শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা প্রস্তুতি ও পরীক্ষার কিছু নিয়মাবলি
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা! আগামী ৯ সফর ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক ৬ সেপ্টাম্বর ২০২২ খ্রিস্টাব্দ (মঙ্গলবার) থেকে আমাদের আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় প্রথম সাময়িক পরীক্ষা আরম্ভ হবে, ইনশা আল্লাহ। তেমনি স্বল্পসময়ের ব্যবধানে অন্যান্য মাদরাসাগুলোতেও প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হতে চলছে। নিম্নে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং এর কিছু নিয়মাবলি আলোচনা করা হলো। পরীক্ষার পাঠ প্রস্তুতি বিষয়ে অন্য কোনো সময় লিখব, ইনশা আল্লাহ।
প্রিয় বন্ধুরা! পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন কিংবা জীবনকে সফল ও সার্থক করার জন্য তিনটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত দৃঢ় সংকল্প বা দৃঢ় প্রত্যয়। দ্বিতীয়ত কঠোর পরিশ্রম। তৃতীয়ত সময়ের যথাযথ প্রয়োগ। আশা করি আপনারা নিজের জীবনকে সফল ও সার্থক করার দৃঢ় প্রত্যয়পূর্বক কঠোর পরিশ্রম করার জন্য সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করবেন।
প্রিয় তালেবে ইলম! মনে রাখতে হবে, সময়কে যথাযথ কাজে লাগিয়েই মানুষ কামিয়াবি অর্জন করতে পারে। বিশেষত একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও ভালো ফলাফল করার জন্য জীবনের প্রতিটি সময়কে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হয়। অপরিকল্পিত অনেক পরিশ্রমেও সফলতা অর্জিত হয় না। বিশেষভাবে পরীক্ষার পূর্বপ্রস্তুতির সময় সুচিন্তিতভাবে একটি রুটিন তৈরি করে নিতে হয় এবং সে অনুযায়ী নিজের সময়কে কাজে লাগাতে হয়। পড়ার সময় ও পঠিতব্য বিষয়গুলোর পরিমাণের মাঝে সামঞ্জস্য বজায় রেখে রুটিন তৈরি করতে হয়। যেন কোনো একটি কিতাব বা বিষয় পড়তে পড়তেই সময় শেষ না হয়ে যায়। দরস চলাকালীন সময়েও দরসের ফাঁকে ফাঁকে বহু সময় পাওয়া যায়। সে সময়কেও কোনো একটি কিতাবের প্রস্তুতির জন্য কাজে লাগানো যায়। ভালো ফলাফল প্রত্যাশী সচেতন ছাত্রের ক্ষেত্রে তা অবশ্যই কাম্য।
প্রিয় পরীক্ষার্থী বন্ধুরা! আপনাদের সামনে পরীক্ষা বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা পেশ করা হচ্ছে। আশা করি বিষয়গুলো খুবই যত্ম সহকারে আমলে নেবেন।
পরীক্ষার দিনের করণীয়
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা! চেষ্টা করবেন যেন পরীক্ষার নির্দিষ্ট সময়ের আধা ঘণ্টা পূর্বে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছানো যায়, যেন একটু রেস্ট নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করা যায়। পরীক্ষার হলে প্রবেশের পর আপনাকে যে উত্তরপত্র দেওয়া হয়েছে, তা যথাযথ কিনা, প্রথমে তা যাচায় করে নিন। অতঃপর প্রশ্নপত্র হাতে নেওয়ার পর তা ভালোভাবে পড়ুন। আপনাকে কয়টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, তা দেখে নিন। প্রশ্নপত্রে বর্ণিত সকল প্রশ্নেরই উত্তর দিতে হবে, না সেখানে অতিরিক্ত প্রশ্নও আছে? অতিরিক্ত প্রশ্ন থাকলে আপনার কাছে অধিক সহজ প্রশ্নগুলোতে টিক চিহ্ন দিন। প্রশ্ন দেখার সময় ভালোভাবে লক্ষ করুন, এমন কোনো প্রশ্ন আছে কি না, যার জবাব দেওয়া বাধ্যতামূলক। উত্তর লেখার পূর্বে প্রত্যেক প্রশ্নের ছোট-বড় উত্তরের জন্য সময় নির্ধারণ করুন। যেমন প্রথম প্রশ্নের (ক) আলিফের জন্য দশ মিনিট, (খ) বায়ের জন্য সাত মিনিট ইত্যাদি।
সুহৃদ বন্ধুরা! লেখা শুরু করার পূর্বে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা একান্ত প্রয়োজন। তাই কিছু দোয়া-দরুদ পাঠ করে আল্লাহর সাহায্য কামনা করবেন। বিশেষত ‘رَبِّ زِدْنِيْ عِلْمًا۰۰۱۱۴, رَبِّ اشْرَحْ لِيْ صَدْرِيْۙ۰۰۲۵’—এ দোয়াগুলো পড়বেন এবং তিনবার اللّٰهُمَّ عَلِّمْنِيْ مَا جَهِلْتُ وَذَكِّرْنِيْ مَا نَسِيْتُ—এ দোয়াটি পড়ে বিসমিল্লাহ বলে লেখা আরম্ভ করবেন।
একটি তাদবীর
মুফতি তকী ওসমানী (হাফিজাহুল্লাহ) বলেন, আমার পিতা মুফতি শফী (রহ.) আমাকে একটি তদবীর শিখিয়েছেন যে, পরীক্ষার হলে গিয়ে প্রথমে ডান হাতের পাঁচ আঙুলে كٓهٰيٰعٓصٓ۫ۚ۰۰۱ এভাবে পড়াবে যে, প্রথমে ছোট আঙুলের ওপর ك পড়ে সেটি বন্ধ করে ফেলুন। তারপর প্রতিটি আঙুলে এক-এক হরফ পড়ে সেটি বন্ধ করবেন। যেন ص পড়ার সময় সবগুলো আঙুল বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর বলুন, كُفِيْتُ। তারপর ‘হামীম আইন সীন কফ’ এভাবে পড়ুন যে, ح বলে ছোট আঙুল খুলবেন। অতঃপর প্রতিটি হরফ পাঠ করে একেকটি আঙুল খুলতে থাকুন। যখন সবগুলো আঙুল খুলে যাবে, তখন বলবেন, حُمِيْتُ। এ আমল করার পর প্রশ্নপত্র খুলবে (আমার জীবনকথা, ৭/৫৯)। আশা করি, আপনারাও এই আমলটি করে উপকৃত হতে পারবেন।
পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীর কর্তব্য
- প্রশ্নপত্র হাতে আসার পর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো প্রশ্ন ভলোভাবে দেখে নিন। অতঃপর প্রশ্নের চাহিদা অনুযায়ী স্পষ্ট ভাষায় শুধুমাত্র উত্তর লিখুন। যদি কোনো প্রশ্ন অস্পষ্ট হয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট উস্তাদের কাছ থেকে এর সমাধান জেনে নিন। অথবা মুরাকেবকে জানাবেন। আর মুরাকেব তা নাযূরকে অবহিত করবেন এবং তিনিই এর সমাধান দেবেন।
- যদি কোনো পরীক্ষার্থীর তার লিখিত উত্তরে কোনো ভুল দৃষ্টিগোচর হয়, তাহলে শুধুমাত্র ভুল অংশের ওপর একটা দাগ টেনে দেবে। কাগজের কোনো অংশ ছেঁড়া যাবে না। ছিঁড়লে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।
- পরীক্ষার্থীদের আরবি, ফারসি, উর্দু ও বাংলা; এ চার ভাষা থেকে যেকোনো এক ভাষায় উত্তর লেখার অনুমতি আছে।
- পরীক্ষা চলাকালীন পরস্পর কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ। প্রয়োজন ছাড়া পরীক্ষার হল থেকে বের হওয়া যায় না এবং পেসাব-পায়খানার জন্য বের হলেও পথে কারো সাথে কথা বলার অনুমতি থাকে না।
- প্রত্যেক পরীক্ষার্থী উত্তরপত্রের প্রথম পৃষ্ঠা (কভার পেইজ)-এ পরীক্ষার্থীর জন্য নির্ধারিত খালি স্থানগুলো অবশ্যই পূরণ করবে। বিশেষ করে তারতীব নম্বর, কিতাবের নাম ও জামায়াতের নাম স্পষ্ট করে খুবই সতর্কতার সাথে লিখতে হবে।
- প্রত্যেক পরীক্ষার্থী প্রতিদিন উত্তরপত্র জমা দেওয়ার সময় মুরাকেবের কাছে থাকা উসুলশীটে উসুল দেবে। আর বার্ষিক পরীক্ষায় দস্তখত শীটে দস্তখত করবে। অন্যথায় উত্তরপত্র বাতিল বলে গণ্য হয়।
- পরীক্ষার্থীদের জন্য যেকোনো ধরনের মোবাইল নিয়ে হলে প্রবেশ করা দণ্ডণীয় অপরাধ বিবেচিত হয়।
পরীক্ষার সময় ও নিয়মাবলি
- সাধারণত সকাল ৮.৩০ মিনিটে পরীক্ষা শুরু হয়ে ১১.৩০ মিনিটে সমাপ্ত হয়ে থাকে (এটি শিক্ষাপরিচালক কর্তৃক রুটিন ঘোষণার ওপর নির্ভরশীল)। পরীক্ষার্থীরা হলে যাওয়ার প্রস্তুতির জন্য ৩০ মিনিট পূর্বে একটি সতর্ক ঘণ্টা বাজানো হয় এবং ১৫ মিনিট পূর্বে আরেকটি সতর্ক ঘণ্টা বাজানো হয়। অতঃপর যথা সময়ে চূড়ান্ত ঘণ্টা বাজানো হয়।
- পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১৫ মিনিটের ভেতর কোনো পরীক্ষার্থী পরীক্ষা হলে উপস্থিত হতে না পারলে ‘নাযূর’ (হল প্রধান)-এর অনুমতি ব্যতীত পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারে না।
- প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে শুধুমাত্র কলম-দোয়াত ও রুলার সঙ্গে নিয়ে হলে যেতে হয়। অন্য কোনো লিখিত বা অলিখিত সাদা কাগজ সাথে রাখার কোনো অনুমতি নেই।
- প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে নিজ নিজ আসনে বসতে হয়। ব্যতিক্রম হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।
- প্রশ্নপত্র বণ্টনের পর ১ঘণ্টার ভিতর কোনো পরীক্ষার্থী পরীক্ষার হল থেকে বের হতে পারে না এবং উত্তরপত্রও জমা দিতে পারে না (তবে অসুস্থতা ও অপারগতার ব্যাপারে নাযূরের সিদ্ধান্তই অগ্রাধিকারযোগ্য)।
- পরীক্ষার্থীদেরকে নির্ধারিত টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। অবশ্য নাযূর (হল প্রধান)-এর অনুমতি ব্যতীত হল থেকে বের হওয়া যায় না। আর তিনি একসাথে একাধিক পরীক্ষার্থীকে বের হওয়ার অনুমতি দেন না।
- যদি কোনো পরীক্ষার্থীর অতিরিক্ত কাগজ (লুজ পেপার)-এর প্রয়োজন হয়, তাহলে সে নিজ আসনে দাঁড়িয়ে মুরাকেবের কাছ থেকে তা চেয়ে নেবে, কোনো অবস্থায়ই আপন স্থান ত্যাগ করতে পারে না।
বিশেষ সতর্কীকরণ
- পরীক্ষার্থীর কাছে যদি কোনো কিতাব বা লিখিত কিছু পাওয়া যায়, তা হলে নাযূর (হল প্রধান) তাকে বহিষ্কার করবেন। এ ক্ষেত্রে প্রথম সাময়িক ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় ওই দিনের পরীক্ষা বাতিল এবং বার্ষিক পরীক্ষায় সম্পূর্ণ পরীক্ষা বাতিল করবেন।
- কোনো পরীক্ষার্থী যদি উত্তরপত্রের কোনো অংশ কেটে নেয়, তা হলে পরিক্ষক তার প্রাপ্ত নম্বর হতে ৫ নম্বর কেটে দেবেন।
- যদি কোনো পরীক্ষার্থী মুরাকেবের অনুমতি ব্যতীত পরীক্ষা হল থেকে বাইরে যায়, অথবা হলের ভিতরে বা বাইরে কথা বলে বা নিজ আসন ত্যাগ করে এবং সতর্ক করার পরও সতর্ক না হয়, তখন নাযূর (হল প্রধান) তার প্রাপ্ত নম্বর হতে ৫ নম্বর কেটে দেবেন এবং উত্তরপত্রের ওপর তা লিখে দস্তখত করবেন।
- যদি কোনো পরীক্ষার্থী পরীক্ষার হলে বেয়াদবি বা অশালীন আচরণ করে, তা হলে নাযূর (হল প্রধান) তার পরীক্ষা বাতিল করবেন।
- কোনো পরীক্ষার্থীর কাছে নকল পাওয়া গেলে মুরাকেব সাহেব নাযূর মহোদয়কে (হল প্রধান)-কে অবগত করবেন, তিনি উল্লেখিত ধারা অনুযায়ী তার পরীক্ষা বাতিল করবেন এবং নকলপত্র উত্তরপত্রের সাথে সংযুক্ত করে দেবেন।
- যদি কোনো পরীক্ষার্থী কোনো দিন উত্তরপত্র জমা না দিয়ে হল ত্যাগ করে, তাহলে বার্ষিক পরীক্ষায় অবশিষ্ট কিতাবের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না এবং পরীক্ষা বাতিল বলে গণ্য হবে।
- যদি কোনো পরীক্ষার্থী কোনো একদিন অনুপস্থিত থাকে, তাহলে বার্ষিক পরীক্ষায় অবশিষ্ট কিতাবের পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি থাকবে না।
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা! উল্লিখিত বিষয়গুলো আমাদের জামিয়ার প্রসিদ্ধ কিছু নিয়মনীতি। এ ছাড়াও আরও অনেক নিয়মনীতি রয়েছে, যা পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার একদিন পূর্বে জামিয়ার জামে মসজিদে শোনানো হয়। আশা করি সেগুলো খুব ভালোভাবে শুনবেন এবং সে অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করবেন।
পরিশেষে আমরা দোয়া করছি আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে দুনিয়া-আখেরাতের সকল পরীক্ষায় সফলতা দান করুন, আমীন।
লেখক, গবেষক ও শিক্ষক, আল–জামিয়া আল–ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম