নদওয়াতুল ওলামামায় ছাত্র-ধর্মঘট; প্রখর মেধাবী ছাত্রের করুণ পরিণতি
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা!
আপনাদেরকে তালিবে ইলম বলা হয়। তালিবে ইলমের প্রধান ব্যস্ততা ও নিমগ্নতা হচ্ছে ইলমের তলব ও আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া। আমাদের জামিয়াসহ সকল দীনী প্রতিষ্ঠানে যারা ভর্তি হয়, তারা তালীম-তরবিয়ত হাসিল করার জন্য, দীনের সঠিক বুঝ অর্জন করার জন্যই ভর্তি হয়ে থাকে। তাই প্রত্যেক তালিবে ইলমকে এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে শিক্ষার যামানা সমাপ্ত করতে হয়। বিশেষত শিক্ষাকালিন সময়ে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোনিবেশ করা জরুরি।
(ক) শিক্ষকমণ্ডলীর সাথে আদব ও বিনয়পূর্ণ আচরণ করা। (খ) মাদরাসার নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে মেনে চলা। (গ) মাদরাসার ইন্তেযামী ও ব্যবস্থাপনাগত বিষয়াবলিতে হস্তক্ষেপ না করা। (ঘ) প্রাতিষ্ঠানিক যে কোনো ইস্যু নিয়ে স্ট্রাইক-ধর্মঘট কিংবা এ ধরনের যে কোনো কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকা। (ঙ) রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, নামধারী-বেনামী, অজ্ঞাত বা গোপন যে কোনো ধরনের তানযীম বা সংগঠনের সাথে যুক্ত না হওয়া। (চ) তালবে ইলমীর যামানায় সক্রিয় রাজনীতিতে না জড়ানো। কেননা, ছাত্রদের আসল কাজ হল তালীম-তরবিয়তে নিমগ্ন থাকা এবং নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টায় মগ্ন থাকা। (ছ) সকল প্রকার অনর্থক কাজ ও অন্যায় দখল-আন্দাজি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।
প্রিয় তালিবে ইলম!
আপনারা জামিয়ার সাথে এ অঙ্গীকার করে ভর্তি হয়েছেন যে, জামিয়ার সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলবেন। তাই কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া জামিয়া থেকে বের হওয়া বা জামিয়ার নিয়মের বাইরের কোনো কাজে অংশগ্রহণ করা আপনাদের জন্য বৈধ হবে না। আর কর্তৃপক্ষ ছাত্রদেরকে কখন অনুমতি দেবেন, কীভাবে দেবেন তা চূড়ান্ত করবেন শরয়ী নীতিমালা ও জামিয়ার সংবিধানকে সামনে রেখে, পরস্পর পরামর্শ ও চিন্তা-ভাবনার পর। এতে যদি অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় তাহলে পূর্ণ আনুগত্যের সঙ্গে তালিবে ইলম ভাইদের সে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো বদগুমানি-কুধারণা বা বদযবানি-কুমন্তব্য করার কোনোভাবেই আছে বলে মনে হয় না। এরপরও যদি আপনারা তা করেন, অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নিজে নিজে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাহলে সেটা হবে আবেগতাড়িত এমন অন্যায় কাজ, যা আপনাদের শিক্ষাজীবন বরকতহীন করে দেবে। সকলের শিক্ষার উদ্দেশ্যে ‘দারুল উলূম নদওয়াতুল ওলামার’ সাবেক নাযিমে আলা আল্লামা সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.)-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো।
একজন প্রখর মেধাবী ছাত্রের করুণ পরিণতি
