তুরস্ক ইসলামী ঐতিহ্যে ফিরে যাচ্ছে
(তুরস্কের রয়েছে সুদীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাস। উসমানী খেলাফতের পতন পরবর্তী দীর্ঘ বিরতির পর সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক আবারো প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার তুর্কি আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত এরদোয়ানের তৎপরতায় স্পষ্ট। বলাবাহুল্য, সেলজুকদের সময় থেকেই তুরস্কের সাথে ইসলামের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। আবার সবচেয়ে কট্টর সেক্যুলার শাসনও তুরস্কের মানুষ দেখেছে। সম্প্রতি তুরস্ক ধীরে ধীরে তার অতীতে ফিরে যাচ্ছে। তুরস্কের উত্থান–পতনের নানা বাঁকে ইসলামের অবস্থান কী ছিলো, আগ্রহী পাঠককে তা জানাতে লিখেছেন আবিদুল ইসলাম চৌধুরী—এডিটর’স নোট)।
রজব তাইয়েব এরদোয়ানের সময়ে তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। ক্রয় সক্ষমতা (পিপিপি) অনুযায়ী তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১৬৭ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৯৫ ডলারে।
তুরস্কের এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মধ্য এশিয়াসহ মুসলিম বিশ্বে বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করেছে। ২০১২ সালে তুরস্ক মুসলিম বিশ্বে বিনিয়োগ করেছিল ২২২ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ২০১৩ সালের হিসাবে, তুরস্ক মুসলিম বিশ্বে মানবাধিকার সহায়তা প্রদান করে ১.৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে সৌদি আরব করেছিল ১.৬ বিলিয়ন ডলার। বৈশ্বিকভাবে মানবাধিকার সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের (১.০৪ বিলিয়ন ডলার) অবস্থান চতুর্থ।
একেপির জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে, যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন তারাই এ দলের নেতৃত্ব আছেন। ফলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় একেপি’র ভূমিকাকে জনগণ সমর্থন করে। ‘ইসলাম গণতন্ত্রের শত্রু নয় কিংবা গণতন্ত্র ইসলামের বিরোধী নয়’– এই বিষয়টি একেপি বাস্তবায়ন করে দেখাতে পেরেছে।
তারা সীমিত পরিসরে মাদরাসা শিক্ষার ব্যবস্থা ও তার আধুনিকায়ন করেছে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সরকারের সহযোগিতায় নারীরা হিজাব পড়ার অধিকার ফিরে পেয়েছে। এছাড়া ২০১৪ সালে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও একেপি জোড়ালো অবস্থান নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও সেখানকার দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করতে পিছপা হয়নি।
পর্যালোচনা
সেক্যুলারিজমের ঝড়: সেক্যুলারিজমের তিনটি মডেল বিভিন্ন দেশে চর্চা হচ্ছে: রেডিক্যাল ফরাসী মডেল, মডারেট ব্রিটিশ মডেল ও লিবারেল আমেরিকান মডেল। আধুনিকতার নামে ফ্রেঞ্চ রেডিক্যাল সেক্যুলারিজমের মডেলটি কঠোরভাবে তুরস্কের জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অন্য কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের জনগণকে এ রকম প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি।
অরাজনৈতিক ধর্মীয় গণশিক্ষা পদ্ধতি: রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত চরম ধর্মবিরোধী নীতির প্রেক্ষিতে বদিউজ্জমান নূরসী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলাম সম্পর্কে আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতি-নিরপেক্ষ ধর্মীয় শিক্ষা পদ্ধতির অনুসরণ করেন। ফলে তুরস্কের সমাজ ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠে এবং ইসলামের প্রভাব ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হতে থাকে। এক পর্যায়ে রাষ্ট্র-আরোপিত ধর্মহীনতাবাদ ক্রমান্বয়ে সহনশীল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে রূপ লাভ করে।
ধর্ম সমর্থনকারীদের দৃশ্যমান নীতিগত ঐক্য: চরম প্রতিকূল অবস্থায় এরবাকানের ‘মিল্লি গুরুশ’কে কেন্দ্র করে ইসলামপন্থীদের মধ্যে আদর্শ ও নীতিগত যে ঐক্য-চেতনা গড়ে উঠে, তা মোটাদাগে এখনো সক্রিয়। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে মতানৈক্য দেখা গেলেও ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে তুরস্কের ইসলামপন্থীদের মধ্যে তেমন কোন দ্বিমত পাওয়া যায় না। যুগপৎভাবে সরকারী ও বিরোধী দলে ইসলামপন্থীদের নানা মাত্রায় প্রভাব লক্ষ করা যায়।
অর্থনৈতিক সফলতাকে গুরুত্বারোপ: গত এক দশক ধরে ৫ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে তুরস্ক। সমকালীন বিশ্বমন্দা ইউরোপের বাজারকে স্তিমিত করে দিলেও তুরস্ক তার অর্থনীতিকে উন্নয়নের ধারায় ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। যদিও বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতি ও ভূরাজনৈতিক ইস্যুগুলোর কারণে তৃতীয় প্রান্তিকে এসে তারা জিডিপি’র লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ অর্জন করতে পারেনি। ব্যাংক ঋণের লাগাম টেনে ধরার জন্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা আগের তুলনায় কিছুটা খারাপ। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে সফল হলে তুরস্কের অর্থনীতি আরো গতি পাবে বলে আশা করা যায়।
জাতির সামনে বৃহত্তর লক্ষ্যকে হাজির করা: মানযিকার্ট যুদ্ধের এক হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০৭১ সালকে তুরস্কের লক্ষমাত্রার বছর হিসেবে এরদোয়ান ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন। যা তুরস্কের জনগণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে বেশ উজ্জীবিত করেছে। গত এক দশকের বেশি সময় থেকে তুরস্ক স্বীয় পররাষ্ট্র নীতিকে ঢেলে সাজিয়েছে। গাজা ইস্যুতে তুরস্কের ভূমিকা, আরবি ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে চালু করার সংকল্প ঘোষণা, পাকিস্তানে সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিচালিত স্কুলে তালিবান হামলায় নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণাসহ নানা ধরনের ত্বড়িৎ ও সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা মুসলিম বিশ্বের শীর্ষনেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রভাবে তখন ইসলামের সময়োচিত ব্যাখ্যা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো। তৎকালীন উসমানীয় খেলাফতের রক্ষণশীল কার্যক্রম ইসলামী মূল্যবোধ ও ভাবাদর্শের গতিশীলতাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে এক সময়ের প্রতাপশালী সাম্রাজ্যে ভাঙ্গনের শুরু হয়। মুসলিম সাম্রাজ্যের নেতা তথা খেলাফতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিচালনাকারী হিসেবে উসমানীয়দের বিভিন্ন অদূরদর্শীতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুরো মুসলিম বিশ্বে। এক পর্যায়ে কামাল আতাতুর্কের মত আধুনিকমনস্ক তুর্কী নেতৃত্ব প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান গ্রহণ করে স্বীয় ইসলামী ঐতিহ্যের বিরুদ্ধেই খড়গহস্ত হয়ে উঠেন।
ইসলাম চর্চার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সাঈদ নূরসীর মতো তাত্ত্বিক-কর্মবীর ইসলামের সর্বজনীন ব্যাখ্যাকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে তুলে ধরতে সমর্থ হন। এ কারণে, দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মহীনতার চর্চা হলেও তুরস্কের সমাজ থেকে ইসলাম হারিয়ে যায়নি। বর্তমান তুরস্কের রাজনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। ইসলামের সময়োপযোগী ব্যাখ্যাগুলো ধীরে ধীরে সুধীসমাজ ও সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
একবিংশ শতাব্দীর শুরু হতে একেপির মতো ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল দলের ধারাবাহিক বিজয় বিশ্বের মুসলিম রাজনীতির জন্যে একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে। অবশ্য সরকারের প্রতি জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও এরবাকানের টিকে থাকতে না পারাটা একেপি’র জন্যে সতর্কবার্তা। এরদোয়ানের মত প্রাজ্ঞ নেতা বর্তমান তুরস্কের তরুণ প্রজন্মকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নই শুধু দেখাচ্ছেন তা নয়, এর সাথে সাথে তুরস্ককে ভবিষ্যত পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য করে গড়ে তোলার কাজ ইতোমধ্যে শুরু করেছেন। তুরস্ক সরকারের নানা ধরনের সাহসী পদক্ষেপের ফলে বিশ্বগণমাধ্যম কর্তৃক এরদোয়ানকে ‘নতুন খলিফা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
অর্থনীতির উন্নয়ন ও প্রবল জনসমর্থন নিয়ে সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ ও দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির সমন্বয়ে তুরস্ক এমন একটা অবস্থানে এসেছে যার ফলে তারা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শক্তিশালী সমরতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসায় সক্ষম হয়েছে। তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের সেই সব দেশগুলোর অন্যতম যারা নিপীড়ক সেনাবাহিনী, চরম বিরূপ বিচার বিভাগসহ উল্লেখযোগ্য সব বিরোধী শক্তিকে সহনশীল মাত্রায় নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রায়োগিক কর্মনীতি অনুসরণের মাধ্যমে তারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’কে এ পর্যন্ত অকার্যকর প্রমাণ করেছে।
তুরস্ক তার গৃহীত এসব পদক্ষেপ সফলতার সাথে বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে পারলে বিশ্ব রাজনীতি এক নতুন সমীকরণ তৈরী হবে। কৌশলগত কারণে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রের তালিকায় থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের পাশাপাশি শক্তিশালী কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থান পরাশক্তিগুলো কতটুকু সহ্য করবে সেটা অবশ্য দেখার বিষয়। সাবেক প্রতিপক্ষ রাশিয়ার সাথে তুরস্কের দৃশ্যমান সাম্প্রতিক বন্ধুত্ব কতদিন টিকে সেটাও দেখার বিষয়। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ নিয়ে জটিতার অবসান এখনো শেষ হয়নি। এসব বৈদেশিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও পরিপক্ব ও সময়োচিত নীতির কারণে তুরস্ক আজ এপর্যন্ত আসতে সক্ষম হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে তুরস্ক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।