মুফতি আযম হযরত আজিজুর রহমান দেওবন্দী (রহ.): যাকে দিয়ে সূচনা হয় দারুল উলুম দেওবন্দের দারুল ইফতা বিভাগ
যুবাইর হানীফ কাসেমী
দারুল উলুম দেওবন্দের সর্বপ্রথম মুফতি৷ যার হাতে অসংখ্য আকাবির ইফতার তামরীন করেছেন৷ দেওবন্দের রেজিস্ট্রারভুক্ত ফতওয়ার নাম নিলে যার নাম সর্বাগ্রে আলোচিত হয়৷ বর্তমানে ফতওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ নামে বাজারে ১৮ খণ্ডের যে কিতাব পাওয়া যায় তা পুরোটাই তাঁর হাতেই প্রদান করা ফতওয়ার সংকলন৷ প্রায় দীর্ঘ ৪০ বছর দেওবন্দে ফতওয়া প্রদান ও খেদমত করেছেন যিনি৷ বলছিলাম দারুল উলুম দেওবন্দের নায়েবে মুহতামিম ও সর্বপ্রথম মুফতি মুফতি আযম হযরত আজিজুর রহমান দেওবন্দী (রহ.)-এর কথা (১২৭৫-১৩৪৭ হি./১৮৫৮-১৯২৮ খ্রি.)।
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শুরা সদস্য ও হযরত কাসেম নানুতুভী (রহ.)-এর নিকটতম বন্ধুদের একজন হযরত ফজলুর রহমান উসমানী (রহ.)। তাঁরই সুযোগ্য সন্তান তিনি৷ তাছাড়া দারুল উলুম দেওবন্দের ষষ্ঠ মুহতামি হযরত হাবিবুর রহমান উসমানী তাঁর আপন ভাই৷ সহীহ মুসলিমের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল মুলহিমের রচয়িতা শায়খুল ইসলাম মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহ.) তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই৷ দিল্লির নদওয়াতুল মুসান্নিফীনের প্রতিষ্ঠাতা হযরত আতিকুর রহমান উসমানী (রহ.) তাঁরই সুযোগ্য সন্তান৷
১৩১০ হিজরিতে কুতুবুল আলম হযরত রশীদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.)-এর প্রস্তাবে সূচনা হয় মাদরাসায়ে দেওবন্দের দারুল ইফতা৷ এর পূর্বে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দিকে কেউ কোনো ফতওয়ার জন্য আসলে তার উত্তর হযরত কাসেম নানুতুভী (রহ.) ও হযরত রশীদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.) দিতেন৷ এ দিকে দেওবন্দের ভেতরে ফতওয়ার বিষয়টি দেখাশুনা করতেন দেওবন্দের সর্বপ্রথম শায়খুল হাদীস হযরত ইয়াকুব নানুতুভী (রহ.)৷ অত্যন্ত সুচারুরূপে আঞ্জাম দিতেন৷
১৩০২ হিজরিতে হযরত ইয়াকুব নানুতুভী (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর এ জিম্মাদারি ততকালীন মুহতামিম হযরত রফীউদ্দীন দেওবন্দী (রহ.) বিভিন্ন উস্তাদদের মাধ্যমে আঞ্জাম দিতেন৷ এরপর দিন দিন দেওবন্দের সুনাম সুখ্যাতি বাড়ার কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রশ্ন এতো বেশি আসত যে ১৩০৪ হিজরিতে ফকীহুন নফস হযরত গঙ্গুহী (রহ.) ফতওয়া প্রদানের জন্য পৃথক এক জিম্মাদার নিয়োগ দেওয়ার কথা উঠান৷ অবশেষে তা কার্যকর হয় ১৩১০ হিজরিতে৷
ওই বছরই দেওবন্দের দারুল ইফতার প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা হয়৷ আর সূচনালগ্নেই এ গুরুদায়িত্বের জন্য নির্বাচিত হন আমাদের আজকের মধ্যমণি মুফতি আযম হযরত আজিজুর রহমান দেওবন্দী (রহ.)৷ এর এক বছর পূর্বে ১৩০৯ হিজরিতে হযরতকে মিরাঠ থেকে দারুল উলুমে ডেকে আনা হয়৷ তাঁকে দারুল উলুমের নায়েবে মুহতামিম ও উস্তাদ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়৷ পাশাপাশি ফতওয়া লেখার কাজও করতেন কিছু কিছু৷ পরের বছরই দারুল ইফতার জিম্মাদার বানিয়ে দেওয়া হয়৷ তাঁর মাধ্যমে আরম্ভ হয় দারুল উলুম দেওবন্দের নতুন এক দিগন্তের পথচলা৷ দীর্ঘ ৩৭ বছর দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতি আযম হিসেবে ছিলেন তিনি৷ হাজার হাজার ফতওয়া তাঁর নিজ হাতেই দিয়েছেন৷
শুধু জিলকদ ১৩২৯ থেকে ১৩৪৬ হিজরি পর্যন্ত এ ১৬ বছরে যে ফতওয়া দিয়েছেন তার সংখ্যা হল প্রায় ৩৭৫৬১টি৷ যা সংরক্ষিত আছে দারুল উলুমের লাইব্রেরিতে৷ এর পূর্বের ২১ বছরের ফতওয়াসমূহ সংরক্ষণ করা হয়নি৷ যদি সেগুলো সংরক্ষিত হত তাহলে সাধারণ হিসাব মতে ১ লাখ ১৮ হাজার ফতওয়া হওয়ার কথা৷ কিন্তু আফসোস তা সংরক্ষণ করা হয়নি৷ নেজাম ছিল না সংরক্ষণের৷
জন্ম, শিক্ষা-দীক্ষা ও শিক্ষকতা
১২৭৫ হিজরিতে হিন্দুস্তানের ঐতিহাসিক স্থান দেওবন্দ ও তার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম হযরত ফজলুর রহমান (রহ.)-এর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর ঐতিহাসিক নাম ছিল ‘জফরুদ্দীন’৷ দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার তৃতীয় বছর ১২৮৫ হিজরিতে তিনি হিফযুল কুরআন বিভাগে ভর্তি হন৷ ১২৯৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছর যাবৎ হিফয থেকে নিয়ে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত শেষ করেন৷ ১২৯৫ সালে দাওরায়ে হাদীস শেষ করেন৷ সেই সময় হযরত ইয়াকুব নানুতুভী, হযরত সাইয়েদ আহমদ দেহলভী, হযরত শায়খুল হিন্দ ও হযরত আবদুল আলী (রহ.) দারুল উলুমের প্রসিদ্ধ উস্তাদ ছিলেন৷ ১১৯৮ হিজরিতে দস্তারবন্দি জলসায় হযরত রশীদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.)-এর হাত থেকে দস্তারে ফযীলত লাভ করেন৷
