পাবলিক মাদরাসা বনাম প্রাইভেট মাদরাসা
মাওলানা মাহফুযুল হক
১. পাবলিক মাদরাসা: নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গং এ ধরণের মাদরাসার স্বত্বাধিকারী থাকে না। বাস্তবে মুসলিম সম্প্রদায় এগুলোর স্বত্বাধিকারী। আর কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক কাল্পনিক এক আইনি স্বত্বাকে মাদরাসার সকল সম্পদের মালিক গণ্য করা হয়। কমিটি বা মুতাওয়াল্লী বা শুরা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধী হিসেবে এগুলো পরিচালনা ও দেখভাল করে থাকে। এগুলো অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এগুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠান। নিছক সেবা প্রতিষ্ঠান।
এ ধরণের মাদরাসা থেকে যারা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেন তারা পূর্বনির্ধারিত হারে গ্রহণ করেন। কমিটি বা মুতাওয়াল্লীর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে তাদের সুযোগ সুবিধার হার নির্ধারিত হয়।
জমা-খরচ পরবর্তী উদ্বৃত্ত অর্থ ও সমুদয় সম্পদ মাদরাসার থাকে। কেউ তা ভোগ করার অধিকার রাখে না। আর ঘাটতি থাকলেও তা মাদরাসার দায়ে থাকে। পরিচালক বা মুহতামিমের দায়ে তা থাকে না।
পরিচালক, মুহতামিম, প্রতিষ্ঠাতা এ ধরণের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার পিছনে নিজেদের গাঁটের যা ব্যয় করেন তা দান হিসেবে করেন। এ ব্যয় তারা বিনিয়োগ হিসেবে করেন না। তাই তারা মারা গেলে মাদরাসার সম্পদে তাদের ওয়ারিসদের কোনো অধিকার থাকে না।
শত শত বছরের গড়ে উঠা ভাষায় আপামর জনসাধারণ মাদরাসা বলতে এ গুলোকেই বুঝে। ছওয়াবের জন্য, সদকায়ে জারিয়ার জন্য মানুষ মাদরাসা নামে যা দান করে, সহযোগিতা করে তা মাদরাসার এ পরিচয় ও ধারণার ভিত্তিতেই দান করে।
২. প্রাইভেট মাদরাসা: নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গং এ ধরণের মাদরাসার স্বত্বাধিকারী হয়। এগুলো সেবা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এ ধরণের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা ও পরিচালনা করার পিছনে উদ্যোক্তরা যা ব্যয় করেন তা দান হিসেবে করেন না। বরং বিনিয়োগ হিসেবে করেন। তাই জমা-খরচ পরবর্তী মাদরাসার যা উদ্বৃত্ত থাকে তা সম্পূর্ণটুকু উদ্যোক্তার একান্তই নিজস্ব আয়। উদ্যোক্তা মারা গেলে মাদরাসার স্থাবর-অস্থাবর সমুদয় সম্পদ তার ওয়ারিসদের সম্পদ গণ্য হবে।
প্রাইভেট মাদরাসার ইতিহাস একদম নতুন। কয়েক দশক মাত্র। অনেক সাধারণ মানুষ জানেই না, যে মাদরাসা প্রাইভেট হয়, বাণিজ্যিক হয়।
সাধারণ জনগণ না জেনে, না বুঝে, অসচেতনতার কারণে শুধু মাদরাসা নাম শোনেই শত শত বছরের গড়ে উঠা পরিভাষা ও পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রাইভেট মাদরাসায় দান করে।
অনেক প্রাইভেট মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মানুষের এ সরলতার সুযোগে নিজের প্রাইভেট মাদরাসার প্রাইভেট হওয়ার বিষয়টি দাতার কাছে গোপন রেখে, অস্পষ্ট রেখে মাদরাসার কথা বলে দান গ্রহণ করেন। যা সুস্পষ্ট প্রতারণা, ধোঁকাবাজি, শঠতা।
আমার পরিচিত ও আত্মীয়দের অনেককেই দেখছি মাদরাসার নামে জনগণের সাথে এ প্রতারণা করতে।
মাদরাসা করছি বলে জনগণ থেকে বাঁশ, কাঠ, ইট, সিমেন্ট, রড ইত্যাদি কালেকশন করে মাদরাসার ঘর করেছে আবার মাদরাসার জরুরত ও শিক্ষার্থীদের কষ্টের কথা বলে পানির পাম্প, পানির ট্যাঙ্কি, সিলং পাখা, কার্পেট ইত্যাদি কালেকশন করেছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের থেকে বেতন, ভর্তি ফি নিয়ে আর নিয়োগকৃত শিক্ষকদের বেতন দিয়ে যা থাকছে সব তার পকেটে। এমনকি কোনো কারণে প্রতিষ্ঠান থেমে গেলে এ সব দালানকোঠা, পাম্প, পাখা কার্পেট তাদের বা তাদের ওয়ারিসদের হয়ে যাবে।
ছাত্র-ছাত্রীদের মানসম্মত আবাসন সুবিধা না দিলে ছাত্র-ছাত্রী থাকবে না। ছাত্র-ছাত্রী না থাকলে পরিচালকের লাভ হবে না। তো পরিচালকের লাভের স্বার্থে আবাসন সুবিধার সামগ্রী অন্যরা দান করবে কেন। মনে করেন আমি রেস্টুরেন্ট দিয়েছি। আমার কাস্টমারদের বসার চেয়ার, টেবিল, বাতাসের পাখা, খাবারের থালা, মগ, পানির পাম্প, ট্যাঙ্কি আপনি দান করবেন কি।
আবাসিক শিক্ষার্থীদের থেকে বোর্ডিংয়ের পুরো মাসের টাকা নেয় তারা। আবার বাইরের কেউ বোর্ডিংয়ের সব ছাত্রকে দাওয়াত খাওয়াতে চাইলে তাও কবুল করে। মাসে ৫/৬ টা দাওয়াত আসলে বোর্ডিংয়ের যে টাকাগুলো বেঁচে গেল সেগুলোও প্রাইভেট মাদরাসার পরিচালকের নিজস্ব আয় হয়ে গেল।
এক পরিচালককে জিজ্ঞেস করলাম, মাদরাসা প্রাইভেট নাকি পাবলিক? তিনি বললেন, প্রাইভেটের মতো। আমি বললাম, ‘মতো’ আবার কি? পরিষ্কার একটা বলেন। পরে বললাম, ঘর করেছেন নিজের টাকায় নাকি দানের টাকায়? জানালেন, দানের। বললাম, তাহলে সরাসরির ‘পাবলিক’ বলতে পারছেন না কেন। তাতে তিনি লম্বা বক্তৃতায় যা বুঝালেন তার সার কথা হলো, অন্যদের বেতন দিয়ে যা থাকবে সব তার হবে।
অনেক প্রাইভেট মাদরাসা জাকাত কালেকশন করে। পরিচালকের বক্তব্য হলো, জাকাত তো আমি খাই না, ছাত্রদের খাওয়াই। এখানেও শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। জাকাত কালেকশন করে ফ্রি খাবার দিলে ছাত্র বাড়ে। আর ছাত্র বাড়লে ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন বাড়ে। যা পুরোটাই পরিচালকের ব্যক্তিগত আয়ে জমে। পাবলিকের জাকাত সরাসরি তার আয় বাড়াচ্ছে।
আবার এমনও দেখেছি, পাবলিক থেকে দুই হাত ভরে কালেকশন করে পৈতৃক ভূমিতে মাদরাসার বহুতল ভবন করছে। বললাম, জমি ওয়াক্ফ না করেই দানের টাকায় বাপের জমিতে বিল্ডিং করছেন? আজ বাদে কাল আপনি মারা গেলে বা আপনি মাদরাসা চালাতে না চাইলে জনগণের লক্ষ লক্ষ টাকার দানের এ ভবন কার হবে? জনগণ কি আপনাকে বা আপনার সন্তানদের জন্য দান করেছে?
বার্ষিক মাহফিল পাবলিক মাদরাসাগুলোর আয়ের একটা খাত। মাহফিলের আয় থেকে মাহফিলের ব্যয় সেরে এক থেকে কয়েক লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। যা পাবলিক মাদরাসাগুলোর পরিচালনা ও উন্নয়নে ব্যয় হয়। এখন দেখি প্রাইভেট মাদরাসাগুলোও ব্যাপক কালেকশন করে বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল করে। স্বাভাবিকভাবেই ওয়াজ মাহফিলের নামে কালেকশনের সমুদয় উদ্বৃত্ত প্রাইভেট মাদরাসার পরিচালকের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হয়।
অনেক বক্তাকে দেখি, ভক্তদের বলে, আমার মাদরাসায় এই দেন, সেই দেন। আর ভক্তরাও ভক্তিতে গদগদ হয়ে চোখ বন্ধ করে প্রিয় হুজুরের মাদরাসায় দান করে। খোঁজ নিয়ে দেখি নিজস্ব জমিতে প্রাইভেট মাদরাসা তার।
এভাবে অনেক প্রাইভেট মাদরাসাই প্রতারণার বহুমুখী ফাঁদ। আমি প্রাইভেট মাদরাসার বিপক্ষে বলছি না। আমি বলছি প্রতারণার বিপক্ষে। যদি কোনো প্রাইভেট মাদরাসা এমন হয় যে, উদ্যোক্তা কারোর থেকে দান গ্রহণ করেননি। সম্পূর্ণ শতভাগ নিজস্ব অর্থায়নে করেছেন। কেউ দান করতে আগ্রহী হলে তাকে বুঝিয়ে বলেন, এটা আমার নিজস্ব ও প্রাইভেট মাদরাসা। তাহলে এমন প্রাইভেট মাদরাসাকে সুস্বাগতম জানাই। দেশের আনাচেকানাচে, অলিতে-গলিতে মাদরাসা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রাইভেট মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা ও অবদান অনস্বীকার্য।
আমার স্পষ্ট কথা, আপনার মাদরাসা কোন ক্যাটাগরির তা দাতার কাছে পরিষ্কার করুন। প্রাইভেট দাবি করলে শতভাগ নিজস্ব অর্থায়নে করুন আর শতভাগ লাভ ভোগ করুন। জনগণ থেকে মাদরাসার নামে একটা টাকাও দান গ্রহণ করবেন না। বিপরীতে জনগণ থেকে মাদরাসার নামে দান গ্রহণ করতে চাইলে মাদরাসাকে অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করুন। নিজের জমি হলে এখনই মাদরাসার নামে ওয়াকফ বা দান রেজিস্ট্রি করুন। পরিচালনার ভার মুতাওয়াল্লী বা কমিটি বা শুরার হাতে ছেড়ে দিন। আপনি মাদরাসা থেকে আর্থিক সুবিধা নিতে চাইলে কর্তৃপক্ষভুক্ত হওয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখুন এবং কর্তৃপক্ষ থেকে যথাযথ নিয়োগ গ্রহণ করুন। আর কোনোরূপ আর্থিক সুবিধা নিতে না চাইলে আপনিও কর্তৃপক্ষভুক্ত থাকুন।
সাধারণ জনগণকে প্রতারকদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে হবে তো।
এখানে বেফাক বা অপরাপর বোর্ডগুলোরও যথেষ্ট অবহেলা আছে। বেশ আগে প্রাইভেট মাদরাসা দেশে ছিল না। সব মাদরাসাই তখন পাবলিক ছিল, ওয়াক্ফ ছিল, দাতব্য ছিল। বেফাক বা অন্য কোনো বোর্ডের নিবন্ধনের জন্য তখন কমিটির তালিকা ও কমিটির রেজুলেশন জমা দেওয়ার নিয়ম করা হয়েছিল। সে সময়ের জন্য এ একমুখী নিয়ম ঠিক ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে দেশে এখন প্রাইভেট মাদরাসা, বাণিজ্যিক মাদরাসা প্রচুর, অগণিত। তাইর বেফাকসহ অন্যান্য বোর্ডগুলোর এখন উচিৎ নিবন্ধন প্রক্রিয়ার নিয়ম একমুখী না রেখে, দুইমুখী করা। প্রাইভেট আর পাবলিক দুটি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে মাদরাসাগুলোকে নিবন্ধন দেওয়া। এ প্রাইভেট মাদরাসাগুলোও কিন্তু বর্তমানেনে বেফাক বা কোনো বোর্ডের নিবন্ধন প্রাপ্ত। প্রশ্ন দেখা দেয় প্রচলিত পুরোনো নিয়মে এগুলো কিভাবে নিবন্ধন পেল? এখানে চলে আরেক জালিয়াতি। বেফাকের নিবন্ধন পেতে নিয়ম রক্ষার্থে একটা কাগুজে কমিটি ও রেজুলেশন জমা দেওয়া হয়। অথচ বাস্তবে এ কমিটির কোনো অস্তিত্ব ও শক্তি থাকে না। থাকবে কিভাবে, মাদরাসা যে প্রাইভেট। বেফাক ও অপরাপার বোর্ডগুলো তাদের নিয়ম সংস্কার করতে পারে। মাদরাসার প্রাইভেট ও বাণিজ্যিক পদ্ধতিকে অফিসিয়াল স্বীকৃতি দিয়ে এ গুলোর নিবন্ধনের জন্য পৃথক নিয়ম ও শর্তারোপ করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে, শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য আমি নিন্দার চোখে দেখছি না। বরং শিক্ষা নিয়ে প্রতারণা বন্ধে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যকে অফিসিয়াল স্বীকৃতি ও নিয়মের আওতায় আনার পক্ষে। প্রতারণার থেকে নিয়মতান্ত্রিক বাণিজ্য ঢের ভালো।
প্রাইভেট মাদরাসার সাইনবোর্ডে, প্যাডে, সিলে ও সমস্ত কাগজে মাদরাসার নামের ভেতরে ‘প্রাইভেট’ শব্দের সংযুক্তি বাধ্যতামূলক করা দরকার। প্রাইভেট মাদরাসার নিবন্ধনের ভিত্তি কমিটিকে না রেখে উদ্যোক্তাকে ভিত্তি রাখা দরকার। উদ্যোক্তার পরিচয়ের ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করা দরকার।
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এবং আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া উদ্যোগ নেবে কি।