিম আলহাজ মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুস সাহেব (রহ.) আমাকে কিছু দিনের জন্য দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ছিলেন। তিনি হযরত মাওলানা আলী মিয়া নদভী (রহ.)-কে এ মর্মে একটি চিঠিও লিখেছিলেন। হযরত মাওলানা তিন মাসের জন্য আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু যাওয়া আর হয়ে উঠেনি। এবার সেমিনারে অংশ গ্রহণের জন্য আমার কাছে দাওয়াতনামা এলে মুহতামিম সাহেব সফরের অনুমতি দিয়ে দিলেন এবং এক মাসের ছুটি মঞ্জুর করলেন। সেমিনারে আমার প্রবন্ধ ছিল: اختيار النصوص الأدبية من وجهة نظرة إسلامية (ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে আরবি সাহিত্য পাঠ নির্বাচন)। সেমিনারে বিভিন্ন আরব দেশ থেকে আরব প্রতিনিধিদল অংশ নিয়েছিল। এই সেমিনার থেকেই আন্তর্জাতিক ইসলামি সাহিত্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার গঠনমূলক ও পর্যায়ক্রমিক প্রয়াস শুরু হয়। এজন্য এই সেমিনার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেমিনারের পর আমি দুই মাস ইলমী ইস্তেফাদার জন্য নদওয়ায় অবস্থানের ইচ্ছে ব্যক্ত করলে হযরত ভীষণ খুশি হলেন। হযরত মাওলানা রাবে হাসান নদভী সাহেবকে হুকুম দিলেন আমার রুটিনসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য।

নদওয়াতুল উলামায় দুমাস

যেহেতু পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নদওয়াতুল উলামায় আমার এই সফর ছিল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সেমিনারে অংশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে, তাই প্রসঙ্গত এখানে সেই সেমিনারের কথা কিছুটা বিস্তৃত পরিসরে উল্লেখ করা দরকার। সেমিনারকে দুটি ভাগে সাজানো হয়েছিল। একভাগে আরবি ভাষা আর অপর ভাগে উর্দু, ফারসি ও ইংরেজি ভাষা। প্রায় ৮০টি প্রবন্ধ এই সেমিনারের বিভিন্ন অধিবেশনে উপস্থাপিত হয়েছিল। বেশির ভাগই ছিল আরবি প্রবন্ধ। এই আরবি পর্বের কার্যক্রম সাতটি অধিবেশনে সমাপ্ত হয়েছিল। সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার সদ্য নির্মিত নতুন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন সেমিনার হলে।

নদওয়াতুল উলামার রেক্টর হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) সভাপতিত্ব করেছিলেন এবং সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন আরব মেহমানদের মধ্যে মরহুম শায়খ আবদুল আজিজ আর-রেফায়ী। আর কোন কোন অধিবেশনে বিশিষ্ট আরবি সাহিত্যিক প্রফেসর আবদুর রহমান হাসান হাবান্নাকাহ হযরত মাওলানা আলী মিয়া (রহ.)-এর প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রখ্যাত ইসলামি সাহিত্যিক ডক্টর আবদুর রহমান রাফাত পাশা (রহ.) ছিলেন সেমিনারের অনুষ্ঠান সূচি-নির্ধারক। বিভিন্ন ইসলামি ইউনিভার্সিটি, সংস্থা, আরব বিশ্বে নানা দেশের মন্ত্রী পরিষদ সদস্যসহ আগত মেহমানদের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আরব মেহমানদের প্রাণময় উপস্থিতি, জীবনপ্রবাহে দ্যুতি ছড়ানো বক্তৃতামালা এবং তাদের কবিতা আবৃত্তি উপস্থিত শ্রোতারা প্রাণভরে উপভোগ করেছিল। অধিবেশন প্রলম্বিত হচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু তাতে কোন বিরক্তিবোধ ছিল না; বরং সবারই মনের আকুতি ছিল অধিবেশনটা যদি আরও দীর্ঘায়িত হতো। অনুষ্ঠানজুড়ে বিরাজ করছিল শান্ত সমাহিত ও হৃদয়-তৃপ্তির শীতল অনুভূতি। অনুষ্ঠানের তিন তিনটি দিন এই উদ্যম ও উদ্দীপনা পরিবেশের ভেতর দিয়েই কেটে গেলো। শায়খ নদভী (রহ.) তাঁর সমাপনী বক্তব্যে কতো সুন্দর করে বলেছিলেন,

 كنا نعتقد أننا دعونا هذه الندوة في غير أوانها وفي غير مكانها، ولكن الله c علىٰ كل شيء قدير، فقد أثبت أنها جاءت في أوانها وفي مكانها.

‘আমরা তো ভাবছিলাম যে, অসময়ে এবং অনুপযুক্ত জায়গায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বসেছি, কিন্তু আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনি আজ দেখালেন যে, এই অনুষ্ঠান হয়েছে যথা সময়ে এবং যথাস্থানে।’

এই সেমিনার গতানুগতিক ধারার কোন সেমিনার ছিল না; বরং সাহিত্য ও সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে এক নতুন ধারা প্রবর্তনের দিকে একটি আহ্বান ছিল। ইসলামি সাহিত্যের প্রতি যুগচাহিদা, সচেতনতা ও জাগৃতির দাওয়াত ছিল। প্রচলিত বাণিজ্যিক ও মেকি আধুনিক সাহিত্যের নামে মাথা উঠানো অশ্লীল সাহিত্যকে প্রতিরোধ করার জন্য জিহাদী সাহিত্যের একটি স্পষ্ট বার্তা ছিল। যার চিন্তায় দীর্ঘদিন ধরে শায়খ নদভীর অন্তরাত্মা ব্যাকুল ছিল।

তাই এই বিষয়ে কলম ধরার কথা সবার আগে তাঁর হৃদয়েই ‘ইলহাম’ হয়। তিনি দামেস্কভিত্তিক আরবি ভাষা অ্যাকাডেমির সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বড় স্পষ্ট ভাষায় এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যাতে তিনি জোরালোভাবে ইসলামি সাহিত্যের প্রতি দাওয়াত পেশ করেন। পরবর্তী সময়ে এ ধারায় আরব বিশ্বের নামী দামি লেখক-সাহিত্যিকরা লিখতে শুরু করেন। যাদের মধ্যে শহীদ সাইয়েদ কুতুব এর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি তার التاريخ فكرة ومنهاج (ইতিহাস: চিন্তা ও পন্থা) নামক গ্রন্থে এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধও ছাপেন।

মোটকথা এই সেমিনারে অংশগ্রহণের সুবাদে ইসলামি জগতের খ্যাতিমান লেখক-সাহিত্যিক ও কবিদের সাথে পরিচিত এবং উপকৃত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। সুযোগ হয়েছিল আরবদের সামনে এবং ইসলামি সাহিত্যের সেনাপতি ও দিক-দিশারী আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর সামনে নিজের প্রবন্ধ উপস্থাপনের। প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় লক্ষ করছিলাম। যে, হযরত বড় মনোযোগের সাথে তা শুনছিলেন। হযরত মুফাক্কিরে ইসলাম থেকে অনুগ্রহ অর্জনের এবং তাঁর স্নেহ ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ লাভ করলাম।

এই সাক্ষাতে হযরতের মহান ব্যক্তিত্বের পরশ থেকে কতোটা নৈকট্য লাভ করেছিলাম এবং অধমের ওপর কতোটা কৃপাদৃষ্টি যে বর্ষিত হয়েছিল তা শুধুই অনুভবযোগ্য—বলার নয়। হযরত মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে হাসানী নদভী দামাত বারাকাতুহুমকে নির্দেশ দিলেন আমার কর্মসূচি ঠিক করতে। মাওলানা রাবে (হাফি.) তখন আমার রুটিন ঠিক করে আমাকে জানালেন, ‘আপনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় আদব ও ইনশার ওপর দুয়েকটি ক্লাশ নিতে থাকুন। দ্বিতীয়ত কয়েকটি সাহিত্য দরসে বসুন এবং কুতুবখানায় বসে গবেষণা করুন।’

আমি ইনশা এবং আরবি তরজমার একটি ঘণ্টা নেওয়ার কথা জানালাম যা সানুভিয়ার ছাত্রদের পাঠ্য মুআল্লিমুল ইনশা কিতাবের অংশ ছিল পাশাপাশি হযরত মাওলানা সাঈদুর রহমান আজমী, হযরত মাওলানা ওয়াজেহ রশিদ নদভী ও মাওলানা রাবে হাসানীর আদব ও ইসলামি চিন্তা দর্শনের বিভিন্ন সবকে বসা শুরু করলাম। হযরত মাওলানা সাঈদ আজমী খুব সহজ উপস্থাপনায় আরবি কবিতার ব্যাখ্যা করতেন আরবি ভাষায়। তাঁদের শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং চিন্তাধারা থেকে আমি অনেক উপকৃত হয়েছিলাম।

দুই মাস সময় ছিল খুব অল্প। তবুও এই অল্প সময় থেকে বেশি বেশি কাজ নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। হযরত মাওলানা ডক্টর আবদুল্লাহ আব্বাস নদভী নদওয়াতুল উলামার শিক্ষা সচিব; সৌদি আরবের বাদশা আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। গ্রীষ্মকালীন ছুটিটা তিনি নদওয়ায় কাটাতেন। তিনি সমাপনী বর্ষের ছাত্রদের সামনে মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। সেসব বক্তব্য থেকেও আমি উপকৃত হতে লাগলাম। ড. আবদুল্লাহ আব্বাস নদভী অভিধান বিষয়ক একাধিক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেছেন। আরবি এবং ইংরেজিতে যেমন অপরিসীম পাণ্ডিত্য রয়েছে তাঁর তেমনি বিস্তৃত ও বহুমুখী অভিজ্ঞতায়ও তিনি পরিপুষ্ট। আর উর্দু তার মাতৃভাষাই। যখন মাওলানার সাথে দেখা করে উপকৃত হওয়ার উদ্দেশ্যে দুই মাস নদওয়াতুল উলামায় অবস্থানের কথা তাকে জানালাম তখন আমার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, ‘আরবি সাহিত্যের কি কি কিতাব পড়েছেন? আমি مفيد الطالبين، نفحة اليمن، نفحة العرب، نفحة الأدب، مقامات حريري ইত্যাদির নাম উল্লেখ করলাম। মাওলানা তখন বললেন, ‘আরবি সাহিত্যের একটি কিতাবই কেবল আপনি পড়েছেন নাফহাতুল ইয়ামান।’ মাওলানার কথা ঠিক ছিল। কেননা نفحة اليمن-এর আরবি খুবই উঁচু মানের এবং উপস্থাপনা পদ্ধতিও সাহিত্যপূর্ণ। কিন্তু এই কিতাবটি সিলেবাসে বহাল রাখার পক্ষপাতী আমি নই। কেননা এ কিতাবটির নৈতিক মান খুবই নীচু। একদিকে এতে ভরে দেওয়া হয়েছে উঠতি বয়সের তরুণ ছাত্রদের ভেতরে যৌনানুভূতি উসকে দেওয়ার মতো বিভিন্ন কাহিনি, অপরদিকে খলীফা হারুনুর রশিদের মতো ন্যায়পরায়ণ মুসলিম বাদশার চরিত্র হননের ভিত্তিহীন গল্পগুজব।

সর্বোপরি এক ইংরেজকে খোশামোদ করে তা রচিত হয়েছিল, যা লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন। কোন মহৎ উদ্দেশ্য তাড়িত হয়ে তিনি এই কিতাব লিখেননি। দীনী মাদরাসাগুলির কর্তৃপক্ষগণ আজও পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারছেন না যে, কোন স্কুল-কলেজেও এই ধরনের অশ্লীলতাপূর্ণ বই সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত নেই। দারুল উলুম দেওবন্দের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত নেই। দারুল উলুম দেওবন্দের সিলেবাস থেকে তা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর শূন্যস্থান পূরণের লক্ষ্যে শায়খুল আদব হযরত মাওলানা ইজাজ আলী (রহ.) نفحة العرب লিখেছেন এবং দারুল উলুমের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। মাওলানা ওয়াহিদুজ্জমান কিরানুভী (রহ.) (আল-কামুসুল জাদীদ প্রণেতা) লিখেছেন, تحفة الأدب এবং পাশাপাশি লেখক নিজেও مع الطفل المسلم المعاصر সিরিজের চতুর্থ কিতাব القراءة للراشدين লিখেছেন। যা দারুল মাআরিফ ছাড়াও আরও অনেক মাদরাসায় সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। অনেক আরব সাহিত্যিক এই কিতাবকে পছন্দ করেছেন এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠানের জন্য তা মনোনীতও করেছেন। এসব কিতাব কি نفحة اليمن-এর স্থান পূরণ করতে পারে না? ড. আবদুল্লাহ আব্বাস নদভী আরও বললেন যে, ‘আপনি ভুলে যান যে আপনি কোন মাদরাসার শায়খুল আদব। একজন গবেষকের ন্যায় পড়াশোনায় মনোনিবেশ করুন।

ইনশা এবং তরজমার ব্যাপারে সেখানে বেশ গুরুত্ব পরিলক্ষিত হলো। দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় ইনশার (রচনা শিক্ষা) পাঠদান প্রত্যেক শিক্ষককেই নিজেদের ইনশার পাঠদান সংখ্যা যেমন- ১০০-১৫০ আবশ্যকীয়ভাবে পূরণ করতে হয়। প্রিন্সিপালের দফতর থেকে খোঁজ নেওয়া হয়। যে বছরান্তে ইনশার নির্ধারিত পরিমাণ শেষ করা হয়েছে কি না। গুণে গুণে তা যাচাই করা হয়। ঘটনাক্রমে পূর্ববর্তী শিক্ষকের অনেক সবকই বাকি রয়ে গিয়েছিল, পরবর্তী যা আমাকে পূরণ করতে হলো।

যাক, আমি যখন দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার ছাত্রদের সামনে ক্লাসে গিয়ে বসলাম তখন শিক্ষকের প্রভাব ছাত্রদের ওপর পড়ার পরিবর্তে আমার ওপরই এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়লো। নদওয়ার ছাত্রদের প্রভাব আমার মন-মানসে ছেয়ে গেলো। যা আমি আড়াল করার চেষ্টা করছিলাম। ছাত্রদের মধ্যে কিছু ছিল বিহারের আর অন্যরা ছিল লক্ষ্ণৌর স্থানীয় প্রভৃতি অঞ্চলের অধিবাসী, লক্ষ্ণৌর ছাত্রদের উর্দু-আরবি লেখা সংশোধন করা সহজ কাজ ছিল না। তবে উর্দু ও আরবি ভাষার সাথে যে স্বাভাবিক সম্পর্ক আমার ছিল এবং অনেক বছর ধরে জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় ছাত্রদের লেখালেখি সংশোধন করার যে অভিজ্ঞতা আমার সঞ্চিত ছিল, তার ওপর ভর করেই কোনোভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। আল্লাহর বড় মেহেরবানিই ছিল। নইলে এক বাঙালি শিক্ষকের পক্ষে নদওয়াতুল উলামার মতো ইলম ও আদবের কেন্দ্রভূমিতে গিয়ে পাঠদান কোন মামুলি কাজ ছিল না। আল-হামদু লিল্লাহ! ছাত্ররা আমাকে সম্মানের চোখে দেখতে লাগলো এবং ক্লাসের বাইরেও উপকৃত হওয়ার জন্য মেহমানখানা সোলাইমানিয়ায় আমার অবস্থানস্থলে এসে ভিড় করতে লাগলো।

দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় ফারসি একেবারেই নেই। এজন্য উর্দু কিতাবের ভেতরে যখন কোন অবোধগম্য ফারসি বাক্য বা কবিতাংশ এসে যেতো তখন ছাত্ররা তার পাঠোদ্ধার করতে হিমশিম খেতো। কোন কোন ছাত্র ফারসি কবিতা বোঝার জন্য আমার কাছে চলে আসতো। আসলে ফারসিকে এভাবে একেবারে উঠিয়ে দেওয়াও ঠিক না। ফারসিতে অনেক উদ্ধৃতি গ্রন্থ এমনও রয়েছে—যা এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। তাছাড়া উর্দু-ফারসি, সংস্কৃত, আরবি ইত্যাদি ভাষার সংমিশ্রিত একটি ভাষা। তাই ফারসিতে যার মধ্যে দক্ষতা থাকবে উর্দুতে তার ততো পূর্ণতা আসবে।

পাকিস্তান আমলে যখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের পূর্বাংশ ছিল, কাভিশ ওমর নামে একজন বিহারি কবি ছিলেন। গুলিস্তাঁবুস্তাঁর অনেক কবিতাই তার কণ্ঠস্থ ছিল। এজন্যই তাঁর উর্দু কবিতা ও গজল বেশ উঁচুমানের হতো। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের এক সফরে আমি যখন সেখানকার কবিদেরকে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম তারা জানালেন যে, তাকে দেখিনি, তবে শুনেছি কাভিশ ওমর নামের এক কবি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।

যাই হোক ইনশার ঘণ্টায় প্রথম দিন গিয়েছিল পরস্পর পরিচয় পর্বে এবং আলাপচারিতায়। এক তালিবে ইলম জিজ্ঞাসা করল যে ‘মাওলানা! শুনেছি যে আপনি একজন কবিও?’ প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল যেন আমি তাদেরকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাই। পরদিন উর্দুতে একটি কবিতা লিখে আমি তাদেরকে শোনালাম। তার কয়েকটি পঙ্‌ক্তি হলো এই:

لہوں پہ کوئی حرف حسرت نہیں ہے

کہ یاروں کی بولی پہ قدرت نہیں ہے

یہ چہرے اجالے ہیں، مانوس کیوں ہیں

جو پہلے سے باہم اخوت نہیں ہے

یہ ندوہ، یہ دار العلوم اور یہ لکھنو

ہے اپنا چمن، دار غربت نہیں ہے

نگاہوں میں ایسی بصیرت نہیں ہے

یہاں کی فضا کا ہُو ادراک کامل

کیا مجھ کو گمنام ذوق سخن نے

مرے نام کی ایسی شہرت نہیں ہے

‘মুখে নেই বেদনার কোন উচ্চারণ, এ কারণে যে, বন্ধুদের ভাষা ভিন্ন।

এ মুখাবয়ব কেন আলোকোদ্ভাসিত, সুপরিচিত? অথচ ছিল না আগে থেকে পরস্পর ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক? এ হলো নদওয়া আর এ হলো দারুল উলুম এবং এ হলো লক্ষ্ণৌ। সবই আমার (চোখ জুড়ানো) বাগান। মোটেই নয় কোন পরদেশ। এখানকার সৌন্দর্যের পূর্ণ অবলোকন করি—সে দৃষ্টি আমার কোথায়! আমার নামকে অপরিচিত করে দিয়েছে কাব্যের রুচি (যওক), আমার নামের এমন কোন খ্যাতি নেই।

ছাত্ররা আমার সাথে সহজ হয়ে উঠলো। আমিও তাদের সাথে সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম। লক্ষ্ণৌ এবং নদওয়ার পরিবেশও আমার কাছে আপন হয়ে উঠলো। আমি ড. আবদুল্লাহ আব্বাস নদভীর নসীহতে খুবই প্রভাবিত হলাম। ভুলে গেলাম—আমি জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মুহাদ্দিস, অথবা আদীব (সাহিত্যিক) অথবা আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান। ফাইনাল পরীক্ষার এক উদ্যমী ছাত্রের ন্যায় অথবা এক গবেষকের মতো লেখা-পড়ায় ডুবে গেলাম। প্রতিদিনের রুটিন ছিল ইনশার ঘণ্টার জন্য ক্লাসরুমে যাওয়া, মাওলানা সাঈদ আজমী (হাফি.)-সহ অন্যান্যদের আরবি সাহিত্য ও ইসলামি চিন্তা-দর্শনের ক্লাসে হাজির হওয়া, লাইব্রেরিতে বসে পাঠাভ্যাস চালিয়ে যাওয়া এবং রাতের বেলা ড. আবদুল্লাহ আব্বাস নদভীর শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়ক বক্তৃতামালায় অংশ নেওয়া। পাশাপাশি হোস্টেলে বসে বিভিন্ন প্রবন্ধ তৈরি করা এবং ছাত্রদের খাতা দেখা—সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটতে লাগলো আমার। একদিন ভটকল এলাকার এক তালিবে ইলম বলল,

مولانا! اللہ آپکو نظر بد سے بچائے، میں نے کہا: کیوں؟ اس نے جواب دیا: آپ کے ہاتھ میں یا کتاب ہوتی ہے یا قلم ہوتا ہے۔

‘মাওলানা! আপনার ওপর যেন কারো নজর লেগে না যায়।’ বললাম, ‘কেন?’ বললেন, ‘যখনই তাকাই- আপনার হাতে হয়ত দেখি কলম নয়ত কিতাব। কখনোই আপনাকে অবসর দেখি না।’

খাওয়া-দাওয়া আমার কামরায় পৌঁছে দেওয়া হতো। কখনো কখনো মেহমানদের সাথে, আবার কখনো কখনো হযরত মাওলানা তাঁর দস্তরখানে ডেকে পাঠাতেন। জুমার দিন সন্ধ্যায় মাওলানা সাঈদ আজমী (হাফি.)-এর দাওয়াত নিয়মিতই চলছিল। এক জুমায় আমি নিয়ম ভঙ্গ করে ছাত্রদের দাওয়াত কবুল করে ফেললাম এবং মাওলানাকে তা জানানোর প্রয়োজন অনুভব করলাম না। এ ছিল আমার ভুল। কেননা মাওলানা খুবই মেজাজি মানুষ ও ভীষণ সময়ানুবর্তী। সকালে অফিসে যাওয়া এবং ক্লাসরুমের উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। আবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইমামতির জন্য ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় এসে হাজির হয়ে যেতেন মসজিদের মিহরাবে। এক মিনিটও এদিক সেদিক হতো না।

প্রকাশ আছে ছাত্ররা মাওলানার উপস্থিতি দেখে নিজেদের ঘড়ি ঠিক করে নেয়। মাওলানা নিজেই জুমা পড়ান। তাঁর উপস্থিত খুতবা অনেক দীর্ঘ। বিষয় ভিত্তিক খুতবাদানে তাঁর পারঙ্গমতা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। পরের দিন মাওলানা আমার ভুলের ওপর অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। দেখা হতেই বললেন, মাওলানা! ‘গতকাল আমি আপনার অপেক্ষায় বসেছিলাম। আপনি কোথায় চলে গিয়েছিলেন।’…

এ সফরে ছাত্রদের মধ্যকার বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে ও সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকার বেশ সুযোগ ঘটেছিল। সেমিনারের পরে এ সফরে ছাত্রদের মধ্যকার বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে ও ছাত্ররা মেহমানখানার পাশে সোলায়মানিয়া হলের পার্কে আরব মেহমানদের সম্মানে এক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করল। এক তালিবে ইলম আল্লামা ইকবালের উর্দু সংগীত:

جب عشق سکھاتا ہے آداب خود آ گاہی الخ۔

অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করল। তখন আরব মেহমানদের পক্ষ থেকে তার অনুবাদ পেশ করার দাবি উঠলো। পাকিস্তান থেকে আগত সম্মানিত মেহমান আল্লামা নদভী (রহ.)-এর সহপাঠী মরহুম মাওলানা মুহাম্মদ নাজেম নদভী তাৎক্ষণিকভাবে তার তরজমা পেশ করলেন এবং বললেন, ‘এক ভাষার অলংকার আরেক ভাষায় বিবৃত করা যায় না। কোন প্রকারে শুধু ভাবার্থটা পেশ করা হলো। আরব মেহমানরা তখন অনেক প্রীত হলেন।’

এই সফরে হযরত মাওলানা নদভী (রহ.)-এর পৈতৃক ভিটা দেখারও সুযোগ হয়। রায়বেরেলির দায়েরায়ে শাহ আলামুল্লায় (তাকিয়া কালা) উপস্থিত হলাম। এখানে সাঈ নদীর কোল ঘেঁষেই অবস্থিত দীপ্তিময় ঐতিহাসিক মসজিদ এবং মাকবারা। যেখানে ঘুমিয়ে আছেন বড় বড় খ্যাতিমান বুজুর্গ ও মনীষীগণ। মসজিদের সামনেই রয়েছে এই আলোকিত ভূখণ্ড। যাতে সমাধিস্থ আছেন হযরত মাওলানা শাহ আলামুল্লাহ, হযরত শাহ জিয়াউন্নবী (রহ.) (হযরত মাওলানার পূর্বপুরুষ) হযরতের পিতা প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল্লামা সাইয়েদ আবদুল হাই হাসানী বেরেলভী, হযরত মাওলানার বড় ভাই হাকীম সাইয়েদ আবদুল আলী হাসানী এবং البعث الإسلامي-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ হাসানী (রহ.)।

এখন তো এই আলোকিত ভূ-খণ্ডের বেষ্টনীতে নদওয়ার প্রাণপুরুষ, বিগত শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-কেও সামহিত করা হয়েছে। আমি যখন রায়বেরেলি আসি তখন হযরত মাওলানা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মাওলানা অত্যন্ত স্নেহভরা কণ্ঠে, দরদভরা গলায় আমাকে বললেন, ‘মৌলবী সাহেব! এ জায়গা সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রহ.)-এর জন্মস্থান।’ হযরত সাইয়েদ সাহেব এই নদী পাড়ি দিয়ে কাফেলা সমভিব্যাহারে রওয়ানা হয়েছিলেন এবং বালাকোটের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। গরমকাল ছিল। আমি এখানে দুয়েক দিন হযরত মাওলানার সান্নিধ্যে কাটালাম। দ্বিপ্রহরের দিকে নদওয়ার প্রাক্তন কৃতি ছাত্র প্রিয় বন্ধু মাওলানা সদরুল হাসান নদভীর নুরানি পরিবেশের জান্নাতী আবহাওয়া থেকে আত্ম প্রশান্তির শ্বাস নিতাম। সঙ্গে আরও কয়েকজন মিলে সাঈ নদীতে গোসল করতাম। …

নদভী হওয়ার বিরল সম্মান

আমার ফিরে আসার কিছুদিন পূর্বে উক্ত মজলিসে হযরত মাওলানা রাবে হাসানী, হযরত মাওলানা সাঈদ আজমী ও হযরত মাওলানা ওয়াজেহ রশিদ নদভী (হাফি.) বসা ছিলেন। আমাকে লক্ষ্য করে মাওলানা রাবে’ হাসানী (হাফি.) বললেন, ‘মাওলানা যওক সাহেব! বলুন তো, আপনার উর্দু এতো চমৎকার ও বিশুদ্ধ কী করে হলো? বাঙালিরা যদিও বা উর্দু বলেন, কিন্তু উচ্চারণ ও ভঙ্গিতে পার্থক্য থেকেই যায়। কিন্তু আপনার উর্দু হিন্দুস্তানের কোন না কোন এলাকার উর্দুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি নিরুত্তর বসে রইলাম। কেননা আমার কাছে এর কোন জবাব ছিল না। মাওলানা সাঈদ আজমী সাহেব বললেন, যওক সাহেব! আপনি ‘নদভী’ লেখা শুরু করে দিন। মাওলানা রাবে হাসানী সাহেব তখন বললেন, হ্যাঁ… আপনি এই সফরে নদওয়া থেকে প্রচুর উপকৃত হয়েছেন। আপনি ‘নদভী’ লেখেন, এটি আমাদের জন্য গৌরবের বিষয় হবে। ফিরে আসার পর হযরত মাওলানা সাঈদ আজমী সাহেব এক চিঠিতে আমার নামের সাথে নিজেই নদভী লিখলেন। তারপরও জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার এক সন্তান হওয়ার আত্মমর্যাদাবোধ আমাকে সীমাহীন বাধা দিচ্ছিলো। জামেয়া পটিয়ায় থেকে আমি যতটুকুই উর্দু-আরবি সাহিত্যচর্চা করে যাচ্ছিলাম, এই অবস্থায় আমি যদি নদভী লিখি তাহলে মানুষ মনে করবে যে, তারা একজন নদভী পেয়ে গেছেন। তিনিই এসব সাহিত্য কর্ম আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

হযরত মাওলানাও এক সফরে আমাকে বললেন, ‘আমরা আপনাকে সম্মানসূচক নদভী করে দিলাম। আপনি নদভী লিখবেন। কেউ সনদ জিজ্ঞাসা করলে আমার নাম বলে দেবেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করতে বলবেন।’

একদিন এই সফরেই লেখা আমাদের মুখপত্র الصبح الجديد পত্রিকার সম্পাদকীয় رحلة علمية لا أنساها (একটি ইসলামি সফর, যার কথা ভুলতে পারবো না) হযরত মাওলানা ওয়াজেহ রশিদ নদভীকে দিলাম একটু দেখে ঠিকঠাক করে দেওয়ার জন্য। মাওলানা সন্ধ্যায় তা ব্যাগে করে বাসায় নিয়ে গেলেন এবং পরদিনই তা আমাকে হুবহু ফিরিয়ে দিলেন। আরজ করলাম: মাওলানা! আপনি তো কিছুই করলেন না! যেমন দিয়েছিলাম তেমনি রয়ে গেলো। মাওলানা বললেন, আপনি তো নদভী। কিছু যদি করতেই হয় তা আপনি নিজেই করে নেবেন।…

সফর বেশি লম্বা ছিল না! দুই মাস সময় দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু এর প্রভাব ছিল অনেক বেশি গভীর। হযরত মাওলানা (রহ.)-এর ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়:

هذا الزمان ما كان فيه طول، وكان له عرض، وعرضه أكثر من طوله، وكان له عمق عميق.

‘এই যুগ… এই সময় তার নেই কোন দৈর্ঘ্য। আছে শুধু প্রস্থ। এর প্রস্থ দৈর্ঘ্যের চেয়েও দীর্ঘ। তার গভীরতা অনেক বেশি।’ সুতরাং এ সফর শুধু এক সাহিত্য সেমিনারের দাওয়াতে নিছক সাড়া দেওয়া ছিল না; বরং এ ছিল সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারকারী এক শিক্ষা সফর।

আমার খেদমতের নিসবত যেন জামিয়া পটিয়ার দিকে হয়!

দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার পক্ষ থেকে আমাকে সম্মানসূচক নদভী উপাধি দেওয়া হয়। এমনকি আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) নিজেই আমাকে এই উপাধি লিখতে বললেন। তা সত্ত্বেও আমি নদভী লিখিনি। কেন লিখিনি? কারণ আমি যদি কুরআন-হাদীসের আরবি বিষয়ক কোন খেদমত করি, তাহলে মানুষ বলবে, এটি নদভী তথা নদওয়ার ফারেগ একজন আলেমের কাজ। তখন আমার কাজটি আর জামিয়া পটিয়ার দিকে নিসবত করা হবে না। কিন্তু আমি চাই মানুষ বলুক, এটি জামিয়া পটিয়ার একজন ফাযেলের কাজ। তাতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। নিঃসন্দেহে এটিই আমার জন্য গর্বের বিষয়। আমি চাই, আমার খেদমতের নিসবত যেন জামিয়া পটিয়ার দিকে হয়!

জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতার আজব তরবিয়ত!

এই জামিয়ার অবদান আমি কখনো ভুলতে পারি না। জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কুতবে যামান আল্লামা মুফতী আযীযুল হক (রহ.)-এর স্নেহ, মমতা ও আজব তরবিয়তের মাধ্যমে আমি বড় হয়েছি। তিনি আমাকে অত্যধিক ভালোবাসতেন। আমি একবার মুফতি সাহেব (রহ.)-কে না বলে জামিয়া পটিয়া থেকে চলে গিয়ে খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর মাদরাসাসায় ভর্তি হয়েছিলাম। আমার আব্বা আমার মেজো ভাইকে পাঠিয়ে আমাকে পটিয়ায় নিয়ে আসেন। আমি খুব ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলাম। লজ্জা ও ভয়ে মুফতি সাহেব (রহ.)-এর সাথে দেখা করতে পারছি না। তখন মুফতি সাহেব (রহ.) আমাকে কাছে ডাকলেন। আর মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বললেন, তুমি চলে গিয়েছিলে কেন? আমি তো তোমাকে মহব্বত করি। তখন আমি বললাম, হযরত! ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিন। আর হবে না। তখন মুফতি সাহেব (রহ.) বলেন, তাহলে তোমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। তখন তিনি বলেন, তাহলে তুমি তোমার মুখ দ্বারা আমার জুতাগুলো উঠাও। আমি কোন ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই হযরতের জুতাগুলো মুখে তুলে নিয়েছিলাম। আমি মনে করি, হযরতের এই জুতার বরকতেই এ পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি। আজ এটি আমার জন্য বড় গর্বের বিষয়!

খামোশ বুজুর্গ আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)

মরহুম আবদুল হালীম বোখারী সাহেব (রহ.) ও মাওলানা আইয়ুব সাহেব (রহ.)-এর ছাত্র জীবন আমার এখনো স্মরণ আছে। আমি যখন এই জামিয়ার শিক্ষক, তখন তারা এখানকার ছাত্র। জামিয়ার বিভিন্ন বির্তক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান এবং সাহিত্য চর্চা অনুষ্ঠানে দুইজনই অত্যধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত হতেন। তখন থেকেই তারা জামিয়ার উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। জামিয়ার মুহতামিমের দায়িত্ব গ্রহণের পর আল্লামা বোখারী সাহেব (রহ.) যেভাবে জামিয়ার পরিচালনাসহ অন্যান্য সবকিছু যে চমৎকারভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন, তা সবার জানা। তিনি একজন মুহাক্কিক আলেম, দক্ষ মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি একাধারে আরবি-উর্দু, ফারসি-ইংরেজি ভাষার পণ্ডিত ছিলেন। তিনি খামুশ বুজুর্গ ছিলেন। তিনি সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। তাঁর জীবনী আলোচনার জন্য একটি সুদীর্ঘ আলোচনা সভার প্রয়োজন রয়েছে।

জামিয়া পটিয়া মুহতামিমের পদটি সম্মানযোগ্য!

আমি আল্লামা মুফতী আবদুল হালীম বুখারী (রহ.)-কে সম্মান করতাম। তাকে আমি ‘মুহতারম’ বলে সম্বোধন করতাম। কারণ তিনি জামিয়া পটিয়ার যে মসনদে বসেছেন, সেটি ‘কাবেলে ইহতেরাম’ সম্মানযোগ্য একটি পদ। সুতরাং একে যথাযোগ্য সম্মান করা সকলের জন্য জরুরি। আমি একবার চট্টগ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমি আমার গাড়িতে ছিলাম আর আল্লামা বোখারী (রহ.) তাঁর গাড়িতে ছিলেন। হঠাৎ আল্লামা বুখারী (রহ.)-এর গাড়ি পিছনে পড়ে গেল। তখন আমি আমার ড্রাইভারকে বললাম, থামো! আল্লামা বোখারী (রহ.)-এর গাড়িকে সামনে যেতে দাও। তাঁর গাড়ির সামনে আমার গাড়ি চললে তা জামিয়া পটিয়ার অসম্মান হবে। সুবহানাল্লাহ!

তখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, হযরত! তিনি তো মনে হয় আপনার শাগরিদ? তাহলে তাঁর গাড়ি পেছনে থাকলে অসুবিধা কোথায়? তখন আমি বললাম, তিনি এখন যে মসনদে আছেন, তা ‘কাবেলে এহতেরাম’ তথা সম্মানযোগ্য। সুতরাং আমার গাড়ি আল্লামা বোখারী (রহ.)-এর গাড়ির আগে যেতে পারে না। তখন আল্লামা বোখারী (রহ.)-এর গাড়ি আমার গাড়ির পাশে এসে থামল। তিনিও আমার সামনে চলতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরবর্তীতে আমার পীড়াপীড়ির কারণে বাধ্য হয়ে যান। আহ! তিনি আজ আল্লাহর প্রিয় হয়ে গেলেন। আমরা দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাঁর খেদমাত কবুল করেন এবং জান্নাতুল ফিরদাউস দান করেন, আমীন।

আল্লামা ওবায়দুল্লাহ হামযাহর ওপর কেন জামিয়ার দায়িত্ব অর্পণ করা হলো?

বর্তমানে জামিয়ার মুহতামিম হলেন আল্লামা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ (হাফি.)। গত শুরা অধিবেশনে আমি সদর ছিলাম। পরামর্শের ভিত্তিতে আমি তাঁকে মুহতামিমের যিম্মাদারি সোপর্দ করেছি। এখন কেউ কেউ আমার কাছে গিয়ে জানতে চায় যে, আমি কেন তাঁকে মুহতামিম নিযুক্ত করেছি। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, হুযুর! আপনি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহকে কেন জামিয়া পটিয়া পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন? আমি জবাবে তাদেরকে বলেছি, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ আমার সরাসরি ছাত্রও না, আবার তিনি আমার কোন আত্মীয়-স্বজনও নন। তা সত্ত্বেও আমি তাকে জামিয়া পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার কারণ হলো, আমি তাঁকে মুহতামিম করার মধ্যেই জামিয়ার জন্য মঙ্গল দেখেছি। আমি জামিয়ার জন্য যা মঙ্গল মনে করি তা করতে কখনো কার্পণ্য করিনি। আগামীতেও জামিয়ার জন্য যা যা কল্যাণকর, তাতে আমার সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে, ইনশাআল্লাহ। অতএব আমি সকলের নিকট অনুরোধ করবো, জামিয়ার সদরে মুহতামিম মাওলানা আমিনুল হক (হাফি.) জামিয়ার মুহতামিম মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ (হাফি.) এবং নায়েবে মুহতামিম মাওলানা আবু তাহের নদভী (হাফি.)-সহ যারা দায়িত্বে আছেন, তাঁদেরকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবেন। দোয়া করি, আল্লাহ যেন, জামিয়াকে উত্তরোত্তর উন্নতি দান করেন, সকল ষড়যন্ত্র থেকে জামিয়াকে হেফাজত করেন এবং জামিয়াকে উন্নতির শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে দেন, আমীন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