১২৯৯ হিজরিতে কোনো ধরনের ভাতা ছাড়া দেওবন্দে খেদমত আরম্ভ করেন৷ ১৩০০ থেকে ১৩০৯ হিজরি পর্যন্ত দেওবন্দে হযরতের অবস্থান ছিল না৷ এ সময়ে তিনি কিছু সময় মিরাঠ ইসলামিয়া মাদরাসায় খেদমত করেন, কিছু দিন হযরতের শায়খ মাওলানা রফীউদ্দীন (রহ.)-এর নিকট থেকে আত্মশুদ্ধির উন্নতির ফিকির করেন৷ মধ্যখানে শাওয়াল ১৩০৫ হিজরিতে হজের উদ্দেশ্যে হেজাজ সফর করেন৷ সেখানে দেড় বছর হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করে আত্মশুদ্ধিতে মনোযোগী হন। সেই সময় হাজী সাহেব থেকে ইজাজতও লাভ করেন৷ সফর ১৩০৭ হিজরিতে দেশে ফিরে আসেন৷ অতঃপর ১৩০৯ হিজরিতে তাঁকে দেওবন্দের মুরব্বিগণ ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে মিরাঠ থেকে দেওবন্দে ডেকে নিয়ে আসেন৷ মুহতামিম সাহেবের অনুপুস্থিতে তিনিই প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করতেন৷
ফতওয়া প্রদানে যোগ্যতা
১৩১০ হিজরিতে দেওবন্দের দ্বিতীয় পৃষ্ঠপোষক ফকীহুন নফস হযরত রশীদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.) মুফতি সাহেব (রহ.)-এর ভেতর একজন মুফতির জন্য যেসব যোগ্যতা থাকার প্রয়োজন তা অবলোকন করতে পেরে দারুল ইফতার জিম্মাদার বানানোর সিদ্ধান্ত নেন৷ তাঁর হাতে সোপর্দ করা হয় দারুল ইফতার জিম্মাদারি৷ সেই দিন থেকে থেকে তিনি দেওবন্দের সর্বপ্রথম মুফতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন৷
জিম্মাদারি লাভের পর থেকে তিনি নিরলসভাবে মেহনত করতে থাকেন৷ ফতওয়ার কিতাবাদি ঘেঁটে ঘেঁটে ফতওয়া দিতে থাকেন৷ ধীরে ধীরে হযরতের যোগ্যতা এ পর্যায়ে পৌঁছায় যে, লম্বা লম্বা মতপার্থক্যপূর্ণ মাসআলায় কিতাব দেখা ছাড়া মুখস্ত, এমনকি সফর অবস্থায়ও উত্তর লিখে ফেলতেন৷
বড় বড় লম্বা মাসআলা যার উত্তর প্রদানে অন্যান্য মুফতিগণ সপ্তাহকে সপ্তাহ কিতাব দেখে মেহনত করে সঠিক সমাধানে পৌঁছাতে পারেন না এমন মাসআলায় হযরত সাধারণভাবে অন্য ১০টা মাসআলার মতো উত্তর লিখে দিতেন৷ সঠিক উত্তরই দিতেন৷ সফরে হযরতের সাথে সবসময় প্রশ্নের একটি বড়সড় থলে থাকত৷ সফরে কিতাব দেখা ছাড়া নিজের যৌগ্যতা ও পূর্বের মুতালাআ থেকে নির্দ্বিধায় উত্তর দিতেন৷
ফিকহি জুয এত বেশি জানা ছিল যে, শত শত মাসআলার উত্তর মুখস্ত লিখতেন, কিন্তু পরবর্তীতে কিতাব দেখা হলে হুবহু মিল পাওয়া যেত৷ এভাবে নিজেই একসময় কিতাবে পরিণত হলেন৷ কারও কোনো সমস্যা কিতাব দেখার পর মুফতি সাহেবের নিকট আসতেন৷
তাঁর ফতওয়া প্রদানের বৈশিষ্টসমূহ
- হযরতের ফতওয়া সকলে বুঝতে পারত৷ একদম সাবলিল, সহজ সরলভাবে লিখতেন৷
- প্রত্যেক ফতওয়ায় যুগের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন৷ যুগচাহিদার প্রতি হযরতের গভীর দৃষ্টি ছিল৷
- কোনো মাসআলায় দুই দিকের অবকাশ থাকলে তিনি এসব ক্ষেত্রে সহজ পন্থাকে অবলম্বন করতেন এবং তার ওপর ফতওয়া দিতেন৷
- জনসাধারণের জন্য কঠিন হয়ে যাবে এমন পন্থা কখনও অবলম্বন করতেন না৷
- তাঁর ফতওয়ায় জায়গায় জায়গায় উদাহরণ থাকত৷ যাতে প্রশ্নকারী ভালোভাবে বুঝে নিতে পারে৷
- হযরতের ফতওয়াকে হিন্দুস্তান ও বহির্বিশ্বের মুসলমানদের লেনদেন, ইবাদত ও আকিদার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত মনে করা হত৷
আত্মশুদ্ধি ও বায়আত
মুফতি সাহেব (রহ.) শুধু একজন আলেম ও মুফতি ছিলেন বটে তাই নয় বরং আধ্যাত্মিক জগতেরও মুরব্বি ছিলেন৷ আরেফ বিল্লাহ ছিলেন৷ এ পথের খুব পারদর্শী একজন শায়খ ছিলেন৷ হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কী (রহ.)-এর খলীফা ছিলেন৷ শাওয়াল ১৩০৫ হিজরিতে দ্বিতীয়বার হজের উদ্দেশে হেজাজ সফর করেন৷ সেখানে দেড় বছর হযরত হাজী সাহেব (রহ.)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করে আত্মশুদ্ধির কাজে মনোযোগী হন৷ এ সফরের মূল উদ্দেশ্যই ছিল হাজী সাহেবের সোহবত গ্রহণ৷ সেই সময় হাজী সাহেব থেকে ইজাজতও লাভ করেন৷ সফর ১৩০৭ হিজরিতে দেশে ফিরে আসেন৷ পাশাপাশি তিনি দেওবন্দের দ্বিতীয় মুহতামিম হযরতে আকদস শাহ রফিউদ্দীন দেওবন্দী (রহ.)-এর বিশিষ্ট খলীফাদের অন্যতম ছিলেন৷
হাজার হাজার আত্মশুদ্ধি পিপাসু ব্যক্তি মুফতি সাহেবের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক পিপাসা নিবারন করেছে৷ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল৷ গ্রামগঞ্জ থেকে মানুষ এসে সবক নিয়ে যেত৷ মিরাঠে খুব বড়সড় একটা ইসলাহি মজলিস হত৷ সে মাজলিসে অসংখ্য সালিকীন শরীক হত৷ হযরতের উল্লেখ্যযোগ্য খলীফাদের অন্যতম হলেন হযরত বদর আলম মিরাঠী (রহ.)।
বিনয় ও খেদমতে খালক
ইলম ও আমলের পাশাপাশি বিনয় ও নিজেকে ছোট করে দেখানো হযরতের বিশেষ রঙ ছিল৷ যা ছোট ছোট বিষয়াদিতে প্রতীয়মান হত৷ তিনি নিজেকে এত এত মিটিয়েছেন, তার সামান্য নমুনা পাবেন এ দুটি ঘটনায়৷
- হযরত মুফতি সাহেব (রহ.)-এর বাসার পাশে একজন বৃদ্ধা বুড়ি থাকতেন৷ যাকে দেওবন্দ এলাকার সবাই ‘আম্মা খোবী’ ডাকত৷ বয়সে হযরত থেকে অনেক বড় হবে৷ একদিন তিনি বলেন, আজীজুর রহমান! আমার ঘরের ছাদ নষ্ট হয়ে গেছে৷ বৃষ্টিতে পানি পড়তে থাকে৷ সারা রাত পানি টপ টপ করে পড়তে থাকে৷ ঘুমাতে পারি না৷ ঘরের ছাদ ছিল মাটির৷ তিনি বলেন, যদি ছাদে মাটি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে! হযরত বলেন, অনেক ভাল কাজের কথা বলেছেন৷ হযরত নিজে মাটি কিনলেন এবং তার ঘরের সামনে মাটিগুলি স্তুপ করে রাখেন৷ মাটি এসে গেল খুব সহজেই৷ এটি দেখে বৃদ্ধা বলতে লাগল, আজীজুর রহমান! মাটি তো এসেছে৷ কিন্তু আমার কোনো কাজের লোক নেই, যাকে বলব, মাটিগুলি ছাদে ঢেলে দিতে৷ হযরত বললেন, আম্মা! মাটি যখন এসেছে ঢালারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে৷ তখন বৃষ্টি হচ্ছিল হযরত কোমরে লুঙ্গি বেঁধে নিজে ছাদে উঠেন এবং নিজেই মাটি ঢালা শুরু করেন৷ এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পুরো সবগুলি মাটি ছাদে নিয়ে যান এবং বৃষ্টির পানি পড়া বন্ধ করে আসেন৷ বুড়ি টেরও পাননি৷ বৃষ্টিতে ভেজার ফলে এমন হয়েছে যে, হযরত খুব বেশি জ্বরাক্রান্ত হয়ে গেছেন এবং অনেক কষ্ট করেছেন৷ কিন্তু বৃদ্ধাকে হযরত বুঝতে দেননি যে, কোনো শ্রমিক কাজ করেছে বা ছাদে মাটি কে ঢেলেছে৷ হুযুর যে নিজেই সে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়েছেন তা পর্যন্ত বৃদ্ধাকে শুনাননি৷
- এভাবে হযরতের প্রতিদিনের নিয়ম ছিল সকাল বেলায় হযরত মাদরাসায় আসার পূর্বে দেওবন্দে তার মহল্লায় যেসব মহিলাদের স্বামী মারা গেছে, তাদের খবর নিতেন৷ তাদের বাজার করে দিতেন৷ প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন কোনো বাজার লাগবে? সবার বাজার করে নিজে কাঁধে করে বহন করে নিয়ে আসতেন৷ বাজার করে সবার ঘরে ঘরে গিয়ে নিজে সামান দিয়ে আসতেন৷ কারও মরিচ, কারও ধনিয়া কারও আলু, যার যা প্রয়োজন ইচ্ছেমতো লিস্ট দিত৷ হুযুর বাজার করে নিয়ে আসতেন৷ যদি বাজার উলট-পালট হয়ে যায় তখন সাথে সাথে বাজারে গিয়ে পালটে নিয়ে আসতেন৷ একবার এক বৃদ্ধার বাজার ভুল হয়ে গেছে৷ অন্য কিছুর জায়গায় আলু নিয়ে আসেন৷ ওই মহিলা বলল যে, আজীজুর রহমান! এ সামান তো ভুল নিয়ে এসেছেন৷ সাথে সাথে হাসিমুখে বাজারে যান৷ গিয়ে সে সামান পরিবর্তন করে নিয়ে আসেন৷ তার বাসায় পৌঁছান৷ দেওবন্দী ওলামায়ে কেরাম বিশেষ করে দেওবন্দের তৎকালীন মুরব্বিদের মাঝে তাঁর বিনয় ও নিজেকে ছোট করে উপস্থাপনে তিনি সকলের নিকট প্রসিদ্ধ ছিলেন৷ এটি একমাত্র তাঁরই বিশেষ বৈশিষ্ট ছিল৷
দরস ও পাঠদান
হযরত এসব গুণে গুণান্বিত হওয়ার পাশাপাশি ইলমি সূক্ষ্ম বিষয়েও খুব পারদর্শী ছিলেন৷ ফতওয়া প্রদানের পাশাপাশি কিতাবাদির পাঠ দান করতেন৷ ফিকহ, হাদীস ও তাফসীরের বড় বড় কিতাবসমূহ সবক নিতেন৷ সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম তাহকীক পেশ করতেন৷ কখনও এসব সূক্ষ্ম বিষগুলোকে নিজের প্রতি নিসবত দিয়ে দাবির সুরে বলতেন না৷ বরং ইহতিমালের সুরে বলতেন৷ দরসের মাঝে বলতেন,
اس مسئلے میں ایک صورت یہ بھی ہوسکتی ہے۔
(এ মাসআলায় এ সুরুতও হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে), অথচ তা হযরতের নিজস্ব তাহকীক হত৷ কিন্তু কখনও এমন বলতেন না যে, এ মাসআলায় আমার রায় এটি, তাহকীক এটি৷ কত বড় দিল, বিনয়ী মানুষ হলে এমনটি করতে পারেন! সুবহানাল্লাহ।
একটি বিশেষ হালত
মুফতি আযম (রহ.) সারা জীবনে রাতে কখনো পা মেলে ঘুমাতেন না৷ হযরতের ছাত্র জমানার সাথী হযরত মাহমুদ আহমদ রামপুরী (রহ.) বলেন, আমরা পড়ার জমানায় উভয় একই রুমে থাকতাম, তাঁর সবগুলো অবস্থা, হালত আমার সামনে৷ আমি সারাজীবনে কখনও তাঁকে পা লম্বা করে মেলে দিয়ে শুতে বা ঘুমাতে দেখি নি৷ সবসময় উভয় পাকে জড়ো করে পেটের দিকে গুটিয়ে শুইতেন৷ এ হালত দেখে প্রথম প্রথম মনে করতাম এটি হয়তো অনিচ্ছাকৃত এমন হয়৷ কিন্তু যখন দেখলাম নিয়মিত এমন করে ঘুমান, একদিন হযরতকে জিজ্ঞাসা করে বসলাম, আপনি এভাবে ঘুমান কেন? উত্তরে তিনি বলেন,
دنیا پیر پھلا کر سونے کی جگہ نہیں ہے، اس کا مقام قبر ہے جہاں آدمی پیر پھلا کر سوئیگا۔
দুনিয়া পা প্রসারিত করে শোয়ার স্থান নয়৷ এভাবে ঘুমানোর স্থান হল কবর, যেখানে প্রত্যেক মানুষ পা মেলে ঘুমাবে৷ সুবহানাল্লাহ! একথা সেই ব্যক্তির জবান থেকেই বের হতে পারে যে সর্বদা আখেরাতের জন্য প্রস্তুত এবং যার অন্তরে সর্বদা আল্লাহর মহব্বত ছেয়ে আছে৷
আখেরাতের ফিকির
মুফতি আযম (রহ.) একদিন জালালাইনের দরসে হযরত কারী তাইয়েব ও মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.) প্রমুখকে নিজের এক কাহিনি শুনিয়েছিলেন যে, একবার রাতে ঘুমানোর জন্য বিছানায় যান৷ হঠাৎ করে কুরআনের আয়াত:
لَيْسَ لِلْاِنْسَانِ اِلَّا مَا سَعٰى ۙ۰۰۳۹
এ আয়াতে বলা হয়েছে কিয়ামতের দিন একমাত্র মানুষের নিজের অর্জিত আমলই কাজে আসবে অথচ হাদীস শরীফে ইসালে সাওয়াবের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, যার দ্বারা শাস্তি হালকা হয়, মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি৷ অন্য দিকে নবীগণ, শহীদ ও হাফেজরা সুপারিশের সুযোগ পাবেন৷ যার দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় কিয়ামত দিবসে অন্যের চেষ্টাও কাজে আসবে৷ হাদীস ও কুরআনের আযাতে বাহ্যত বৈপরিত্য মনে হচ্ছে৷ এর সমাধান কী? মনে হচ্ছে আয়াতের প্রতি আমার ঈমান দুর্বল৷ পূর্ণ সবল ও মজবুত নয়৷ তখন আমি চিন্তা করলাম এ অবস্থায় যদি আমার ইন্তেকাল হয়ে যায় তাহলে কুরআনের একটি আয়াতের ওপর আমার অন্তর সন্দেহ নিয়ে ইন্তেকাল হবে৷ এ অবস্থায় আমি আল্লাহ সামনে মুখ দেখাব কীভাবে? অথচ কুরআনের একটি আয়াতের প্রতি আমার ঈমান দুর্বল৷ এটি চিন্তা করতে করতে খুব গভীরে পৌঁছে গেলেন৷ সাথে সাথে বিছানা থেকে উঠে গঙ্গুহের প্রতি রাওয়ানা হয়ে গেলেন৷ উদ্দেশ্য ছিল রাতে গঙ্গুহী (রহ.)-এর নিকট পৌঁছে উক্ত সমস্যার সমাধান নিয়ে ফিরেন৷ গভীর রাতে পায়ে হেঁটে রাওয়ানা করলেন৷ হযরত এমনিতে পায়ে হাঁটার প্রতি অভ্যস্ত ছিলেন না৷ সুবহানাল্লাহ! প্রায় ৩০ মাইল পায়ে হেঁটে গঙ্গুহতে পৌঁছান তাও আবার রাতের বেলায়৷ তখনকার সময়ে রাতের বেলা গাড়িও চলত না, থাকত মানুষ পায়ে হাঁটবে৷ বন-জঙ্গলের ভয় হত খুব বেশি৷ একমাত্র আখেরাতের ফিকিরই হযরতকে এত দূর পায়ে হেঁটে সফর করাকে সহজ করে দিছে৷ কিছু মনে করেননি৷ শেষ রাতে গঙ্গুহ গিয়ে পৌঁছান৷ সেই সময় গঙ্গুহী (রহ.) তাহাজ্জুদের অযু করছিলেন৷
হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) সালাম দিলে গঙ্গুহী (রহ.) জিজ্ঞাসা করেন, কে? উত্তরে মুফতি সাহেব বলেন, আজীজুর রহমান বলছি৷ তুমি এ সময়ে কোত্থেকে? মুফতি সাহেব বললেন, একটি ইলমি সমস্যার সমাধানের জন্য আসা৷ যা আমাকে পিড়া দিচ্ছে বার বার৷ সমাধান পাচ্ছি না৷ এরপর পুরো সমস্যাটি জানালেন৷ কুরআন ও হাদীসের মাঝে বাহ্যত বিরোধের কথা তুলে ধরলেন৷ হযরত গঙ্গুহী (রহ.) অযু করতে করতে উত্তর দিয়ে দিলেন, বললেন, কুরআনে سَعٰى ۙ۰۰۳۹ (চেষ্টা) থেকে ‘ঈমানী চেষ্টা’ উদ্দেশ্য৷ কেয়ামত দিবসে একজনের ঈমান অন্যের কোনো কাজে আসবে না৷ আর হাদীসে سَعٰى ۙ۰۰۳۹ (চেষ্টা) থেকে ‘আমলি চেষ্টা’ উদ্দেশ্য৷ যা কিয়ামত দিবসে এক অন্যের কাজে আসবে৷ দুনিয়াতেও কাজে আসবে৷ এজন্য কুরআন ও হাদীসের মাঝে কোনো বৈপরীত্য নেই৷ এ উত্তর শুনে মুফতি সাহেবের চোখ খুলে যায়৷ সাথে সাথে বুঝে এসে যায়৷ উত্তর পেয়ে আর দেরি করেন সে সময় শেষরাতেই দেওবন্দের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রাওয়ানা করেন৷ ৩০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সকালে এসে দেওবন্দে দরস প্রদান করেন৷ ইলমের জন্য মুফতি সাহেব যে ফিদা ছিলেন তা একমাত্র তারই বৈশিষ্ট্য৷ আল্লাহর ভয়-ভীতি এত বেশি ছিল যে, রাতে ঘুমাতে পারেননি সামান্য একটি প্রশ্নের উত্তর না জানার কারণে৷
জন্মগত স্বভাব-চরিত্র
মুফতি সাহেবের বৈমাত্রেয় ভাই হযরত সাঈদ আহমদ সাহেব (রহ.) বলেন, ছোট থেকে সে ধৈর্যশীল, বিনয়ী, সহনশীল স্বভাবের ছিল৷ যদি তার কোনো কাজ করতে মন চাইছে কিন্তু আম্মাজান করতে দেননি৷ নিষেধ করেছেন, তখন কোনো ধরনের চিল্লাচিল্লি করত না৷ যখন মুফতি আযম (রহ.) শাহ রফিউদ্দীন সাহেব (রহ.)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন এবং আত্মশুদ্ধির পথ অবলম্বন করে তখন স্বাভাবের মধ্যে একাগ্রতা ও মানুষের সমাগম থেকে দূর থাকার মানসিকতা বেশি কাজ করত৷ দূরে থাকত৷ এ অবস্থা দেখে মুফতি সাহেবের আব্বাজান ফজলুর রহমান দেওবন্দী (রহ.) হযরত রফীউদ্দীন সাহেব (রহ.)-এর নিকট এসে আরয করলেন, আপনি আজীজুল হককে যে পথের সবক দিয়েছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়৷ তাকে এ থেকে বের করাও যাবে না৷ শুধু এটুকু চাচ্ছি সে যেন বিবি-বাচ্চার প্রতি একটু মনোনিবেশ হয়৷ একথা শুনে হযরত রফীউদ্দীন (রহ.) বললেন, মাওলানা! আপনাকে আল্লাহ আরও সন্তান দিয়েছেন৷ তাদেরকে যেখানে ইচ্ছে কাজে লাগান৷ শুধু একে (মুফতি সাহেবকে) আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করে দেন৷ ছেড়ে দেন৷ একথা শুনে ফজলুর রহমান সাহেব নিশ্চুপ হয়ে ফিরে গেলেন৷ দেওবন্দের আশপাশে কারও কোনো সমস্যা, কেউ পেরেশানিতে পড়লে মুফতি সাহেব অগ্রসরর হতেন৷ তাদের খবর নিতেন৷ সাহায্যের প্রয়োজন হলে সাহায্য করতেন৷ যেভাবে উচিৎ তাদের সাথে থাকতেন৷ এ বিষয়ে অসংখ্য ঘটনা তার জীবনে পাওয়া যায়৷
মোটকথা তিনি আধ্যাত্মিক জগতের উচু মানের ব্যক্তি ছিলেন৷ আদবে আখলাকে যার কোনো তুলনা হয় না৷ ইলম, আমল ও অবস্থানে মুফতি সাহেবের মতো আকাবির দারুল উলুমের জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য ও সুন্দর্য্য ছিল৷ এ ধরনের ব্যক্তিত্ব একবারই আসেন৷
১৩৪৬ হিজরি/১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে হযরত আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.)-এর সাথে তিনিও দারুল উলুম থেকে অব্যহতি নিয়ে নিয়েছিলেন৷ ১৩৪৭ হিজরি/১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে হযরত কাশ্মীরী (রহ.)-এর অসুস্থতার দরুন যখন জামিযা ইসলামিয়া ঢাবিল থেকে নিজের বাসস্থান দেওবন্দ তাশরীফ নিয়ে আসেন তখন বুখারী শরীফের ১৪ পারা বাকি ছিল৷ জামিয়া ইসলামি ঢাবিলের জিম্মাদারদের বার বার অনুরোধে হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) ঢাবিলে তাশরীফ নিয়ে যান এবং বুখারী শরীফের দরস শুরু করে দেন৷ শুধু দেড় মাসের অল্প সময়ে বুখারী শরীফের অবশিষ্ট ১৪ পারা শেষ করে দেন৷
মৃত্যু
মুফতি আযম (রহ.) ঢাবিল থেকে জুমাদস সানী ১৩৪৭ হিজরি/ডিসেম্বর ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে দেওবন্দের উদ্দেশ্য রাওয়ানা করেন৷ পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ দেওবন্দে পৌঁছার পর চিকিৎসা শুরু হলেও কোনো ধরনের সুস্থতার দেখা মিলছে না৷ অবশেষে ১৭ জুমাদাল আখিরা ১৩৪৭ রাত দুইটা বাজে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন৷ পরের দিন সকাল ১০টায় দারুল উলুম দেওবন্দের এহাতায়ে মূল সারিতে হযরত মাওলানা সাইয়েদ আসগর হুসাইন সাহেব (রহ.)-এর ইমামতিতে নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়৷ ১১ টায় মাকবারায়ে কাসেমীতে দাফন করা হয়৷ তারাই আমাদের আকাবির, তারাই আমাদের আদর্শ৷