১১৬ আলিম ও ১০০০ মাদরাসার বিরুদ্ধে গণকমিশনের শ্বেতপত্র! একটি পর্যালোচনা
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
দেশের ১১৬ শীর্ষস্থানীয় আলিম, ওয়ায়েজ ও পীর-মাশায়েখকে ‘ধর্মব্যবসায়ী’ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী এবং মৌলবাদী তৎপরতায় যুক্ত অভিযোগ করে এক হাজার মাদরাসার নামের তালিকা সংবলিত ‘শ্বেতপত্র’ দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে জমা দিয়েছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক ককাসের যৌথ উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গঠিত গণকমিশন’। ১১৬ আলিমের বিরুদ্ধে সারাদেশে মৌলবাদী তৎপরতা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, অনিয়ম, দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ করা হয়েছে এ শ্বেতপত্রে। গণকমিশনের চেয়ারপারসন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ১১ মে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ও মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের হাতে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ শীর্ষক ২ হাজার ২০০ পৃষ্ঠার এ শ্বেতপত্র তুলে দেন। অপরাধ তদন্ত করে এই ‘ধর্মব্যবসায়ী’ ও মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে গণকমিশনের শ্বেতপত্রে।
শ্বেতপত্র জমা দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন গণকমিশনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, কমিশন সচিবালয়ের সমন্বয়কারী কাজী মুকুল, সদস্য আসিফ মুনীর তন্ময় ও ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জানান, তারা নয় মাস তদন্ত করে ২ হাজার ২০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি করেছেন। তাতে বহু ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তদন্তে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। জঙ্গিবাদ ছড়াতে জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করার তথ্যও মিলেছে। তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও দুর্নীতির তথ্য দুদকে জমা দেওয়া হয়েছে। তাদের আর বাড়তে দেওয়া যায় না। দেশের বিভিন্ন স্থানের ডিসি, এসপি, ইউএনওসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে এ শ্বেতপত্রে জানানো হয়েছে, তারা মৌলবাদী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে উসকানি দিচ্ছেন। গণকমিশন সূত্র জানায়, গত ১২ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আনুষ্ঠানিকভাবে শ্বেতপত্রের মোড়ক উন্মোচন করেন (সমকাল, ঢাকা ১২ মে ২০২২)। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, গণ কমিশনের আইনত কোন ভিত্তি নেই। যে অভিযোগের কোন প্রমাণ নেই আমরা সেটা বিবেচনায় নেই না। এটা নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে (ঢাকা টাইমস ২৪ ডট কম, ২০ মে ২০২২) ।
প্রকাশিত শ্বেতপত্র একতরফা। অভিযুক্ত কোন আলিম বা মাদরাসার মুহতামিমের বক্তব্য নেয়া হয়নি। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নি। অভিযোগ ও প্রকাশিত তালিকা যে দায়সারা গোছের এবং একেবারে ঠুনকো তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১ হাজার মাদরাসার তালিকায় এমন অনেক মাদরাসার নাম আছে বাস্তবে যেগুলোর অস্তিত্ব নেই। চট্টগ্রামে দুটো মাদরাসার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো দোকান (দ্র. ক্রমিক ৯৪-৯৫, শ্বেতপত্র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৮৯)। বহু মুহতামিমের নাম উল্লিখিত হয়েছে যারা ৩/৪ বছর আগে মারা গেছেন। ফেনী ওলামাবাজার হোসাইনিয়া মাদরাসার নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৩বার। মুহতামিম ও ছাত্র সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন (দ্র. ক্রমিক ৩৪৫, ৪৮০ ও ৭৬৭, শ্বেতপত্র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৮৯, ১০০২, ১০১২)।
ধর্মব্যবসার সংজ্ঞা কী? এ পরিভাষাটি কমিউনিষ্ট ও নাস্তিকদের সৃষ্ট। ইসলাম ধর্মের প্রচারকরা যদি ধর্মব্যবসায়ী হন তা হলে অপরাপর ধর্মের প্রচারকরা কোন অভিধায় চিহ্নিত হবেন? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ একাডেমিক কার্যক্রম বিশেষত পাঠদান, পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করে নির্ধারিত বেতন ও পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। এ কাজ মহৎ কিন্তু ব্যবসায় নয়। মাহফিলের আয়োজকরা ধর্মীয় বক্তাদের পথভাড়া বা হাদিয়া হিসেবে যে অর্থ দিয়ে থাকেন তা সামান্য। এটা কোনক্রমেই ব্যবসায় হতে পারে না। ধর্মপ্রচার শরিয়তের নির্দেশনা। ওয়াজের বিনিময়ে অর্থ নেয়া বা দেয়া বৈধ কি না তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব প্রাজ্ঞ ধর্মবেত্তাদের, ধর্ম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ঘাদানিকের নয়। এটা স্পষ্টত ধৃষ্টতা ও অনধিকারচর্চা। ইসলাম কেন একমাত্র টার্গেট অন্য ধর্মে কী ব্যবসায়ী নেই? আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, দুবাই, ভারত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে যারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে এবং বিলাসবহুল অট্টালিকা তৈরি করেছে তাদের একটি তালিকা তৈরি করার সাহস দেখাক না গণকমিশন। তালিকায় ৩০ নম্বরে আছে মাওলানা মতিউর রহমান মাদানির নাম। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার বাসিন্দা। ৭৬ ও ৯৪ নম্বরে মুফতি ওমর ফারুক যুক্তিবাদীর নাম আছে দুইবার। ৪১ ও ৮৩ নম্বরে আছে মাওলানা আবু নাঈম মুহাম্মদ তানভিরের নাম। একই ব্যক্তির নাম দু’বার। তালিকায় এমন ব্যক্তির নাম আছে যারা আদৌ ধর্মীয় বক্তা নন।
মাওলানা মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ পরিচালিত ঢাকার শায়খ জাকারিয়া ইসলামিক সেন্টারের নাম উল্লিখিত হয়েছে ২বার। ছাত্র-শিক্ষকদের সংখ্যায়ও রয়েছে ভিন্নতা (দ্র. ক্রমিক ৩১৮, ৪৬৫, শ্বেতপত্র ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৯৭, ১০০১)। চট্টগ্রাম ওমর গণি কলেজের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনকে নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়েছে শ্বেতপত্রে। তাকে বলা হয়েছে ‘তিনি পটিয়া জমিরিয়া মাদরাসার পরিচালক’ (শ্বেতপত্র, ১ম খ. পৃ. ৭৩১)। এটা অসত্য। পরিচালক হচ্ছেন আল্লামা মুফতি আবদুল হালিম বোখারী। বলা হয়েছে ‘ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন সহীহ মুসলিম পড়েছেন যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সাবেক আমির প্রয়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর কাছে’ (শ্বেতপত্র, ১ম খ. পৃ. ১১১-১১২)। আসলে নিজামী দুজন। চট্টগ্রামের নিজামী সাহেব ছিলেন বড় মুহাদ্দিস, প্রচারবিমূখ শিক্ষাবিদ ও দরবেশ। তিনি চট্টগ্রামের মীরসরাই থানার নিজামপূর এলাকার বাসিন্দা। প্রায় ৩০ বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর হাজার হাজার ছাত্র রয়েছেন। তাঁর হাজার হাজার ছাত্র রয়েছেন। হযরত শাহ আল্লামা কুতুবউদ্দিন (রহ.) বায়তুশ শরফ, অধ্যক্ষ ড. সাইয়েদ আবু নোমান সাহেব, বায়তুশ শরফ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. শব্বির আহমদ (রহ.) ও প্রফেসর ড. হাফেয বদরুদ্দোজা সাহেব, গারাঙ্গিয়ার দরবারের পীর মাওলানা হাফেয মাহমুদুল হাসান (রহ.) তাঁর অন্যতম ছাত্র। গণকমিশন শিক্ষাবিদ নিজামীকে রাজনীতিক নিজামীর সাথে গুলিয়ে ফেলেছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। রাজনীতিক নিজামী সাহেব পাবনা জেলার সাথিঁয়া উপজেলার বাসিন্দা। তিনি ছিলেন ছাত্রনেতা, রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী। তিনি কোন দিন চট্টগ্রামে শিক্ষকতা করেননি। এটা কোন ধরনের তদন্ত?
১১৬ জনের তালিকার পাশাপাশি ৩৫জন ধর্মীয় বক্তা ও বিদগ্ধ আলিমের আরও একটি তালিকা শ্বেতপত্রে (পৃ. ৭৬১-৮০৮) সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ৩৫জনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। তালিকা দুটো থেকে বাদ পড়েননি জননন্দিত ও বর্ষীয়ান আলেমেদীন চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, শায়েখে চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মুহামমদ ফয়জুল করীম, মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলিপুরী, মাওলানা কামাল উদ্দিন জাফরী, মুফতি আবদুল হালিম বুখারী, মাওলানা তাফাজ্জল হক হবিগঞ্জী, মাওলানা হাবিবুর রহমান সিলেটি, মাওলানা হাসান জামিল, ড. আসাদুল্লাহ গালিব, মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জি, মাওলানা সালাহ উদ্দিন নানুপুরী, মাওলানা খোরশেদ আলম কাসেমী, মাওলানা হাফিজুর রহমান কুয়াকাটা, মুফতি দিলাওয়ার হোসেন, মাওলানা আবদুল বাসেত খান, মাওলানা মুশতাকুন্নবী, মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী, মুফতি মাহমুদ হাসান ভুজপুরী, মুফতি হাবিবুর রহমান মিসবাহ, ড. আবুল কালাম আজাদ বশর, ড. মিজানুর রহমান আজহারী, মাওলানা তারেক মনোয়ার, মাওলানা মুহিব খান, মাওলানা আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, মাওলানা মুজাফ্ফর বিন মহসিন, মুফতি নুর হোসাইন নুরানী ও মাওলানা আবু বকর মোহাম্মদ জাকারিয়ার মতো দেশের শীর্ষ আলেমরাও। তালিকায় আছেন বেশ কয়েকজন কারাবন্দি আলেম। গণকমিশনের এ তালিকা সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর ইতোমধ্যেই দেশের ধর্মপ্রিয় মানুষের মাঝে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক গঠিত গণকমিশনের এই তালিকা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং এদেশের ইসলাম, ধর্মশিক্ষা ও ধর্মীয় গুরুজনদের বিরুদ্ধে এক গভীর চক্রান্ত। সুনির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা নিয়ে তারা মাঠে নেমেছেন। গণ কমিশনের আইনগত কর্তৃত্ব নেই; দেশকে অস্থিতিশীল করে গোলা পানিতে মাছ শিকার করার অশুভ মতলব নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছেন। জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। আলিম-ওলামারা ওয়াজ-নসিহত, তাজকিয়ায়ে নফস এবং দরস তাদরিসের খিদমতে নিয়োজিত আছেন। জঙ্গি অর্থায়ন, মানি লন্ডারিং তো দূরের কথা তালিকাভুক্ত অধিকাংশ আলিমের রাজধানী বা নিজ নিজ জেলা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট পর্যন্ত নেই। তারা সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবনধারায় অভ্যস্ত।
আরও একটি আশ্চর্যের ব্যাপার হল মাঠ পর্যায়ে ডিসি, এসপি, ইউএনওসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে শ্বেতপত্রে তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়েছে। ক্যাডারভুক্ত সরকারি অফিসারদের তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের জন্য সরকারের অ্যাজেন্সি ও মন্ত্রণালয় রয়েছে। গণকমিশন কোনক্রমেই তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার অধিকার রাখে না। এটা ইখতিয়ার বহির্ভূত। উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল ঘাদানিক সমর্থিত একটি চিহ্নিত গ্রুপ হেফাজতে ইসলামকে জঙ্গি সংগঠন ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেনের নিকট স্বারকলিপি প্রেরণ করেন। ঘাদানিক ও গণকমিশনের পেছনে কারা কারা কলকাঠি নাড়ছেন এমন ব্যক্তিদের নাম ও পরিচিতি শ্বেতপত্রে রয়েছে। তারা বাম ঘরানার কমিউনিস্ট ও ধর্মবিদ্বিষ্ট বুদ্ধিজীবী (শ্বেতপত্র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩,৪, ৯৫৮-৯৬২, ৯৭৮-৯৮২)।
স্বাধীনতার পর থেকে একটি মহল এদেশের ইসলাম, মাদরাসা শিক্ষা ও ওলামা মাশায়েখদের নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে যাচ্ছে। অনেকে এটাকে প্রায় পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এ দেশের ঐতিহ্যবাহী কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে বিষোদগারের এক সুগভীর চক্রান্ত নতুনভাবে শুরু হয়েছে। এ চক্রান্তের নেটওয়ার্ক সুবিস্তৃত ও অত্যন্ত সুসংগঠিত। আন্তর্জাতিক অক্ষশক্তির বৃত্তিভোগী এজেন্টরা সুকৌশলে কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে। এসব অ্যাজেন্টরা সরকারের অভ্যন্তরে, বিরোধী দলে, প্রশাসনে, বেসরকারি সেবাসংস্থায়, সংবাদপত্রে ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমানভাবে সক্রিয় থেকে এক ভাষায় কথা বলছেন এবং একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন নানা অজুহাত খাড়া করে। এনজিও সমর্থিত বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র তিলকে তাল করে এবং তালগোল পাকিয়ে তথ্যসন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, যাতে জনমত বিভ্রান্ত হয়। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট এনজিওরা কোন সরকারের বন্ধু নয়; সরকারকে ব্যবহার করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাই হচ্ছে তাদের কর্মকৌশল।
বেশ কিছুদিন আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আলোচনাচক্রে জনাব রাশেদ খান মেনন, যিনি গণকমিশনের সদস্য, যে মন্তব্য করেন তা রীতিমত আপত্তিকর। তিনি বলেন, দেশে যেভাবে কওমি মাদরাসা গড়ে উঠেছে এবং সেখানে যে ধরনের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা আসলে কোন শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে না। যে মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হোক না কেন, সেখানে কি ধরনের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা অবশ্যই রাষ্ট্র ও সমাজকে জানতে হবে। ‘কওমি মাদরাসার ধারাকে কোন শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে না’ এমন মন্তব্য বিদ্বিষ্ট মনের পরিচায়ক। সেখানে কি ধরনের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা তো সবার জন্য উন্মুক্ত। রাষ্ট্র ও সমাজের নিকট কোন তথ্য গোপন নেই। এখানে গোপনীয়তা বা রহস্য বলতে কিছু নেই। ‘দরসে নিজামী’ পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে দেড় শ’ বছর ধরে পুরো ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ব্রিটেন, আফ্রিকা, মায়ানমার, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত একটি সফল ইসলামী শিক্ষাধারার বাহক হচ্ছে কওমি মাদরাসা। কওমি মাদরাসা তো এ দেশের বাস্তবতা। সরকার স্বীকৃত শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশের ছড়িয়ে আছে ৩০ হাজার কওমি মাদরাসা। বর্তমান সরকার ও কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্য তৃতীয় একটি শক্তি সক্রিয়। তৃতীয় শক্তিটি সরকারের বন্ধুবেশী শত্রু। এ বিষয়টি মাথায় রাখার জন্য আমরা সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
ঘাদানিক ও গণকমিশন চাচ্ছে মাদরাসা শিক্ষা ও ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ যে দীনে ইসলামের আলো পাচ্ছে সেটাকে বিনষ্ট করে দেয়া এবং মানবিক মূল্যবোধ যারা সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাদেরকে দমিয়ে রাখা। ওয়াজ হাজার বছরের বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয় এমন কোন কথা ওয়ায়েজরা মাহফিলে বলেন না বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহ তৈরির জন্য জনগণকে আহবান করে থাকেন। ওলামায়ে কেরাম মাহফিলে মাদক, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, যৌতুক, ধর্ষন, ইভটিজিং, নারী নির্যতন, খুন-খারাবি, ব্যভিচারসহ নানা সামাজিক অপরাধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে জনগণকে সচেতন করে যাচ্ছেন। ইসলামের নির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করা, ইহ জীবনে সমৃদ্ধি, পরকালে মুক্তি এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ওয়াজের মূল সূর। ওয়ায়েজ ও আলিমদের শেকড় মজবুত। তৃণমূল পর্যায়ে রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা। তারা সামাজিক শক্তির প্রতিভূ। ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় ভাবাবেগ বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের গভীরে প্রোথিত। এটাকে উপড়ে ফেলা প্রয়াস কোন দিন সফল হবে না।
যারা এই তালিকা দুদকের কাছে পেশ করেছেন তারা নিজেরাই বিতর্কিত। তাদের মূল লক্ষ্য হলো দেশের মানুষকে ধর্মবিমুখ করা এবং ওয়াজ-নসিহত বন্ধ করে দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করার পরিবেশ তৈরি করা। জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের সভাপতি আল্লামা নুরুল হুদা ফয়েজী গত ১৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তাদের কার্যক্রমের নাম তারা দিয়েছেন ‘তদন্ত’। কিন্তু তদন্ত সংক্রান্ত কোড অফ দ্যা ক্রিমিনাল প্রসিডিউর-(১৮৯৮) এর ধারা ৪-এর ১ উপধারা অনুসারে তদন্ত করার জন্য কোন অথরাইজড ব্যক্তি প্রয়োজন। এই বিবেচনায় জনাব শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও মিসেস তুরিন আফরোজ গং যা করেছেন তা আমাদের সংবিধানের মৌলিক ধারণার স্পষ্ট লঙ্ঘন। একই সাথে তারা কোনো অথরাইজড পারসন বা সংস্থা না হয়েও ‘তদন্ত প্রতিবেদন’ শিরোনামে কিছু প্রকাশ করার মাধ্যমে আইনগত অনধিকার চর্চা করেছেন; যা নৈতিক ও সামাজিক অপরাধ এবং জনমনে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন। আদতে তাদের এই শ্বেতপত্র প্রকাশ সংবিধানবিরোধী। নাগরিকের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত মানবিক মর্যাদানীতির প্রতি অশ্রদ্ধা। এই কথিত কমিশনের তদন্ত ও শ্বেতপত্রের নৈতিক ও আইনত কোনো ভিত্তি নেই বরং এটা সংবিধান, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা মানবিক মর্যাদার বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত অপরাধ।’
বিশ্লেষকরা মনে করেন শ্বেতপত্র প্রকাশের নেপথ্যে উদ্যোক্তাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। ধাপে ধাপে তারা অগ্রসর হবে বাস্তবায়নে। গণকমিশন, গণআদালত, গণজাগরণ মঞ্চের সাথে গণসম্পৃক্ততা বা এগুলোর আইনগত ভিত্তি না থাকলেও পাকা খেলোয়াড়রা এর পেছনে সক্রিয়। শক্তিশালী থিংক ট্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইসলামোফোবিয়া বিশেষত উপমহাদেশীয় ঘটনাপ্রবাহ ও বাস্তবতার সাথে শ্বেতপত্র প্রকাশের গভীর সংযোগ বিদ্যমান। মোটা দাগে নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যকে সামনে রাখা হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেশে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করা।
- কওমি মাদরাসা শিক্ষার ঐতিহ্য ধ্বংস করা।
- ওয়াজ, নসিহত ও তাফসীর মাহফিলকে নিয়ন্ত্রণ করা।
- আলিম-ওলামা মাঠে নামলে ‘জঙ্গিবাদের উত্থান’ হিসেবে দেশ বিদেশে প্রচার করা।
- সমাজে সম্মানিত ওলামা-মাশায়েখের হেয় প্রতিপন্ন করা।
- মুসলিম বাঙালি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রাধান্য খর্ব করা এবং আমদানিকৃত সংস্কৃতির পথ সুগম করা।
- জাতীয় নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা।
- মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও শ্রীলঙ্কার ঘটনাপ্রবাহে জনগণের মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরানো।
- আলিম ওলামারা মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করলে দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে স্যাবোটেজ করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা। ফলশ্রুতিতে শীর্ষ আলিমদের বিরুদ্ধে ২০/৩০ টা মামলা দায়ের করা। নিকট অতীতে এর বহু নজির রয়েছে।
- বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপন করা এবং দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
- মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের জিগির তোলে বৈশ্বিক আগ্রাসীশক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
- শ্রদ্ধাভাজন ওলামা-মাশায়েখকে সরকারের মুখোমুখি করে একটি সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করা এবং উভয় পক্ষকে বেকায়দায় ফেলা।
- মুসলিম তরুণদের মধ্যে সৃষ্ট ইসলামি জাগরণকে দমিয়ে রাখা।
- ‘মৌলবাদ বিরোধী’ বড় কোন অভিযানের কৃতিত্ব প্রদর্শন করা।
শ্বেতপত্র দেখলে বোঝা যায় এদেশের সব ঘরানার উলামায়ে কেরামকে এতে যুক্ত করা হয়েছে। মোটকথা এদেশে যারা ইসলামকে ফোকাস করেন তাদের সবাইকেই টার্গেট করা হয়েছে। দেওবন্দি, আলিয়া, চরমোনাই, জৈনপুরী, বেরলভী, আহলে হাদীস কাউকেই বাদ দেওয়া হয়নি। গণকমিশনের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সব মাসলাকের আলেমদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এখন অস্থিত্বের প্রশ্ন। দলীয় বা গোষ্ঠীয় সঙ্কীর্ণতা পরিহার করতে হবে এবং হৃদয়কে করতে হবে বড় ও প্রসারিত। ‘ইত্তেফাক মাআল ইখতিলাফ’ এই নীতিমালাকে সামনে রেখে কাছে আসতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আইনের পথে লড়াই করতে হবে। পাতানো ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। জোশকে নিয়ন্ত্রণ করে হুঁশকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে ঐক্যই শক্তি, বিভেদে পতন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক