ইসলামি দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: কারণ ও প্রতিকার
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
অতএব দ্রব্যমূল্য উর্ধ্বগতির এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের সর্বপ্রথম কর্তব্য হল, আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। দ্বিতীয়ত তাঁর কাছে নিজ নিজ পাপাচারের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। তৃতীয়ত জীবিকা অর্জনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শরীয়ত বর্ণিত নীতিগুলো অনুসরণ করা এবং এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ অনুযায়ী কাজ করা। নিম্নে সংক্ষেপে এসব বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হল:
আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক জোরদার করা
আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক জোরদার করা অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশিত বিধান, ফরজ-ওয়াজিবগুলো পালন করার প্রতি যত্মবান হতে হবে এবং রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ মোতাবেক জীবন যাপন করতে হবে। আর হারাম ও মন্দ কাজ থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহই আমাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী, প্রত্যেক প্রাণির রিযিকের জন্য তিনিই জিম্মাদার, যেমন হযরত আনাস (রাযি.) বলেন,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، وَقَتَادَةُ، وَحُمَيْدٌ، عَنْ أَنَسٍ، قَالَ: النَّاسُ يَا رَسُوْلَ اللهِ، غَلَا السِّعْرُ فَسَعِّرْ لَنَا، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْـمُسَعِّرُ الْقَابِضُ الْبَاسِطُ الرَّازِقُ، وَإِنِّيْ لَأَرْجُوْ أَنْ أَلْقَى اللهَ وَلَيْسَ أَحَدٌ مِنْكُمْ يُطَالِبُنِيْ بِمَظْلَمَةٍ فِيْ دَمٍ وَلَا مَالٍ».
‘হযরত আনাস (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা বললো, হে আল্লাহর রসুল! জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। আপনি আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহই মূল্যের গতি নির্ধারণকারী, তিনিই তা কমান ও বৃদ্ধি করেন এবং একমাত্র তিনিই রিজিকদাতা। আমি এই আশা করি যে, আমি আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবো যেন আমার ওপর কারো জীবন বা সম্পদের ওপর জুলুম করার কোনোরূপ অভিযোগ না থাকে।”[1]
কিছু লোক হযরত আবু হাযিম (রহ.)-এর নিকট এসে বলল, হে আবু হাযিম! দেখছেন না দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি কত বেড়েছে? এমন পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত? আবু হাযিম (রহ.) উত্তরে বললেন, তোমাদের চিন্তিত হওয়ার কারণ কী? নিশ্চয় যিনি আমাদের প্রাচুর্যের সময় রিজিক দিতেন, তিনিই অভাবের সময়েও আমাদের রিজিক দেবেন। সুতরাং চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু তাঁর অবাধ্যতা ছেড়ে দাও এবং তাঁর আনুগত্য করো।[2]
«إِذَا اهْتَمَمْتَ لِغَلَاءِ السِّعْرِ فَاذْكُرِ الْـمَوْتَ فَإِنَّهُ يُذْهِبُ عَنْكَ هَمَّ الْغَلَاءِ».
‘যদি তোমরা উচ্চমূল্যের বিষয়ে চিন্তিত হও, তবে মৃত্যুর কথা স্মরণ করো, কেননা তা তোমাদের থেকে উচ্চমূল্যের বোঝা দূর করে দেবে।’[3]
তাওবা ও ইস্তিগফার
দুনিয়ার যাবতীয় দুঃখ ও কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রধান ব্যবস্থা হল, বান্দা মহান আল্লাহর দরবারে তার পাপের কথা স্বীকার করা। এর জন্য আন্তরিকভাবে অনুশোচনা প্রকাশ করা। ভবিষ্যতে তা পরিত্যাগ করার সংকল্প করা। আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। যদি তিনি তা করেন, তাহলে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং তাঁর রহমত নাযিল করেন। যেমনটি হযরত নূহ আ. এর ভাষায় আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ١ؕ اِنَّهٗ كَانَ غَفَّارًاۙ۰۰۱۰ يُّرْسِلِ السَّمَآءَ عَلَيْكُمْ مِّدْرَارًاۙ۰۰۱۱ وَّيُمْدِدْكُمْ بِاَمْوَالٍ وَّبَنِيْنَ وَيَجْعَلْ لَّكُمْ جَنّٰتٍ وَّيَجْعَلْ لَّكُمْ اَنْهٰرًاؕ۰۰۱۲
