আর্তমানবতার সেবায় মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুস (হাজী সাহেব হুজুর রহ.)
সাঈদ হোসাইন
পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ করছে। ক’জন মানুষ স্বীয় কর্মের মাধ্যমে দেশ-জাতির উপকারে আসে! নিজের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে এসে চির অমরত্ব লাভ করেছে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক মহাপরিচালক আল্লামা মুহাম্মদ ইউনুস (হাজী সাহেব হুজুর রহ.) (১৯০৬-১৯৯২ খ্রি.) এমনই একজন ব্যক্তি ছিলেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের অসহায় আর্ত, দরিদ্র, দুস্থ মানুষের প্রতি তিনি সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সবসময়।
জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক সহকারী মহাপরিচালক ও ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি আবদুর রহমান (রহ.) তাঁর সেবা-কর্ম সম্পর্কে বলেন, আমি সুদীর্ঘ ৩৫ বছর তাঁর সঙ্গে ছিলাম। যখন খালেক ও মালেকের সঙ্গে নিয়াজও নওয়াজ করতেন, তখনও ছিলাম পাশে। তিনি আমার উস্তাদও ছিলেন না, পীরও নন। তবু তাঁকে আমি নিজের পীর ও উস্তাদের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা ও অগাধ আস্থার সঙ্গে মেনে চলেছি। সুদীর্ঘ চলার পথে তাঁর জীবনের পরতে পরতে যে জিনিসটি আমি দেখেছি, তা হলো নবী করীম (সা.)-এর ওই পাঁচটি আদর্শ তাঁর মধ্যে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
নবী করীম (সা.) সর্বপ্রথম অহীপ্রাপ্তির পর গারে হেরা থেকে উম্মাহাতুল মুমিনীন সাইয়িদা খদিজাতুল কুবরা (রাযি.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘আমি নিজের ওপর আশঙ্কা বোধ করছি। জবাবে উন্মাহাতুল মুমিনীন সাইয়িদা খদিজাতুল কুবরা (রাযি.) রসুলে কারিম (সা.)-এর পাঁচটি আদর্শের কথা এখানে উল্লেখ করে বলেছেন, যেহেতু আপনি ১. আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন। ২. দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন। ৩. নিঃস্বকে সাহায্য করেন। ৪. দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। ৫. মেহমানের মেহমানদারি করেন। তাই আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না।’
হজরত হাজি সাহেব (রহ.)-এর জীবনে এই পাঁচটি আদর্শ আমি পুরোমাত্রায় অবলোকন করেছি। তাঁর এই বিশাল জীবনীগ্রন্থে হজরত হাজী সাহেব (রহ.)-এর উল্লিখিত পাঁচ আদর্শের ভিত্তিতে অতিবাহিত জীবনের সামান্যতম চিত্রও ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। তাঁকে কোনো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে অসদাচরণ করতে কখনো দেখিনি। সব সময় সর্বাবস্থায় আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে দেখেছি।
দুর্বলের দায়িত্ব বহনের ক্ষুদ্র একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি, যাতে সহজে অনুমান করা যায়, এই আদর্শটি তাঁর মধ্যে কী মাত্রায় ছিল। মক্কা শরীফে আমরা একসঙ্গে কোথাও যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে দেখা আমার এলাকার একটি সরকারি মাদরাসার প্রিন্সিপালের সঙ্গে। তিনি কতগুলো কিতাব কিনেছেন এবং সেগুলো বহন করে বাসা পর্যন্ত নিতে পারছেন না। হজরত হাজি সাহেব (রহ.) বললেন, চলো এগুলো আমরা নিয়ে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসি। এ কথা বলে তিনি কিতাবের একটি কার্টন মাথায় তুলে নিলেন। আমরাও নিলাম। পৌঁছে দিলাম প্রিন্সিপালের বাসায়। এই ছিল তাঁর আদর্শ। নিঃস্ব এবং দুর্দশাগ্রস্তের সাহায্যের ক্ষেত্রে তিনি যা করেছেন, তা কয়েক ডজন এনজিও মিলেও করতে পারবে বলে আমি মনে করি না।
মেহমানদারি। এটি তো তাঁর মধ্যে এত মাত্রায় ছিল যে রাত যত গভীরই হোক না কেন, কোনো মেহমান এলে তিনি নিজে রান্নাঘরে গিয়ে মেহমানের জন্য আহার-বিহারের ব্যবস্থা করতেন নিঃসংকোচে। তিনি এ কথা পূর্ণমাত্রায় বিশ্বাস করতেন, মেহমানের যথাসাধ্য সম্মান ও খেদমত করা ঈমানের লক্ষণ। যেমন- হাদীস শরীফে বর্ণিত, হজরত আবু হুরায়রা (রাযি.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।’
এ আদর্শগুলোর ওপর গোটা জীবন তিনি অবিচল ছিলেন বলে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সর্বত্র। অপমানিত হননি জীবনে কখনো। এই আদর্শের প্রতীক ছিলেন বলেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন শায়খুল আরব ওয়াল আযম। এই আদর্শগুলো তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতি ও তাঁর জীবন থেকে সবার জন্য শিক্ষণীয়।
আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে এই কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তাঁর মতো এমন মুরব্বি এ দেশে আগেও দেখিনি, বর্তমানেও না, ভবিষ্যৎ আল্লাহই জ্ঞাত। (কালের কণ্ঠ, ৪ এপ্রিল ২০১৪)
জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক মুহাদ্দিস আল্লামা নুরুল ইসলাম জাদিদ (রহ.) বলেন, পরোপকার সম্পর্কে তাঁর অবদান সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। কার ঘরে অভাব, কার ঘর ভেঙ্গে পড়েছে, কার গৃহ নির্মাণের একান্ত প্রয়োজন, কে কর্জের বোঝায় জর্জরিত। সব বিষয়ে তিনি খোঁজ-খবর নিতেন। আর বিত্তশালী লোকদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সংগোপনে তা দরিদ্র-গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। বহু সংখ্যক দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানাভাবে বিপুল পরিমাণ সাহায্য দান করে আসছেন। নানা জায়গায় নতুন মাদরাসা স্থাপনসহ বহু সংখ্যক নতুন মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংস্কারযোগ্য পুরাতন মসজিদগুলোর সংস্কার সাধনে ব্রতী হন। তা ছাড়া পার্বত্য এলাকায় যেখানে খ্রিস্টান মিশনানিরা ফ্রি চিকিৎসার নামে মুসলমানদের ঈমান-আকীদা হরণ করে নিচ্ছে তাদের মোকাবেলায় হজরত হাজী সাহেব হুজুর (রহ.) তারই পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের সুখ বিলাস আর বান্দরবান শহরের প্রপারে মসজিদ, মাদরাসা ও হাসপাতাল স্থাপন করে স্থানীয় পাহাড়ীয়া লোকদের শিক্ষা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। যাতে তারা খ্রিস্টান না হয়ে ইসলামের দিকে ধাবিত হতে সক্ষম হয়।…
১৯৬০ ইংরেজির প্রলয়ংকরী সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস যা কুতুবদিয়া, মহেষখালী, ও আনোয়ারার পশ্চিমাংশে মারাত্মক আঘাত হেনেছিল, হজরত হাজী সাহেব হুজুর (রহ.) সে সময় নিরাশ্রয় মানুষের জন্য খাদ্য সামগ্রী, কাপড় ও নগদ অর্থদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এমনকি দুই-তিন দিনের পরিত্যক্ত গলিত লাশসমূহের কাফন পরিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করেন। দেশ-বিদেশের বিত্তশালী লোকজনের হজরত হাজী সাহেব হুজুরের ওপর অগাধ বিশ্বাস ছিল বিধায় তারা হজরত হাজী সাহেব হুজুরের মাধ্যমে সাহায্য সামগ্রী বন্টন করান। (মাসিক আত–তাওহীদ, আগস্ট ১৯৯২)
জামেয়া দারুল মাআরিফের সহকারী মহাপরিচালক মাওলানা ফুরকানুল্লাহ খলীল বলেন, হজরত হাজী সাহেব (রহ.) ছিলেন একজন অসাধারণ জনদরদী সমাজসেবক। যখনই যেখানে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সাহায্যের হাত বাড়াতে ছুটে গেছেন তিনি। বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন। চট্টগ্রাম-ককসবাজারের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কবলিত উপকূলীয় অঞ্চলের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সব শ্রেণির মানুষ তাঁকে একজন মানুষদরদী বুজর্গ হিসেবেই বেশি চিনেন। ১৯৬৫ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ককসবাজারের উপকূলীয় এলাকাসমূহ বিশেষত মহেশখালী দ্বীপ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অধিকাংশ ঘর-বাড়ি, মসজিদ-মাদরাসা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বড় মহেশখালী নতুন বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও ইমদাদিয়া মাদরাসার পুরাতন টিনের ছাউনী সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায়। শুধু মাটির কাঁচা দেয়ালগুলো খাড়া ছিলো। তখন আমি রামু চাকমারকুল মাদরাসায় সবেমাত্র জামায়াতে শশম শেষ করে বাড়িতে অবস্থান করছি। আমি এবং আমার সহপাঠী নুরুল আমিন (বর্তমানে দারুল মা‘আরিফে কর্মরত) রাতে বিধ্বস্ত মসজিদ-মাদরাসার জিনিসপত্র পাহারা দিতাম। একদিন হজরত হাজী সাহেব হুজুর সম্ভবত হাটহাজারীর মরহুম কারী ফয়েজ আহমদসহ (তখন পটিয়ার মুবাল্লিগ ছিলেন) নতুন বাজারে আসলেন। মসজিদ-মাদরাসার দুরবস্থা দেখে খুবই ব্যথিত হলেন। মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আলতাফ ও মসজিদের ইমাম-খতীব এবং হিতাকাঙ্ক্ষী কিছু লোকজন ডেকে মসজিদ-মাদরাসার জন্যে নগদ সাহায্য দিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। এই সফরে গোটা মহেশখালীর আনাচে-কানাচে গিয়ে নগদ সাহায্য প্রদান করেছেন। (মাসিক আল–হক, নভেম্বর ২০১৪)
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন লিখেন, ১৯৭১ সালের ২৩ শে এপ্রিলের প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসে আশ্রয়হীন ও বাস্তুভিটা হারা হাজারো আদমসন্তানের পূনর্বাসনের জন্য তিনি নগদ টাকা, খাদ্য বস্তু, ওষুধপত্র ও নির্মাণসামগ্রী বিতরণ করেন। দুর্গত এলাকায় ৫৪টি মসজিদ তিনি নূতনভাবে নির্মাণ করেন এবং প্রায় ১৫০০ মাদরাসা ও মসজিদ আংশিকভাবে মেরামত ও পুনর্নির্মাণে অর্থ যোগান দেন। মক্কাভিত্তিক রাবেতা আলমে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ত্রাণসংস্থার চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে তিনি মুবাল্লিগ নিয়োগ ও ত্রাণ বিতরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বিত্তশালী লোকদের কাছে অর্থ সংগ্রহ করে। ক্ষুধার্ত ও বুভুক্ষ মানুষের মাঝে বিতরণ করাই ছিল হুজুরের আমৃত্যু চেষ্টা-সাধনা। (হেরার জ্যোতি, ৩০ এপ্রিল ১৯৯২)
১৯৭০ ও ১৯৮৫ সালের প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসের সময় তিনি আর্তমানবতার সেবায় পাগলপারা হয়ে ছোটাছুটি করেছেন। এমনকি ১৯৯১ সালের নজীরবিহীন জলোচ্ছ্বাসের সময় আর্তমানবতার জন্য তাঁর ত্যাগ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। তখন তিনি এককভাবে ছয় কোটি টাকার রিলিফ বিতরণের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন। (দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩)
উল্লেখ্য যে, ১৯৯১ সালের ২৯ শে এপ্রিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর আল্লামা মুহাম্মদ ইউনুস (হাজী সাহেব হুজুর রহ.) ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় ত্রাণ বিতরণ, মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, এতীম-মিসকিন-দরিদ্র ছাত্র ও আলেমদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান এবং দাওয়াতী তৎপরতা পরিচালনার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশা ফাহাদ বিন আবদুল আজিজসহ মধ্যপ্রাচ্যের আমিরদের নিকট সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আর্থিক সহযোগিতা আসতে শুরু করে সরকারিভাবে।
১৯৯১ সনের ২৮ জুন আল্লামা মুহাম্মদ ইউনুস (রহ.) ইসলামী রিলিফ কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানের কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিম্নে দেওয়া হল:
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যেকোনো দুর্ঘটনায় বিপন্ন অথবা আর্থিক অভাব-অনটনে আক্রান্ত জনগণকে সময়োপযোগী সাহায্য সরবরাহ বা জরুরি পুনর্বাসনের সূত্রে তাদের মাঝে দীনী চিন্তাধারা এবং ইসলামী তহজীব-তামাদ্দুনের প্রচার-প্রসার ঘটানো।
- ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন, অগ্নিকান্ড ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত বা ক্ষতিগ্রস্থ মাদরাসা, মসজিদ, এতিমখানাসমূহের পুননির্মাণ ও সংস্কার করে আর্থিক সহায্য প্রদান করা।
- দীনী শিক্ষার উৎকর্ষ সাধন ও দীনী দাওয়াতের ব্যাপক প্রচারের লক্ষ্যে দেশের সাধারণ মাদরাসা, মসজিদ, ফোরকানিয়া ও হেফজখানা এবং এতিমখানায় জরুরি আর্থিক সহায়তা করা।
- ইসলামী আকীদা, বিশ্বাস ও রীতি-নীতির প্রচার এবং সমাজ থেকে বিভিন্ন প্রকার অসামাজিক কার্যক্রম যেমন- নারী নির্যাতন, মাদকদ্রব্য সেবন, হত্যা, জুলুম প্রতিরোধ কল্পে কাজ করা।
- নব মুসলিমদেরকে পুনর্বাসন, দীনী শিক্ষা-দীক্ষা লাভ এবং তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা।
- গরীব মেয়েদের বিয়েতে আর্থিক সহায্য ও সহযোগিতা দান করিয়া কন্যা দায়গ্রস্ত থেকে পিতাকে মুক্তি দান করা।
- মৃত বেওয়ারিস লাশ দাফন কাফন করার ব্যবস্থা করা (ইসলাম ধর্মের লোক)।
- দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র: গরীব অসহায় রোগীদের জন্য একটি দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র খোলা বা অনুরূপ দাতব্য চিকিসা কেন্দ্রে আর্থিক সহযোগিতা দান করা। (গঠনতন্ত্র, ইসলামী রিলিফ কমিটি, পৃ. ২)
১৯৯১ সালের জুলাই থেকে ১৯৯২ সালের জুন পর্যন্ত ইসলামী রিলিফ কমিটির তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার, চকরিয়া মহেশখালী, কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, ফটিকছড়ি, রামগড়, মিরশ্বরাই, হাতিয়া, সন্দ্বীপ অঞ্চলে ১৭টি মসজিদ, ৪ টি মাদরাসা, ৯টি এতিমখানা, গরীব-দুঃখীদের জন্য ২২৩টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। (বার্ষিক প্রতিবেদন, ইসলামী রিলিফ কমিটি, পৃ. ৪)
সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পাশাপাশি নওমুসলিম পুনর্বাসন সংস্থা গঠনও ছিল হাজী সাহবে হুজুরের আরেক মহান কর্ম। তার পরিকল্পনা ছিল শক্তি ও সামর্থ অনুযায়ী নওমুসলিমদের সাহায্যে এগিয়ে আসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।…
হেদায়তের আলো থেকে বঞ্চিত মানুষের কাছে দ্বীনের আলো পৌছানো এবং ধর্মান্তরিত নওমুসলিমদের সব রকম সহযোগিতার লক্ষ্যেই হাজী সাহেব হুজুর (রহ.) উল্লিখিত দুটি মিশনানি সেন্টার স্থাপন করেন। নওমুসলিম পুনর্বাসন কেন্দ্রের উদ্যোগে তিনি তার জীবদ্দশায় অনেক সংখ্যক নওমুসলিমের নৈতিক, মানবিক, আত্মিক ও আর্থিক উন্নতি সাধনে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। (কুতবে জমান, শায়খুল আরব ওয়াল আজম আল্লামা শাহ হাজী মুহাম্মদ ইউনুস (রহ.): জীবন কর্ম অবদান, লেখক: মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, পৃ.১৯৮–১৯৯)
সমাজতান্ত্রিক বার্মা সরকারের নিপীড়নের কারণে হাজার হাজার বর্মি মুসলমান বাস্তুভিটা হারিয়ে ১৯৭৮ সালে নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করলে এক আন্তর্জাতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। মানবিক এ সমস্যার প্রতি বিশ্বের ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশের জনগণ ও সরকার প্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য নেজামে ইসলাম পার্টি এক কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে। নেজাম নেতা মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ আমেরিকা ও সউদি আরবের রাষ্ট্রপ্রধান এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে জরুরি তারবার্তা প্রেরণ করে বর্মি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান। বায়তুল মোকাররম চত্বরে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় তিনি উদ্বাস্তু সমস্যাটি আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানান। চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে আয়োজিত অপর এক গণজমায়েতে মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ সাহেব বাংলাদেশ সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘আগামী ১ মাসের মধ্যে বার্মা সরকারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বর্মি মুসলমানদেরকে তাদের নিজ বাসভূমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করলে আমি উদ্বাস্তুদের নিয়ে লংমার্চ করে টেকনাফ নদী অতিক্রম করব।’
নেজামে ইসলাম নেতা পটিয়া আল-জামেয়া আল-ইসলামিয়ার প্রধান পরিচালক আলহাজ মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুছ (প্রকাশ হাজী সাহেব হুজুর) সাহেব আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সহায়তায় বর্মি শরণার্থীদের মধ্যে লাখ লাখ টাকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। (জাতীয় রাজনীতি ও ইসলামী আন্দোলনে নেজামে ইসলাম পার্টিম ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, পৃ. ১৭)
এ সম্পর্কে মাওলানা রমিজ আহমদের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি। তাঁর জবানি পড়ি, ‘১৯৭৮ সালের ঘটনা। জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণের জন্য একদিন আগেই আমি সেখানে গিয়ে পৌঁছি। প্রথমেই আমি হাজী সাহেব হুজুর (রহ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করি। তখন তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। বিছানায় শোয়াবস্থায় তিনি আমার সাথে মোসাফাহা করলেন। আলাপের শুরুতেই তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আরাকানী মুসলিম শরণার্থীদের অবস্থা কি?’ উত্তর দিতে আমার একটু দেরি হচ্ছিল। ইতিমধ্যেই তিনি বিছানায় উঠে বসলেন এবং বলতে লাগলেন, ‘বর্মি সামরিক জান্তার নির্যাতন ও বর্বরতার শিকার হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে; তাদের খোঁজ-খবর না নিয়ে তুমি এখানে কেন এসেছ? এখনি চলে যাও, যতদুর সম্ভব তাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করো এবং আমার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে আমার এই আবেদন পৌঁছিয়ে দেবে।
হজরত হাজী সাহেব হুজুরের (রহ.) নির্দেশ মোতাবেক আসর নামায আদায় করার পর পরই আমি কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। রাতে মহেশখালীস্থ গোরকঘাটা বাজারে পৌঁছে দোকান থেকে কিছু টাকা নিয়ে পরদিন উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী শিবিরসমূহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সেখানে পৌঁছে হাজার হাজার নির্যাতিত ও ইজ্জত-আব্রু হারা মুসলিম নর-নারীর করুণ চিত্র দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। তৎক্ষণাৎ আমি সেখান থেকে চলে আসি এবং কক্সবাজার ও মহেশখালীর বেশ কিছু সংখ্যক গণ্যমান্য ও বিত্তশালী বন্ধু-বান্ধবগণের সাথে সাক্ষাৎ করি। তাদেরকে শরণার্থী শিবিরসমূহের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করি এবং হজরত হাজী সাহেব হুজুরের (রহ.) আবেদনের কথা জানিয়ে দিই। তাঁরা প্রায় সকলেই তৎক্ষণাৎ এ আবেদনে সাড়া দেন এবং প্রায় দুই শত ইঞ্জিন-চালিত নৌকাযোগে বিপুল পরিমাণ সাহায্যসামগ্রী নিয়ে সমুদ্র পথে টেকনাফ রওনা হন। এতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীরও সক্রিয় সহযোগিতা ছিল বৈকি।
আমরা দুই দিন পর হ্নীলা দারুস সুন্নাহ মাদরাসায় গিয়ে পৌঁছি। সেখানে আগে থেকেই খতীবে আযম হজরত মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ সাহেব (রহ.) অবস্থান করছিলেন। তাঁর সাথে আমার মোলাকাত হওয়া মাত্রই তিনি বললেন, ‘গাঙচিলের আগমনই হাজীদের জাহাজ আসার নির্দেশ করে। সুতরাং মওলভী রমিজকে দেখেই আমার অন্তর সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, হজরত হাজী সাহেবও পৌঁছে গেছেন।’
বাস্তবিকপক্ষেই হজরত খতীবে আযম (রহ.) এর এ ধারণা সঠিক হয়েছিল। দুই ঘণ্টার মধ্যেই হজরত হাজী সাহেব হুজুর (রহ.) শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্যসামগ্রী ও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে গাড়ি রিজার্ভ করে হ্নীলা এসে পৌঁছেন। হজরত খতীবে আযম (রহ.) তাঁকে দেখে খুবই আনন্দিত হলেন এবং বলতে লাগলেন, ‘আপনাকে না পেয়ে আমি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করতে পারছি না। এতদিন পর্যন্ত কেবল ঢাকাবাসীদের প্রেরিত ত্রাণসামগ্রী বিতরণেই ব্যস্ত ছিলাম। হজরত হাজী সাহেব হুজুর (রহ.) বললেন, ‘হুজুর, ‘গুরুত্বপূর্ণ কাজ’ সমাধা করার আগে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে থাকতে দেখতে পাচ্ছি। শরণার্থীদের পেশাব-পায়খানার ব্যবস্থা করা না হলে বেচারাদের কি দুর্দশাই না হবে?’
হজরত খতীবে আযম (রহ.) আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘সত্যিই তো, আজ তিন দিন যাবত এ বিষয়টি আমার মনে আসেনি। পানাহারের ব্যবস্থা করা তো দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। পেশাব-পায়খানার ব্যবস্থা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বলুন, এখন আমরা কোন পন্থা ও পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারি?’ হজরত হাজী সাহেব হুজুর (রহ.) বললেন, ‘আমি সাথে চট নিয়ে এসেছি। ইনশাআল্লাহ, এগুলো দিয়ে একশখানা পায়খানার ব্যবস্থা করা যাবে। তবে কাজ করার জন্য কিছু লোকের প্রয়োজন।’ অতঃপর হাজী সাহেব হুজুর (রহ.) আমাকে নির্দিষ্ট মাপ অনুযায়ী চটগুলো টুকরো করার জন্য আদেশ দেন। আমি যথানিয়মে কাজে লেগে যাই। এদিকে হাজী সাহেব হুজুর (রহ.) নিজেও পূর্ণ উদ্যম ও সাহসিকতার সাথে কাজে অংশগ্রহণ করেন। হজরত খতীবে আযম (রহ.) বিশজন লোক যোগাড় করে নিয়ে আসেন। আল্লাহর রহমতে একদিনের মধ্যেই শরণার্থী শিবিরের বিভিন্ন স্থানে একশখানা পায়খানা নির্মিত হয়। শিবিরের মহিলাদের মুখে এ দোয়া করতে শুনা যায় যে, ‘যে নেক ব্যক্তি এসবের ব্যবস্থা করেছেন, আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিনা হিসাবে জান্নাত দান করুন।’
হজরত হাজী সাহেব হুজুর (রহ.) ও হজরত খতীবে আযম (রহ.) প্রায় ছয় রাত নিদ্রা যাননি। শরণার্থীদের সেবা, খোঁজ-খবর নেওয়া ওয়াজ-নসিহত প্রভৃতি কাজে তাঁরা সার্বক্ষণিকভাবে ব্যস্ত ছিলেন। শুধু বৈষয়িক সাহায্য নয়, আধ্যাত্মিক বিষয়ের প্রতিও তাঁরা গুরুত্বারোপ করতেন। রাতে হজরত হাজী সাহেব হুজুর (রহ.)-এর সাথে আমার যাবার অনুমতি ছিল না। শুধু এতটুকু জানি যে, তিনি রাতেও শরণার্থীদের অবস্থার খোঁজ-খবর নিতেন। হজরত খতীবে আযম (রহ.) দিনের বেলায় অল্পক্ষণ আরাম করতেন। কিন্তু হজরত হাজী সাহেব হুজুর (রহ.) দিনের বেলায়ও আরাম করতেন না। অবশেষে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন যে, ‘শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও বার্মার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তখন হ্নীলা দারুসসুন্নাহ মাদরাসার মসজিদে কিছু নফল নামায আদায় পূর্বক আমরা সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করি। হজরত খতীবে আযম (রহ.) দু’দিন আগেই চলে এসেছিলেন। (মাসিক আত–তাওহীদ, সেপ্টেম্বর ১৯৯২ সংখ্যা, পৃ. ৩৪–৩৫)
এ দুজন আকাবিরের দূরদর্শিতা ও সুচিন্তিত কর্মপ্রয়াস আমাদের হতবাক করে দেয়। তাঁরা একদিকে আমেরিকা, সউদি আরব ও জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে বর্মা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান। অন্য দিকে বাংলাদেশ সরকারকে বার্মা সরকারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বর্মি মুসলমানদেরকে তাদের নিজ বাসভূমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁরা শুধু এগুলোতেই ক্ষ্যান্ত হননি। পাশাপাশি উদ্বাস্তুদের সেবা-শুশ্রূষা, খোঁজ-খবর নেওয়া, অন্য-বস্ত্র-বাসস্থান ও দীনি শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করাসহ সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করতেন, যাতে সাহায্য-সহযোগিতার আড়ালে স্বার্থান্বেষী এনজিও গোষ্ঠী এদের ওপর তাদের নখর-থাবা ফেলতে না পারে। এ দুজন বরেণ্য আকাবিরের অঙ্কিত রেখাচিত্র আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা। বার্মার এই সংকটময় মুহূর্তে আমরা যদি তাঁদের দেখানো চিত্ররেখা অনুসরণ করে আরো নতুন কোন চিন্তাধারা ধারণ করে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করি, তাহলে আমরাও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ।
আর্তমানবতার সেবায় আল্লামা মুহাম্মদ ইউনুস (হাজী সাহেব হুজুর) (রহ.) এর এ বিশাল কর্মযজ্ঞ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আল্লাহ যেন আমাদেরকে তাঁর এ কর্ম-তৎপরতা থেকে উদ্ভুদ্ধ হয়ে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার তওফিক দান করেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।