আর্তমানবতার ত্রাণকর্তা
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নুবুওয়তি মিশনের লক্ষ্য ছিল জুলুমের অবসান ঘটিয়ে মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করা। যে লক্ষ্য নিয়ে তিনি দুনিয়ায় আবির্ভূত হন, ২৩ বছরে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে তিনি তা কার্যকর করেন সার্থকভাবে। তাঁর উপস্থাপিত জীবন ব্যবস্থা মানব জীবনের সব ক্ষেত্রে সবদিক দিয়ে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নিয়ামক ও চালিকা শক্তি। পবিত্র কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী, মহান আল্লাহ সব নবী ও রসুলকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের বিধান এবং তা কার্যকর করার দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন (সুরা আল-হাদীদ: ২৫)।
আল্লাহ তাআলার নির্দেশনা অনুযায়ী রসুলুল্লাহ (সা.) সমাজে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। জাতি-ধর্ম, বর্ণ-শ্রেণি, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ধনী-দরিদ্র, প্রভু-ভৃত্য সবার ক্ষেত্রে বিচার সমান, এখানে বিন্দুমাত্র হেরফেরের অবকাশ ছিল না। দয়া বা পক্ষপাতিত্ব আল্লাহর বিধান কার্যকরকরণে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর নিজস্ব ব্যাপারে কারও কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি (হাফিয আবু শায়খ ইসফাহানী, আখলাকুন নবী (সা.), পৃ. ১৯)।
সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রসুলুল্লাহ (সা.) বেশকটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমত তিনি অর্থসম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনার প্রয়াস চালান। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের লক্ষ্যে অহীনির্ভর যে দর্শন পেশ করেন তা হলো মানব জীবনে অর্থ-সম্পদ অপরিহার্য। জীবন ও জীবিকার তাগিদে অর্থ-সম্পদ অর্জন করতে হয়, কাজে লাগাতে হয়, কিন্তু তা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। অর্থ ও ধন-সম্পদসহ দুনিয়ার সবকিছুই মানুষের সেবক ও খাদেম। পৃথিবীর বস্তুনিচয় মানুষের জন্য সৃষ্টি (সুরা আল-বাকারা: ২৯)।
মানুষ ও মানুষের সব কর্মকাণ্ড কেবল আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিবেদিত। সুতরাং অর্থ-সম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয় করতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত পথে। এতেই নিহিত আছে মানুষের মুক্তি ও কামিয়াবি।
সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রসুলুল্লাহ (সা.) জনগণকে নীতি ও বিধিসম্মতভাবে অর্থ-সম্পদ অর্জন করার এবং জাকাত ও সদ্কার মাধ্যমে সে অর্জিত সম্পদের কিয়দংশ দুঃখী ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের নির্দেশ দেন। অধিকন্তু রাষ্ট্রের আর্থিক সম্পদে জনগণের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য রসুলুল্লাহ (সা.) ছয় ধরনের রাজস্ব প্রবর্তন করেন। এগুলো হলো ১. আল-গনিমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি, ২. যাকাত বা ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার, ৩. খারাজ বা অমুসলিম কৃষকদের ভূমি কর, ৪. জিজিয়া বা অমুসলিমদের নিরাপত্তা কর, ৫. আল-ফাই বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, ৬. সদকা বা স্বেচ্ছাধীন দান।
রসুলুল্লাহ (সা.) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশ কৌলিন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজবন্ধন সুদৃঢ় করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সব মানুষ একে অপরের ভাই। সব মানুষ আদমের বংশধর আর আদম মাটি থেকে তৈরি (আহমদ ইবনে হাম্বল, মুসনদ, ৫/৪১১ ও জাহিয, আল-বয়ান ওয়াত তিবয়ান, ২/৩৩)।
তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যার মধ্যে খোদাভীতি প্রবল। রসুলুল্লাহর (সা.) এ ঘোষণা ছিল তৎকালীন সমাজের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ও দ্রোহ। কারণ বংশ কৌলিন্য ও রক্তের মর্যাদা ছিল সামাজিক আভিজাত্যের ভিত্তি। তিনি ঈমানদারদের সুভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সুদৃঢ় করে এক অখণ্ড দেহসত্তায় পরিণত করেন।
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রসুলুল্লাহ (সা.) যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা ছিল যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক। মদিনায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজ কাঠামোতে যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল; পৃথিবীর অন্য কোনো সমাজে তার নজির পাওয়া মুশকিল। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শের অনুসরণে খুলাফায়ে রাশেদীন যে সমাজব্যবস্থা কায়েম করেন তা ছিল পুরোপুরি সুবিচার ও ন্যায় ইনসাফনির্ভর। মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারের যে নজির ইসলামের মহান রসুল (সা.) দুনিয়ার বুকে স্থাপন করে গেছেন, তার আলোকশিখা এখনও পৃথিবীতে অনির্বাণ।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন