বিরহের বছর নবীজি (সা.)-এর রক্তঝরা দিনগুলো
আবদুল কাদির ফারূক
কারও হৃদয়ের স্পন্দন যদি না থাকে—তাহলে সে স্পন্দনশূন্য। আর স্পন্দশূন্য হয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর পদতলে আমাদের জীবন উৎসর্গ। যেসব গুণাবলির সমারোহ একজন মানুষকে প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসতে বাধ্য, সেসব গুণাবলীর প্রতিটি আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান ও বিরাজমান। তাই আমরা তাঁকে মনেপ্রাণে ভালোবাসি। শুধু ভালোবাসি বললে ভুল হবে—বরং নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। মানুষ তখনই অনুসরণীয়- অনুকরণীয় ব্যক্তি হয়ে উঠে, যখন তাঁর কথায় ও কাজে পরিপূর্ণ মিলন ঘটে। আমাদের প্রিয়নবীর জীবনালেখ্যর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই পুরোপুরিভাবে দৃষ্টিগোচর হবে এই জিনিসটি। তাই তিনি আমাদের অনুসরণীয়-অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
তিনি এমন ব্যক্তি যে-ই তাঁর কাছে আসত, সে-ই তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রেমিক বনে যেত। তাঁকে পাওয়ার জন্য উম্মাদ হয়ে যেত। কারণ তাঁর প্রতিটি কাজকর্ম শীলিত ও পরিশীলিত। তিনি এমন ব্যক্তি যাঁর কাছে গেলে মনে হত, তিনি আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। যাঁর চরিত্র সুন্দর ও কোমল ফুলের মতন পবিত্র। তাঁর সম্পর্কে মুখের ভাষায় প্রকাশ করা, কলমের ডগা দিয়ে কালো কালো অক্ষরে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। কারণ তাঁর সম্পর্কে যা-ই বলব, যা-ই লিখব, তা-ই নিতান্ত কম হবে। নিতান্ত কম হবে। আমি যে ক্ষেত্রেই যাই না কেন, সবক্ষেত্রেই তিনি ভালোবাসা পাওয়ার হকদার।
নুবুওয়তের দশম বছর। ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম নারী, রসুলে আরাবির প্রথম স্ত্রী, হযরত খদিজা (রাযি.) ইন্তেকাল করেন। এতে রসুল (সা.) মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এতটাই ভেঙে পড়েন, কয়েকদিন ঘর থেকে বের হওয়ারই শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তিনি শোকে কাতর হয়ে ঘরে বসে থাকেন। হযরত খদিজা (রাযি.) তো সেই মহান মানুষ যিনি নুবুওয়তের সবচেয়ে কঠিন সময়ে রসুল (সা.)-এর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে পরামর্শ ও আশ্বাস দিয়েছিলেন। তিনিতো সেই মহান ব্যক্তি যাঁর প্রতি স্বয়ং মহান রব ও জিবরাইল (আ.) সালাম পেশ করেছিলেন। খদিজা (রাযি.) শুধু নবীজির স্ত্রীই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন রসুল (সা.)-এর জীবনের স্তম্ভ। এই একটি ঘটনাই হয়তো রসুল (সা.)-এর জন্য ‘আমুল হুযুন’ বা শোকের বছর হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। এরই কিছুদিন পর তিনি আরও একটি বড় ধরনের ধাক্কা অনুভব করেন। তাঁর আপন চাচা আবু তালিব মৃত্যুবরণ করেন। সম্পর্কে চাচা হলেও, এতিম হয়ে জন্মগ্রহণ করা রসুল (সা.) শৈশবকালে দাদাকে হারিয়েছেন, তাঁর জন্য আবু তালিব অনেকটা বাবার মতোই ছিলেন।
খদিজা রসুলকে (সা.) সবসময় পরম মমতায় জড়িয়ে—নিজের ভালোবাসার বাগডোরে আগলে রেখেছেন। রসুল পাশে না থাকলে খদিজার মন সবসময় উচাটন হয়ে থাকত। পাশে এলেই আবার মনে স্বস্তি ও শান্তনা ফিরে আসত। খদিজা ছিলেন রসুল (সা.)-এর অভয়াশ্রয়। খদিজা রসুলোর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, তা শুধু নবিজিই অনুভব করতে পেরেছেন। ব্যক্তিজীবনে খদিজা (রাযি.) যদি তাঁর সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়ে থাকেন, তাহলে সামাজিক জীবনে সেই অবস্থানে ছিলেন আবু তালিব। রসুল (সা.)-এর জন্য এই মৃত্যুটা আরও বেদনাদায়ক ছিল। অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে রসুল (সা.) যেন একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন। আবু তালিবের আশ্রয় হারিয়ে তিনি যেন সমাজে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রবল শোকের সঙ্গে যোগ হল সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়া। রসুল (সা.) দেখলেন এই মুহূর্তে মক্কার বাইরে ইসলামের বাণী প্রচার করা অত্যন্ত জরুরি।
ইসলাম যখন নিভু নিভু, নিস্প্রভ হয় হয় এমন, তখন নবী (সা.), দাওয়াতের জন্য উপযুক্ত ও ঊর্বর ভূমি মনে করলেন তায়েফ শহরকে। তখনকার সময়ে তায়েফ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। এটি মক্কা থেকে সত্তর মাইল দূরে অবস্থিত, কিন্তু নবীজি (সা.) কৌশলগত বা আর্থিক সংকটের কারণে হোক পায়ে হেঁটেই সেই পথ পাড়ি দেন। রসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন, তাঁর পালকপুত্র যায়েদ ইবনে হারেসা (রাযি.)। সত্তর মাইল দূরত্বের পথ! কথাটা বলতে খরচ হয় কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু এর পেছনে যে ত্যাগ ও কষ্ট ছিল তা বর্তমান যুগে— একমাত্র ঘর ছেড়ে আসা শরণার্থীরাই উপলব্ধি করতে পারবে।
উত্তপ্ত সূর্যের নিচে কর্কষ নিষ্প্রাণ মরুভূমি মধ্যে দিয়ে পঞ্চাশ বছর বয়সী রসুল (সা.) হেঁটে গিয়েছেন। যেন জাহিল কুরাইশরা সত্যের বাণী দমিয়ে না দেয়। তায়েফ শহর তখন তিন ভাই দ্বারা পরিচালিত। তারা যার যার প্রশাসনের জায়গা ভাগ করে নিয়েছিল। রসুল (সা.) প্রথমে তাদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার কথা ঠিক করলেন। কারণ একটি সমাজের নেতারা যখন কোনো অবস্থাকে গ্রহণ করে ফেলে, তখন সেখানকার সাধারণ মানুষের জন্য তা অনুসরণ করা সহজ হয়ে যায়। তিনি একে একে তিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন এবং প্রত্যেকেই তাঁর আহ্বানকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে প্রত্যাখ্যান করে।
প্রথমজন তাঁর আহ্বান শুনে এতটাই রাগান্বিত হয়েছিল, সে বলল, ‘আল্লাহ যদি সত্যিই তোমাকে নবী হিসেবে পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে আমি নিজ হাতে কাবার গিলাফ ছুঁড়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেব।’ দ্বিতীয়জন ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলল, ‘আল্লাহ কি রসুল হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য তোমার থেকে ভালো কাউকে পাননি—?’ আর তৃতীয় ভাইও ব্যঙ্গ করে বলল, ‘তুমি যদি সত্যিই নবী হয়ে থাক, তাহলে তোমার সঙ্গে আমি কথা বলতে পারব না, কারণ তুমি আমার থেকে অনেক উপরে। আর যদি তুমি মিথ্যুক হয়ে থাক, তাহল তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবে না, কারণ তুমি আমার থেকে অনেক নীচুস্তরের মানুষ।’ অবশেষে সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই কথা বলল, তুমি মিথ্যা বল আর সত্যি বল আমি তোমার কোনো কথাই গ্রহণ করব না।
যে রসুল (সা.)-এর চরিত্র পরম, এত সুন্দর; যার চরিত্রের সার্টিফিকেট স্বয়ং মহান রব কুরআনুল কারিমে সুনিপূণভাবে উল্লেখ করেছেন, সেই মানুষের আমন্ত্রণকে তায়েফের তিন মূর্খ নেতা এরকম বীভৎস মন্তব্য করে বসল। একের পর এক ধাক্কার পরও রসুল (সা.) হাল ছেড়ে দেননি, তাদের এরকম নিকৃষ্ট আচরণেও তিনি আশাহত হননি। তিনি সপ্তাহখানেক সেখানে অবস্থান করেন, কিন্তু কেউই তাঁর ডাকে সাড়া দেয়নি। তিনি বুঝতে পারেন, এখন ফিরে যাওয়াটা সমীচীন হবে, কিন্তু সেখানকার মানুষ এতটা নিকৃষ্ট মনোভাবের ছিল, তারা রসুলকে (সা.) শুধু অপমান আর প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হয়নি। আহ! লিখতেই বুকটা ফেঁটে চির চির হয়ে যাচ্ছে। তবুও লিখতে হচ্ছে; তাদের নেতারা শহরের দুর্বৃত্তদের ডেকে বলল, এই দুজন যেন শহর থেকে সসম্মানে বের হতে না পারে। রসুল (সা.) এবং জায়েদ (রাযি.) শহর থেকে বের হওয়ার সময় দেখেন, শহরের বাইরে থেকে শুরু করে অনেক দূর পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যেই তাঁরা শহর থেকে বেরুতে শুরু করেন, অমনিই তারা তাদেরকে অনবরত পাথর মারা শুরু করল। বৃষ্টির মত একের পর এক পাথর তাদেরকে আঘাত করতে লাগল। প্রতি ধাপে ধাপে এসে তাঁদের গায়ে পাথর পড়া শুরু করল এবং বিশেষভাবে তারা রসুল (সা.)-এর পা-কে লক্ষ করে পাথর মারতে থাকল। যেন নবীজি বেরোতে সময় লাগে আর তারা আরও বেশি কষ্ট দিতে পারে।
আহ! কতো নির্দয় আর নিষ্ঠুরতম মনের অধিকারী হলে মানুষ এরকম করতে পারে! যে নবীর গায়ে মশা-মাছি বসা হারাম, সেই নবীর শরীর থেকে আজ অঝোরে রক্ত বের হচ্ছে। পাথর একই জায়গা বারবার পড়ার কারণে সেই চামড়া ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। নবীজি অবচেতন হয়ে গেলেন। দীর্ঘ পাঁচ মাইল ধরে এই মানুষরূপি পশুরা তাঁদেরকে নির্মমভাবে পাথর নিক্ষেপ করে, কিন্তু এত সবের পরে ভেবে দেখুন! নবী (সা.) যা করেছেন, তা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। রক্তাক্ত, আহতাবস্থায় রসুলকে (সা.) ধরে ধরে হযরত যায়েদ (রাযি.) কিছুটা এগিয়ে একটি ছায়াবিশিষ্ট গাছের নিচে বসেন। রসুল (সা.) পা থেকে এত বেশি রক্ত বের হচ্ছিল, চামড়ার সেন্ডেলটা পায়ের সঙ্গে আটার মত লেগেছিল। একটু একটু করে পা থেকে ছুটাতে হয়েছিল।
এরপর রসুল (সা.) যা করছেন, তা অবিশ্বাস হলেও সত্যি। রসুল (সা.) এই ব্যথিত রক্তাক্ত শরীর নিয়ে দুই রকআত নফল নামাজ পড়েন। আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর রসুল এমনভাবে দুয়া করেন, যা প্রতিটি মানুষকে মুগ্ধ করবে। প্রতিটি নিপীড়িত, নির্যাতিত, অপমানিত এবং লাঞ্ছিত ব্যক্তির জন্য দিকনির্দেশক। চরম দুর্দশা এবং হতাশার ভেতরে থেকেও আল্লাহর প্রতি কেমন আচরণ করব। কেমন মনোভাব রাখব। কীভাবে তাঁরই ওপর ভরসা করতে থাকব।
রসুল (সা.) বললেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আমার দুর্বলতার কথা জানাচ্ছি। এবং আপনার কাছে আমি আমার অভাবের কথা জানাচ্ছি। মানুষের কাছে আমার অসম্মানের কথা একমাত্র আপনাকেই বলছি। এভাবে দীর্ঘক্ষণ নবী (সা.) হৃদয়স্পর্শী ও মর্মস্পর্শী দুয়া করতে থাকেন। পরিশেষে নবী (সা.) বলেন, হে আল্লাহ! আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন, কেননা তারা জানে না। আজ তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলেও একসময় তাদের পরবর্তী প্রজন্ম ইসলাম গ্রহণ করবে।
আজ নিজেকে নবীর উম্মত বলে দাবি করতে লজ্জাবোধ করি! কারণ আমার নবী যেই দীনের জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন, নিজের দেহকে রক্তাক্ত করেছেন, আমি কী সেই দীনের জন্য এক ফোঁটা রক্ত ঝরিয়েছি? আমি কী সেই দীনের জন্য সত্তর মাইল পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছি? আমি কী সেই দীনের জন্য পাথরের আঘাত সহ্য করেছি? আমি কী সেই দীনের জন্য গালিগালাজ শুনেছি? আমি কী সেই দীনের জন্য কটাক্ষমূলক কথা ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করেছি? নিজের জন্য ধিক্কার জানাই!
আমার নবী মুহাম্মদ, দরূদ পড়ি নামে যাঁর, তাঁর নামে বদনাম, বরদাশত হবে না আমার।