বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী মুহাম্মদ (সা.)–এর আদর্শ
শেখ আহসান উদ্দিন
আল্লাহ তাআলা এই দুনিয়ায় নবী ও রসুলদেরকে মানবজাতির হিদায়েতের জন্য প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বান্দার হিদায়েতের নিমিত্তে তাদের মধ্য থেকে মনোনীত বান্দার মাধ্যমে যে বাণী পাঠান, তাকেই রিসালত বলা হয়। আর যারা এই রিসালত বহন করেন, তাদের বলা হয় রসুল। আমাদের প্রিয়নবী শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) রিসালত বহন ও আল্লাহর হিদায়েতের পাশাপাশি শান্তির জন্যেও কাজ করেছেন। আল্লাহ তাআলা মহানবী (সা.)-কে রহমাতুল লিল-আলামীন হিসেবে প্রেরণ করেছেন। শান্তির নিমিত্ত যার জন্ম, আজীবন সে ঠিকানায় তিনি ছুটে চলবেন—এটাই স্বাভাবিক। তাই তো বোধহীন শৈশবে, দুরন্ত ও রাঙা কৈশোরে, উদীপ্ত তারুণ্যে এবং জীবনসায়াহ্নে তিনি ছুটেছেন একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে। শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাই আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেন যে,
وَمَاۤ اَرْسَلْنٰكَ اِلَّا رَحْمَةً لِّلْعٰلَمِيْنَ۰۰۱۰۷
‘আমি আপনাকে (মুহাম্মদ সা.) রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।’[1]
সমাজে তাঁর শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ও পদ্ধতি ছিল অনন্য। যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, রক্তপাত, অরাজকতা দূরীভ‚ত করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ভিত্তিতে তিনি একটি কল্যাণমূলক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তিনি দল-মত-গোত্র নির্বিশেষে আরবের জাতি-ধর্ম-বর্ণ সকলের মাঝে শান্তিচুক্তি এবং সন্ধি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করেন। তাঁর অনুপম চরিত্র-মাধুর্য ও সত্যনিষ্ঠার কথা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। কিশোর বয়সে তিনি ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক শান্তিসংঘ গঠন করে সামাজিক অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আর্তমানবতার সেবা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ, অত্যাচারিতকে সহযোগিতা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি বজায় রাখা ছিল এ শান্তিসংঘের অঙ্গীকার বাণী। মানুষের কল্যাণে তাঁর গড়া স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর প্রথম সাংগঠনিক রীতিতে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ সমাজ সংস্কারমূলক প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে তিনি সমাজ জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলায় বাধা সৃষ্টিকারী সকল কার্যক্রম প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিয়ে মক্কা থেকে যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার ও সন্ত্রাসবাদ উচ্ছেদ করে সুশীল সমাজ গঠনে সচেষ্ট হন।
হুদায়বিয়ার সন্ধি ও
রাসুলের শান্তি প্রতিষ্ঠা
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর অনবদ্য ভূমিকার অনন্য স্মারক হুদায়বিয়ার সন্ধি। কিন্তু আল্লাহর রাসুল সাহাবিদের প্রবল মনোরোষ ও বিরোধিতা সত্ত্বেও কুরাইশদের সঙ্গে এক অসম চুক্তিতে উপনীত হলেন। বাহ্যিক পরাজয়মূলক হওয়া সত্ত্বেও কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তিনি এ সন্ধিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির ছয়টি ধারার প্রতিটি ছিল চরম মানবতাবিরোধী ও বৈষম্যমূলক। চরম অপমানজনক ও বিদ্বেষপূর্ণ। চুক্তির ধারাগুলো পর্যালোচনা করলে সামান্য বোধের মানুষের মনেও প্রশ্নের উদয় হওয়ার কথা, হযরত মুহাম্মদ (সা.) কেন এমন চুক্তি স্বাক্ষর করলেন? তিনি তা করেছিলেন শুধুই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। বস্তুত অল্প সময়ের মধ্যেই তা প্রমাণিত হয়েছিল।
মক্কা বিজয়ের দিন
বিশ্বশান্তির বার্তা
শান্তিপূর্ণভাবে চূড়ান্ত মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্র কাবার চৌকাঠে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন তার সামনে অতীতের সব জঘন্য অপরাধ নিয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে ছিল মক্কার অধিবাসীরা। তাদের ঘিরে নির্দেশের অপেক্ষায় তীক্ষ্ণ তরবারি হাতে মুসলিম সেনাদল দাঁড়িয়েছিল। মক্কার অপরাধীদের সে সঙ্গীন মুহূর্তে মহানবী (সা.) চাইলে বলতে পারতেন, ‘যে হাত শান্তিকামী তাওহীদবাদীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল, ওই হাতগুলো কেটে দাও! যে চোখগুলো অসহায় মুসলমানদের দিকে হায়েনার হিংস্রতা নিয়ে তাকাত, সে চোখগুলো উপড়ে ফেলো! যে মুখ আল্লাহ, তার রাসুল ও মুমিনদের বিরুদ্ধে শুধুই মিথ্যা অপবাদ, বিষোদগার ও কুৎসা রটনা করে বেড়াত, সে জিবগুলো কেটে ফেলে দাও!’
তিনি চাইলে আরও ঘোষণা করতে পারতেন, ‘আজ থেকে কুরাইশ জালিমদের পুরুষরা বিজয়ী মুসলিম বাহিনীর গোলাম আর নারীরা দাসী হিসেবে গণ্য হবে।’ অত্যন্ত আশ্চর্য হলো, কুরাইশরাও তাদের প্রাপ্য এমনটা ছিল বলে বিশ্বাস করেছিল; কিন্তু মহানবী (সা.) অপার বদান্যতা ও অনুপম মহানুভবতা দেখালেন। তিনি বলেছিলেন,
«لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ اذْهَبُوا فَأَنْتُمُ الطُّلَقَاءُ»
‘আজ তোমাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তোমরা সবাই মুক্ত-স্বাধীন।’[2]
শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে মক্কার জীবন ও মদীনার জীবন—সর্বত্রই ষড়যন্ত্র, সংঘাত, যুদ্ধ ও মুনাফেকি মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। শত অত্যাচার-নির্যাতন ও যুদ্ধ করে আজীবন যে জাতি নবী করীম (সা.)-কে সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে, সেসব জাতি ও গোত্রকে মক্কা বিজয়ের দিন অতুলনীয় ক্ষমা প্রদর্শন করে এবং তাদের সঙ্গে উদার মনোভাব দেখিয়ে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই তিনি একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বসমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বুনিয়াদ রচনা করে গিয়েছিলেন।
চলমান বিশ্বসমাজ সংসারে তাঁর ন্যায়নীতি, সুবিচার ও সুশাসন কায়েম হলে পরে পৃথিবীতে কোনো প্রকার সামাজিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান থাকতো না। প্রখ্যাত দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ’ সমস্যা-জর্জরিত বর্তমান বিশ্বে সামাজিক শান্তি ও মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো কোনো ব্যক্তি যদি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন, তাহলে এমন এক উপায়ে তিনি এর সমস্যা সমাধানে সফলকাম হতেন, যা পৃথিবীতে নিয়ে আসতো বহু বাঞ্ছিত শান্তি ও সুখ।’
রসুল (সা.) সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ উপহার দিয়ে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তার বাণী শুনিয়েছিলেন। তাঁর অনুপম জীবনচরিত ও সমাজ সংস্কারমূলক কর্মধারা সব মানুষের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় এক চিরন্তন আদর্শ। মানবজাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-সংহতি ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি সুরক্ষা এবং সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার ও অসত্য দূরীভূত করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর আজীবন প্রয়াস বিশ্বমানবতার জন্য মহান অনুপ্রেরণার উৎস। মানব সমাজে পরিপূর্ণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ সঠিকভাবে অনুসরণ করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
মহানবী (সা.) তিনি মহিলাদের জন্য শান্তি ও মুক্তির পথ প্রদর্শন করেছেন। সকল শ্রেণির মানুষের জন্য শান্তি ও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। হাবশি সম্রাট নাজ্জাশী, রোম, বাইজেন্টাইন, দামেস্ক, আম্মান ও তখনকার ইয়েমেনের সম্রাটদেরকে মহানবী (সা.) শান্তির বার্তা দিয়ে চিঠি দিয়েছেন। প্রত্যেকটা চিঠি এমন ছিল, ‘সালাম তাদের ওপর যারা হিদায়েত অনুসরণ করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.)-এর ওপর বিশ্বাস করবে। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর কোনোই অংশীদার নেই, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ উপাস্য হওয়ার উপযুক্ত নয়। তিনি কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি এবং তাঁর কোনো সন্তানও নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দান করছি যে, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা এবং রসুল। আমি আপনাকে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য দাওয়াত দিচ্ছি। কারণ আমি আল্লাহর রসুল (সা.), অতএব ইসলাম গ্রহণ করুন তাহলে শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন।’
মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণও ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদান। এজন্যই মুসলিম বিশ্বের অন্যতম আলেম আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ‘নবীয়ে রহমত’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ মানবো। তাহলেই বিশ্বে শান্তি থাকবে।
[1] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:১০৭
[2] ইবনে কাইয়িম আল-জাওযিয়া, যাদুল মা‘আদ ফী হাদয়ি খায়রিল ইবাদ, মুআস্সাসাতুর রিসালা লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত-তাওযী’, বয়রুত, লেবনান ও মাকতাবাতুল মানার আল-ইসলামিয়া, কুয়েত (সপ্তদশ সংস্করণ: ১৪১৫ হি. = ১৯৯৪ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ৩৫৯