তখন আল্লামা সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.) ভারতের নদওয়াতু ওলামা লক্ষ্মৌর নাযিমে আলা। নদওয়াতুল ওলামার এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর এসব পদক্ষেপ ও তার প্রতিক্রিয়ার কথা আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) লেখেন, ‘দারুল উলূম নদওয়াতুল ওলামার রূহানি ও ফিকরি তারাক্কীর জন্য সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.)-এর নতুন চিন্তা-ভাবনা ও পদক্ষেপগুলোর পক্ষে ছাত্রদের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি।বরং ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল নদওয়ার ১৯৪৩ সালের অনাকাঙ্খিত ছাত্র-ধর্মঘটের মাধ্যমে। যদিও ধর্মঘটের সূচনা হয়েছিল ব্যবস্থাপনাগত কিছু বিষয় থেকে, কিন্তু এর পেছনে মূল কারণ ছিল সাইয়েদ সাহেবের গৃহীত সংস্কার উদ্যোগ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ধর্মঘটের নেতৃত্বে ছিল আমাদেরই স্নেহভাজন কিছু শাগরিদ, যারা ছিল দারুল উলূমের প্রথম সারির ছাত্র। যাদের নিয়ে আমাদের, বরং পুরো দারুল উলূমের অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক আশা ও প্রত্যাশা ছিল। আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল আমার অতি প্রিয় ও স্নেহভাজন একজন ছাত্র। আমি দারুল উলূমে দশ বছর শিক্ষক ছিলাম। এরপর নায়েবে নাযিম ও নাযিম হিসেবেও বহুদিন কাজ করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে এই নওজোয়ানের চেয়ে মেধাবী, প্রতিভাবান ও রুচিশীল কোনো তালিবে ইলম আমি দেখিনি। দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তরে পড়ার সময় তাঁর অব্স্থা এমন ছিলো যে, সাবলিল আরবীতে সে লিখতে ও বলেতে পারত। তাতে নাহু-সরফের কোনো ক্রটি খুঁজে পাওয়াও মুশকিল ছিলো।
সে যখন চতুর্থ স্তরের ছাত্র তখন একবার তার পরীক্ষার খাতা দেখে আমার প্রিয় উস্তাদ আরবী সাহিত্যের পণ্ডিত মাওলানা খলীল আরব বলেছিলেন, ‘খাতাগুলি দিন, এগুলো দেখিয়ে যত বেশি বলুন, নদওয়ার জন্য আমি চাঁদা তুলতে সক্ষম।’
যখন সে চতুর্থ-পঞ্চম স্তরে পড়ে তখন তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো বিষয়ের ওপর আরবী ভাষায় সাবলিলভাবে বক্তব্য দিতে পারত। স্মৃতিশক্তি এত প্রখর ছিল যে, ওই বয়সেই ইকবাল, আকবর ইলাহাবাদী ও যফর আলী খানের মতো কবিদের হাজারো শের তার ঠোঁটস্থ ছিল। এই হাঙ্গামার পর যখন সে করাচি গেল, এত কম বয়সী হওয়া সত্ত্বেও করাচির ইলমী ও গবেষণা মজলিসগুলোতে আল্লামা খেতাবে বরিত হতে লাগল।
আন্দোলন-হাঙ্গামাগুলো যেমন ঘটে থাকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার নেতায় পরিণত হল। এই হাঙ্গামায় তার অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানে তার সকল উস্তাদ, বিশেষত আমি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণ আমি জানতাম, এই হাঙ্গামার সবচেয়ে বড় আঘাত আসবে সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.)-এর ব্যক্তিত্ব ও তার পরিচালনার ওপর। কারণ তিনি তখন নদওয়ার প্রধান মুরব্বি ও একমাত্র অভিভাবক। নদওয়ার জন্য তিনি ছিলেন জান কুরবান।
এ হাঙ্গামার কারণে সাইয়েদ সাহেবের দিলে খুব চোঁট লেগেছিল। তাঁর মনে নদওয়ার খেদমত ও ছাত্রদের তারবিয়তের বড় বড় স্বপ্ন ছিল, যা তিনি এই হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে ধুলোয় মিশে যেতে দেখলেন। তার সকল সাধনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার দৃশ্যও দেখতে পেলেন। তিনি বেচাইন হয়ে গেলেন এবং তাঁর দিল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) লিখেন, এই সময়েরই ঘটনা। আমাদের সেই প্রিয় ছাত্রটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেল। হালত এতই নাজুক হল, আত্মীয়-স্বজনরা তাঁকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখতে বাধ্য হল। বহু চিকিৎসা করানো হল। একপর্যায়ে তার এক ভাই আমাদের বাড়িতে এসে আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ডাক্তার সাইয়েদ আবদুল আলী সাহেবকে তার চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেল। বিশেষ সম্পর্কের সুবাদে আমিও তার সাথে গেলাম। বিশ্বাস করুন, ‘রশিতে বাঁধা আমার প্রিয় ছাত্রকে দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
আফসোস! মেধা ও প্রতিভায় যে ছিল সবার ঈর্ষার পাত্র, আজ তার এই করুণ অবস্থা!! আমার ভাই ওষুধ-পত্র লিখে তাশরীফ নিয়ে এলেন। সে সময় সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.) এতই ব্যথিত ছিলেন যে, রাতে দারুল উলূমে থাকতেন না। থাকতেন আমাদের ঘরে। একদিন একাকীত্বের সুযোগে আমি তাঁর কাছে আরয করি, ‘আমার ধারণা, অমুক ছাত্রটির মুখ থেকে আপনার ব্যাপারে কোনো শব্দ বের হয়ে গিয়েছিল। হাঙ্গামার তুফানে এটা অসম্ভব নয় যে, আবেগতাড়িত হয়ে কোনো অসৌজন্যমূলক আচরণ সে করে ফেলেছে। আর হাদীস শরীফে তো আল্লাহ বলেছেনই ‘যে আমার কোনো অলী-বুজুর্গকে কষ্ট দেবে, তার সাথে স্বয়ং আমি আল্লাহ যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।’ আর আপনি তো তার অত্যন্ত মুহসিন অভিভাবক ও শফীক মুরব্বি!!
উত্তরে সাইয়েদ সাহেব তাওয়াযূ ও বিনয়ের সাথে বললেন, আমিই বা আর তেমন কে? আমি পুনরায় একই কথা আরয করলাম এবং সেই ছাত্রটির জন্য দুআর দরখাস্ত করলাম। কিন্তু সাইয়েদ সাহেব চুপ রইলেন। কিছুই বললেন না।
দুই কি তিন দিন পর। তিনি আমাকে বললেন, ‘মৌলভী আলী! আমি আপনার হুকুম পালন করতে পেরেছি আশ্চর্য, এখন আপনি একে সাইয়েদ সাহেবের কারামত বলুন বা অন্য কিছু, এর পরপরই আমাদের এই প্রিয় ছাত্রটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল। আমি যতটুকু জানি, দ্বিতীয়বার সে এই রোগে আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু খুব কম বয়সেই ১৯৫০ সালে ক্ষণিকের জ্বলে উঠা এই প্রদীপ শিখা চিরদিনের জন্য নিভে গেল। আফসোস! সেই কলির তরে, না ফোটেই যা গেল ঝরে।
প্রিয় তালিবে ইলম বন্ধুরা!
এ মর্মস্পর্শী ঘটনাটি বারবার পড়ুন এবং অন্তরে খোদাই করে রাখুন। যদি উস্তাদদের ছায়ায় থেকে তাঁদের খেদমতে নিজেকে সঁপে দিতে না পারি, (যদিও এটিই ছিল একজন হাকীকী তালিবে ইলমের প্রধান কাজ) অন্তত এতটুকু সতর্ক তো অবশ্যই থাকতে পারি যে, আমার আচার-উচ্চারণ, কাজ-কর্মে যেন আমার উস্তাদকে ‘উফ’ বলতে না হয়। রব্বে করীম, আমাদের সকলকে আমল করার তওফিক দান করুন আমীন।