কুরআন করীম অন্তরের অবস্থা শোধরানোর একমাত্র উৎস
হযরত মাওলানা খলীলুর রহমান সাজ্জাদ নু’মানী
অনুবাদ: মাওলানা আবদুল আযীয
আল-হামদু লিল্লাহ! হামদ ও সালাতের পর, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَرَدَّ اللّٰهُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِغَيْظِهِمْ لَمْ يَنَالُوْا خَيْرًا١ؕ وَكَفَى اللّٰهُ الْمُؤْمِنِيْنَ الْقِتَالَ١ؕ وَكَانَ اللّٰهُ قَوِيًّا عَزِيْزًاۚ۰۰۲۵ وَاَنْزَلَ الَّذِيْنَ ظَاهَرُوْهُمْ مِّنْ اَهْلِ الْكِتٰبِ مِنْ صَيَاصِيْهِمْ وَقَذَفَ فِيْ قُلُوْبِهِمُ الرُّعْبَ فَرِيْقًا تَقْتُلُوْنَ وَتَاْسِرُوْنَ فَرِيْقًاۚ۰۰۲۶ وَاَوْرَثَكُمْ اَرْضَهُمْ وَدِيَارَهُمْ وَاَمْوَالَهُمْ وَاَرْضًا لَّمْ تَطَـُٔوْهَا١ؕ وَكَانَ اللّٰهُ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرًاؒ۰۰۲۷
وقال تعالىٰ: قَالَ الَّذِيْنَ يَظُنُّوْنَ اَنَّهُمْ مُّلٰقُوا اللّٰهِ١ۙ كَمْ مِّنْ فِئَةٍ قَلِيْلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيْرَةًۢ بِاِذْنِ اللّٰهِ١ؕ وَاللّٰهُ مَعَ الصّٰبِرِيْنَ۰۰۲۴۹
وقال تعالىٰ: فَلَمْ تَقْتُلُوْهُمْ وَلٰكِنَّ اللّٰهَ قَتَلَهُمْ١۪ وَمَا رَمَيْتَ اِذْ رَمَيْتَ وَ لٰكِنَّ اللّٰهَ رَمٰى١ۚ وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِيْنَ مِنْهُ بَلَآءً حَسَنًا١ؕ اِنَّ اللّٰهَ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ۰۰۱۷ ذٰلِكُمْ وَاَنَّ اللّٰهَ مُوْهِنُ كَيْدِ الْكٰفِرِيْنَ۰۰۱۸ اِنْ تَسْتَفْتِحُوْا فَقَدْ جَآءَكُمُ الْفَتْحُ١ۚ وَاِنْ تَنْتَهُوْا فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ١ۚ وَاِنْ تَعُوْدُوْا نَعُدْ١ۚ وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْـًٔا وَّلَوْ كَثُرَتْ١ۙ وَاَنَّ اللّٰهَ مَعَ الْمُؤْمِنِيْنَؒ۰۰۱۹
‘আল্লাহ তাআলা কাফেরদেরকে তাদেরকে ক্রোধসহ ফিরিয়ে দিয়েছেন। তারা কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারেনি। মুমিনদের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আর আল্লাহ মহাশক্তিশালী এবং মহাপরাক্রমশালী। কিতাবীদের মধ্যে যারা তাদেরকে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দূর্গ থেকে অবতরণ করালেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন; তোমরা তাদের কিছু সংখ্যককে হত্যা করেছ এবং কিছু সংখ্যককে করেছ বন্দি। আর তিনি তোমাদেরকে তাদের ভূমি, ঘরবাড়ি, ধন-সম্পদ এবং এমন ভূমির অধিকারী করলেন, যেখানে তোমরা এখনও পদার্পণ করনি। আর আল্লাহ সবকিছুর ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।’[1]
‘যারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে তারা বলল, কত ছোট্ট সৈন্যদল আল্লাহর হুকুমে কত বিশাল দলের ওপর বিজয়ী হয়েছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই রয়েছেন।’[2]
‘তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি; বরং আল্লাহই তাদেরকে ধ্বংস করেছেন। যখন তোমরা তীর নিক্ষেপ করেছ তখন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই নিক্ষেপ করেছেন। এ বিষয়টি মূলত মুমিনদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তমভাবে পরীক্ষার জন্য; নিশ্চই আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ। মনে রেখ, নিশ্চই আল্লাহ কাফেরদের ষড়যন্ত্র দুর্বল করেন। যদি তোমরা মীমাংসা চেয়ে থাক, তাহলে তা তোমাদের কাছে এসে গেছে। আর যদি তোমরা বিরত হও, তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু যদি তোমরা আবার যুদ্ধ করতে আস, তবে আমরাও আবার শাস্তি নিয়ে আসব। আর তোমাদের দল সংখ্যায় বেশি হলেও কোনো কাজে আসবে না। আর নিশ্চই আল্লাহ মুমিনদের সাথে আছেন।’[3]
কুরআন করীম অন্তরের অবস্থা শোধরানোর একমাত্র উৎস
আল্লাহ তাআলার সেসব বান্দা-বান্দিরা কতইনা সৌভাগ্যবান, যাদের কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক এতটাই গভীর যে, তাদের ব্যক্তিজীবনে যেকোনো ধরনের ঘটনাই ঘটুক না কেন, অথবা তাদের পরিবারের কারও যেকোনো ঘটনাই ঘটুক না কেন; বা আরেকটু বড় পরিসরে কোনো জাতীয় ঘটনা ঘটলেও তাদের মন সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার উপযোগী কোনো আয়াতের দিকে ছুটে যায়। এমন লোকেরা সত্যিই বড় সৌভাগ্যবান। কুরআন হয়ে যায় এদের হৃদয়ের বসন্ত। এমন লোকেরা প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি উপলক্ষ্যে এ অবস্থা ও ‘কাইফিয়ত’ অর্জন করতে পারে। অন্যভাবে বললে, প্রতিটি মুহূর্তের জন্য উপযুক্ত কাইফিয়াত তাদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্জিত হয়ে যায়। একথার গুরুত্ব যদি আমরা বুঝতে পারতাম যে, বিভিন্ন অবস্থা যেমন সুস্থতা-অসুস্থতা, হাসি-কান্না, সুখ-দুখ, জয়-পরাজয় এবং উত্থান-পতন যাই হোক না কেন, এসব অবস্থা সফলভাবে মোকাবেলা করার জন্য সবচে’ প্রয়োজনীয় যে বস্তু তা হল, যে ব্যক্তি বা পরিবার বা জাতির ওপর দিয়ে বিভিন্ন অবস্থা আসবে তাদের হৃদয়ের এমন ‘কাইফিয়ত’ হবে, যার মাধ্যমে তারা এ অবস্থার মোকাবেলা সফলভাবে করা সহজ হয়। মূলত অন্তরের অবস্থার প্রেক্ষিতেই মানুষ বিজয়ী হয় কিংবা পরাজিত। যদি মানুষের অবস্থা অর্থনৈতিক ও শারিরিকভাবে ভালো হয়; কিন্তু তার মনের অবস্থা ভালো না হয় তাহলে এ আর্থিক এবং শারিরিক স্বাচ্ছন্দ্য তার ব্যর্থতার কারণ ডেকে নিয়ে আসে। পক্ষান্তরে যদি কোনো মানুষ দারিদ্র্য, অভাব, অসুস্থতাসহ বিভিন্নরকম কষ্টে নিপতিত থাকা সত্ত্বেও তার মনের অবস্থা ভালো হয় তবে সে এ কঠিন পরিস্থিতি অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবেলা করতে এমনকি আরও উন্নতি করে উৎরে যেতে সক্ষম হয়। মানুষের উন্নয়ন বাহ্যিক স্বচ্ছলতার কারণে হয় না, আবার ব্যর্থতাও বাহ্যিক পরাজয়ের কারণে হয় না। মানুষের সাফল্য-ব্যর্থতা সবই মূলত অন্তরের অবস্থার প্ররিপ্রেক্ষিতে হয়। এ বাস্তবতা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন সত্য; একটি জাতির বেলায়ও তাই। একটি জাতিরও রয়েছে হাসি-কান্না আর সুখ-দুখের নানা মুহূর্ত। প্রতিটি মুহূর্ত সফলভাবে মোকাবেলা করার জন্য অবস্থার উপযোগী মানসিক অবস্থার প্রয়োজন।
প্রয়োজনীয় মুহূর্তে কাঙ্ক্ষিত মানসিক প্রশানিg্ লাভ করার একমাত্র উৎস আল-কুরআন। কুরআনের আলো, কুরআনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। রসুলুল্লাহ (সা.) নিরর্থক এ দোয়া করতেন না; হে আল্লাহ কুরআনকে বানিয়ে দিন আমার হৃদয়ের বসন্ত, আমার দুশ্চিন্তার উপশম এবং কষ্টের নিরসন। এ দোয়ার আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে, মানসিক অবস্থা ঠিক করার একমাত্র মাধ্যম কুরআন করীম। কোনো রকম অহংকার ছাড়াই শোকরের জযবা আর কল্যাণ কামনার প্রেরণা নিয়ে বলছি, কখনও কখনও আমার খুব বেশি অনুভব হয় যারা কুরআন করীম বুঝে না, যাদের কুরআনের সঙ্গে যথাযোগ্য সম্পর্ক নেই তারা কীভাবে জীবনযাপন করে?! আল্লাহ তাআলা আমার মুরব্বিদেরকে এবং আমার পিতামাতাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন, যাদের দোয়ার বরকতে অধমের কুরআনে করীমের সঙ্গে এতটুকু সম্পর্ক হয়ে গেছে আল-হামদু লিল্লাহ যে, যখনই কোনো অবস্থা সামনে আসে সঙ্গে সঙ্গে আমার মন কুরআনের দিকে ছুটে যায়।
ইমারতে ইসলামিয়ার বিজয় এবং কুরআনের কিছু আয়াত
এ মুহূর্তে আমি আপনাদের সম্মুখে কিছু আয়াত পাঠ করেছি। এছাড়া আরও বহু আয়াত সাম্প্রতিক সময়ে আমার মাথায় সবসময় ঘুরছে। আমি সারাক্ষণ এসব আয়াত নিয়েই ভাবছি। সেগুলোই আমার আলোচ্য বিষয় হয়ে আছে। আমার একান্ত আশা আপনাদের সবার আমার চেয়ে বহুগুণ বেশি কুরআনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়ে যাক, যাতে সারাক্ষণ আপনারা কুরআন নিয়ে ভাবতে পারেন।
এ মুহূর্তে আমি যেসব আয়াত পাঠ করেছি, সে আয়াতসমূহের সরল মর্ম আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। প্রথম আয়াত আমি পাঠ করেছি সুরা আল-আহযাব থেকে। এ আয়াতগুলোতে খন্দক যুদ্ধের আলোচনা করা হয়েছে। খন্দকের যুদ্ধেই কাফের-মুশরিকদের সম্মিলিত জোট মদীনার ওপর আক্রমণ করেছিল।
‘আল্লাহ তাআলা কাফেরদেরকে তাদেরকে ক্রোধসহ ফিরিয়ে দিয়েছেন। তারা কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারেনি। মুমিনদের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আর আল্লাহ মহাশক্তিশালী এবং মহাপরাক্রমশালী। কিতাবীদের মধ্যে যারা তাদেরকে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দূর্গ থেকে অবতরণ করালেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন।’
আমরা দূর থেকেই প্রত্যক্ষ করেছি সোশ্যাল মিডিয়ার আহাজারি আর ভীতি। উর্দু ভাষায় প্রবাদ আছে, ‘মাথায় পা তুলে পলায়ন করা।’ ইমারতে ইসলামিয়ার বিজয়ের পর তথাকথিত সংবাদমাধ্যম আর মিডিয়ার অবস্থা বোঝানোর জন্য হয়তো এ প্রবাদও পুরোপুরি ফিট হবে না। বেচারারা লেজ তুলে পালিয়েছে যেন। অনেক চেঁচামেচি শুনতাম, পৃথিবীর সবচে’ সুপারপাওয়ার এলিট ফোর্স। অথচ তারা রাস্তায় চলাফেরা করার সময় চারপাশে আফগানী সৈন্যদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে মাঝখানে অবস্থান করে। এর এছাড়া আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরে ভীতি ঢেলে দিয়েছেন? পুরো পৃথিবীর রাজনৈতিক বিশ্লেষক, নামকরা সাংবাদিক, নিবিড় বিশ্লেষণকারীদের মাথায় হাত। কি হচ্ছে এসব! এ কি করে সম্ভব?! বাস্তবতা হল, কুরআনের নির্দেশনা আর ঈমানী বুঝ ছাড়া এসবের সমাধান করা সম্ভব নয়। কোনো বিষয়ের সমাধান কুরআন ছাড়া অন্য কোথাও সন্ধান করলে ব্যর্থ হতে বাধ্য সেটা। সামনে অগ্রসর হয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কাউকে তোমরা জাহান্নামে পাঠিয়ে দিচ্ছিলে আর কাউকে করছিলে গ্রেফতার।’ মনে হচ্ছে যেন স্বচক্ষে দেখা অবস্থার বর্ণনা। এরপর আল্লাহ বলেন, রাজত্বও তোমরা পেলে। তাদের ঘরবাড়িও তোমাদের দখলে এল। তাদের সম্পত্তিও তোমাদের হস্তগত হল। এমন ভূমিও তোমরা পাবে যেখানে এখন অব্দি তোমরা পদার্পণ করনি। সুবহানাল্লাহ! কুরআন কি কেবল অতীতের কোনো গ্রন্থ? কুরআন বর্তমানেরও কিতাব এবং ভবিষ্যতেরও কিতাব। ‘ওয়া আরদান লাম তাতাউহা।’ অপেক্ষা করুন আর বিশ্বাস রাখুন, তারকাদের ছাড়িয়ে পৃথিবীর সীমা আরও বহু বিস্তৃত।
‘আর এসব কী? এসব আল্লাহর কুদরতের বহিপ্রকাশ।’আল্লাহ তাআলা সবকিছু করতে পারেন। কোনো কিছুই তাঁর ক্ষমতার বহির্ভূত নয়।
আরেকটি আয়াত আমি পাঠ করেছি। ‘যারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে তারা বলল, কত ছোট্ট সৈন্যদল আল্লাহর হুকুমে কত বিশাল দলের ওপর বিজয়ী হয়েছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই রয়েছেন।’[4]
একটি বিশেষ মুহূর্তে যখন বনু ইসরাইল জাতি একটি যুদ্ধের সম্মুখীন ছিল, তাদের মধ্যে বহু লোক ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তখন তাদের মধ্যে মজবুত ঈমানের অধিকারী কিছু লোক তাদের সহযোদ্ধাদের সম্বোধন করে বলল, তোমরা সাহস হারিও না, ভীত হয়ো না। সম্মুখে অগ্রসর হও। মনে রেখ, ইতিহাসে বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে যে, ছোট্ট সৈন্যদল বিশাল সৈন্যদলকে পরাজিত করেছে। এটা সংখ্যাধিক্য আর সাজসরঞ্জামের ব্যাপার-স্যাপার নয়। আসল তো হল বুকের সাহস আর অদম্য জয়ের পিপাসা। বীরত্ব, সাহস আর শৌর্য-বীর্য এমন জিনিস যা কাউকে জয়ী কিংবা পরাজিত করে। আর মনে রাখতে হবে, আল্লাহ সর্বদা সেসব লোকদেরই সাহায্য করেন, যারা ময়দানে পাহাড়ের মতো অবিচল থাকে। ভয় পায় না, ঘাবড়ে যায় না, আতঙ্কিত হয়ে পিছু হটে না।
তৃতীয় যে আয়াতটি আমি পাঠ করেছি সেটি হচ্ছে, একটি কঠিন লড়াই শেষে যখন মুমিনরা বিজয় লাভ করল তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এ শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, যেন বিজয়ের কারণে তাদের মনে কখনও এ ধারণা না জন্মে যে, ‘আমরা বিজয়ী হয়েছি’ তাদেরকে লক্ষ করে বললেন, ‘শত্রুদেরকে তোমরা হত্যা করনি; বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন।’ তোমাদের মনে যেন একথা না আসে আমরা এটা করে ফেলেছি, ওটা করে ফেলেছি। হৃদয় যেন সর্বদা আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি মনযোগী থাকে। সাহাবা তো সাহাবা, স্বয়ং রসুলুল্লাহ (সা.)-কে আল্লাহ তাআলা বলছেন, হে রসুল, আপনি যে বালুকণাগুলো বাতাসে নিক্ষেপ করেছেন আর সেগুলো সোজা টার্গেটে গিয়ে আঘাত করে যুদ্ধের কায়া পাল্টে দিয়েছে আপনি মনে করবেন না যে এটা আপনার কাজ। এটা আপনার কাজ নয়; বরং আপনার প্রতিপালকের কাজ। আর আল্লাহ চাইলে একেবারে প্রথমভাগেই সাহায্য করতে পারতেন; কিন্তু এত বিলম্ব যে হল এবং আপনি যে এত কষ্টের সম্মুখীন হলেন এর কারণ হল, আল্লাহ তাআলা ভালোভাবে মুমিনদের পরীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন। এটা ভাববেন না যে, আল্লাহ তাআলা কিছুই জানেন না। বরং আল্লাহ তাআলা সবকিছু জানেন ও বুঝেন। ‘যালিকুম ওয়া আন্নাল্লাহা মুহিনু কাইদিল কাফিরীন।’ এবার যা কিছু হল তা তো হয়েই গেল। সামনের জন্য মনে রেখ, আল্লাহ তাআলা কাফেরদের সবরকম চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেওয়ার ইচ্ছা করে ফেলেছেন। অতীতের বরাতে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। কারণ এখন শুধুমাত্র একটি যুদ্ধের একটি স্তর শেষ হল মাত্র। পরীক্ষা এখনও সমাপ্ত হয়নি। এ দুনিয়া তো পরীক্ষারই ক্ষেত্র। এজন্য আল্লাহ তাআলা ভবিষ্যতের ব্যাপারে মুমিনদের জানিয়ে দিচ্ছেন, কাফেরদের কিছু ছাড় অবশ্যই দেবেন কিন্তু তাদেরকে বিজয়ী করবেন না। কেননা আল্লাহ তাআলা তাদের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সামনের সময়ের জন্য আলেমরা নিজেদের প্রস্তুত করুন
এ আয়াতগুলো সামনে রেখে কিছু কথা বলার জন্য মন কয়েকদিন থেকে অস্থির ছিল। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের অনুমান হচ্ছে, সাম্প্রতিককালের ঘটনাগুলো কোনো সাময়িক ঘটনা নয়। এটি একটি যুগের পরিবর্তনের আভাস। পরিবর্তনের সূচনা। আগামী দিনগুলোতে পৃথিবীর পরিচালনায় বিশাল পরিবর্তন সমাগত।
কিছুদিন আগে আমি আলেম এবং তালিবে ইলমদের সামনে বলেছিলাম, যুগের পরিবর্তনের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে যে কথাটি খুব তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে তা হচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীতে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে যে, বেশ কিছু দেশের নেতৃত্ব উম্মতে মুহাম্মদিয়ার হাতে চলে আসবে। আর এ রকম মুহূর্তে বড় বড় সামরিক কমান্ডার এবং ডিফেন্সের সুদক্ষ ব্যক্তিদের চেয়েও বেশি প্রয়োজন পড়বে যুগসচেতন আলেমদের, যারা খুব গভীরভাবে শরীয়তে ইসলামিকে প্রয়োগ করার পূর্ণ তফসিল সম্পর্কে অবগত। কারণ এটা বলা তো খুব সহজ যে শরীয়াকে বাস্তবায়ন করতে হবে।
শরীয়া বাস্তবায়নের দাবিতে পাঁচ লক্ষ লোকের একটা মিছিল কিংবা সমাবেশ অনুষ্ঠিত করা খুবই সহজ। কিন্তু যখন আপনাকে প্রশ্ন করা হবে, আচ্ছা বলুন তো ব্যাংকিং সিস্টেম ইসলামি রীতি অনুযায়ী কীভাবে পরিচালনা করতে হবে? এ যুগের আমাদের মতো লাখো আলেমরা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ইন্টারন্যশনাল বিজনেসে ইন্স্যুরেন্সের নীতি কি হবে? তখন আমাদের অধিকাংশের কাছেই এর কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। কোনো ব্যক্তি যখন শ্রীলংকা থেকে দশ কোটি ডলারের কোনো পণ্য ইউরোপে পাঠায় তখন তার পুরো আশঙ্কা থাকে যে, পথিমধ্যে আমার পণ্য তুফানে পড়তে পারে, কোনো নৌদস্যুদের কবলে পড়তে পারে। ফলে একজন ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে দশ কোটি ডলারের পণ্য ইন্স্যুরেন্স ছাড়া পাঠাতে পারে না। সুতরাং এমন আলেমদের খুবই প্রয়োজন, যারা বলতে পারবেন যে, ইন্টারন্যশনাল বিজনেসে ইন্স্যুরেন্সের বৈধতার কি সূরত হতে পারে? অথবা এর বিকল্প কি হতে পারে? আপনারা যদি কেবল অজু-গোসলের মাসায়েল জানার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেন, তবে দুনিয়ার বিভিন্ন সেক্টরে শরীয়া বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আপনার মাধ্যমে কোনো কাজ হবে না। হাজারও প্রশ্ন আছে। আমি কেবল দুয়েকটি উদাহরণ পেশ করেছি মাত্র। মেডিকল সাইন্সে এমন বহু সমস্যা সামনে আসে যেগুলোর সমাধান গবেষণাসাপেক্ষ। যেমন মানুষের মৃত্যুর পর তার কিডনি বের করে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করা। এটিকে বলা হয় ট্রান্সপ্লান্টেশন। এরকমভাবে একজনের রক্ত আরেকজনের শরীরে প্রবেশ করানো। এ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা কি?
পলিটিক্যাল সাইন্স এবং রাজনীতিতে হাজারও বিষয়, যেগুলো সম্পর্কে আলেমদের মতামত দিতে হবে। উদাহরণত বর্তমান প্রচলিত গণতান্ত্রিক সিস্টেম কি শরীয়াসম্মত? যদি শরীয়াসম্মত না হয়, তবে এর সংস্কার পদ্ধতি কীরূপ হবে? আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, শরীয়া আইন বাস্তবায়নকল্পে একসঙ্গে সকল আইনের প্রয়োগনীতি বাস্তবায়ন করা হবে নাকি গ্রাজুয়াল এপ্রোচ তথা ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন নীতি প্রয়োগ করা হবে? ইসলামের সূচনাকালে যেমন শরীয়া বিধিমালা ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হয়েছিল এখনও কি সে রীতি চলবে? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক প্রশ্ন।
স্মরণ রাখা উচিত, জ্ঞানের জগতে যখন একাধিক মতামত থাকবে তখনই মূলত গবেষণার বহুমুখী দিগন্ত উন্মোচিত হবে। একপক্ষের মতামত হচ্ছে, কোনো প্রকার ধীরে চলার নীতি চলবে না; বরং একসঙ্গেই শরীয়ার সকল নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। শরীয়া বিধিমালার অবতরণ যে ধীরে ধীরে হয়েছে এটা তো ছিল সূচনাপর্বে। যেমন মদের হারাম হওয়ার বিধান এটা প্রথমবারেই আসেনি। প্রথমে বলা হয়েছে, তোমরা নামাজের সময় মদ্যপান করো না। ‘লা তাকরাবুস সালাতা ওয়া আনতুম সুকারা।’ ধীরে ধীরে সমাজের অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করার পর একসময় এ বিধান অবতীর্ণ হল। ‘ইন্নামাল খামরু ওয়াল মাইসিরু ওয়াল আনসাবু…।’ ব্যস, এখন থেকে মদ হারাম। সুতরাং এখন যেখানেই ইসলামি শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নের পর্যায় আসবে, সেখানেই একেবারে সূচনালগ্ন থেকেই মদ অবৈধ হওয়ার বিধান প্রয়োগ করতে হবে নাকি এ যুগে এসেও ধীরে ধীরে একে প্রয়োগ করতে হবে? যখন ক্ষমতা হাতে আসবে তখন বোঝা যাবে ইসলামি আইনের বাস্তবায়নের দাবি করা কত সহজ আর এ যুগে এ ব্যবস্থা প্রয়োগ করা কতটা কঠিন। অথচ যুগ ইসলামি আইন ব্যবস্থা থেকে কত দূরে সরে গিয়েছে!
সময় এসে গেছে…
আমি বলতে চাচ্ছিলাম, কিছুদিন আগেও আমি আপনাদের বলেছি আমরা হয়তো এ পরিবর্তিত পৃথিবীতে থাকব না। কিন্তু ছাত্র ভাইয়েরা, আপনাদের সামনে কিন্তু সে সময় আসছে, যখন আপনাদেরকে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আপনারা যখন দায়িত্ব নেওয়ার বয়সে পৌঁছে যাবেন তখন হতে পারে ইনশাআল্লাহ পৃথিবীর বেশ কিছু ভূখণ্ডে মুহাম্মদের গোলামেরা দেশ পরিচালনার ভার নিজেদের স্কন্ধে নিয়ে নেবে। তখন আপনাদের কাছে জিজ্ঞাসা করা হবে, আমাদেরকে বলুন আমরা ইকোনমিক সিস্টেমকে ইসলামি নীতিমালা অনুযায়ী কীভাবে পরিচালনা করব? এটাও এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। গোটা বিশ্বের অর্থনীতি আজ অনৈসলামি রীতি অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। একে কীভাবে ইসলামি নীতিমালা অনুযায়ী ঢেলে সাজানো যায়? আপনাদের জিজ্ঞাসা করা হবে, ইসলামি আইন কি ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হবে নাকি একেবারে প্রথম থেকেই সকল আইন বাস্তবায়ন করা হবে? আমি আপনাদের এও বলেছিলাম এটাই আপনাদের কঠিন পরিশ্রম করার সময়। আমার অনুমান ছিল না যে, সে সময় এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আমি মনে করতাম সে সময় আসতে আরও দেরি আছে। কিন্তু এ প্রয়োজন তো খুব দ্রুত চলে এসেছে। বড় বড় বিশ্লেষকরা বলছিলেন, পাঠানদের অমুক অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে ছয় মাস লাগবে। কিন্তু তারা তো মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সেসব অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছেন। আল্লাহ করুন যে অঞ্চলে এ প্রয়োজন সামনে এসেছে সেখানে আলেমদের মধ্যে এ যোগ্যতা তৈরি হয়ে যাক। পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের আলেমরা তাদের দীনী ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে আসুক।
তালিবানে ইলমের দায়িত্ব হল পৃথিবীর নেতৃত্ব
এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, যা আপনাদেরকে আমার বলার ছিল। আমি বারবার বলছি আমাদের এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ইসলামের গভীর বোধ ও কনসেপ্টের অধিকারী, ইসলামকে যুগোপযোগী ভাষায় উপস্থাপন করার যোগ্য আলেম তৈরি করা। আমাদের এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য পেটপূজা কিংবা কিছু চাকরির সুযোগ বের করা নয়। এর চেয়ে ক্ষুদ্র কোনো উদ্দেশ্য আমাদের দৃষ্টিতে হতেই পারে না। আমরা নেতৃত্ব তৈরি করতে চাই। আমরা অফিসার তৈরি করতে চাই না। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রত্যেকজন ছাত্র তার আপন আপন এলাকার নেতা আর লিডার হবে। যত আধুনিক বিদ্যা এখানে পড়ানো হচ্ছে এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এ বিদ্যা লাভ করে যেন যুগকে বুঝতে সহজ হয়। যুগের সংকটগুলো বোঝার যোগ্যতা তৈরি হয়। কারণ আলেমগণ বলেছেন, যে নিজের যুগের পরিস্থিতি বুঝে না সে মূলত মূর্খ।
প্রিয় ভাইয়েরা, খুব কঠিন পরিশ্রম করুন। আমি জানি আমার এখানে যেসব ছাত্ররা আসেন তাদের সবার ব্যাকগ্রাউন্ড মাদরাসার নয়। ফলে তাদের একটু বেশিই পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু যে আগ্রহ আর উদ্দীপনা আপনাদের ভেতরে আমি লক্ষ করেছি এতে আমার আশা জাগে। আল্লামা ইকবালের সে কবিতা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
হে যুবক, আবার গ্রহণ কর তুমি সততা, ইনসাফ আর বীরত্বের পাঠ।
পৃথিবীর নেতৃত্ব মানুষ তোমার হাতেই তুলে দেবে।
ইকবালের এ ভবিষ্যত বাণীতে আমার বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলা মনে হয় না। সাধারণ মানুষ তো একে কেবল কবিতাই মনে করে। সাম্প্রতিককালে যারা এ নজিরবিহীন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড আঞ্জাম দিয়েছেন তারা সবাই মাদরাসাপড়ুয়া। তারা সবাই মাদরাসার ছাত্র। আল্লাহর ওয়াস্তে এখন তো অন্তত বুঝতে হবে। আমি আপনাদের মাধ্যমে পুরো দেশের তরুণ আলেম সমাজ এবং মাদরাসার ছাত্রদের সম্বোধন করছি। ইউনিভার্সিটিতে পাঠরত আমাদের অত্যন্ত যোগ্য ও উদ্যমী ছাত্রছাত্রীরাও আমার সম্বোধনের পাত্র। কিন্তু সর্বাগ্রে আমার সম্বোধনের পাত্র হচ্ছেন আপনারা তালিবে ইলম এবং তরুণ আলেমরা। সমগ্র বিশ্ব দেখেছে যে, দীনী শিক্ষাব্যবস্থা কতটা সফল শিক্ষাব্যবস্থা। যারা এ মহান কীর্তি আঞ্জাম দিয়েছে পৃথিবীতে তাদের নামই হয়ে গেছে তালিবান। এটা কোনো বিশেষ দল নয়। ফারসি ভাষায় মাদারিসে ইসলামিয়ার ছাত্রদেরকেই তালিবান বলা হয়। আধুনিক শিক্ষিত লিবারেলরা অনেক তুচ্ছ ভাবত তাদেরকে। এ মাদরাসার মোল্লারা কি করতে পারবে? এরা তো মসজিদে দুই রকআত নামাজ পড়িয়ে প্রতিবেশী মুসল্লিদের নাশতার অপেক্ষায় থাকবে। ঘরে ঘরে গিয়ে খাবার উত্তোলন করবে। মানুষেরা বলাবলি করত আমরা কি নিজেদের সন্তানদের মাদরাসায় দিয়ে ফকির আর দরিদ্র বানাব? এমন লোকদের চোখ যদি এখনও না খুলে তবে কখন খুলবে? যে কাজ পৃথিবীর বড় বড় প্রফেসররা করতে পারেনি তারা সেটা করে দেখিয়েছে। যে সাহস, বীরত্ব, দুঃসাহসিকতা, অবিচল ইচ্ছা আর হিম্মত তারা দেখিয়েছে তারা অন্তত আমাদের সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আমাদের আস্থা আরও হাজারগুণ বেড়ে গিয়েছে। এ শিক্ষাব্যবস্থা এখনও জীবন্ত। আজও এ ব্যবস্থা অদ্ভুত সব কীর্তি আঞ্জাম দিতে পারে। শর্ত একটাই, আমাদেরকে পুনরায় সততা, ইনসাফ আর বীরত্বের পাঠ গ্রহণ করতে হবে। নিয়তকে রাখতে হবে একেবারে স্বচ্ছ ও নির্মল।
আমার জীবনের উদ্দেশ্য তোমার দীনের বিজয়
দিবানিশি আমরা একথাই জপি, আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি কণা থেকে এ স্লোগানই উচ্চারিত হয়: ‘ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন…’ সবাই বলুন, আমরা তো নিজেদের জীবনের ব্যাপারে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। ইসলামের সুমহান বাণীকে উচ্চকিত করার জন্য, ইসলামের প্রচার আর প্রসারের জন্য আমি আমার জীবনকে ওয়াকফ করে দিয়েছি। আর মনে রাখতে হবে, যেকোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে ওয়াকফ হয়ে যায় তার জন্য উদ্দেশ্যের বাইরে অন্য কিছুতেই ব্যবহার হওয়া যাবে না। আমার জীবিকা আমার সম্মান সবই আল্লাহর হাতে। যে ব্যক্তি এরকম হিম্মত করতে পারে আল্লাহ তাকে এ পরিমাণ রিজিক দান করেন যে, তা শুধু তার জন্য নয় আরও বহু মানুষের জন্য সে রিযিকের মাধ্যমে পরিণত হয়। ইতিহাস সাক্ষী, কোনো আলেমে রাব্বানী কোনো বিজ্ঞ আলেম কখনও অন্যের মুখাপেক্ষী থাকেননি। যদি কেউ মাদরাসা থেকে ফারেগ হওয়ার পরও লাঞ্চনার জীবনযাপন করে, তাহলে বুঝতে হবে কোথাও তার অবশ্যই ত্রুটি আছে। আখেরাতের সাফল্যের কথা এখন আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। এখন তো আমি কেবল দুনিয়ার মর্যাদার কথা বলছি। পার্থিব সম্মান ও সুখ্যাতির কথা বলছি। আচ্ছা বলুন তো, পৃথিবীতে আকবরের সুখ্যাতি আর সম্মান বেশি নাকি মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর মর্যাদা আর খ্যাতি বেশি? ফিরআউনের খ্যাতি আর মর্যাদা বেশি নাকি হযরত মুসা এবং হারুন (আ.)-এ? মানুষেরা কেন নিজেদের সন্তানের নাম ফিরআউন কিংবা কারুন বা হামান রাখে না? এত বড় সম্পদশালী আর ক্ষমতাবানদের কথা শুনলে কি মানুষের ঘৃণা লাগে? মন ভালোভাবে পরিষ্কার রাখুন। নিজেদের কেবলা সবসময় ঠিক রাখুন। সামান্যও এদিক-সেদিক যাবেন না। ইসলামের সংরক্ষণ, প্রচার এবং প্রতিষ্ঠাকে নিজেদের মিশন বানিয়ে নিন। আল্লাহর দায়িত্ব হচ্ছে, তিনি আপনাকে সম্মান দেবেন, সুখ্যাতি দেবেন, রিজিক দান করবেন এবং দান করবেন সুউচ্চ মর্যাদা। যতক্ষণ পর্যন্ত ওলামায়ে কেরাম নিজেদেরকে শতভাগ দুনিয়াবিমুখ বানাতে পারবেন না এবং অন্তর থেকে সবরকম দ্বিধাসংশয় ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কাজ হবে না। যদি আলেমদেরকে পি এইচ ডি ডিগ্রিও অর্জন করতে হয় তবে তাও যেন সামান্য জীবিকা আর পকেটের জন্য না হয়। বরং আমরা এসব ডিগ্রি এ উদ্দেশ্যে অর্জন করব যে, এসব জ্ঞানবিজ্ঞানে নিজেদেরকে পারদর্শী করে মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করব। মানুষ জীবিকা সম্বন্ধে যতবেশি নিশ্চিন্ত থাকে ততবেশি সে স্বচ্ছন্দ থাকে। হায় যদি কেউ বিশ্বাস করত! যতই মানুষের মনে জীবিকার চিন্তা বেশি থাকে সে তত বেশি সারাজীবন পেরেশান থাকে। (চলবে ইনশাআল্লাহ)
অনুবাদক: শিক্ষক, জামিয়া মাদানিয়া সিলোনিয়া ফেনী
[1] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আহযাব, ৩৩:২৫-২৭
[2] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-বাকারা, ২:২৪৯
[3] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আনফাল, ৮:১৭-১৯
[4] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-বাকারা, ২:২৪৯