শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ বিভাগ
ইলমের জন্য একাগ্রতা ও আত্মত্যাগ জরুরি
আল্লামা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ
[আল–জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সোমবার বাদে যোহর জামিয়ার জামে মসজিদে ছাত্রদের উদ্দেশে ইসলাহী বয়ান করা হয়। প্রতি সপ্তাহে মুরব্বিরা ছাত্রদের আদর্শ জীবন গঠনের লক্ষ্যে মূল্যবান আলোচনা করে থাকেন। বিগত ২২ সফর ১৪৪৪ হিজরী মোতাবেক ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ইংরেজি সোমবার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন জামিয়া প্রধান আল্লামা ওবায়দুল্লাহ হামযা (দা. বা.)। এক ঘন্টা ব্যাপী দীর্ঘ সে ভাষণটির শ্রুতিলিপি করেছে জামায়াতে উলার ছাত্র মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ। বয়ানটি ছাত্রদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রয়োজনীয় সম্পাদনাসহ মাসিক আত-তাওহীদের ‘শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ বিভাগে’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হল।—সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি]
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
প্রিয় শিক্ষার্থীরা! একজন তালিবে ইলমের জন্য অধ্যয়নের প্রতি অত্যধিক মনোনিবেশ করা জরুরি। আমাদের দরসে নেজামীতে যে সকল কিতাব অন্তর্ভুক্ত আছে তা যথাযথভাবে অধ্যয়ন ও হৃদয়ঙ্গম করার মাধ্যমেই একজন আলেমের উপযুক্ত যোগ্যতা অর্জিত হয়। এজন্য সর্বাবস্থায় তালিবে ইলমকে যোগ্যতা অর্জনের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। তবে রুচি পরিবর্তনের জন্য কিংবা মেধা বিকাশের জন্য দরসী কিতাব ব্যতীত ইলমী কিতাবাদি অধ্যয়ন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে দক্ষ ও স্বীকৃতিপ্রাপ্তলেখকদের লেখাই পড়তে হবে। বিতর্কিত লেখক কিংবা কাঁচা হাতের অনিরাপদ লেখা কখনো পড়া যাবে না; বরং তালিমি মুরব্বি ও শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আকাবিরের কিতাব পড়তে হবে।
কিতাব সংগ্রহের জন্য হযরত আলী মিয়া নদভী (রহ.)-এর কান্না
আমাদের আকাবির-বড়রা কিতাবাদি অধ্যয়ন করেছেন। বই-পুস্তুক সংগ্রহ করেছেন। তারা কিতাবাদি সংগ্রহ করার জন্য রীতিমত কান্নাকাটিও করেছেন। মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) লিখেছেন, ছোট বেলায় তিনি আল্লামা সোলাইমান মানসূরপুরী (রহ.) কর্তৃক রচিত রহমাতুললিল আলামীন সীরাতের কিতাবটি পড়ে অনেক মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই তিনি কিতাবটি ডাক যোগে অর্ডার করেন। কিতাব আসলো। (হযরতের আব্বা তখন জীবিত ছিলেন না) মায়ের কাছে টাকা নেই। কিন্তু তিনি কিতাব ফিরিয়ে দিতে চাননি। তাই তিনি কান্নাকাটি শুরু করলেন এবং বললেন, মা! যেভাবেই হোক বইটা আমার লাগবে, তুমি টাকার ব্যবস্থা করে দাও। কারণ আমি বইটার আশেক হয়ে গেছি। আহ! তারা কিতাবের জন্য কান্নাকাটি করেছেন। আমরা কি তাদের মতো হতে পেরেছি? আমরা কি কিতাবের জন্য কখনো কান্নাকাটি করি? আজকে লক্ষ লক্ষ কিতাব আমাদের হাতের নাগালে কেন্দ্রীয় লাইব্রেবিতে পড়ে আছে। ছাত্ররা কয়জনই বা সেখানে যায়? এটা বড় দুঃখজনক! প্রিয় ছাত্ররা, এজন্য তোমাদেরকে বলছি, তোমরা প্রচুর হারে কিতাবাদি সংগ্রহ করবে এবং তা গভীরভাবে অধ্যয়ন করবে।
কিতাব সংগ্রহের জন্য কাপড় বিক্রি করা
আমাদের আকবিররা বড় কষ্ট করে কিতাবাদি সংগ্রহ করেছেন। এমনকি কিতাবের জন্য নিজের কাপড় পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছেন। আল্লামা খতীবে বাগদাদী (রহ.) বলেন, ইমাম বুখারী (রহ.)-এর সহপাঠীরা হঠাৎ একদিন তাকে খুজে পাচ্ছিল না। তারা সবাই বলল, আমাদের মেধাবী ছাত্র ইসমাইল কোথায় গেল? সে ক্লাসে উপস্থিত হচ্ছে না কেন? পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, সে এক জায়গায় কোন মতে একটা কাপড় পরিধান করে পড়ে আছে। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ভাই ক্লাসে যাচ্ছেন না কেন? তখন তিনি বললেন, পরিধান করার জন্য আমার কাছে কাপড় নেই। এভাবে কী ক্লাসে যাওয়া যায়? সাথীরা বলল, তো কাপড় কোথায়? তিনি বললেন, ইলমের জন্য বিক্রি করে দিয়েছি। আহ, তিনি কাপড় বিক্রি করে ইলম শিখলেন। আর আমরা কিতাবের টাকা দিয়ে নতুন নতুন কাপড় সেলাই করি! আমাদের আর তাদের মধ্যে পার্থক্য এই জায়গায়। এজন্যই তিনি যুগ শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম বুখারী হয়েছেন। তাই আমি বলব, আমাদের জানতে হবে যে ইমাম বুখারী (রহ.) এমনি এমনি ইমাম বুখারী হয়নি। গাযালী-রাযী এমনি এমনিতে তৈরি হয়নি। অনেক ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমেই গাযালী-রাযী ও বুখারী তৈরি হয়েছেন। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানাভী (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, এ যুগে গাযালী-রাযী তৈরি হয় না কেন? তিনি বললেন, এ যুগেও হয়। কিন্তু সেই যুগের মেধাবী ছাত্রদেরকে মাদরাসায় দেয়া হতো আর এই যুগে অসুস্থ, মেধা দুর্বল, বিকলাঙ্গদেরকে মাদরাসায় দেওয়া হয়। আর তারা যথাযথ মেহনতও করে না। তাই হয়ে উঠে না। অন্যথায় মেধাবীরা যদি তাঁদের মতো মেহনত করেন, তাহলে তাঁরাও রাযী-গাযালী হয়ে উঠবেন।
মেহনতের মাধ্যমে আল্লাহপ্রদত্ত মেধা শাণিত হয়
মেধার কথা যখন আসলো, তাহলে বলব, এটা স্বীকার করি যে, সবার মেধা সমান নয়। কিন্তু মেধা কম মানে এই নয় যে, পড়াশোনা না করা। মেধা আল্লাহপ্রদত্ত একটি নেয়ামত! আল্লাহ কাউকে বেশি দিয়েছেন আবার কাউকে কম। আল্লাহপাক আমাদেরকে চেষ্টা-মেহনতের আদেশ দিয়েছেন। আমাদের মেহনত ও চেষ্টার বিনিময়ে আল্লাহ আমাদের মেধা বাড়িয়ে দিবেন।হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.)-এর মেধা খুবই দুর্বল ছিল। তিনি একবার রসুল (সা.)-কে বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! কোন কিছুই মনে থাকে না। রসুল (সা.) দোয়া করে দিলেন। তারপর থেকে তিনি আর কিছুই ভুলেন না। আমি বলব, সেই যুগে রসুলের দোয়ার স্থলে বর্তমান যুগে উস্তাদের দোয়া স্থলাভিষিক্ত হবে । কম মেধাবী ছাত্ররা উস্তাদের দোয়া নিয়ে মেধাবী হতে পারে।
উস্তাদের দোয়ার মাধ্যমে মেধা বিকাশ
আল্লামা সাআদুদ্দীন তাফতাযানী (রহ.) কত দুর্বল মেধার অধিকারী ছিলেন! একবার স্বপ্নে এক লোক এসে বলেন, এসো খেলতে যাই। তখন তিনি বললেন, আমি তো ২৪ ঘন্টা মেহনত করার পরও কোন কিছু শিখতে পারি না। আমি কীভাবে খেলতে যাব? এভাবে দ্বিতীয়বার ডাকলেন। তখনও তিনি একই জবাব দেন। তৃতীয় বার এসে বললেন রাসুল (সা.) তোমাকে ডাকছেন। তখন তিনি তাড়াতাড়ি রসুলের কাছে গেলেন। রসুল (সা.) তাকে বললেন, কী ব্যাপার সাআদ? তোমাকে বারবার ডাকছি, তুমি আসছো না কেন? তখন তিনি বললেন, হুযুর! আপনি যে ডাকছেন, তা তো আমি জানিনা। তখন রসুল (সা.) বললেন, তোমার কী সমস্যা? তিনি বললেন, হুযুর আমি তো ইলম শিখতে চাই। কিন্তু মেধা কম। কিছুই মনে থাকে না। তখন রসুল (সা.) নিজের লালা মোবারক আল্লামা তাফতাযানী (রহ.)-এর মুখে দিলেন। সাথে সাথে সাআদের পরিবর্তন সাধিত হলো। তখন থেকে সাআদ আর আগের সাআদ নেই। তিনি ক্লাসে গিয়ে এমন এমন জটিল প্রশ্ন করতে লাগলেন, সবাই অবাক হয়ে গেল। তখন তিনি তার স্বপ্নের কথা উস্তাদের সামনে প্রকাশ করলেন। আর উস্তাদ বললেন, এখনকার সাআদ আর আগের সাআদ এক নয়। এজন্য আমরা মেহনত চালিয়ে যাব। স্মৃতিশক্তি কম এই অজুহাত যেন না হয়। মেহনত করলে আল্লাহ অবশ্যই মেধা বাড়িয়ে দিবেন।
সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন ও কদর করা
প্রত্যেক বড়রা বড় হয়েছেন সময়ের কদর করার মাধ্যমে। পাকিস্তানের মুফতী শফী (রহ.) বলেন, বাথরুমে গিয়ে প্রয়োজন সারতে যত সময় ব্যয় হয়, তা আমার নিকট সময়ের অপচয় মনে হয়। তাই সেখানে প্রয়োজন সম্পাদনকালীন সময়ে বদনাটি হলেও পরিষ্কার করে নিতাম। যেন সেই সময়টিও কাজে লাগে। আর আমরা?আমাদের সময় সকালে ঘুমে ও আসরের পর ঘোরাঘুরিতে এবং এশার পর বাইরে না গেলে পেটের ভাত যেন হজম হয় না! আমাদের আর বড়দের মধ্যে পার্থক্য এই জায়গায়। তারা সময়ের গুরুত্ব দিতেন আর আমরা দিই না। আমরা কি খেয়াল করেছি, আমাদের কত সময় নষ্ট হয়ে যায়?
এজন্য বলছি, প্রিয় ছাত্ররা, সময়ের কদর করো। এমনকি দরসে যাওয়ার সময় দরূদ শরীফ পড়তে পড়তে যাও। দরস থেকে আসার সময় কালেমা পড়তে পড়তে আসো। মসজিদে যাওয়ার সময় ইস্তেগফার পড়তে পারো। এভাবে চলাফেরার সময়ও হাজার হাজার আমল হয়ে যায়। কিন্তু আমরা গাফেল। কাজেই সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে হবে এটাই আমাদের শিক্ষা।
পাকিস্তানের মুফতী শফী (রহ.) তাঁর সুযোগ্য সন্তান মুফতী তকী উসমানীকে ছাত্র যামানায় একটা ঘড়ি কিনে দিলেন এবং তাকে বললেন, প্রতিটা মিনিট ও সেকেন্ড মেপে মেপে খরচ করার জন্য ঘড়ি কিনে দিলাম। আমাদের হাতে ঘড়ি আছে, তাঁদের হাতেও ঘড়ি ছিল। তাদের ঘড়ির ব্যবহার আর আমাদের ঘড়ির ব্যবহার কি এক? না, তারা ঘড়ি ব্যবহার করত মেপে মেপে সময় খরচ করার জন্য। আর আমরা ঘড়ি ব্যবহার করি আর কত মিনিট পর ক্লাসে যাওয়া যাবে! এটা একেবারেই অনুচিত। বরং আমাদেরকে সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। কারণ সময়ই জীবন। যারা এই সময়কে মেপে মেপে সময় খরচ করেছেন তাদের জীবনই দামী হয়েছে।
বিনয় ছাত্রদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য
ইলমে নববীর ছাত্রদের মধ্যে তাওয়াজু-বিনয় থাকতে হবে। ছাত্রদের মাঝে কোন ধরনের অহংকার থাকতে পারে না। ছাত্রদের আবার কিসের অহংকার?অহংকারীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ নাযিল হয়। অহংকার পরিত্যাগ করার জন্য সালামের প্রচলন করতে হবে। আমাদের ছাত্রদের মধ্যে সালামের প্রচলন দেখা যাচ্ছে না। আমি ফজরের পূর্বে জামিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ঘুরা-ফেরা করলাম। এদিক-সেদিক একটু হাঁটলাম। তিনজন ছাত্র আমার সামনে দিয়ে গেল, দুজনের মুখে কিছুই নেই, একজন সালাম দিলো। আমাদের জামিয়াতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মেহমান আগমন করে থাকেন। অনেক সময় ছাত্ররা তাদেরকেও সালাম দেয় না। একজন মেহমান আমাকে বলল, এখানে কি সালাম শেখানো হয় না? খুবই দুঃখ পেলাম। কোন উত্তর দিতে পারলাম না। বড়ই আফসোস হলো। এজন্য প্রিয় ছাত্ররা, তোমরাদেরকে বলছি, সালামের পরিবেশ তৈরি করো।
বলছিলাম ছাত্রদেরকে বিনয়ী হতে হবে। আমাদেরকে আকাবিরের মধ্যে কী পরিমাণ বিনয় ছিলো! হাকীমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর বিনয় লক্ষ করুন। দারুল উলূম দেওবন্দের উস্তাদগণ দাওরায়ে হাদীস সমাপ্তকারী ছাত্রদেরকে পাগড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই ব্যাচে ছিলেন থানভী (রহ.)। তিনি বললেন, উস্তাদজি, আমরা তো কোন যোগ্যতাই রাখি না। (পরবর্তীতে তিনি এতো বেশি কিতাব লিখেছেন যে, তার জীবন এবং কিতাবের সংখ্যার মধ্যে কোনভাবে হিসেবে মেলেনা। তিনি তার জীবনে ছোট বড় প্রায় 2800 কিতাব লিখেছেন। তোমরা জানো তিনি লেখালেখির পাশাপাশি আরো দীনী ও ব্যক্তিগত অনেক কাজে জড়িত ছিলেন। এগুলো হলো সময়ের বরকত।) তখন উস্তাদরা বলেন, আশরাফ আলী আজকে আমরা আছি বলে তুমি ভাবছো, তুমি কিছুই না। যেদিন আমরা থাকবো না, সেদিন সারা পৃথিবীতে আশরাফ আলীর জয়জয়কার হবে। পৃথিবী আজ তাই বলছে।
ছাত্রদের জন্য নিযামুল আওকাত-সময়সূচি নির্ধারণ করা
আমাদের আকবিরের নিযামুল আওকাত ছিলো। প্রতিটি সময়ের জন্য নির্ধারিত কাজ ছিলো। তাই তারা বড় হয়েছেন। আমাদের কি নিযামুল আওকাত আছে? আমাদের অনেকের নিযামুল আওকাত নেই। তাই আমরা আমাদের সময়কে কাজে লাগাতে পারি না। বড় হতে হলে আমাদের সময়সূচি থাক জরুরি। সেই অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করতে পারি বা না পারি অন্তত কাজের নিযাম-নিয়ম থাকতে হবে। যদি সেই নিয়ম অনুযায়ী কাজ না হয়, তাহলে অন্তত মনে এই ব্যথা থাকবে যে,এই সময় আমার এই কাজটা করার কথা ছিলো, করতে পারিনি।এজন্য বলবো, ভাই! আমাদের প্রত্যেকটা কাজের নিযাম ও নিয়ম থাকা দরকার।
হাকীমু উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর মেহমান হলেন তাঁরই উস্তাদ হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.)। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) উস্তাদকে সময় দিয়েছেন, সঙ্গ দিয়েছেন। হঠাৎ করে তিনি অনুপস্থিত! কিছুক্ষণ পর তিনি উপস্থিত হলে উস্তাদ জিজ্ঞাসা করলেন, আশরাফ আলী! তুমি কোথায় ছিলে? তিনি বললেন, উস্তাদজি, আমার নিযামুল আওকাত আছে। প্রতিদিন এই সময় আমি বয়ানুল কুরআন লিখি। এজন্য শুধু দুই লাইন লিখে এসেছি, যাতে নিযাম ঠিক থাকে।
উস্তাদের পরিবারের প্রতি আকাবিরের শ্রদ্ধা ও সম্মান
আমাদের বড়রা উস্তাদদেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। শুধু উস্তাদই নন। তারা উস্তাদের পরিবারকেও সম্মান করতেন। তাদের এই কাজ দেখে অন্তর কেঁপে ওঠে। গা শিউরে ওঠে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, তিনি তার উস্তাদের বাড়িতে চাকরের মত থাকতেন। এজন্য আমি বলব, উস্তাদের প্রতি আকিদাত ও মহব্বত, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা; আকাবিরের কাছ থেকেই শিখবো। আমাদের দেওবন্দিয়াতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ছাত্র-উস্তাদের মহব্বত ও হৃদ্যতা। যেটা অন্য কোথাও দেখা যায় না। এজন্য বলব, যতদিন আমরা আমাদের আকাবিরের ঐতিহ্য ধারণ করব, ততদিন আমরা ‘বিল খায়ের’ কল্যাণ ও সফলতা অর্জন করতে পারবো, অন্যথায় আমরা ছিটকে পড়বো। উম্মতের কোন খেদমত আমাদের দ্বারা হবে না। এজন্য বলব উস্তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া, ছোটখাটো কোন জরুরত আছে কিনা, তা পূরণ করার চেষ্টা করা; তালেবে ইলমের নৈতিক কর্তব্য। আমি যত বেশি বড়দের কিতাব পড়েছি,ততই মনে হয়েছে, বড়রা কিতাব পড়ে বড় হননি, বরং তারা উস্তাদের সুহবতের মাধ্যমেই বড় হয়েছেন। যদি সমস্ত কিতাব পড়া হয় আর উস্তাদের দোয়া না থাকে, তাহলে তার এই পড়ার মাধ্যমে কোন ভালো ফলাফল আসবেনা। এজন্য উস্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, সময়কে কদর ও কিতাবের জন্য মেহনত করা একান্ত জরুরি। ইসলামের ১৪০০ বছরের ইতিহাসে এই শ্রদ্ধাবোধ,সময়ের মূল্যায়ন ও ইলমের জন্য মেহনতের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।কাজেই আমি বলব, আমাদের ও তাদের মধ্যে কি কি পার্থক্য আছে? সেগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধান করতে পারলে আমরাও আকাবিরদের মত বড় হতে পারবো, ইনশা আল্লাহ।
আমলহীন ইলম বিপদজনক আর ইলমহীন আমল পথভ্রষ্টকারী
পরিশেষে আমি বলব, «الْعِلْمُ بِلَا عَمَلٍ وَبَالٌ، وَالْعَمَلُ بِلَا عِلْمٍ ضَلَالٌ» অর্থাৎ আমলহীন ইলম বিপদজনক আর ইলমহীন আমল পথভ্রষ্টকারী। কাজেই আমরা যা শিখবো তার ওপর আমল করবো। আমরা প্রায় ছোটবেলা থেকেই প্রত্যেক ক্লাসে কিতাবুস-সালাত পড়ে আসছি, কিন্তু কিতাবের জায়গায় কিতাবের মাসালা পড়ে রয়েছে, এর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমাদের নামাজে কোন রূহানিয়াত নেই,কোন মজা ও স্বাদ নেই। যদি নামাজের স্বাদ পেতো, তাহলে তো নামাজের ধরন ভিন্ন হতো। সে নামাজের জন্য আগে আগে আসতো। কাজেই আমরা যে ইবাদতই করিনা কেন, তা অত্যন্ত আন্তরিকতা ও অনুভূতির সাথে, বিশেষ তাওয়াজ্জু ও মনোনিবেশের সাথে করবো। যেমন ওযু করার সময় নিজের গুনাহ ঝরে যাওয়ার অনুভূতি, সেজদাহরত অবস্থায় মহান স্রষ্টার বিশেষ দৃষ্টির অনুভূতি। তাহলে আমরা ইবাদতের স্বাদ পাবো। আবারো বলবো, ইলম অর্জন, আমলের প্রতি মনোনিবেশ, উস্তাদের প্রতি মহব্বত, সময়ের কদর ও কিতাবের ওপর মেহনত আজ থেকে শুরু করবে। কালকের জন্য অপেক্ষা করবো না। শয়তান এটা ধোঁকা দেয় যে আজকে থাক, কাল থেকে শুরু করব। কারণ আগামীকাল বলতে কোন দিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আগামীকাল যখন এসে যায়,তখন সেটাও আজকে হয়ে যায়, আর আগামীকাল থাকে না।
ভালো কাজের আগ্রহ আল্লাহর পক্ষ থেকে মেহমান
মনে রাখবে, ভালো কাজের আগ্রহ; এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মেহমান। আর খারাপ কাজের আগ্রহ; সেটা শয়তানের পক্ষ থেকে ওয়াসওয়াসা-কুমন্ত্রণা। আর মেহমানকে কদর করতে হয়। ভালো কাজের আগ্রহ নামক মেহমান একবার আসে, দুইবার আসে,তিনবার আসে; কিন্তু আমরা গাফেল থাকি। মেহমানকে কদর না করলে, বা তাড়িয়ে দিলে; সে মেহমান আর কোনদিন এই মেজবানের বাড়িতে আসে না। কারণ এর আগে বহুবার তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য বলব, আমাদের প্রতিটা মিনিট যেন কাজে লাগে সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। হয়তো অধ্যয়ন, না হয় ইবাদত, না হয় ঘুম। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাও, শেষ রাতে তাহাজ্জুদের সুযোগ হবে। ফলে আল্লাহ তাআলার দরবারে কান্নাকাটি করার তওফিক হবে। আর তখন আল্লাহর কাছে নিজের যাবতীয় দুর্বলতা প্রকাশ করবে। তাহলে আল্লাহ তাআলা খুশি হবেন। এই সমস্ত মাদরাসাগুলো চলে চোখের পানিতে। আল্লাহ তাআলা যদি আমাদের ওপর সন্তুষ্টি হন, তাহলে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস সবকিছুর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর যদি আল্লাহ আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হন, আমরা আল্লাহর কাছে চাইলেও প্রয়োজনের জিনিস পাবোনা। এজন্য আমরা সবাই আল্লাহকে রাযি করার চেষ্টা করব। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে আলোচিত কথাগুলোর ওপর আমল করার তওফিক দান করুন। আমীন। وَآخَرُ دَعْوَانَا أَنِ الْـحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَـمِيْنَ।