আত্মহত্যা ও আমাদের সমাজব্যবস্থা
আবিদুর রহমান তালুকদার
সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন ব্যবসায়ী ফেইসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করে। সিনেমার মতো অশ্লীল কাজে জড়িত একজন পরিচিত ব্যক্তির নিকটাত্মীয় হওয়ার সুবাদে এই অপমৃত্যু মিডিয়ার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়। আত্মহত্যার জন্য প্রকাশ্যে কাউকে দোষারোপ না করলেও পরিবার-পরিজনের প্রতি পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, ধারাবাহিক নিঃসঙ্গতা, বিশ্বস্ত বন্ধু-বান্ধবদের প্রতারণা, ব্যবসায় লোকসানসহ বিভিন্ন কারণে তিনি আত্মহননের পথ বেঁচে নেন। সাধারণত ডিপ্রেশন, দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক অশান্তি, মানসিক আঘাত, দারিদ্র ও বেকারত্বকে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলত ধর্মীয় ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে সুশিক্ষার অভাব, জীবনদর্শন সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা, বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও ভোগবাদী সমাজব্যবস্থাই আত্মহত্যার প্রধান কারণ। নিম্নে আত্মহত্যাকে আমাদের সমাজব্যবস্থার আলোকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে।
কোনো ব্যক্তি কর্তৃক নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা বা আত্মহনন (Suicide) বলে। আত্মহত্যার চেষ্টাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে মানসিক অবসাদজনিত গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যা একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ মতে প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে আত্মহত্যার অবস্থান সেগুলোর মধ্যে ত্রয়োদশ। নারীর তুলনায় পুরুষের আত্মহত্যার হার তিন থেকে চারগুণ বেশি। বাংলাদেশ একটি আত্মহত্যাপ্রবণ দেশ। সর্বাধিক আত্মহত্যার দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৩ তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দশম।
সকল ধর্মেই আত্মহত্যা পাপ, আর ইসলামে মহাপাপ। এ বিষয়ে অবগত নয় এমন ধার্মিক খুঁজে পাওয়া গোটা পৃথিবীতে দুষ্কর। ইসলামি জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাবে ধর্মীয় অনুশাসন পালনকারী অনেক ব্যক্তিকে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। দীনের সঠিক জ্ঞানের বদৌলতে কোনো আলেমের আত্মহত্যার খবর অদ্যাবধি শোনা যায়নি। মূলত ধর্মীয় জ্ঞানে অস্বচ্ছতা ও স্বচ্ছতার খোলসে অজ্ঞতার কারণেই মানুষ অধর্ম করে। ইসলাম আত্মহত্যাকে পাপ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হয়নি। মৃত্যু কামনাকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
«لَا يَتَمَنَّيَنَّ أَحَدُكُمُ الْـمَوْتَ مِنْ ضُرٍّ أَصَابَهُ، فَإِنْ كَانَ لَا بُدَّ فَاعِلًا فَلْيَقُلِ: اللّٰهُمَّ أَحْيِنِيْ مَا كَانَتِ الْـحَيَاةُ خَيْرًا لِّيْ، وَتَوَفَّنِيْ إِذَا كَانَتِ الْوَفَاةُ خَيْرًا لِّيْ».
‘বিপদ যতই ঘনিভূত হোক তোমাদের মধ্যে কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে। একান্ত অপারগ হলে এতটুকু বলতে পারে, হে আল্লাহ! আমার জন্য হায়াত কল্যাণকর হলে হায়াত দান করুন। আর মৃত্যু মঙ্গলজনক হলে মৃত্যু দান করুন।’[1]
সৃষ্টিকুলের সবকিছুর নিরঙ্কুশ মালিকানা একমাত্র আল্লাহ তাআলার। জান-মাল আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার নিকট আমানতস্বরূপ। মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেভাবে বান্দার জন্য জায়েয নয়। সম্পদ নষ্ট করা ও অপচয় করাও অন্যায্য ও অবৈধ। জিন-ইনসানকে আল্লাহর নেয়ামতসমূহের ব্যবহার করার অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, নষ্ট ও অপচয় করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ইসলামে ইবাদতের ক্ষেত্রেও আল্লাহর দেয়া সম্পদের অপচয় করার কোনো সুযোগ নেই। অজু করার সময় প্রতিটি অঙ্গ একবার ধোয়া ফরজ। তিনবার ধোয়া সুন্নত। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর চতুর্থবার ধোয়া মকরুহ।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। দুঃখজনকভাবে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামের মৌলিক বিষয়ে ধারণা লাভ করার কোনো সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে আমাদের সমাজব্যবস্থায় এমন কিছু আইন, কুসংসকার ও রীতি-নীতি প্রচলিত রয়েছে যা মানুষকে আত্মহত্যার প্রতি ধাবিত করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যার কারণসমূহ নিম্নরূপ:
তকদীরের প্রতি বিশ্বাসের শিথিলতা
বান্দার জন্য অবধারিত আল্লাহর ফয়সলা ও সিদ্ধান্তকে তকদীর বলে। তকদীরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজে আইন। হায়াত-মউত, ধন-দৌলত ও ইজ্জত-আবরুসহ সৃষ্টিজীবের অনেক বিষয় আল্লাহর ফয়সলায় নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে সীমাতিরিক্ত কর্মপ্রয়াস অকার্যকর হিসেবে প্রমাণিত। সৃষ্টির অনেক পূর্বে রিজিক বরাদ্দ করে মানুষকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব ও আশরাফ-আতরাফ তকদীরের ফয়সলা। মানবসমাজে পরিদৃষ্ট শ্রেণিবৈষম্য ও ভেদাভেদ আল্লাহর কুদরতের কারিশমা। বিশ্বের শৃঙ্খলা বিধানে এটিই আল্লাহর চিরাচরিত নিয়ম। শ্রেণিবিভাজনের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষকে প্রতিনিয়ত পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। তকদীরের প্রতি বান্দার বিশ্বাসের শিথিলতা আত্মহত্যার প্রধান কারণ। তকদীরের ফয়সলা হিসেবে সুখ-শান্তি ও দুঃখ-দুর্দশা উভয়টিই মুমিনের জন্য সমান কল্যাণকর। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
«عَجَبًا لِأَمْرِ الْـمُؤْمِنِ، إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ».
‘মুমিনের জন্য বড় আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তার প্রতিটি কাজই কল্যাণকর। এ বৈশিষ্ট্য একমাত্র মুমিনের মধ্যেই পাওয়া যায়। সে নেয়ামত লাভ করলে শোকর আদায় করে। সুতরাং এটি তার জন্য মঙ্গলজনক হয়। বিপদাক্রান্ত হলে সবর করে। এটিও তার জন্য কল্যাণ ডেকে আনে।’[2]
তকদীরে বিশ্বাস স্থাপনকারী ব্যক্তি কখনো বিপদাপদে মুষড়ে পড়ে না। এটিকে তারা আল্লাহর নির্ধারিত সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিয়ে সবর এখতিয়ার করে এবং তাঁর ফয়সলার ওপর সন্তোষ প্রকাশ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَاۤ اَصَابَ مِنْ مُّصِيْبَةٍ فِي الْاَرْضِ وَلَا فِيْۤ اَنْفُسِكُمْ اِلَّا فِيْ كِتٰبٍ مِّنْ قَبْلِ اَنْ نَّبْرَاَهَا١ؕ اِنَّ ذٰلِكَ عَلَى اللّٰهِ يَسِيْرٌۚۖ۰۰۲۲ لِّكَيْلَا تَاْسَوْا عَلٰى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوْا بِمَاۤ اٰتٰىكُمْ١ؕ وَاللّٰهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرِۙ۰۰۲۳
‘পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর যে বিপদাপদ পতিত হয়, তার মধ্যে এমন কোনো বালা-মুসিবত নেই, যা সেই সময় থেকে এই কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই, যখন আমি সেই প্রাণসমূহ সৃষ্টিও করিনি। নিশ্চয় এটি আল্লাহর জন্য সহজ। যাতে তোমরা হারানো বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ না করো এবং আল্লাহ যা দান করেছেন তার জন্য উল্লসিতও না হও। বস্তুত আল্লাহ উদ্ধত ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’[3]
মুমিন যাতে বিপদাপদে ধৈর্যহারা না হয়, সেজন্য আল-কুরআনে বান্দাকে পূর্ব থেকেই এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে যে, ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَاۤ اَصَابَ مِنْ مُّصِيْبَةٍ اِلَّا بِاِذْنِ اللّٰهِ١ؕ وَمَنْ يُّؤْمِنْۢ بِاللّٰهِ يَهْدِ قَلْبَهٗ١ؕ وَاللّٰهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ۰۰۱۱
‘কোনো বিপদই আল্লাহর হুকুম ছাড়া আসে না। যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আল্লাহ তার অন্তরকে হেদায়ত দান করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞাত।’[4]
হতাশা ও আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ্য
বিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণু আল্লাহর রহমতের বদৌলতেই টিকে থাকে। সৃষ্টিজগতের কোনো বস্তুর ওপর থেকে আল্লাহর রহমত উঠে গেলে তার অস্তিত্ব বিনাশ হয়। আল্লাহর রহমতের কারণেই মানুষ বিশ্বজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে জীবনের প্রতি হতাশার কারণেই মানুষ আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়। এ ধরনের নৈরাশ্য প্রকাশ্য গোমরাহি ও স্পষ্ট কুফরি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
قَالَ وَمَنْ يَّقْنَطُ مِنْ رَّحْمَةِ رَبِّهٖۤ اِلَّا الضَّآلُّوْنَ۰۰۵۶
‘পথভ্রষ্টরাই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়।’[5]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
قُلْ يٰعِبَادِيَ الَّذِيْنَ اَسْرَفُوْا عَلٰۤى اَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللّٰهِ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا١ؕ اِنَّهٗ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ۰۰۵۳
‘বলুন! হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ বান্দার গুনাহসমূহ মার্জনা করেন।’[6]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়াকে কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত করে বলেন।
«أَكْبَرُ الْكَبَائِرِ: الْإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَالْأَمْنُ مِنْ مَكْرِ اللهِ، وَالْقَنُوطُ مِنْ رَحْمَةِ اللهِ، وَالْيَأْسُ مِنْ رَوْحِ اللهِ».
‘সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, আল্লাহর শাস্তি থেকে নির্ভয় থাকা ও তাঁর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া।’[7]
সুসময়ে উৎফুল্ল হওয়া ও বিপদাপদে ভেঙে পড়া কাফের-মুশরিকের বৈশিষ্ট্য। সুখ-দুঃখ সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ঠ থাকাই মুমিনের পরিচয়। কাফেরদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاِذَاۤ اَذَقْنَا النَّاسَ رَحْمَةً فَرِحُوْا بِهَا١ؕ وَاِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌۢ بِمَا قَدَّمَتْ اَيْدِيْهِمْ اِذَا هُمْ يَقْنَطُوْنَ۰۰۳۶
‘আমি যখন তাদেরকে আমার রহমত আস্বাদন করাই তারা আনন্দ প্রকাশ করে। আর যখন তাদের পাপের কারণে কোনো বিপদে পতিত হয়, নিরাশ হয়ে পড়ে।’[8]
আল্লাহর রহমতের বিশালতা ও অনুগ্রহের প্রশস্থতা প্রসঙ্গে রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
«إِنَّ اللهَ خَلَقَ الرَّحْمَةَ يَوْمَ خَلَقَهَا مِائَةَ رَحْمَةٍ، فَأَمْسَكَ عِنْدَهُ تِسْعًا وَتِسْعِيْنَ رَحْمَةً، وَأَرْسَلَ فِيْ خَلْقِهِ كُلِّهِمْ رَحْمَةً وَاحِدَةً، فَلَوْ يَعْلَمُ الْكَافِرُ بِكُلِّ الَّذِي عِنْدَ اللهِ مِنَ الرَّحْمَةِ، لَـمْ يَيْئَسْ مِنَ الْـجَنَّةِ، وَلَوْ يَعْلَمُ الْـمُؤْمِنُ بِكُلِّ الَّذِيْ عِنْدَ اللهِ مِنَ الْعَذَابِ، لَـمْ يَأْمَنْ مِنَ النَّارِ».
‘আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সূচনায় একশটি রহমত সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিরানব্বইটি রহমত নিজের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত রাখেন। সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য বরাদ্দ করেন একটিমাত্র রহমত। কাফেরগণ আল্লাহর রহমতের এই প্রশস্ততা সম্পর্কে জানতে পারলে কখনো জান্নাত থেকে নিরাশ হতো না। মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর আজাবের কঠিনতার ব্যাপারে অবগত হলে জাহান্নাম থেকে নির্ভয় হতে পারতো না।’[9]
পার্থিব সমস্যা মানুষের দৃষ্টিতে যতই দুঃসাধ্য বিবেচিত হোক, প্রয়োজনের মুহূর্তে আল্লাহর সাহায্য ততই নিকটে। আল্লাহর রহমতের ওপর আস্থা রাখার কারণে তাঁর সাহায্য লাভের হাজারো ঘটনা কুরআন-হাদীসে বর্ণিত আছে। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ঘটনাসমূহ স্মরণ থাকলে বিপদাপদে ধৈর্য ধারণের শক্তি লাভ করা যায় এবং আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে মুক্তি লাভে সহায়তা পাওয়া যায়।
সন্তানকে দীনি শিক্ষা দান
সন্তান দাম্পত্য জীবনে পরিপূর্ণ আনন্দের অন্যতম উপলক্ষ। সন্তান একটি সুখী পরিবারের সৌন্দর্য বহুগুণ বর্ধন করে। ধন-সম্পদ ব্যতীত যেভাবে মাবন জীবন সমৃদ্ধ হয় না, তেমনিভাবে সন্তানহীন দাম্পত্য জীবনও স্বাচ্ছন্দ্যকর হয় না। অনুগত সন্তান পিতা-মাতার জীবনের শোভনীয় অংশ। আর অবাধ্য সন্তান পরিবারের অশান্তির অন্যতম কারণ। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اِنَّ مِنْ اَزْوَاجِكُمْ وَاَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَّكُمْ فَاحْذَرُوْهُمْۚ ۰۰۱۴
‘হে ঈমানদারগণ! কিছু কিছু স্ত্রী-সন্তান তোমাদের শত্রুসমতুল্য। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সতর্ক হও।’[10]
অন্যত্র বলা হয়েছে,
اِنَّمَاۤ اَمْوَالُكُمْ وَاَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌؕ ۰۰۱۵
‘কিছু ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন তোমাদের জন্য পরীক্ষার বস্তু।’[11]
ইসলামের মৌলিক বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ। তাওহীদের শিক্ষাই মানব জীবনের প্রথম ও প্রধান শিক্ষা। এ শিক্ষার পাশাপাশি মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণের বিষয়টি সংযুক্ত করে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَضٰى رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ۠ اِحْسَانًاؕ ۰۰۲۳
‘তোমাদের রব এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন যে, আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করো না এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণ করো।’[12]
ইসলাম পিতা-মাতার ওপর সন্তানের কিছু অধিকার বিধিবদ্ধ করে দিয়েছে। এ দায়িত্বের কথা স্মরণপূর্বক আল্লাহ তাআলা বলেন,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَارًا ۰۰۶
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো।’[13]
পরিবার-পরিজনকে দুনিয়া-আখিরাতের সব ধরনের বিপদাপদ থেকে রক্ষা করার প্রধান হাতিয়ার হল দীনি শিক্ষা। এ বিষয়টি যত দ্রুত মানুষের বোধগম্য হবে পারিবারিক শান্তি ও সমৃদ্ধি ততই ত্বরান্বিত হবে। দীনি শিক্ষার বিপরীতে যারা পার্থিব শিক্ষাকে উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে, তারা দুনিয়া-আখিরাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দীনের সঠিক জ্ঞানে অনুপ্রাণিত ব্যক্তি কখনো মাতা-পিতাকে অবহেল করতে পারে না। উম্মতের গৌরবদ্বীপ্ত এ প্রজন্মের দীনি শিক্ষার সূচনা হয় শৈশবকাল থেকে। এ সময় থেকে তাদেরকে আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তোলা পিতা-মাতার একান্ত কর্তব্য।
সন্তানের সংখাধিক্য
ইহজীবনের শান্তি ও পরকালের কল্যাণে সন্তানের ভূমিকা অপরিসীম। আল্লাহ তাআলা বলেন,
اَلْمَالُ وَالْبَنُوْنَ زِيْنَةُ الْحَيٰوةِ الدُّنْيَاۚ ۰۰۴۶
‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি ইহকালীন জীবনের শোভনীয় বস্তু।’[14]
পিতা-মাতার মৃত্যুর পর দুনিয়ায় সুসন্তান রেখে গেলে নেক আমলের একটি ধারা চলমান থাকে। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
«إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ، انْقَطَعَ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثٍ: عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ صَدَقَةٍ تَجْرِيْ لَهُ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ».
‘আদম সন্তানের মৃত্যুর পর সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি কর্মের সওয়াব অব্যাহত থাকে। সদকায়ে জারিয়া। উপকারী ইলম। নেককার সন্তান, যারা পিতা-মাতার জন্য দোয়া করে।’[15]
সন্তানের সংখ্যা বেশি হলে পুণ্যের ধারা যেভাবে বর্ধিত হয়, দুনিয়ার জীবনেও তারা বহুমুখী অবদান রাখতে সক্ষম হয়। অধিক সন্তান লাভ করার নিমিত্তে রসুল (সা.) পুরুষদের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে এমন নারীদের বিয়ে করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন, যারা অধিক সন্তান জন্মদানে সক্ষম। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
«تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُوْدَ فَإِنِّيْ مُكَاثِرٌ بِكُمُ الْأُمَمَ».
‘তোমরা মায়াবতী ও অধিক সন্তান জন্মদানকারী নারীদের বিয়ে করো। কেননা কিয়ামতের দিন আমি উম্মতের সংখাধিক্যের কারণে গর্ব করবো।’[16]
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাযি.)-এর জন্য রসুল (সা.) সম্পদের প্রাচুর্য ও অধিক সন্তানের দোয়া করেন, ইমাম বুখারী বরকতসহ অধিক সন্তানের জন্য দোয়া নামে একটি শিরোনামে কায়েম করেছেন (بَابُ الدُّعَاءِ بِكَثْرةِ الْوَلَدِ مَعَ الْبَرَكةِ)। হযরত আনাস (রাযি.) বলেন, আমার মা রসুল (সা.)-এর নিকট আমার জন্য অধিক সম্পদ ও সন্তানের দোয়া করার আবেদন করেন, তিনি এই মর্মে দোয়া করেন,
«اللّٰهُمَّ أَكْثِرْ مَالَهُ وَوَلَدَهُ، وَبَارِكْ لَهُ فِيْمَا أَعْطَيْتَهُ».
‘হে আল্লাহ! তার সন্তান ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করুন এবং আপনার দেওয়া নেয়ামতে বরকত দান করুন।’[17]
অধিক সন্তান থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় রসুল (সা.) বন্ধ্যা নারীদের বিয়ে করতে নিরুৎসাহিত করেন। হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার (রাযি.) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রসুল (সা.)-এর নিকট এসে বললেন,
إِنِّيْ أَصَبْتُ امْرَأَةً ذَاتَ حَسَبٍ وَجَمَالٍ، وَإِنَّهَا لَا تَلِدُ، أَفَأَتَزَوَّجُهَا، قَالَ: «لَا»، ثُمَّ أَتَاهُ الثَّانِيَةَ فَنَهَاهُ، ثُمَّ أَتَاهُ الثَّالِثَةَ، فَقَالَ: «تَزَوَّجُوا الْوَدُوْدَ الْوَلُوْدَ، فَإِنِّيْ مُكَاثِرٌ بِكُمُ الْأُمَمَ».
‘হে আল্লাহর রসুল! আমি একজন বংশমর্যাদাসম্পন্ন ও সুদর্শন নারীকে মহব্বত করি, যে সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। আমি কি তাকে বিয়ে করতে পারি? রসুল (সা.) বললেন, ‘না।’ লোকটির দ্বিতীয়বারের আবেদনেও তিনি না বললেন। তৃতীয়বার আবেদন করার পর তিনি বললেন, ‘তোমরা মায়াবতী ও অধিক সন্তান জন্মদানকারী নারীদের বিয়ে করো। কেননা কিয়ামতের দিন আমি উম্মতের সংখাধিক্যের কারণে গর্ব করবো।”[18]
তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির সুবাদে লেখা-পড়া, চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানাবিধ প্রয়োজনে মানুষের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অনেককে ভিনদেশে স্থায়ীভাবে নিবাস গ্রহণ করতে হয়। এ অবস্থায় দেশে অবস্থানরত মাতাপিতার সেবা-যত্ন করা সন্তানের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। একাধিক সন্তান থাকলে কেউ না কেউ মাতা-পিতার সেবাদানে নিজেকে ধন্য করার সুযোগ লাভ করে।
একাধিক বিয়ে
ইসলাম মানবতার কল্যাণে এমন কিছু বিধি-বিধান প্রণয়ন করেছে, যা অত্যন্ত বাস্তবানুগ ও সময়োপযোগী। একাধিক বিয়ের বিধান একটি বিজ্ঞানসম্মত ও সময়োচিত আইন। প্রয়োজনের মুহূর্তে এবং শর্তসাপেক্ষে ইসলাম পুরুষের জন্য একাধিক বিয়ের অনুমতি দিয়েছে। নারীর সংখ্যাধিক্য, বিপদাপদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে পুরুষ সদস্যের মৃত্যু, নারীর স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বন্ধাত্ম ও কিছু পুরুষের একাধিক নারীর প্রয়োজনীয়তার কারণে ইসলাম একাধিক বিয়ের অনুমোদন দিয়েছে। ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই বহু বিবাহের প্রচলন থাকলেও এতে কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম ছিল না। ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়ের স্বার্থ বিবেচনায় স্ত্রীর সংখ্যা নির্ধারণপূর্বক প্রয়োজনীয় বিধি-নিষেধও আরোপ করেছে। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
عَنْ سَالِـمٍ، عَنْ أَبِيْهِ، أَنَّ غَيْلَانَ بْنَ سَلَمَةَ الثَّقَفِيَّ: أَسْلَمَ وَتَحْتَهُ عَشْرُ نِسْوَةٍ، فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ ﷺ: «اخْتَرْ مِنْهُنَّ أَرْبَعًا»، فَلَمَّا كَانَ فِيْ عَهْدِ عُمَرَ طَلَّقَ نِسَاءَهُ، وَقَسَمَ مَالَهُ بَيْنَ بَنِيْهِ، فَبَلَغَ ذَلِكَ عُمَرَ، فَقَالَ: «إِنِّيْ لَأَظُنُّ الشَّيْطَانَ فِيمَا يَسْتَرِقُ مِنَ السَّمْعِ سَمِعَ بِمَوْتِكَ، فَقَذَفَهُ فِيْ نَفْسِكَ، وَلَعَلَّكَ أَنْ لَا تَمْكُثَ إِلَّا قَلِيْلًا، وَايْمُ اللهِ، لَتُرَاجِعَنَّ نِسَاءَكَ، وَلَتَرْجِعَنَّ فِيْ مَالِكَ، أَوْ لَأُوَرِّثُهُنَّ مِنْكَ، وَلَآمُرَنَّ بِقَبْرِكَ فَيُرْجَمُ كَمَا رُجِمَ قَبْرُ أَبِيْ رِغَالٍ».
‘গায়লান ইবনে সালামা আল-সাকাফীর ইসলাম গ্রহণের সময় তার অধীনে ১০জন স্ত্রী ছিল। রসুল (সা.) তাঁকে বললেন, ‘তুমি স্ত্রী হিসেবে মাত্র চারজনকে বাছাই করতে পারো।’ হযরত ওমর (রাযি.)-এর খেলাফতকালে গায়লান তাঁর স্ত্রীদের তালাক দিয়ে যাবতীয় সম্পদ সন্তানদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়। হযরত ওমর (রাযি.)-এর নিকট খবরটি পৌঁছার পর তিনি বললেন, ‘শয়তানের গোপন অনুসন্ধানে সম্ভবত তোমার মৃত্যুর খবর ধরা পড়েছে। সে তোমার নিকট এ সংবাদ পৌঁছে দিয়েছে যে, তুমি হয়তো বেশি দিন বাঁচবে না। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, অবশ্যই স্ত্রীগণ তোমার নিকট ফিরে আসবে এবং তোমার সম্পদের মালিক হবে অথবা তিনি বলেছেন যে, আমি তাদেরকে তোমার সম্পদের উত্তরাধিকার করে দেবো। আবু রেগালের সমাধিতে যেভাবে প্রস্তরাঘাত করা হয়েছিল, তোমার কবরেও অনুরূপ রজম করা হবে।”[19]
ইসলাম চারজন নারীকে একসঙ্গে বিয়ে করার সীমারেখা নির্ধারণ করে তাদের মধ্যে ন্যায়বিচারের শর্ত আরোপ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاِنْ خِفْتُمْ اَلَّا تُقْسِطُوْا فِي الْيَتٰمٰى فَانْكِحُوْا مَا طَابَ لَكُمْ مِّنَ النِّسَآءِ مَثْنٰى وَثُلٰثَ وَرُبٰعَ١ۚ فَاِنْ خِفْتُمْ اَلَّا تَعْدِلُوْا فَوَاحِدَةً اَوْ مَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ١ؕ ذٰلِكَ اَدْنٰۤى اَلَّا تَعُوْلُوْاؕ۰۰۳
‘তোমরা যদি এতিমদের মধ্যে ন্যায়বিচার করার ব্যাপারে আশঙ্কা করো, তবে দুই, তিন ও চারজন স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারো। আর যদি তাদের প্রতি সুবিচার করার ব্যাপারে আশঙ্কা করো, তবে একটিমাত্র বিয়ে করবে। অথবা অধিকারভুক্ত দাসীদের নিয়ে ক্ষান্ত থাকবে। এতে পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভাবনা অধিক।’[20]
এস্তেগফার
ডিপ্রেশন বা অবসাদ একটি মানসিক রোগ। এটি এখন বৈশ্বিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। অবসন্নতা ও হতাশার কারণে মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতা হ্রাস পায়। এটি মানুষের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ মতে পৃথিবীর ৩০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ এ সমস্যায় আক্রান্ত। এক গবেষণায় দেখা যায়, ১০ ভাগের বেশি আমেরিকান ডিপ্রেশনের মতো মানসিক রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশের মতো নিম্নবিত্তের দেশের মানুষ এখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এ সমস্যা জটিল আকার ধারণ করলে অনেক মানুষ আত্মহত্যা করে মুক্তি পেতে চায়। উপরে বর্ণিত আত্মহত্যার কারণসমূহ ও কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে এ রোগ সৃষ্টি হতে পারে। মানবজীবনের সর্বস্তরে সুন্নাহর আমল এ সমস্যা থেকে মুক্তির প্রধান উপায়। দুশ্চিন্তা ও অবসাদগ্রস্থ ব্যক্তির সামনে পুরো পৃথিবী অন্ধকার দেখায়। আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হওয়া ও দুনিয়ার প্রতি অধিক মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ার কারণে বান্দার জন্য গোটা পৃথিবী সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَنْ اَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِيْ فَاِنَّ لَهٗ مَعِيْشَةً ضَنْكًا وَّنَحْشُرُهٗ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ اَعْمٰى ۰۰۱۲۴ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِيْۤ اَعْمٰى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا۰۰۱۲۵ قَالَ كَذٰلِكَ اَتَتْكَ اٰيٰتُنَا فَنَسِيْتَهَا١ۚ وَكَذٰلِكَ الْيَوْمَ تُنْسٰى۰۰۱۲۶
‘যে আমার স্মরণ থেকে গাফেল থাকবে তার জীবন সংকটময় হয়ে পড়বে। কিয়ামতের দিন আমি তার হাশর করবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে অন্ধ অবস্থায় কেন উঠালেন? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন, এভাবেই তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আজ সেভাবেই তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে।’[21]
কুরআন-সুন্নাহর বিভিন্ন জায়গায় এ রোগের অব্যর্থ চিকিৎসার কথা বর্ণিত আছে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) একদিন মসজিদে প্রবেশ করে আবু উমামা নামক একজন আনসারি ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন। রসুল (সা.) তাকে বললেন, তুমি অসময়ে মসজিদে বসে আছো কেন? আবু উমামা উত্তর দিল, হে আল্লাহর রসুল! ঋণ আমাকে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। রসুল (সা.) বললেন, আমি কি তোমাকে এমন একটি বাক্য শিখিয়ে দেবো? যা পাঠ করলে আল্লাহ তাআলা তোমার দুশ্চিন্তা দূর করে দেবেন এবং তোমার ঋণ শোধের ব্যবস্থা করবেন। লোকটি বলল, অবশ্যই। রসুল (সা.) বললেন, তুমি সকাল সন্ধ্যা এই দোয়া পাঠ করবে।
«اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْـهَمِّ وَالْـحَزَنِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْـجُبْنِ وَالْبُخْلِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ غَلَبَةِ الدَّيْنِ، وَقَهْرِ الرِّجَالِ».
‘লোকটি বলল, রসুল (সা.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী আমি দোয়াটি পড়তে লাগলাম। ফলে আল্লাহ তাআলা আমার দুশ্চিন্তা দূর করে দিলেন এবং ঋণও পরিশোধ হয়ে গেলো।’[22]
বান্দা আল্লাহর নাফরমানি থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে সে পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে বান্দার দায়িত্ব হল, পাপ সংঘটিত হওয়ার পর তৎক্ষণাৎ আল্লাহর নিকট পাপমুক্তির প্রার্থনা করা। তাওবা করার মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয়ে গেলে বান্দার আত্মা প্রশান্তি লাভ করে এবং দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে মুক্তি লাভ করে। দুশ্চিন্তা ও অবসাদ থেকে মুক্তির একটি কার্যকর উপায় হল অধিকহারে এস্তেগফার করা বা আল্লাহর নিকট নিজের গুনাহ মার্জনার প্রার্থনা করা। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
«مَنْ لَزِمَ الْاِسْتِغْفَارَ، جَعَلَ اللهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيْقٍ مَخْرَجًا، وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا، وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ».
‘যে ব্যক্তি নিয়মিত এস্তেগফার করে আল্লাহ তাআলা তাকে সকল প্রকার সংকট থেকে উদ্ধার করবেন। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দান করবেন এবং এমন রিজিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করেনি।’[23]
[1] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৭, পৃ. ১২১, হাদীস: ৫৬৭১
[2] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৪ হি. = ১৯৫৫ খ্রি.), খ. ৪, পৃ. ২২৯৫, হাদীস: ২৯৯৯
[3] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-হাদীদ, ৫৭:২২-২৩
[4] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আত-তাগাবুন, ৬৪:১১
[5] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-হিজর, ১৫:৫৬
[6] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আয-যুমার, ৩৯:৫৩
[7] আত-তাবারানী, আল-মু’জামুল কবীর, মাকতাবাতু ইবনে তায়মিয়া, কায়রো, মিসর (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪০৪ হি. = ১৯৮৩ খ্রি.), খ. ৯, পৃ. ১৫৬, হাদীস: ৮৭৮৪
[8] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আর-রূম, ৩০:৩৬
[9] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৮, পৃ. ৯৯, হাদীস: ৬৪৬৯
[10] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আত-তাগাবুন, ৬৪:১৪
[11] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আত-তাগাবুন, ৬৪:১৫
[12] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-ইসরা, ১৭:২৩
[13] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আত-তাহরীব, ৬৬:৬
[14] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-কাহফ, ১৮:৪৬
[15] আদ-দারিমী, আস-সুনান = আল-মুসনাদ, দারুল মুগনী লিন-নাশর ওয়াত তাওযী’, রিয়াদ, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০০ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৪৬২, হাদীস: ৫৭৮
[16] আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ২, পৃ. ২২০, হাদীস: ২০৫০
[17] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৮, পৃ. ৮১, হাদীস: ৬৩৭৮-৬৩৮১
[18] আবু দাউদ, আস-সুনান, খ. ২, পৃ. ২২০, হাদীস: ২০৫০
[19] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনাদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত-তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৮, পৃ. ২৫১-২৫২, হাদীস: ৪৬৩১
[20] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নিসা, ৪:৩
[21] আল-কুরআনুল করীম, সূরা তাহা, ২০:১২৪-১২৬
[22] আবু দাউদ, আস-সুনান, খ. ২, পৃ. ৯৩, হাদীস: ১৫৫৫
[23] আবু দাউদ, আস-সুনান, খ. ৩, পৃ. ৮৫, হাদীস: ১৫১৮