‘আমি বলেছি তোমরা তোমাদের রব্বের কাছে ক্ষমা চাও, তিনি বড়ই ক্ষমাশীল। (তোমরা তা করলে) তিনি অজস্র ধারায় তোমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তানাদি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’[4]
ব্যবসা-বাণিজ্যে ইসলামি নীতিমালা মেনে চলা
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এর প্রতিটি বিধান মানব কল্যাণের জন্য। ইসলাম সর্বক্ষেত্রে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। আর ইসলাম ব্যবসাকে সম্মানজনক পেশা হিসেবে ঘোষণা করেছে। মানব জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও রয়েছে তার নিজস্ব কিছু নীতিমালা। বিশেষত «لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ» (নিজেও ক্ষতিগ্রস্থ না হওয়া এবং অপরকেও ক্ষতিগ্রস্থ না করা)[5]-এর নীতিকে সামনে রেখে ইসলাম ক্রয়-বিক্রয়ের কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে, যার ভিত্তিতে সমগ্র মানবসমাজ ব্যবসায় সমানভাবে লাভবান হয় এবং কারো কোনো ক্ষতি হয় না। ব্যবসা-বাণিজ্যের ইসলামি নীতিগুলো এতই চমৎকার যে, সেগুলো অবলম্বন করলে দ্রব্যমূল বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়। তাই নিম্নে ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক কিছু নীতিমালা উল্লেখ করা হল:
প্রতারণা এড়িয়ে চলা
বর্তমান যুগে বেশিরভাগ ব্যবসাই প্রতারণার ওপর নির্ভর করে। খাদ্য, পোশাক, গহনা ক্রয়, যাই হোক না কেন, ব্যবসায়ীরা প্রতারণা থেকে বিরত থাকছে না। পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করা এবং অল্প পরিমাণ মুনাফার পরিবর্তে অধিক মুনাফা গ্রহণ করাকে বাণিজ্যের শিল্প হিসেবে গণ্য করা হয়। অথচ ইসলাম এ কাজকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.)-এর সূত্রে বর্ণিত
«مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّيْ».
অর্থাৎ রসুলুল্লাহ (সা.) একটি এলাকার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি সেখানে শস্য-স্তুপ দেখতে পেলেন, যার উপরের অংশ ছিলো শুকনো এবং ভিতরের অংশ ছিলো ভেজা। তখন তিনি শস্য-মালিককে সম্বোধন করে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? তখন সে বলল; পানি পড়ে ছিল, ইয়া রসুলুল্লাহ। তখন তিনি বলেন, তাহলে তুমি এই ভেজা দানা উপরে রাখলে না কেন, যেন লোকেরা দেখতে পায়? মনে রাখবে, ‘যে প্রতারণা করে, তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’[6]
ক্রয়ের অভিপ্রায় ছাড়া মূল্য নির্ধারণের নিষেধাজ্ঞা
বর্তমানে কিছু কিছু জায়গায় দেখতে পাবেন যে, যখন আপনি কোনো কিছু ক্রয় করার জন্য যাবেন, তখন সেখানে অনেক লোকের উপস্থিতি দেখতে পাবেন। আপনি যে জিনিসটি কিনতে চান, তারাও সেটির ক্রেতা হয়ে যায় এবং এর দাম বাড়াতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটিকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘নাজাশ’ বলা হয়। আসলে এটা অসাধু ব্যবসায়ীদের ধোঁকাবাজী, যাতে কাঙ্খিত জিনিসটি আপনাকে বেশি দামে কিনতে হয়। অথচ আল্লাহর নবী (সা.) এ কাজটি নিষেধ করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) বলেন,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، «أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ نَهَىٰ عَنِ النَّجْشِ».
‘রসুলুল্লাহ (সা.) বায়য়ে নাজাশকে নিষেধ করেছেন।’[7]
‘বায়য়ে নাজাশ’ হচ্ছে, পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বিক্রেতার সাথে গোপন আঁতাত করে পণ্য অধিক মূল্যে দরদাম করা, যাতে অন্য ক্রেতারা প্রতারিত হয় এবং বর্ধিত মূল্যে পণ্য ক্রয় করে। বর্তমান যুগে অনেক লোক নিলামের ক্ষেত্রে এ কাজটি করে থাকে এবং এই কাজটিকে পাপ হিসাবে বিবেচনা করে না। অথচ ইসলামে এটি নিষিদ্ধ এবং অবৈধ। এভাবে ধোকাতে পড়ে যদি ক্রেতা পণ্যের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্য দিয়ে দেয় তখন তিনি বিক্রয় বাতিল করার অধিকার রাখেন এবং পণ্য ফেরত দিয়ে তার অর্থ গ্রহণ করারও অধিকার রাখেন।
কাফেলার মালামাল বাজারে পৌঁছানোর পূর্বে কেনা নিষেধ
গ্রামের কৃষকরা পণ্য নিয়ে শহরের বাজারে প্রবেশ করার পূর্বেই তাদের কাছ থেকে পাইকারীভাবে তা ক্রয় করে নেওয়াকে তালাক্কী বলে। হযরত আবদুল্লাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
عَنْ عَبْدِ اللهِ h، قَالَ: «كُنَّا نَتَلَقَّى الرُّكْبَانَ، فَنَشْتَرِيْ مِنْهُمُ الطَّعَامَ، فَنَهَانَا النَّبِيُّ ﷺ أَنْ نَبِيعَهُ حَتَّىٰ يُبْلَغَ بِهِ سُوقُ الطَّعَامِ».
‘আমরা ব্যবসায়ী দলের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের কাছ থেকে খাদ্য ক্রয় করতাম। নবী করীম (সা.) বাজারে পৌঁছানোর পূর্বে তা ক্রয় করতে আমাদেরকে নিষেধ করলেন।’[8]
এভাবে পাইকাররা কৃষকদের কাছ থেকে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিতে পারে। সেজন্য রসুলুল্লাহ (সা.) এই বিক্রয়কে নিষিদ্ধ করে বলেন, «لَا تَلَقَّوُا الرُّكْبَانَ» (তোমরা (পণ্যবাহী) কাফেলার সাথে শহরে প্রবেশের পূর্বে সাক্ষাৎ করবে না)।’[9]
অন্য হাদীসে এর হেকমত ও দর্শন ব্যাখ্যা দিয়ে মহানবী (সা.) বলেন,
«دَعُوا النَّاسَ يَرْزُقُ اللهُ بَعْضَهُمْ مِنْ بَعْضٍ».
‘মানুষকে ছেড়ে দাও। আল্লাহ কিছু মানুষকে অন্য মানুষের মাধ্যমে রিজিক প্রদান করেন।’[10]
মজুদদারির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অন্যতম কারণ হল মজুদদারি। একশ্রেণির মুনাফালোভী, সুযোগসন্ধানী ও অসৎ ব্যবসায়ী সস্তা দামে পণ্য ক্রয় করে এবং ভবিষ্যতে চড়া দামে বিক্রয় করার মানসে তা মজুদ করে রাখে। ফলে বাজারে দুষ্প্রাপ্যতার দরুন পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং পণ্যমূল্য হু হু করে বেড়ে যায়। এ জন্য ইসলামে তা নিষিদ্ধ। হযরত মুয়াম্মার ইবনে আবদুল্লাহ (রাযি.) বলেন , আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি,
«لَا يَحْتَكِرُ إِلَّا خَاطِئٌ».
‘যে মজুদদারি করে সেই পাপী।’[11]
আল্লামা ইবনে তায়মিয়া (রহ.) বলেন,
فَإِنَّ الْـمُحْتَكِرَ هُوَ الَّذِيْ يَعْمَدُ إلَىٰ شِرَاءِ مَا يَحْتَاجُ إلَيْهِ النَّاسُ مِنْ الطَّعَامِ، فَيَحْبِسُهُ عَنْهُمْ وَيُرِيْدُ إغْلَاءَهُ عَلَيْهِمْ وَهُوَ ظَالِـمٌ لِلْخَلْقِ الْـمُشْتَرِيْنَ وَلـِهَذَا كَانَ لِوَلِيِّ الْأَمْرِ أَنْ يُكْرِهَ النَّاسَ عَلَىٰ بَيْعِ مَا عِنْدَهُمْ بِقِيمَةِ الْـمِثْلِ عِنْدَ ضَرُورَةِ النَّاسِ إلَيْهِ مِثْلَ مَنْ عِنْدَهُ طَعَامٌ لَا يَحْتَاجُ إلَيْهِ وَالنَّاسُ فِيْ مَخْمَصَةٍ، فَإِنَّهُ يُجْبَرُ عَلَىٰ بَيْعِهِ لِلنَّاسِ بِقِيْمَةِ الْـمِثْلِ.
‘কেননা মজুদদার মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে মজুদ করে রাখে এবং তাদের নিকট চড়া দামে বিক্রি করতে চায়। ক্রেতা সাধারণের ওপর সে যুলুমকারী। এজন্য শাসক মানুষের প্রয়োজন দেখা দিলে তাদের নিকট মজুদকৃত জিনিস প্রকৃত মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারেন। যেমন, কারো নিকট এমন খাদ্য মজুদ আছে যা তার প্রয়োজন নেই। আর এমতাবস্থায় মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। তবে তাকে প্রচলিত বাজার মূল্যে মানুষের কাছে তা বিক্রি করতে বাধ্য করা হবে।’[12]
বরকত লাভের উপায় অবলম্বন করা
নিঃসন্দেহে শরীয়ত বরকত লাভের অনেক আচার-আচরণ ও উপায় নির্ধারণ করেছে, যা প্রয়োগ করে একজন ব্যক্তি বরকত লাভ করতে পারে। আর এটা স্পষ্ট যে, আজও যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত নাযিল হয়, তাহলে গোটা দেশ ও জাতি দারিদ্র্য ও মুদ্রাস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে এবং সবাই শান্তি ও স্বস্তিতে জীবন যাপন করতে শুরু করবে। বরকতের কারণে মানুষের সম্পদ বাড়বে এবং প্রত্যেকের জন্য নিজের সম্পদই যথেষ্ট হবে। অন্য কারো কাছে হাত পাততে হবে না। তাই সকল মুসলমানের উচিত শরীয়ত কর্তৃক বর্ণিত বরকতময় আমলগুলো পালন করার চেষ্টা করা। যেমন: হযরত হাকিম ইবনে হিযাম (রাযি.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
«الْبَيِّعَانِ بِالْـخِيَارِ مَا لَـمْ يَفْتَرِقَا، فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُوْرِكَ فِيْ بَيْعِهِمَا، وَإِنْ كَذَبَا وَكَتَمَا مُحِقَ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا».
‘ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্য (চুক্তি ভঙ্গ করার) অবকাশ থাকবে, যতক্ষণ না তাদের একজন অপরজন থেকে পৃথক হয়ে যায়। তারা যদি সততা অবলম্বন করে এবং মালের দোষ-ত্রুটি বলে দেয়, তবে তাদের বেচাকেনায় বরকত হবে। আর যদি তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং দোষ-ক্রটি গোপন রাখে, তবে উক্ত ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত মুছে দেওয়া হবে।’[13]
মূল্যবৃদ্ধি হওয়া পণ্যের বিকল্প তালাশ করা
হযরত আলী (রাযি.)-এর খেলাফতকালে মক্কায় কিসমিসের দাম বেড়ে যায়। লোকেরা চিঠির মাধ্যমে কুফায় অবস্থানরত হযরত আলী এর কাছে অভিযোগ জানালো। তখন তিনি পরামর্শ দিলেন যে, আপনারা কিসমিসের পরিবর্তে খেজুর ব্যবহার করুন। কারণ আপনারা যখন তা করবেন তখন চাহিদার অভাবে কিসমিসের দাম কমে যাবে এবং তা সস্তা হয়ে যাবে। আর সস্তা না হলেও কোনো অসুবিধা নেই। কারণ কিসমিসের উত্তম বিকল্প হল খেজুর।
عَن رزين بن الْأَعْرَج مولى لآل الْعَبَّاس، قَالَ: غلا علينا الزَّبِيب بِمَكَّة، فكتبنا إِلَىٰ علي بن أَبي طَالب بِالْكُوفَةِ أَن الزَّبِيب قد غلا علينا، فَكتب أَن أرخصوه بِالتَّمْرِ. [14]
মূল্যবৃদ্ধি হওয়া পণ্যের ব্যবহার পরিহার করা
একবার হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রহ.)-কে বলা হল, গোশতের দাম বেড়ে গেছে। হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রহ.) একথা শুনে বললেন, যদি তার দাম বেড়ে যায় তবে তা কমিয়ে দাও। লোকেরা বলল, আমরা নিজেরাই তো গোশতের মুখাপেক্ষী, আমাদের কাছে অতিরিক্ত গোশত কোথায় আছে, আমরা কীভাবে এর দাম কমাতে পারি? তখন হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রহ.) বললেন, আসলে আমি বলতে চাচ্ছি যে, তোমরা এর ব্যবহার কমিয়ে দাও, অর্থাৎ তোমরা যখন এর কেনাকাটা বন্ধ করে দেবে, তখন এর ব্যবহার ও চাহিদা কমে যাবে। আর যখন চাহিদা কমে যাবে, তখন এর দাম নিজে থেকেই কমে যাবে।
قِيْلَ لِإِبْرَاهِيْمَ بْنِ أَدْهَمَ: «إِنَّ اللَّحْمَ غَلَا قَالَ: فَأَرْخِصُوْهُ أَيْ: لَا تَشْتَرُوْهُ».[15]
আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন এবং আমল বৃদ্ধি করা
একজন আল্লাহঅলা বুযুর্গ বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই বলে কি আল্লাহর ভাণ্ডার শেষ হয়ে গেছে? নাউযু বিল্লাহ! তাহলে কেন দোয়ার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে না? রসুলুল্লাহ (সা.) যা করতে বলেছেন, তা কেন করা হচ্ছে না? আমরা সবাই কি আমাদের আর্থিক সমস্যা হোক কিংবা অন্য যেকোনো সমস্যায় রসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত আমলগুলোর পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারি না?
লক্ষ করুন কারো জ্বর হলে সে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট সেবন করে। কিন্তু যদি সেই ব্যক্তির টাইফয়েড হয়ে যায়, তখন সে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে এবং সেক্ষেত্রে সে কোনো অনিয়ম করে না। কারণ সে জানে যে, অনিয়ম করলে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব শেষ হয়ে যায়। ঠিক তেমনি আমাদেরকেও আমলের অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে। যা প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর উম্মতকে সেবন করতে বলেছিলেন। নিম্নে তার কয়েকটির আলোচনা উল্লেখ করা হল। আসুন, নিয়মিত তা মেনে চলি এবং এর জোরদার অনুশীলন করি। এই কাজের বরকত আমাদের জীবনে খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাবে, ইনশাআল্লাহ।
- সর্বাবস্থায় ফরজ নামাজের পাবন্দি করি এবং যথা সম্ভব আল্লাহর রাস্তায় সদকা করি। তাতে আল্লাহ রিজিক বাড়িয়ে দেবেন।
- ফজরের পর ১০০ বার ‘সুবহানাল্লাহ ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযীম’ এবং ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পাঠ করি।
- দিনের শুরুতে সুরা ইয়াসীন পাঠ করে দোয়া করি। হাদীস শরীফে আছে, ‘দিনের শুরুতে সুরা ইয়াসীন পাঠ করলে আল্লাহ তাআলা ওই দিনের সকল প্রয়োজন পূরণ করে দেন।’
- ইশরাকের নামাজের অভ্যাস গড়ি। এর মাধ্যমে রিজিকে বরকত হয়।
- প্রতিদিন রাতে মাগরিবের পর সুরা ওয়াকিয়া পাঠ করি। তাতে ঘরে কখনো অভাব দেখা দেবে না।
- প্রতিদিন সালাতুল হাজাত পড়ে জীবিকার জন্য দোয়া করি।
- সর্বদা অযু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করি। হাদীসে এসেছে, ‘তাতে রিজিক বৃদ্ধি হয়।’
- দোয়া ও প্রার্থনার শক্তি বৃদ্ধি করি। সর্বদা আল্লাহ তাআলাকে সমস্যার কথা বলতে থাকি। তিনি তো সবকিছু জানেন। তবে বান্দা যখন তার নিকট নিজ প্রয়োজনের কথা বলে, তখন তিনি খুশি হন। তাই তার দরবারে আমরা দোয়া করি। হে আল্লাহ, আপনি আমার সংকট দূর করে দিন। আমাকে সাহয্য করুন। আমাকে একা ছেড়ে দেবেন না।
বাস্তবসম্মত কিছু পদক্ষেপ যা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে! দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে! বলে চিৎকার করলে দ্রব্যমূল্য সস্তা হয়ে যাবে না। তবে যদি এর প্রতিকারের জন্য বাস্তবসম্মত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তাহলে মানুষ শান্তি ও স্বস্তি ফিরে পাবে। তাই কিছু পদক্ষেপের কথা নিম্নে উল্লেখ করা হল:
(ক) প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা। এতেই সন্তুষ্ট থাকা। অকারণে অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা থেকে বিরত থাকা। যেন আয়ের অধিক ব্যয় করে ঋণগ্রস্থ হতে না হয়।
(খ) পারিবারিক খরচ কমানোর একটি উপায় হল, ভোগ্যপণ্য কেনাকাটার পূর্বে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের একটি তালিকা তৈরি করা এবং এই সমস্ত আইটেমগুলি সত্যিই প্রয়োজন কিনা এবং সেগুলি ছাড়া জীবন চলা মুশকিল কিনা, তা সাবধানতার সাথে মূল্যায়ন করা। শাক-সবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। (সাধারণ এগুলোর দাম মাছ-মাংসের চেয়ে কম হয় এবং এগুলো স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী)। নিজেকে এবং নিজের সন্তানদের সাধারণ জীবনধারায় অভ্যস্ত করা। (এতে করে অন্যান্য সুবিধার পাশাপাশি রোগ-ব্যাধি থেকেও মুক্ত থাকা যায়। এতে অহেতুক হাসপাতালে যেতে হয় না। অত্যাধিক ব্যয়বহুল ওষুধ খরচ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়)।
(ঙ) দামি মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও ট্যাবলেট, পিসি ইত্যাদির পরিবর্তে সহনীয় দামের সাধারণ মোবাইল ফোন ইত্যাদি ব্যবহার করার চেষ্টা করা।
(চ) কোনো খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়ে গেলে তা পরিত্যাগ করে তুলনামূলক কম মূল্যের অন্য জিনিস কিনে নেওয়া।
মোটকথা সর্বপ্রকারের বিলাসিতাপূর্ণ জীবন পরিত্যাগ করা, মিতব্যায়ী জীবন যাপনের চেষ্টা করা। আমরা যদি উল্লিখিত বিষয়গুলো পালন করতে সক্ষম হই, তাহলে আমাদের কর্মের বরকত আমাদের জীবনে লাভ করতে সক্ষম হবো, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে আমল করার তওফিক দান করুন, আমীন।
লেখক: গবেষক ও শিক্ষক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
[1] আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ৩, পৃ. ২৭২, হাদীস: ৩৪৫১
[2] আবু নুআয়ম আল-আসবাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবাকাতুল আসফিয়া, মাতবাআতুস সাআদা, কায়রো, মিসর (প্রথম সংস্করণ: ১৩৯৪ হি. = ১৯৭৪ খ্রি.), খ. 3, পৃ. 239
[3] আবু নুআয়ম আল-আসবাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবাকাতুল আসফিয়া, খ. 8, পৃ. 347
[4] আল-কুরআন, সুরা নুহ, ৭১:১০-১২
[5] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত-তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ৫৫, হাদীস: ২৮৬৫
[6] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৪ হি. = ১৯৫৫ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৯৯, হাদীস: ১০২
[7] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭১ হি. = ১৯৫২ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ৭৩৪, হাদীস: ২১৭৩
[8] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ৭৩, হাদীস: ২১৬৬
[9] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৩, পৃ. ৭১, হাদীস: ২১৫০
[10] আন-নাসায়ী, আল-মুজতাবা মিনাস সুনান = আস-সুনানুস সুগরা, মাকতাবুল মতবুআত আল-ইসলামিয়া, হলব, সিরিয়া (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪০৬ হি. = ১৯৮৬ খ্রি.), খ. ৭, পৃ. ২৫৬, হাদীস: ৪৪৯৫
[11] আত-তিরমিযী, আল-জামিউস সহীহ = আস-সুনান, মুস্তফা মুস্তফা আল-বাবী আল-হালাবী অ্যান্ড সন্স লাইব্রেরি অ্যান্ড প্রিন্টিং কোম্পানি, কায়রো, মিসর (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৩৯৫ হি. = ১৯৭৫ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ৫৫৯, হাদীস: ১২৬৭
[12] ইবনে তায়মিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া, বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স, মদীনা শরীফ, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৬ হি. = ১৯৯৫ খ্রি.), খ. ২৮, পৃ. ৭৬-৭৭
[13] আন-নাসায়ী, আল-মুজতাবা মিনাস সুনান, খ. ৭, পৃ. ২৪৪-২৪৫, হাদীস: ৪৪৫৭
[14] ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন, তারিখু ইবনি মাঈন, মারকাযুল বাহস আল-ইলমী ও ইয়াহইয়াউত তুরাস আল-ইসলামী, মাক্কাতুল মুকাররামা, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৩৯৯ হি. = ১৯৭৯ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ৩১৩, হাদীস: ৪৭১
[15] আবু নুআয়ম আল-আসবাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবাকাতুল আসফিয়া, খ. 8, পৃ. 32