কুরবানির সামাজিক তাৎপর্য
পবিত্র ঈদুল আযহা মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত পরম আনন্দের একটি দিন। সারা বিশ্বের মুসলমানরা ঈদুল আযহায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও করুণা লাভের জন্য গৃহপালিত পশু কুরবানি দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহর কাছে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও হযরত ইসমাইল (আ.)-এর সুমহান ত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র ঈদুল আযহা। কুরবানির মহিমা আমাদের অন্তরলোকের সংকীর্ণতা ধুয়ে দেয়। ইসলামের এই মহান চেতনাকে ধারণ করে ত্যাগ, ধৈর্য ও তিতিক্ষার ভেতর দিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষায় আমরা ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনকে গৌরবান্বিত করে তুলতে পারি।
সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্ত বয়স্ক, মুকীম (মুসাফির নয় এমন ব্যক্তি) ব্যক্তিই ১০ যিলহজ্জ ফজর হতে ১২ যিলহজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব (সাড়ে সাত তোলা সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা সেই পরিমাণ নগদ অর্থ) পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে তার ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব। কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য যাকাতের নিসাবের মত সম্পদের এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং যে অবস্থায় সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয় ওই অবস্থায় কুরবানিও ওয়াজিব হবে (ফতোয়ায়ে আলমগীরী, ৫ম খণ্ড; মুফতি কিফায়তুল্লাহ দেহলভী, কিফায়তুল মুফতি, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১৮৩; মুফতি তকী ওসমানী, দারসে তিরমিযী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১১৪-১১৫)।
আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে হযরত ইবরাহীম (আ.) স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন প্রিয়তম বস্তু তথা তার পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করার জন্য। সেই অনুযায়ী তিনি পরম করুণাময় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রিয়পুত্রকে কুরবানি দিতে উদ্যত হন। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁকে আর শেষ পর্যন্ত পুত্রকে কুরবানি দিতে হয়নি। ইসমাইলের পরিবর্তে কুরবানি হয় একটি পশু (তাফসীর ইবন কসীর, ৪র্থ খণ্ড, ২৩৯৮-২৪০১)। মহান আল্লাহর এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হযরত ইবরাহীম (আ.)। এ সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমাকে তুলে ধরাই ঈদুল আযহার পশু কুরবানির প্রধান মর্মবাণী। কুরবানিকে হাদীসের পরিভাষায় বলা হয় ‘আল উযহিয়া’। এর অর্থ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যা যবাহ করা হয় (সহীহ আল-বুখারী: ৫৫৪৫)।
হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুসলিম সমাজে পশু কুরবানির প্রবর্তন হয়েছে। এটা আল্লাহর প্রেম ও তাঁর নিকট আত্মনিবেদনের এক অনন্য প্রতীক। এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করবে না, সে যেন আমার ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’ (সুনানে ইবন মাজাহ; ইবন কুদামাহ, আল- মুগনী, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৬১৭)। প্রকৃতপক্ষে পবিত্র জিলহজ মাসে হজ, কুরবানি ও ঈদ পরস্পর সম্পর্কিত। আমরা যখন ঈদ ও কুরবানি উৎসব উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছি, তখন পবিত্র মক্কা নগরীতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে আগত লক্ষ লক্ষ মুসলমান হজব্রত পালন করছেন। আমরাও কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের সুযোগ পাব। কেননা ‘কুরব’ শব্দমূল হতে উৎপন্ন কুরবানির অর্থই হল আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা।
আমাদের দেশে কুরবানির ঈদে নূতন করে সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন পাড়া বা গোষ্ঠীভিত্তিক সংঘবদ্ধ হবার চিত্র লক্ষ্য করা যায়। ঈদুল আযহা আসলেই তারা সকল ভেদাভেদ ভুলে ও পূর্ব শত্রুতা মিটমাট করে এক হয়ে যায়। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তাদের এ সংঘবদ্ধতার প্রভাব বিদ্যমান থাকে। নিজেদের আনন্দে অন্যদের শরীক করা ঈদুল আযহার শিক্ষা। কুরবানিকৃত পশুর গোশত তিন অংশে ভাগ করে এক অংশ নিজের জন্য সংরক্ষণ, দ্বিতীয় অংশ আত্মীয় স্বজনকে প্রদান এবং তৃতীয় অংশ সমাজের অভাবগ্রস্থ ও দরিদ্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া ইসলামের বিধান। আল্লাহ তায়ালা কুরবানির পশুর গোশতের একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থ মানুষকে দান করার নির্দেশ দিয়েছেন (আল- কুরআন, সূরা হজ: ২৭, ২৮, ৩৬)। ইসলামের বিধান অনুযায়ী কুরবানির মাংসের বিলি-বণ্টন ন্যায়সংগত হওয়া উচিত। যারা কুরবানি দিতে পারবেন না, তাদেরকে আনন্দে শামিল করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা থাকতে হবে। এটা দীন-দুঃখী, গরিব-মিসকিনসহ যত বেশি অভাবী মানুষকে দেওয়া যায় ততই উত্তম। মনে রাখতে হবে কুরবানি আল্লাহর হুকুম ও কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশিত ইবাদত। এটি কোনো রসম বা প্রথা নয়। তাই কুরবানির নামে উচ্চ দামের পশু কিনে বাহ্যিক আড়ম্বরতা প্রদর্শন বা বাহবা কুড়ানোর প্রবণতা দোষাশ্রিত এবং তা অবশ্যই বর্জনীয়।
মুসলমানদের জীবনে ঈদুল আযহার গুরুত্ব ও আনন্দ অপরিসীম। উৎসব হিসেবে পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি এর সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামের জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাঁথা। তাই ঈদ শুধু আনন্দের উৎস নয় বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধে বৈশিষ্ট্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটা এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এলাকার লোকেরা ঈদের নামাযের জন্য নির্দিষ্ট ঈদগাহে সমবেত হয়। এতে সকলের মধ্যে একাত্মতা ও সম্প্রীতি ফুটে ওঠে ইসলামের মহান ভ্রাতৃত্ববোধে সবাই উদ্দীপ্ত হয়। পরস্পর কোলাকুলির মাধ্যমে সব বিভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই বলে গৃহীত হয়। ধনী-গরিবের ব্যবধান তখন প্রাধান্য পায় না। ঈদের আনন্দ সবাই ভাগ করে নেয়। এর ফলে ধনী-গরিব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-স্বজন সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে। ঈদ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার জন্য পরম মিলনের বাণী নিয়ে আসে। ঈদুল আযহার যে কুরবানি দেওয়া হয় তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কুরবানির রক্ত-মাংস কখনই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। শুধু দেখা হয় মানুষের হৃদয়কে। ঈদের মধ্যে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়। পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন।
কুরবানি আরবি শব্দ, আরবিতে কুরবানুন কুরবুন শব্দ থেকে নির্গত যার অর্থ নৈকট্য, উৎসর্গ, বিসর্জন ও ত্যাগ ইত্যাদি। কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের একটি অন্যতম ঐতিহ্য। শরীয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ্জ মাসের ১০, ১১, ১২ এই তিনটি দিনে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল পশু জবেহ করাই হল কুরবানি। ত্যাগ, তিতিক্ষা ও প্রিয়বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করাই কুরবানির তাৎপর্য। প্রচলিত কুরবানি হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর অপূর্ব আত্মত্যাগের ঘটনারই স্মৃতিবহ। হাদীসে বর্ণিত আছে, ‘রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসুল! এ কুরবানি কী? তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর সুন্নাত। তাঁরা বললেন, এতে আমাদের কি কল্যাণ নিহিত আছে? তিনি বললেন, এর প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। তাঁরা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, বকরীর পশমেও কি তাই? জবাবে তিনি বললেন, বকরীর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি আছে’ (মিশকাত আল-মাসাবীহ: ১৩৯১/২৩)। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.) থেকে অব্যাহত ভাবে চলে আসছে কুরবানির ঐতিহ্যধারা।
নেক আমলসমূহের মধ্যে কুরবানি একটি বিশেষ আমল। এ কারণেই রসুলুল্লাহ (সা.) সবসময় কুরবানি করেছেন এবং সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কুরবানি বর্জনকারী ব্যক্তির প্রতি তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। কুরবানির এ ফযীলত হাসিল করতে হলে প্রয়োজন ওই আবেগ, অনুভূতি, প্রেম-ভালবাসা ও ঐকান্তিকতা যা নিয়ে কুরবানি করেছিলেন আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম (আ.)। কেবল গোশত ও রক্তের নাম কুরবানি নয়, বরং আল্লাহর রাহে নিজের সম্পদের একটি অংশ বিলিয়ে দেওয়ার এক দৃপ্ত শপথের নাম কুরবানি। গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানি করলে তা আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলার নিকট গোশত ও রক্তের কোন মূল্য নেই। মূল্য আছে কেবল তাকওয়া, পরহেজগারি ও ইখলাসের। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে কখনো জবেহকৃত পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছবে না, পৌঁছবে কেবল তাকওয়া (আল-কুরআন, সূরা হজ: ৩৭)। অতএব আমাদের একান্ত কর্তব্য, খাঁটি নিয়ত সহকারে কুরবানি করা এবং তা থেকে শিক্ষার্জন করা। কুরবানিকৃত পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে নিজের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। চামড়া বিক্রি করলে মূল্য সাদকা করা ওয়াজিব। অনাথ আশ্রম, এতিমখানা ও মাদরাসায় পড়ুয়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভরণপোষণের জন্য চামড়া প্রদান করলে দ্বিবিধ সওয়াব হাসিল হয়। এক দুঃখী মানুষের সাহায্য দ্বিতীয় দীনি শিক্ষার বিকাশ (মুফতি কিফায়তুল্লাহ দেহলভী, কিফায়তুল মুফতি, ৮ম খণ্ড, পৃ. ২১৮-২২৬)। প্রকৃতপক্ষে কুরবানিদাতা কেবল পশুর গলায় চুরি চালায় না বরং সে তো চুরি চালায় সকল প্রবৃত্তির গলায় আল্লাহর প্রেমে পাগলপারা হয়ে। এটিই কুরবানির মূল নিয়ামক ও প্রাণশক্তি। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কুরবানি করা হয় তা হযরত ইবরাহীম ও ইসমাইল (আ.)-এর সুন্নত নয়, এটা এক রসম তথা প্রথা মাত্র। এতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে কিন্তু ওই তাকওয়া হাসিল হয় না যা কুরবানির প্রাণশক্তি।
ঈদ মানুষের জীবনে আসে পরম আনন্দ নিয়ে। আর পেছনে থাকে তার তাৎপর্য। ঈদের বৈশিষ্ট্য থেকে এই তাৎপর্য ঈদ উৎসব পালনের মধ্যে উপলব্ধি করতে হবে। ঈদের সীমাহীন আনন্দ উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে নিজেকে নিবেদিত করা আর মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ত্যাগের, ভ্রাতৃত্বের, সম্প্রীতির ও সহমর্মিতার মহান আদর্শ অনুধাবন করতে হবে। তাহলে ঈদ উৎসব পালনের সার্থকতা প্রমাণিত হবে। কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের পাশাপাশি মানবিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন, চিন্তার স্বচ্ছতা, ত্যাগের মহিমা, হৃদয়ের উদারতা সবকিছু মিলে কুরবানির এক স্মরণীয় অধ্যায়।
কুরবানির ঈদ বা ঈদুল আযহা আমাদের নিকট আত্মশুদ্ধি, আত্মতৃপ্তি ও আত্মত্যাগের এক সুমহান বার্তা নিয়ে প্রতি বছর উপস্থিত হয়। ঈদুল আযহার শিক্ষায় উজ্জীবিত হলে আমরা সকল পাপ, বঞ্চনা, সামাজিক অনাচার ও রিপুর তাড়না বা শয়তানের অসওয়াসা হতে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হব। তাই ঈদুল আযহার পশু কুরবানির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশু শক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুগুলোকেই কুরবানি দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কুরবানির মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। আমরা চাই ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সকল অনিশ্চয়তা-শঙ্কা দূর হোক। হিংসা, হানাহানি ও বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে এক সঙ্গে এক কাতারে পবিত্র ঈদুল আযহার আনন্দে শামিল হয়ে সকলের মধ্যে সাম্য ও সহমর্মিতার মনোভাব জাগিয়ে তুলতে হবে।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন