হাকীমুল ইসলাম আল্লামা মুফতী আবদুল হালীম বোখারী (রহ.): স্মৃতি ও স্মরণ
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের অনুপম কিছু স্মৃতি ও অনুভূতি
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতি আবদুল হালীম বোখরী (রহ.)। তিনি ছিলেন আমাদের উস্তাদ ও মুরশিদ। সময়ের উত্তম আদর্শ। আকাবিরের উজ্জ্বল নমুনা। তাঁর সুহবত-সংশ্রব ছিল আমাদের জন্য মহা-নেয়ামত ও বড়-অনুগ্রহ। তাই যথাসম্ভব তাঁর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। তাঁর পাশে থাকার চেষ্টা করতাম। তাঁর সাথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু সফর করার তওফিক হয়েছে। তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে দেশের বাইরেও সফর করার সৌভাগ্য হয়েছে। বিগত ২০ মে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ, মোতাবেক ৪ রমজান ১৪৩৯ হিজরি (রবিবার) তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত আরব-আমিরাত সফর করি। সফরের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সুহবত গ্রহণ ও হযরতের খেদমতে কিছু সময় অতিবাহিত করা এবং সেখানকার জামিয়ার কাজগুলো স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা। আর জামিয়ার হিতাকাঙ্ক্ষীদের সাথে পরিচিতি লাভ করা ইত্যদি। দীর্ঘ একমাস যাবৎ তাঁর খেদমতে ছিলাম। তাঁর চিন্তা-চেতনা ও কর্মপদ্ধতি খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই সফরের কিছু স্মৃতি আলোচনা করা হলো।
সফরের প্রেক্ষাপট
অধম তখন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত জামিয়ার একজন মুদাররিস। মাত্র এক বছর পূর্বেই আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় নিয়োগ প্রাপ্তি হলো। বছর পূর্ণ হওয়ার এখনো একদিন বাকি আছে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। জামিয়া ছুটি হয়ে যাবে। তাই বন্ধুবর মাওলানা নাছিরুদ্দীন (হাফি.) (সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া)-সহ জামিয়া প্রধান আল্লামা আবদুল হালীম বোখারীর (রহ.) সাক্ষাতে যাই। কুশল বিনিময়ের পর তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তোমার ভিসার সময় কতদিন বাকি আছে? অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। বললাম, হযরত আমার তো কোনো স্থায়ী ভিসা নেই। তখন তিনি বলেন, না তোমার পাসপোর্টের কথা বলছি। তোমার পাসপোর্টের ঠিক আছে? পাসপোর্টের মেয়াদ আছে? বললাম, জি হুযুর। সব ঠিক আছে। তিনি আবারো জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার পাসপোর্ট কি ডিজিটাল? বললাম, জি হুযুর, ডিজিটাল। তখন তিনি বলেন, তোমার পাসপোর্টের একটি ফটোকপি আমাকে দাও। আমি অনেক দুর্বল হয়ে গেছি। একাকী সফর করা মুশকিল। বর্তমানে টুরিস্ট ভিসা খোলা আছে। দেখি, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি কি-না। অতঃপর একটি পাসপোর্ট কপি হযরতকে দিলাম। এক সপ্তাহ পরে হযরত ফোন করে জানালেন, ভিসা হয়েছে। আগামী ২০ তারিখ আমরা রওনা হবো, ইনশা আল্লাহ। ১৯ তারিখ বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে জামিয়ায় চলে আসলাম। ২০ তারিখ দুপুর সাড়ে ১২টায় আমরা জামিয়া থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিনামবন্দরের উদ্দেশ্যে বের হলাম।
গাড়ি বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে চলছে। পথিমধ্যে হযরত আমাকে লক্ষ করে বললেন, ‘মওলভী সলীম! মূলত আমি এই দুর্বলতা নিয়ে আরও অনেকবার সফর করেছি। তবে এবার তোমাকে নিয়ে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য, হয়তো আগামীতে আমিরাতের সফর করা আমার জন্য সম্ভব হবে না। আমিরাতে জামিয়ার অনেক হিতাকাঙ্ক্ষী রয়েছেন। তোমাকে তাঁদের সাথে পরিচয় করে দেবো, যেন ভবিষ্যতে তুমি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পার।’ কথাগুলো শুনে কেন যেন নিজের অজান্তে চক্ষুদ্বয় অশ্রুশিক্ত হয়ে পড়লো। হৃদয়ে কম্পন অনুভব করলাম। এই গুরুদায়িত্ব পালনের যোগ্যতা নিজের মধ্যে না পেয়ে খুবই শঙ্কাবোধ করলাম। তবে সাথে সাথে আল্লাহর রহমতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। অন্তরকে প্রবোধ দিলাম যে, মুরব্বিদের পক্ষ থেকে আরোপিত দায়িত্ব পালন করতে আল্লাহ অবশ্যই সহায় হবেন।
শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিনাম বন্দরে ইমেগ্রেশন কাউন্টারে যাত্রীরা হয়রানির স্বীকার হয়। দেখা গেল, টুরিস্ট যাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েই ইমেগ্রেশন অতিক্রম করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। যারা তাদের সাথে কন্টাক্ট করে না তাদেরকে অনেক হয়রানির স্বীকার হতে হচ্ছে। আজব এক বাংলাদেশ, ভিসা ওকে আছে, যাত্রীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু তারপরও তাদেরকে টাকা দিতে হবে! কেন? হয়তো এর কোনো উত্তর নেই। ওইদিকে হুযুর ইমিগ্রেশন শেষ করে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। যখন দেখলেন আমাকে তারা আটকে রেখেছে, তখন তিনি অস্থির হয়ে যান। বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে তাদের কবল থেকে মুক্ত করেন।
বিমান বাংলাদেশের ফ্লাইটটি বিকাল ৫:৪৫ মিনিটে উড্ডয়নের কথা থাকলেও বিলম্ব করলো সেদিন। বিমানে ইফতার দেওয়া হলো। হযরত (রহ.)-এর সাথে বিমানে বসে ইফতার করলাম। কিন্তু মাগরিবের নামাজের জন্য চিন্তা হচ্ছিল, তখন হযরত বলেন, ‘আমরা বিমানেই জামায়াতে নামাজ পড়বো।’ অতঃপর হযরতের আদেশে বিমানের সিটের পাশের খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে রুমাল বিছিয়ে জামায়াতে নামাজ আদায় করলাম। অল্পক্ষণ পরেই বিমান উড্ডয়নের ঘোষণা এলো। সিট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ এলো। সামনে রাখা জিপিএস চালু করলাম। দেখলাম বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করা পর্যন্ত সিট বেল্ট খোলার অনুমতি পাওয়া গেল না। বিমান যখন ইন্ডিয়ায় তখন বেল্ট খোলার অনুমতি পাওয়া গেল। রাতের খাবার পরিবেশন করা হলো। খাবার গ্রহণ করার পর বিমান যখন উড়িষ্যা অতিক্রম করছিল, হঠাৎ বিমানে খট খট আওয়াজ শোনা গেলো। যাত্রীরা সকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। কিন্তু হযরত (রহ.)-কে কোনো রকমের আতঙ্কিত হতে দেখলাম না। তিনি খুবই স্বাভাবিক ছিলেন এবং নিজ আমলে মশগুল ছিলেন। আমিও খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হযরতের দৃঢ়তা দেখে কিছুটা নিরুদ্বেগ হলাম। এমন সময় পাইলটের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো, ‘আবহাওয়া খারাপ, সকল সিট বেল্ট বেঁধে বসে থাকুন, কেউ হাটা-চলা করবেন না। বিমানে ২০ মিনিট পর্যন্ত খট খট আওয়াজ করতে থাকবে। এটি ভয় পাওয়ার কিছু নয়।’ এভাবে পাইলট যাত্রীদেরকে অভয় দিলেন। কিছুক্ষণ পর বিমান মুম্বাই হয়ে গুজরাট অতঃপর পাকিস্তান ও ওমান অতিক্রম করে আমিরাতে প্রবেশ করলো।
আমিরাত সময় তখন রাত সাড়ে ১২টা। আমরা আবুধাবি বিমানবন্দরে ২টায় অবতরণ করলাম। বাংলাদেশ ইমেগ্রেশনের আতঙ্ক এখানেও ছিল। মনে ভয় নিয়ে ইমেগ্রেশন অফিসারের সামনে এলাম। তিনি স্বাগতম জানিয়ে পাসপোর্ট গ্রহণ করলেন। অত্যন্ত সহজ ও আন্তরিকতার সাথে ইমেগ্রেশনের কাজ সম্পন্ন করলেন।
হযরতের বড় সাহেবজাদা মাওলানা হাফেজ রেজাউল করীম বোখারী (হাফি.) গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষারত ছিলেন। তিনি নিজে ড্রাইভ করে আমাদেরকে তাঁর ঘরে নিয়ে যান। হারিস, সরিদ, লবনআব ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। থাকা-খাওয়া সবকিছু তাঁর বাসায় হতো। তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার ও আন্তরিক ভালোবাসায় বিমুগ্ধ হতে হতো। তাঁর বাসার আপ্যায়ন ও খাওয়া-দাওয়ার উন্নত ব্যবস্থাপনা এবং পরিবারের সদস্যদের আন্তরিকতা; একজন আজনবি মুসাফিরের পরদেশি হওয়ার অনুভূতিকে ভুলিয়ে দিতো। আল্লামা বোখারীর (রহ.) স্নেহস্পদ নাতী আম্মার, নাজওয়া ও আবরারকে কাছে পেয়ে পারিবারিক হৃদ্যতা পাওয়া যেতো। তাদের সখ্যতায় স্নেহের মুহাম্মদের শূন্যতা ম্লান হতো। আল্লাহ তাআলা সকলকে তাঁর প্রিয় বান্দা হিসেবে কবুল করুন, আমীন।
কর্মবীর এক অনন্য ব্যক্তিত্ব
আল্লামা বোখারী (রহ.)
সেদিন রাত ১টার দিকে আমরা মাওলানা রেজাউল করীম বোখারীর (হাফি.) বাসায় পৌঁছি। সেহরি করে ফজরেরর নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করি। অতঃপর হযরত (রহ.) আমি ঘুম থেকে উঠার পূর্বেই জামিয়ার কাজ আরম্ভ করে দেন। ল্যাপটপ থেকে জামিয়ার হিতাকাঙ্ক্ষীদের তালিকা বের করেন। জামিয়ার প্রজেক্টগুলো তাদের সামনে পেশ করার জন্য বিশেষ চিঠি তৈরি করেন। নিজ হাতে টাইপ করেই আরবি-উর্দু এবং ইংরেজি দরখাস্তগুলো তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে যান। হঠাৎ জাগ্রত হয়ে হয়ে হযরত (রহ.)-এর কাজের ব্যস্ততা দেখে তাঁর পাশে গেলাম। তিনি বললেন, তোমার ঘুম হয়েছে? বললাম, জি হুযুর। কোনো অসুবিধা হয়নি তো? বললাম, না হুযুর। তিনি তখন কিছু দিরহাম বের করে আমাকে বলেন, নীচে গিয়ে একটি ‘বক্কালা’ দেখতে পাবে। সেখান থেকে মোবাইলের জন্য রিচার্জ কার্ড নিয়ে এসো। অপরিচিত জায়গা। তাই কিছুটা সংকোচবোধ করলাম। কিন্তু হযরত (রহ.)-কে কিছু না বলে নীচে চলে গেলাম। দেখলাম, একটি দোকান খোলা আছে। সেখান থেকে রিচার্জ কার্ড নিয়ে আসলাম। হযরত (রহ.) দোয়া দিলেন। হয়তো তিনি পরীক্ষামূলকভাবে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ কামিয়াবি দান করলেন, আল-হামদুলিল্লাহ।
এসে হযরতের কাজে হাত বাড়ালাম। তিনি নিজেই আলমারি থেকে প্রিন্টার বের করে ল্যাপটপের সাথে সংযোগ করলেন। এ বৃদ্ধ বয়সে কম্পিউটারে টাইপিংয়ের কাজ করা, অতঃপর কম্পিউটারের সাথে প্রিন্টার ইত্যাদি সংযোগ দিয়ে প্রিন্ট বের করা ইত্যাদির মতো বিরক্তকর ও ঝামেলাপূর্ণ কাজগুলো যখন তাঁকে সানন্দে করতে দেখতাম, তখন রীতিমত চমকে যেতাম। মনে হতো, সত্যিই, তিনি কাজের মাধ্যমে বড় হয়েছেন। সময়কে মূল্যায়ন করার মাধ্যমেই সমৃদ্ধ হয়েছেন।
দরখাস্তগুলোর প্রিন্ট বের করে অধমকে প্রুফ রিড়িং করতে বলেন। বড় আজব লাগল, তাঁর সেই দরখাস্তগুলোতে কোনো খুঁত খুঁজে পেতাম না। যেভাবে তিনি প্রিন্ট করেছেন সেভাবেই বিতরণ করা যেতো। শুধুমাত্র একটি দরখাস্তে কিছু সংখ্যাগত এবং টাইপিং মিস্টেক নজরে পড়লে হযরত (রহ.)-কে অবহিত করি। তিনি অত্যন্ত আনন্দচিত্তে তা সংশোধন করেন। সাথে সাথে আমাকে উৎসাহ প্রদান করে বলেন, আমিও হযরত আল্লামা হাজী ইউনুস সাহেব (রহ.)-এর সাথে সৌদি আরবে সফর করেছি। তখন চিঠিপত্রগুলো আমাকেই তৈরি করতে হতো। তখন তো প্রুফ দেখারও কেউ ছিল না। এখন বৃদ্ধ বয়সে তুমি আছো। ভালো করে দেখে নাও। আমি মনে মনে আতঙ্কে ছিলাম। হযরত রাগ করেন কি-না? কিন্তু একি?! তিনি রাগ করা তো দূরের কথা, উলটো আমাকে আরও উৎসাহ প্রদান করেন এবং আর কোনো অসংগতি থাকলে তা বের করার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন।
বস্তুত এটি একটি বড় গুণ ও উন্নত বৈশিষ্ট্য। অন্যকে গ্রহণ করা, অন্যের কথা ও অভিমতকে মূল্যায়ন করা; বিশেষত লেখালেখির ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। আমাদের অনেকেই এ বিষয়টি সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখি না। আত্মতৃপ্তিতে তুষ্ট থাকি। নিজের লেখায় কেউ কলম বসালে, কোনো সংশোধনী দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। অহেতুক বাক-বিতণ্ডা ও অযৌক্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে লিপ্ত হয়ে যায়। এটি বাস্তবতা বিরোধী। আল্লামা বোখারী (রহ.) ছিলেন অত্যন্ত বাস্তববাদী। তিনি সাধারণত কৃত্রিমতা ছাড়া সত্যভাবে উপস্থাপন করতে ভালোবাসতেন এবং শৈল্পিক রীতিনীতি অথবা অসম্ভাব্য ও অতিপ্রাকৃত উপাদানগুলি এড়িয়ে চলতে পছন্দ করতেন। সত্যকে তিনি অকপটে স্বীকার করতেন। সত্য উচ্চারণের জন্য তিনি শুকরিয়া আদায় করতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন এবং আমাদেরকেও তাঁর আদর্শে আদর্শবান হওয়ার তওফিক দান করুন, আমীন।
নিয়মানুবর্তিতা ও
শৃঙ্খলাপ্রিয় জীবন যাপন
আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)-এর জীবন অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিলো। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাপ্রিয় জীবন যাপন। সময়ের মূল্যায়ন ও যথা সময়ে কাজ আঞ্জাম দেওয়া ছিলো তাঁর অন্যতম স্বভাব ও অনন্য বৈশিষ্ট্য। দিনের কর্মসূচি হিসেবে কখনো কখনো সেহরি খাওয়ার পর বলতেন, আজ আমরা ১০টায় বের হবো। দেখা যেতো, তিনি এর আধঘণ্টা পূর্বেই প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন। জামিয়ার কাজে তিনি রাত জাগতেন। কখনো ইফতারের পর রওনা হতেন, কখনো তারাবীহর পর, আবার কখনো সেহরির পরও সফর করতেন।
তাঁর প্রিয় ও বিশ্বস্ত শিষ্য ও ভক্তরাই ড্রাইভ করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। বিশেষত আবুধাবিতে মাওলানা রেজাউল করীম বোখারী (হাফি.)। আলাইনে মাওলানা আসাদ হাজারী ও হাফেজ ওয়ালিউল্লাহ (হাফি.)। শারজাহ, দুবাই ও আজমানে ড্রাইভ করতেন বন্ধুবর মাওলানা হাফেজ আব্বাস ও মাওলানা হাসান (হাফি.) প্রমুখ। সত্যিই, তাঁরা হলেন জামিয়ার জন্য নিবেদিতপ্রাণ কিছু মুখলিস হিতাকাঙ্ক্ষী। হযরত (রহ.) যখনই যেখানে যাওয়ার জন্য বলতেন, তাঁরা প্রস্তুত হয়ে যেতেন। কেউ কেউ শারজায় তারাবীহ নামাজ পড়িয়ে নিজে ড্রাইভ করে আবুধাবিতে এসে সেহরি করতেন। অতঃপর আমাদেরকে নিয়ে আবার শারজায় চলে যেতেন।
একদিন আমরা সেহরি শেষ করে আবুধাবি শহরে যাই। জামিয়ার একজন হিতাকাঙ্ক্ষী শায়খ জামিয়ার জন্য কিছু অনুদান দিয়ে থাকেন। তাঁর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই সেখানে যাওয়া। তিনি মসজিদ থেকে ইশরাক পড়ে বের হন। সেখানে সেহরির পর পরই ফজরের শুরুতেই জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। হযরত (রহ.) ফজরের নামাজ পড়ে প্রতিদিন আরাম করেন। কিন্তু সেদিন সেই সুযোগ ছিলো না। তাই ফজরের পর ইশরাক পর্যন্ত কুরআন পড়তে থাকেন। ইশরাক পড়ে যখন শায়খ বের হলেন, তখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি হযরত (রহ.)-কে একান্তে ডেকে নিয়ে গেলেন। কুশল বিনিময়ের পর নিজের ব্যবসায়িক অসুবিধার কথা জানালেন এবং প্রতি বছর যে পরিমাণে জামিয়ার জন্য অনুদান দিতেন, এ বছর সে পরিমাণ অনুদান দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে উপস্থিত অল্পকিছু দিরহাম দিয়ে জামিয়ার কাজে শরীক হলেন। অতঃপর হযরত (রহ.)-কে বিদায় জানালেন। গাড়িতে বসে হযরত আমাদেরকে শায়খের বিষয়টি বিস্তারিত জানালেন। তাতে আমাদের মন খারাপ হলো। কিন্তু হযরত (রহ.)-কে কোনো ধরনের পেরেশান হতে দেখলাম না। আমাদের অবস্থা দেখে হযরত (রহ.) বললেন, শুনো! আমরা এখানে জামিয়ার কাজের জন্য এসেছি। আমাদের দায়িত্ব হলো, জামিয়ার হিতাকাঙ্ক্ষীদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা। কে কত পরিমাণ অনুদান দিলো, সেটি বিবেচনা করা আমাদের দায়িত্ব নয়। আল্লাহ তাআলা জামিয়ার জন্য বাজেট নির্ধারণ করে রেখেছেন। এই বাজেটে কারা কারা অংশ গ্রহণ করবেন এবং কত পরিমাণ দিয়ে অংশ গ্রহণ করবেন; সবকিছু পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমরা শুধু তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করবো, যেন তাঁদের জন্য জামিয়ার বাজেটে অংশ গ্রহণ করা সহজ হয়।
জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আযীযুল হক (রহ.)–এর শিক্ষণীয় ঘটনা
হযরতুল আল্লামা মুফতী আবদুল হালীম বোখারী (রহ.) এবার আমাদেরকে একটি ঘটনা শোনালেন। তিনি বলেন, ‘জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতী আযীযুল হক (রহ.)। তিনি বড় কষ্ট করে এই জামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে জামিয়ার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। তিনি নিজে গিয়ে বিভিন্ন হিতাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করতেন। একদিন চট্টগ্রাম শহরের এক ব্যবসায়ীর নিকট গিয়ে জামিয়ার প্রয়োজনের কথা বলতেই তিনি রেগে যায়। হযরতের সাথে অনেকটা রূঢ় ব্যবহার করে। তখন মুফতি আযীযুল হক (রহ.) বলেন, আমাকে মাফ করবেন। আমি ভুলে জায়গায় চলে এসেছি। আমি যেখানে যাওয়ার জন্য এসেছি, এটি যে সেই জায়গা নয়, তা আমার জানা ছিলো না। দয়া করে ক্ষমা করবেন, কিছু মনে করবেন না।
হযরত মুফতি আযীযুল হকের (রহ.) কথাগুলো শুনে সেই ব্যবসায়ী হযরত (রহ.)-কে বললেন, আমি আপনার কথা বুঝিনি। আপনি তো আমার এখানে অনেকবার এসেছেন। তাহলে ‘ভুল জায়গায় এসেছি’-এর অর্থ কী? তখন পটিয়ার মুফতী সাহেব (রহ.) বলেন, ভাইজান, আমার ছেলেদের রিযক আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন। তবে তিনি কার মাধ্যমে রিযক দেবেন সেটি আমি জানি না। তাই আমাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। কখনো সঠিক জায়গায় যাই। তারা ছাত্রদের সেই রিযক আমাদের মাধ্যেমে পৌঁছিয়ে দেন। আবার কখনো ভুল জায়গায় যাই। তখন তারা…।’ অতঃপর আল্লামা বোখারী (রহ.) বলেন, ‘হযরত মুফতী সাহেব (রহ.)-এর কথাগুলো কী আজব প্রভাব ছিলো, জানি না। তবে লোকটি খুবই লজ্জিত হলো। সাথে সাথে হযরতের পায়ে লুটিয়ে পড়লো এবং এক গাড়ি চাল মাদরাসায় পাঠিয়ে দিলো।
ঠিক তেমনি আমরাও এখানো বিভিন্ন আহলে খায়ের ও হিতাকাঙ্ক্ষীদের সাথে যোগাযোগ করার অর্থ হলো, তাঁদের অর্থ যদি জামিয়ার জন্য বরাদ্ধকৃত হয়ে থাকে, তা যেন সহজেই জামিয়াতে পৌঁছে যায়।
সুতরাং এ ক্ষেত্রে যদি কেউ অনুদান দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তাতে আমাদের মন খারাপ করার কী আছে?’
অতঃপর তিনি নিজের অভিজ্ঞতার কথা আমাদেরকে শোনান। তিনি বলেন, ‘আমি আরব-আমিরাতে বেশ কয়েক বছর যাবৎ কাজ করছি। কয়েক বছর পূর্বের ঘটনা। আমি গোটা রমজান কাজ করেছি। কিন্তু আগের বছরের তুলনায় সেই বছরের তাহসিল কিছু কম হয়েছিলো। আমি মনে মনে চিন্তিত ছিলাম। হঠাৎ ঈদের দিন এক শায়খ আমাকে ফোন করে বলেন, শায়খ আবদুল হালীম! আপনি কি আমিরাতে আছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, আছি। তিনি বলেন, আপনি কি কষ্ট করে আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবেন? আমি বললাম, জি, ইনশা আল্লাহ। অতঃপর তাঁর সাক্ষাতে গেলে তিনি আমাকে জামিয়ার জন্য প্রায় ৫৫ হাজার দিরহাম প্রদান করেন। তাতে সে বছরের তাহসিল অন্য বছরের চেয়েও অধিক হয়ে যায়। অতএব এগুলো নিয়ে পেরেশান হওয়া যাবে না। তবে অবশ্যই মনে মনে দোয়া করবে আর ইখলাস ও সততার সাথে কাজ করে যাবে। সাহায্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আসবে।’
হযরত (রহ.) আলাইনের এক মসজিদে এক শায়খের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জামিয়ার জন্য কিছু অনুদান দেন। আবার আমাদের প্রত্যেককে নিজের জন্য কিছু হাদিয়া প্রদান করেন। আমি হযরত (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, হযরত! আমাদের জন্য দেওয়া দিরহামগুলো কী করবো? তিনি বলেন, জামিয়ার ফান্ডে জমা করে দেবো। কেননা হাদীস শরীফে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ حُمَيْدٍ السَّاعِدِيِّ h، قَالَ اسْتَعْمَلَ النَّبِيُّ ﷺ رَجُلًا مِنْ الْأَزْدِ، يُقَالُ لَهُ ابْنُ الْلَّتَبِيَّةِ، عَلَى الصَّدَقَةِ، فَلَمَّا قَدِمَ قَالَ: هَذَا لَكُمْ وَهَذَا أُهْدِيَ لِيْ، قَالَ: «فَهَلَّا جَلَسَ فِيْ بَيْتِ أَبِيْهِ أَوْ بَيْتِ أُمِّهِ، فَيَنْظُرَ يُهْدَىٰ لَهُ أَمْ لَا؟ وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ، لَا يَأْخُذُ أَحَدٌ مِنْهُ شَيْئًا إِلَّا جَاءَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَحْمِلُهُ عَلَىٰ رَقَبَتِهِ، إِنْ كَانَ بَعِيرًا لَهُ رُغَاءٌ، أَوْ بَقَرَةً لَـهَا خُوَارٌ، أو شَاةً تَيْعَرُ»، ثُمَّ رَفَعَ بِيَدِهِ حَتَّىٰ رَأَيْنَا عُفْرَةَ إِبْطَيْهِ: «اللّٰهُمَّ هَلْ بَلَّغْتُ، اللّٰهُمَّ هَلْ بَلَّغْتُ» ثَلَاثًا.
‘আবু হুমাইদ আস-সায়িদী (রাযি.) বলেন, নবী (সা.) আযদ গোত্রের ইবনুল লাতাবিয়া নামক এক ব্যক্তিকে যাকাত আদায় করার কাজে কর্মচারী নিয়োগ করলেন। সে ব্যক্তি (আদায়কৃত মালসহ) ফিরে এসে বলল, এটা আপনাদের (বায়তুল মালের), আর এটা আমাকে উপহার স্বরূপ দেওয়া হয়েছে। একথা শুনে আল্লাহর রসুল (সা.) মিম্বরে উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করে বললেন, ‘অতঃপর বলি যে, আল্লাহ আমাকে যেসব কর্মের অধিকারী করেছেন তার মধ্য হতে কোনো কর্মের তোমাদের কাউকে কর্মচারী নিয়োগ করলে সে ফিরে এসে বলে কি না, এটা আপনাদের, আর এটা উপহার স্বরূপ আমাকে দেওয়া হয়েছে! যদি সে সত্যবাদী হয়, তবে তার বাপ-মায়ের ঘরে বসে থেকে দেখে না কেন, তাকে কোনো উপহার দেওয়া হচ্ছে কি না? আল্লাহর কসম! তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো জিনিস অনধিকার গ্রহণ করবে, সে কিয়ামতের দিন তা নিজ ঘাড়ে বহন করা অবস্থায় আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাৎ করবে। অতএব আমি যেন অবশ্যই চিনতে না পারি যে, তোমাদের মধ্য হতে কেউ নিজ ঘাড়ে চিঁহিঁ-রববিশিষ্ট উঁট অথবা হাম্বা-রববিশিষ্ট গাই অথবা ম্যা-ম্যা-রববিশিষ্ট ছাগল বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেছ।’ আবু হুমাইদ (রাযি.) বলেন, অতঃপর নবী (সা.) তাঁর উভয় হাতকে উপর দিকে এতটা তুললেন যে, তাঁর উভয় বগলের শুভ্রতা দেখা গেল। অতঃপর তিনবার বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কি পৌঁছে দিলাম?”[1]
ফিকহবিদগণের দৃষ্টিতে
মুহাসসিলের জন্য হাদিয়া গ্রহণ
উল্লিখিত হাদীসের ব্যাহ্যিক অর্থ হিসেবে তো মুহাসসিলের জন্য কোনো ধরনের হাদিয়া গ্রহণ করা বৈধ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইসলামিক স্কলার ও ফিকহবিদগণ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন- জামিয়া ইসলামিয়া বিননূরি টাউনের ফতওয়ায় বলা হয়েছে,
مدراس کے سفراء عاملین میں داخل نہیں ہیں؛ کیوں کہ یہ اسلامی حکومت کی طرف سے زکاۃ وصول کرنے پر مامور نہیں ہیں ، لہذا مال دار اہلِ خیر حضرات سفراء کو یہ کہہ کر کچھ رقم دیتے ہیں کہ یہ آپ اپنی ضرورت میں خرچ کریں اور اس رقم کے بارے میں رسید بھی نہیں لیتے تو یہ سفراء کے لیے اپنی ذات پر خرچ کرنا جائز ہے۔ ہاں وہ سفراء جو فراہمی چندہ کے کام پر مامور ہوں اور مدرسے نے ان کو شخصی طور پر ہدیہ لینے سے روک دیا ہو ان پر لازم ہے کہ یا تو وہ شخصی ہدایا قبول نہ کریں یا قبول کریں تو مدرسے کے فنڈ میں ڈال دیں۔
‘মাদরাসার কালেকশনে নিয়োজিত ব্যক্তিরা আমিল তথা যাকাত উত্তোলনকারীদের অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা তারা তো ইসলামি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যাকাত আদায়ের জন্য নিয়োজিত নন। সুতরাং দীনের হিতাকাঙ্ক্ষী সম্পদশালী কেউ যদি তাদেরকে এই বলে কিছু দেন যে, এই টাকাগুলো আপনি আপনার প্রয়োজনে খরচ করবেন এবং ওই টাকার রসিদও না নেন। তাহলে তাদের জন্য তা নিজ প্রয়োজনে খরচ করা বৈধ। তবে যাদেরকে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কেবলমাত্র চাঁদা উসুল করার জন্য নিয়োগ দিয়েছে এবং তাদেরকে এমন হাদিয়া গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে,তাহলে তিনি এমন হাদিয়া কবুল করতে পারবেন না অথবা করলেও তা মাদরাসার ফান্ডে জমা করতে হবে।[2]
ফতওয়া হিসেবে যদিও এমন হাদিয়া নিজের জন্য গ্রহণ করা বৈধ। কিন্তু আল্লামা বোখারী (রহ.) অতি সাবধনতা অবলম্বন করতেন। তাই তিনি তা গ্রহণ করে জামিয়ার ফান্ডে জমা করে দিয়েছেন। হে আল্লাহ, দয়া করে তাঁকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমাদেরকেও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করার তওফিক দান করুন,আমীন।
চলবে ইনশা আল্লাহ
[1] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ৯১৭, হাদীস: ২৪৫৭
[2] মুফতী মুহাম্মদ কিফায়তুল্লাহ দেহলভী, কিফায়তুল মুফতী, দারুল ইশাআত উরদু বাজার, লাহোর, পাকিস্তান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৮, পৃ. ১০৩