জামেয়া ওয়েবসাইট

বুধবার-৯ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৮শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমার দৃষ্টিতে আল্লামা ড. ইউসুফ কারযাভী

আমার দৃষ্টিতে আল্লামা ড. ইউসুফ কারযাভী

মূল: সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)

ভাষান্তর: সাঈদ হোসাইন

আমাদের প্রিয় ভাই শায়খ ড. ইউসুফ কারযাভী আজ মুসলিমবিশ্বের একজন শীর্ষসারির আলেম ও মুখলিস মুরুব্বি। মুসলিমবিশ্বের ইলমি ও দাওয়াতি কর্মতৎপরতা সম্পর্কে সচেতন এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও বিশ্বময় দওয়াতি তৎপরতার ক্ষেত্রে তাঁর মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানকে অকপটে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। ইসলামি চেতনাসমৃদ্ধ ও ইলমি গবেষণামূলক মূল্যবান রচনাবলির মাধ্যমে তিনি আধুনিক ইসলামি লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করেছেন। ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য লিখিত তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ‘ফিকহুয যাকাত’ থেকে শুরু করে একেবারে শেষ গ্রন্থটি পর্যন্ত এর জ্বলন্ত প্রমাণ। উম্মাহর তারবিয়াত ও সজাগকরণের কাজে তিনি ক্লান্তিহীন-শ্রান্তিহীন। আর শিক্ষা ও দাওয়াতি কর্মতৎপরতায় তিনি চিরউৎসর্গিত। তাঁর এই বিশাল কর্মযজ্ঞ মুসলিম উম্মাহর জন্য মহা কল্যাণ বয়ে আনছে। উম্মাহর যুবসম্প্রদায়ের মাঝে চিন্তা-চেতনা ও দীনের ব্যাপক বোধ ও সূক্ষ্ম অনুভূতি সৃষ্টি এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকা প্রশংসনীয়। ইসলামি কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন। দীনের সহিহ বুঝ ও মুসলিমবিশ্বের সমকালীন পরিস্থিতির সূক্ষ্ম উপলব্ধির মাঝে তিনি সম্মিলন ঘটানোর প্রয়াস পান।

ড. কারযাভী জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় আল-আযহারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিসন্তান। আরববিশ্বে এটি ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র। যুগে যুগে উম্মতের শ্রেষ্ঠ আলেম, দাঈ, বুজুর্গ ও মনীষীগণ এখানে পড়াশোনা করেছেন। আরব দুনিয়ায় দীন-ইসলামের হেফাজত ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অসামান্য। শায়খ কারযাভী ইসলামি জ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পর তারবিয়াত ও দাওয়াতি ক্ষেত্রে শায়খ হাসান আল-বান্না (রহ.)-এর চিন্তাধারা গ্রহণ করেন। উম্মাহর সংস্কার ও জাগরণের জন্য শায়খ বান্নার রূপরেখাটি ছিল পরিপূর্ণ ও যথাযথ। তাঁর সঙ্গে দুটি দলের সম্পৃক্ততা ছিল খুব বেশি। এক দল হল অভিজ্ঞ মুসলিম স্কলার, আরেক দল হল আধুনিক শিক্ষিতসমাজ। বর্তমানের এই আধুনিক সময়ে এ দু-দলের সম্মিলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শায়খ বান্নার চিন্তা-দর্শন ছিল এককথায়—উপকারী যেকোনো প্রাচীন বিষয় থেকে উপকৃত হওয়া এবং ভালো ও উপযোগী হলে যে কোন নতুন বিষয়কে স্বাগত জানানো। শায়খ কারযাভী এক্ষেত্রে তাঁর কাছ থেকে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছেন। দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মাঝে তিনি যথাসাধ্য ইসলামকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে পরিতৃপ্ত করার চেষ্টা করেছেন।

শায়খ কারযাভী সংকটময় মুহূর্তে যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ শায়খ বান্নার এ চিন্তা-দর্শনকে ধারণ করে কাজ শুরু করেন। সেসময় পাশ্চাত্য সভ্যতা মধ্যপ্রাচ্যে তীব্রভাবে আঘাত হানে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ সভ্যতার রঙ-ঢঙে রঞ্জিত হয়। আর দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণ শক্তি ও হিম্মত হারিয়ে ফেলে। এভাবে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি পাশ্চাত্যের পূর্ণ আনুসারী, আরেকটি স্বকীয় সত্তা হারিয়ে বিকৃতির শিকার। এক দল আরেক দলকে কী বোঝাতে চাই, কী পেশ করতে চাই—কিছুই বুঝে না কেউ। আধুনিক শিক্ষিতসমাজ আলেমদের বিরুদ্ধে চিন্তানৈতিক পিছিয়ে পড়া ও যুগের সমস্যাবলি না বোঝার অভিযোগ তুলে। অপর দিকে আলেমসমাজ তাদের বিরুদ্ধে রুচি ও চিন্তার বিকৃতি এবং দীনি চেতনা হ্রাস পাওয়ার পাল্টা অভিযোগ উত্থাপন করে। এ কঠিন পরিস্থিতিতে নির্ভরযোগ্য আলেমদের উচিৎ ছিল তারবিয়াত ও দাওয়াতি তৎপরতা বৃদ্ধি করে উভয় দলকে সন্তুষ্ট করা। হিন্দুস্থানে ‘নদওয়াতুল ওলামা’ এ চিন্তাধারা ধারণ করেই স্বজাতির মাঝে কাজ করে অগ্রগতি লাভ করেছে। আর আরববিশ্বে এই চিন্তা-দর্শনের বিপ্লব ঘটিয়ে আলেমসমাজ ও আধুনিক শিক্ষিতসমাজকে পরিতুষ্ট করেছেন শায়খ হাসান আল-বান্না (রহ.)। আর শায়খ ইউসুফ কারযাভী হলেন এই শায়খ বান্নারই শীর্ষ সারির অনুসারী ও মুগ্ধ গুণগ্রাহী। তাঁর চিন্তা-দর্শন, দাওয়াত ও কর্মতৎপরতা অনুসরণ করেই তিনি সম্মুখ পানে এগিয়ে চলেছেন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শায়খ বান্নার অনুসারীরা মিসরের সাবেক স্বৈরশাসক জামাল আবুদুন নাসেরের রোষানলে পড়ে। ‘নাসেরী-তাণ্ডবে’ বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের সকল দাওয়াতি তৎপরতা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম। ওলামা-মাশায়েখ ও দাঈদের জন্য দীন-ধর্ম নিয়ে বেঁচে থাকাও তখন সীমাহীন কষ্টকর হয়ে পড়ে।

এই চরম সংকটাপন্ন অবস্থায়ও শায়খ কারযাভী ও তাঁর সঙ্গী-সাথীরা ইসলামের পূত-পবিত্র আখলাক ও চরিত্র ধারণ করে তাঁদের দাওয়াতি কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। এতে তাঁরা ধৈর্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। দীন ও উম্মাহর প্রতি তাঁদের দায়-দায়িত্ব যথাযতভাবে পালন করেন। এর মাধ্যমে তাঁরা এমন এক অসাধারণ জাগরণ সৃষ্টি করেন, যাতে ধর্মানুরাগী যুবসমাজের ওপর প্রবল প্রভাব পড়ে। কন্টকময় পরিবেশে তাঁদের এ কর্ম-পদ্ধতি অবলম্বনের কারণে দীনি আমলেরও হেফাজত হয়। এসময় শায়খ কারযাভী ইসলামিবিশ্বের একজন প্রতীকব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর সুদৃঢ় অভিজ্ঞতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাঁর দক্ষতা এবং সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন দাওয়াতি ও জাগরণমূলক কাজে তাঁর তৎপরতা তাঁকে পূর্ণ প্রস্তুত করেছে। এছাড়াও তিনি একজন সৎ ও মুত্তাকি আলেম। তাঁর সমস্ত দ্বীনি কাজের জন্যে তিনি শুধু আল্লাহর কাছেই ছওয়াব-প্রত্যাশী। এগুলো সে সময়ের কথা যখন আধুনিক জীবন-যাপনের চাকচিক্য অবলোকন করে লোভী দাঈদের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যেত। যশলিপ্সা ও অর্থলিপ্সায় তাদের অন্তর মরে যেত। এ ঐন্দ্রজালিক পৃথিবীর চাকচিক্য ও রূপ-রস-গন্ধ অবজ্ঞাভরে পাশ কাটিয়ে চলেন শায়খ কারযাভী। ইসলামি দাওয়াত, তারবিয়াত ও বিপ্লবের ক্ষেত্রে তিনি এক শক্তিশালী প্লাটফর্মে পরিণত হন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা তাঁর চিন্তা-দর্শনের মাধ্যমে আলোকিত হয়। তাঁর বয়স সত্তরের কাছাকাছি। তিনি এখন ইসলামের এক মহা সম্পদে পরিণত হয়েছেন।

মিসরে আমি যখন শায়খ কারযাভীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি তখন তিনি মাত্র যুবক, আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়া অনুষদের ছাত্র। আমার এই সফরটা ছিল ইমাম হাসান আল বান্নার শহীদি-মৃত্যুর কিছুদিন পর। তখন তাঁর অনুসারী ও ভক্ত-অনুরক্তরা তাঁকে হারিয়ে প্রচণ্ড শোকাহত ছিল। এসময় একদল উচ্ছল প্রাণোচ্ছল ইখওয়ানি যুবক আমার কাছে এলেন। আমার চিন্তাধারা, দীনি কর্মতৎপরতা, ইসলামি জাগরণ ও সমাজ সংস্কারে আমার প্রচেষ্টার সাথে তাঁদের দারুণ সাজুয্য থাকায় তাঁরা আমার ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করেন। আমার সদ্যপ্রকাশিত আরবি গ্রন্থ মাযা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন তাঁদের কাছে বেশ সমাদৃতি পেয়েছে। কিতাবটিকে বড়ো আগ্রহভরে গ্রহণ করেছেন তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা হয়। সেসব প্রোজ্জ্বল নওজোয়ানদেরই একজন ছিলেন শায়খ ইউসুফ কারযাভী।

সেসময় থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল সবসময় অটুট-অবিচ্ছিন্ন। এরপর প্রায় দশ বছর পর আমি একবার কাতার সফরে গিয়েছিলাম। তখন তিনি এবং তাঁর দুই বন্ধু মিসর থেকে নির্বাসিত হয়ে কাতারে বসবাস করছেন। এখানে তিনি ইসলামী শিক্ষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এদেশে যুবক-বৃদ্ধদের সম্মিলনে একটি চমৎকার দীনি পরিবেশ পান তিনি। এসব যুবক-বৃদ্ধ তাঁর সান্নিধ্য পরশে থেকে উপকৃত হয়। এই সফরে তাঁদের সঙ্গে আমার বড়ো আনন্দময় সাক্ষাৎ ঘটে। আমরা অতীতের বিভিন্ন বিষয়ে স্মৃতিচারণ করি। শায়খ কারযাভী ও তাঁর সাথীবর্গকে দেখলাম খুবই কর্মতৎপর। তাঁরা চিন্তা-চেতনা ও কর্মপদ্ধতিতে খুবই সজাগ। তাঁদের এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হচ্ছে এবং সমাজে এর ভালো প্রভাব পড়ছে। এগুলো দেখে আমি সীমাহীন মুগ্ধ হয়েছি। শায়খ কারযাভী তাঁর গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং দাওয়াত ও তারবিয়াতের ক্ষেত্রে তাঁর সজাগ দৃষ্টিতে এগিয়ে চলছেন সম্মুখ পানে। এর ফলে কাতারের মহামান্য আমিরের কাছ থেকে তিনি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেন।

শায়খ কারযাভী পাঠদান, লেখালেখি, গ্রন্থ-প্রণয়ন ও মাহফিলে বয়ানের মাধ্যমে তাঁর কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের দাওয়াত, তারবিয়াত ও জাগরণমূলক তৎপরতার মাধ্যমে ধ্বংসোন্মুখ নতুন প্রজন্ম এখন ইসলামি পরিবেশেই বেড়ে উঠছে। আমার যৎসামান্য কর্ম ও প্রচেষ্টার কারণে তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন এবং সবসময় শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। আমার সঙ্গে তাঁর আচরণ ছোট-বড়’র মতো। এটা হয়ত বয়সে আমি তাঁর চেয়ে তের বছর বড় হওয়ার কারণে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি— তিনি যেন তাঁকে, আমাকে এবং দীনের সমস্ত খাদেমকে ভালো কাজের তাওফিক দেন এবং সবাইকে কবুল করে নেন। সব দয়া ও অনুগ্রহ তাঁরই। শুরু এবং শেষে সমস্ত প্রশংসা ও শুকরিয়া তাঁরই জন্য নিবেদিত।

[এই প্রবন্ধটি মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) ১৯৯৬ সালে দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার একটি ইলমি ও দাওয়াতি প্রোগ্রামে শায়খ ড. ইউসুফ কারযাভী (রহ.)-এর আগমন উপলক্ষ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাঠ করেছিলেন। যা পরবর্তীতে মাসিক আল-বা’সুল ইসলামিতে প্রকাশিত হয়।]

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