আমাদের গর্বের কওমি মাদরাসা
উৎপত্তি, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও অবদান
মুহাম্মদ নূরুল্লাহ
পূর্ব প্রকাশিতের পর
কওমি মাদরাসার বৈশিষ্ট্য
সারা বছর শিক্ষার শান্ত পবিত্র ইনসাফ ও সমতাভিত্তিক পরিবেশ ও অনুশাসন বহাল রাখা এবং ছাত্রদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ অনুভূতির লালন ও চর্চাকে উৎসাহিত করা, শিক্ষার নিরিবিলি সুনসান মার্জিত পরিবেশ বজায়ে রাখা, শিক্ষকের পাঠবিষয়ে যোগ্যতা ও প্রস্তুতি, শিক্ষার্থীর সামনে শিক্ষা, অধ্যয়নস্পৃহা, জ্ঞানার্জন ও সচ্চরিত্রের দৃষ্টান্ত স্থাপন, জ্ঞানমস্কতা সৃজন, গুরু-শিষ্য অটুট পবিত্র সম্পর্ক রচনা ইত্যাদি বিশেষত্বে আমাদের কওমি মাদরাসা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সর্বগ্রাসী আগ্রাসন ও পুঁজিবাদের যুগে শিক্ষা ক্ষেত্রে এখানেই এসব প্রতিষ্ঠানের অতুলনীয়তা।
নিতান্ত নগণ্য বেতনভাতা, রাষ্ট্রীয় অননাকূল্য, চারপাশের প্রতিবেশ বৈরিতা ও মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষকের প্রতি পরিবার, সমাজ ও বিশিষ্টজনের অনাগ্রহ অবমূল্যায়ন তাদের পড়াশোনার উদ্যমকে কোনো দিন ম্লান করে না। তাদের পাঠদান ও শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির কোনো ঘাটতি তৈরি করে না। আমরা মনে করি, কওমি মাদরাসার প্রাণশক্তি হতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের শিক্ষা সম্পর্কিত ব্যক্তি ও বিভাগ উপকৃত হতে পারেন, শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেন।[1] প্রকৃত অর্থে অর্থসম্পদ ও আড়ম্বরহীনতার মধ্যে এটা এমন এক শিক্ষাসাফল্য যা জাগতিক বিচারপদ্ধতির তুলাদণ্ড দিয়ে বিচার করা যাবে না।
আমরা মনে করি, কওমি শিক্ষার অন্ধ বিরোধিতা নয় এখান থেকে কল্যাণ ও সাফল্যের যে ভালো দিকগুলো আছে তা জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত করুন তাতে সবারই মঙ্গল। এর দ্বারা একটি জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও কীর্তির কিঞ্চিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাবে, যা মূলত আমাদের জাতীয় অর্জন যা গড়ে উঠেছে যুগযুগ ধরে এদেশের কৃষক শ্রমিকের ঘামে এবং দেশীয় মুসলমানদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। এখানে কওমি মাদরাসা শিক্ষার সামাজিক চাহিদার কথাটি আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কোনো জিনিসের সামাজিকভাবে চাহিদা তৈরি না হলে তা সমাজে টিকে থাকতে পারে না। একথাটি আমাদের কতিপয় বুদ্ধিজীবী জানেন না এমন নয়। মনে হয় কওমি মাদরাসার শত্রুতা করবার সময় বিষয়টি তারা ভুলে যান। কওমি মাদরাসার চাহিদা কেনো দিন দিন বাড়ছে, কেনো কওমি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা বুঝতে হলে দেশের প্রকৃত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি বুলাতে হবে। আমরা যে ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাটিকে জাতীয় শিক্ষা বলে চালিয়ে দিয়েছি তা আদৌ আমাদের জাতিসত্তার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে সক্ষম হচ্ছে কিনা ভেবে দেখতে হবে।
এ রচনার শেষভাগে একটি সত্যের প্রতি আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারছি না। কওমি মাদরাসার সূতিকাগার দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা সেদিন ইংরেজ সরকার স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। যদিও দারুল উলুম প্রতিষ্ঠা হয়েছিল অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে। শুরুতে কোনো শিক্ষাভবন ছিল না। একটি মসজিদের আঙিনায় একজন শিক্ষক, একজন ছাত্র দিয়ে সূচনা তার এবং প্রতিষ্ঠার সময় স্বয়ং নানুতভী (রহ.) উপস্থিত থাকলেন না। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। দারুল উলুমের নিজস্ব ভবনও সূচনার আট/নয় বছর পর নির্মাণ করা হয়েছিল। তবুও ব্যাপারটা ব্রিটিশ সরকার ও তার গোয়েন্দাদের দৃষ্টি এড়ালো না। ‘শুরু হতেই তারা অভিযোগ শুরু করলো যে, দারুল উলুম মুজাহিদের ঘাঁটি। সে সীমান্তে মুজাহিদ সরবরাহ করে। এ অজুহাত তোলে তারা গোপনে ও প্রকাশ্যে তদন্ত করে। তারা আলেমদের ধর্মোন্মাদ গালি দিতে থাকে। আরও বিপদ হলো, আজাদি আন্দোলনের পর দেশে ওই শ্রেণিটি বেড়ে উঠলো যারা বিরোধীদের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে ইংরেজ মনিবকে খুশি করতে সদা তৎপর ছিল। পরিস্থিতি সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন এ অবস্থায় দারুল উলুমের পথচলা কত কঠিন ছিল।’
এখানে বিবেচ্য, প্রাচীনকাল হতে আমরা দেখতে পাই পশ্চিমা সম্প্রদায় তাদের পশুসুলভ শিক্ষার আগ্রাসী মুখকে আড়াল করার জন্যই সবসময় মাদরাসার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে এসেছে। যেনও মাদরাসার বিরুদ্ধে তাদের শত্রুতা জন্মগত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, দেশ দুই দুইবার স্বাধীন হওয়ার পরও শিক্ষা সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন আমাদের মধ্যে দেখা যায়নি। ব্রিটিশ চলে গেলেও তাদের এজেন্টরা মাদরাসা শিক্ষার প্রতি বিদ্বেষ প্রচার করে তাদের দায়-দায়িত্ব পালন করে চলেছে। এদের মুখের ভাষা হুবুহু মনিব ব্রিটিশের ভাষা। এরা কোনো ধরনের বাছ-বিচার ছাড়াই কওমি মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে মুখস্থ বুলি আওড়িয়ে মাদরাসার মানবতাবাদী শিক্ষা ও চেতনাকে দেশ বিদেশের মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর করে তুলে ধরছে। ইতিহাস থেকে আমরা আশাবাদী, আমাদের সচেতন জনগণের প্রতিরোধের মুখেই সেই আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী উগ্রতা একদিন মুখ নিচু করবে, আশা করি আদর্শিক ক্ষেত্রে অচিরেই তারা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মাদরাসার প্রতি অহেতুক বিদ্বেষের অবসান ঘটাবে।
বাংলাদেশের কওমি মাদরসাগুলোর অনন্য অবদান, বিশেষত্ব, শিক্ষা ও আদর্শ বাস্তবায়নে ক্রমাগত সাফল্য সারা পৃথিবির শত্রুদের মাদরাসার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগতে সাহায্য করেছে। পশ্চিমা জগত সূচনা হতেই মাদরাসা ও ইসলামি শিক্ষার প্রতি বিদ্বেষী হয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অর্থেই বুদ্ধিজীবী আলফ্রেড রাসেল মাদরাসাকে রাজনৈতিক শিক্ষা বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
যাহোক সত্য হলো, শিক্ষা নিয়ে পশ্চিমাদের চক্রান্ত। বাংলাদেশে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিশিষ্টজনদের হতাশা। এ অবস্থায় আমাদের পেছন ফিরে তাকাতে হয়। আকাবিরে দেওবন্দ দীনিয়াতকে অবলম্বন করে মাদরাসা গড়লেন। পরাধীন ভারতে তারা এটাই জরুরি মনে করেছিলেন। স্বাধীনতার পর তারা দীনি আদর্শে পরিপূর্ণ উন্মুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়বেন চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর পাকিস্তান আমলে, আজকের বাংলাদেশ আমলে কখনও আলেমদের কথায় রাষ্ট্র চলেনি। শিক্ষাক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি এ কারণেই হয়েছে। শিক্ষাবিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির দৃষ্টান্ত মিলে নিম্নের ঘটনা দুটি থেকে। এক. জামিয়া মিল্লিয়ার ভিত্তি স্থাপনের জন্য হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.) অসুস্থ শরীর নিয়ে দিল্লি সফর করেন এবং দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে ইসলাম ও আধুনিকতার সমন্বয়ে অনন্য প্রতিষ্ঠান জামিয়া মিল্লিয়া গড়ে উঠে। পরিতাপের বিষয় তা আজ মুসলমানদের হাতছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়টিও পূর্বের আদর্শ হতে বিচ্যুত। দুই. কাল্লাত প্রদেশে যখন আধুনিক ও দীনিয়াতকে সমন্বয় করে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করা হয় তখন শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দারুল উলুমের দুজন শ্রেষ্ঠ উস্তায মাওলানা শামসুল হক আফগানী (রহ.) ও মাওলানা হামীদ আনসারী (রহ.) যোগ দেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দোহাই দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ওই রাজ্য নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ইসলামি আদর্শ স্থাপনের প্রয়াস। না হয় এর মাধ্যমে দারুল উলুমের প্রকৃত শিক্ষাদৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সামনে এসে যেত।[2]
দারুল উলুম মূলত লক্ষ বানিয়েছিল দীনিয়াতের পাঠ রক্ষা করা ও মুসলিম শিক্ষা-আদর্শ পরাধীন আমলেও ধরে রাখা। দীনের কালিমা বুলন্দ করা ও মুসলিম জাতিসত্তার সফল সংরক্ষণ। এটা মূলত গায়েবি ইশারায় সম্ভব হয়েছিল। যা এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সময় হতেই ধারাবাহিক পরিস্কার হয়েছে। সালতানাত গিয়েছে ভূমি পদানত হয়েছে। আমাদের মহান আকাবির চাইলেন না শিক্ষা যা মূলত মেধাগত সম্পদ ওদের নাপাক মুঠোয় নিয়ন্ত্রিত হোক ও জাতির আত্মিক সৌন্দর্য নষ্ট হোক, জাতীয় স্বাতন্ত্র ও বিকাশধারা থেমে যাক।
আধুনিক সময়ে বন বিশ্ববিদ্যালয়, পানি বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনীতি বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তার অভাব নেই। আর দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল উলুমে শরীয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ রাসেখ ওলামা তৈরি সম্ভব হওয়ার জন্য। এ দৃষ্টিকোণ থেকে কওমি মাদরাসাসমূহের লক্ষার্জন, বিশিষ্টতা ও সাফল্যকে দেখলে মাদরাসা ও মাদরাসা সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত করা যায় না। এখানে কয়েকটি ভাষা-আরবি, উর্দু, ফারসি (প্রাথমিক পর্যায়ে অঙ্ক, ইংরেজি), উচ্চপর্যায়ের শিক্ষা মূলত মাতৃভাষা ও আরবি মাধ্যমে পরিচালিত ও প্রাথমিক মাধ্যমিকে সাহিত্য, বিজ্ঞান, ভূগোল ও ইতিহাস পড়ানো হয়।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, আরববিশ্বসহ যখন সমগ্র প্রাচ্যশিক্ষা থেকে ইলমে হাদীসের চর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, দিল্লির ৬০০ বছরের দরসগাহ বন্ধ হয়ে গেলো ইংরেজের শত্রুতার কারণে, তখন উলুমে শরীয়ার পূর্ণাঙ্গ চর্চা সম্পূর্ণ নবউদ্যমে নতুন মানহাজে সূচনা করলো দারুল উলুম দেওবন্দ। সারাবিশ্ব থেকে পঙ্গপালের মতো শিক্ষার্থী ছুটে এলো। আধুনিক অনেক আরব আলেম মত পোষণ করেছেন, সেদিন দারুল উলুমে হাদীসের পাঠ শুরু না হলে পৃথিবি হতে হয়তো ইলমের এ ধারা বিলুপ্তির পথে যেতো।
দারুল উলুম তার বিগত প্রায় দুই শতক ধরে দীনি ক্ষেত্রে জ্ঞান-গবেষণা, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের আন্দোলন ও মুসলিম জীবনের স্তরে স্তরে ধেয়ে আসা বিজাতীয় সংস্কৃতি, কুসংস্কার, আকিদাগত গোমরাহী ও বিচ্ছিন্নতার স্রোতকে যেভাবে সাফল্যের সঙ্গে মুকাবিলা করেছে তার নযির পৃথিবির শিক্ষা ইতিহাসে বিরল।
ভারতবর্ষে দারুল উলুমের পাশাপাশি থেকে আলীগড় ইউনিভার্সিটি, হায়দারাবাদ উসমানিয়া ইউনিভার্সিটি, দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়াসহ অসংখ্য সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যাত্রা করেছিল। আজ সেগুলো হয়তো অস্তিত্বহীন নয়তো থেকেও লক্ষ্যহীন; কিন্তু দারুল উলুম দেওবন্দের পরিণতি সেরকম হয়নি। এর মহান স্থপতি চিন্তা করেছিলেন, আজ গোটা ভারতবর্ষ তারা আলেমশূন্য করে মুসলমান সমাজকে অন্ধকারের অতলে নিক্ষেপ করতে চেয়েছে, শত শত ধর্মীয় ও জাগতিক বাতিল ইসলামের সত্যিকার চেতনার বিরুদ্ধে সৃষ্টি করেছে ও লেলিয়ে দিয়েছে; তারা ভেবেছে হিন্দুস্তানের পরিণতি স্পেনের মতো হবে, হিন্দুস্তান ইসলামশূন্য হবে। তিনি মুসলমানের জীবনে নবজাগরণ আনলেন। তার সমস্ত শক্তি প্রতিভা ও প্রার্থনার ক্ষমতাকে ব্যবহার করলেন। মাদরাসা বানালেন। ইসলামি বিশেষজ্ঞ তৈরি করলেন। দীনি তালিম জারি রাখার পূর্ব মডেল ওয়াকফ প্রথায় গেলেন না। কারণ পূর্বেই অভিজ্ঞতা হয়েছে লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার মাধ্যমে যে, এধরনের ব্যবস্থা আর সফলকাম নয়। মাদরাসার জন্য তিনি নতুন মূলনীতি অষ্টক প্রণয়ন করলেন। নিজে অনেক মাদরাসা তৈরিতে অংশ নিলেন। তার ছাত্রদের সর্বত্র ছড়িয়ে দিলেন। উপমহাদেশ ভরে গেলো মাদরাসায়। জালের মতো ছড়িয়ে পড়লো মাদরাসা। এ মাদরাসার দর্শন ছিল, স্থায়ী কোনো সম্পদ, কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি ভরসা নয়; আসমান হতে আসবে, শূন্যে ঝুলানো হাড়ি; সেখান থেকে খাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তিনি অসীম মনোবল নিয়ে ঘোষণা করলেন, আমরা মুসলিম শিক্ষার পূর্ব আদর্শ জারি করবো। ছাত্রদের বিনাবেতনে পড়াবো। তাদের ভরণ পোষণ পুস্তক সরবরাহ আমরা করবো। তার এ চেষ্টা সর্বত্র সার্থক ও সফল হলো। দীন ও সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যাতা, উম্মাহর আধ্যাত্মিক ও দীনি জীবনের, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সকল ক্ষেত্রে সত্যিকার নেতৃত্ব এখান থেকে বেরিয়ে এলো। দুর্বল-গরিব অভাবীরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হলো না। তাদের প্রতিভার সত্য ব্যবহার ও তাদের উন্নত জীবন গড়ার প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হলো। দারুল উলুম ও তার সহযোগী শাখা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে দেড়শো বছরের ইতিহাসে শিক্ষা সমাজ সংস্কৃতিতে লাখ লাখ কর্মি ও ব্যক্তিত্ব বেরিয়ে এলেন। তারা এ শিখা পূর্ব হতে পশ্চিমে, আরবে আজমে, এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার মতো দেশে জ্বালিয়ে দিলেন। আজ সারা বিশ্বে ইত্তেবায়ে সুন্নাহর, উসওয়ায়ে হাসানার যে মহান আদর্শ পরিলক্ষিত হয়, ঝঞ্ঝাবিড়্গুব্ধ সমাজ ও সময়ে আল্লাহমুখিতার যে শীতল দাওয়াহ ও দর্শন নিয়ে মহান শুভ্র কাফেলা আবির্ভূত হয় তা দারুল দেওবন্দের ফায়যান, বিশ্বের কওমি মাদরাসাসমূহের অবদান।
ভারতীয় একজন হিন্দু
লেখক যথার্থ বলেছেন
প্রাচীন মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তথা ইসলামি মূল্যবোধ ও দৃষ্টিকোণ রক্ষা ও পরিচর্যার উদ্দেশ্যে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তদানীন্তন ভারতে গড়ে উঠে। একথা অনস্বীকার্য যে, এ ধরনের মাদরাসা, মকতব ও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাব ও প্রশিক্ষণের ফলেই ভারত চিরে কালক্রমে পাকিস্তান জন্মের সূত্রপাত ও প্রতিষ্ঠা ঘটে।
উপসংহার
উনিশ শতকের মহান হিন্দুস্তানি প্রতিভা তাপস আলেমকুল শিরোমণি হযরত মাওলানা কাসিম নানুতভী (রহ.) একদিন যে আলো জ্বেলেছিলেন দেওবন্দ পল্লীর ছাত্তা মসজিদের ডালিম গাছের তলে, তা আর সেখানে সীমাবদ্ধ হলো না। ভারতবর্ষের সবচে উত্তাল ও উর্বর অংশ, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সমতল পলিভূমিতে গড়ে ওঠা জনপদ এই বাংলাদেশ শুরু হতেই তার আশ্রয় খুঁজছিল। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শোষণের মধ্য দিয়ে শত সহস্র বেদনা বঞ্চনা আর হারানোর মর্মন্তুদ ব্যথায় বিদ্রোহ বিপ্লবে অগ্নিগিরির রূপ পরিগ্রহ করেছিলো অথচ চিরকালই সে ছিল রূপসী বাংলা, দেওবন্দী চেতনার মধ্যে সে নিজেকে মেলে ধরলো। দারুল উলুমের সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের সাহায্য পৌঁছেছে। সুবে বাংলার ছাত্রই একসময় বেশি হাড়ে ছিল দারুল উলুম দেওবন্দে। ধার্মিকতায় উজ্জ্বল, পবিত্রতায় সিক্ত উত্তর-পশ্চিম ভারতের দেওবন্দ পল্লীর সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরজুড়ে বিসত্মীর্ণ জনপদের আত্মার যে টান, হৃদয়ের গহনের একই সুরে এর অনুরণন বাংলায় মূর্ত হয়, যেমন হয় ওখানে। এখান থেকে কত সাকী গিয়েছে, পূর্ণ করে এনেছে তার পিয়ালা; এরপর ঢেলেছে ৩৬০ আউলিয়ার কর্ষিত ভূমিতে; সাকির প্রেম ও গোলাবের মর্ম, দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়াতের তারানা সুর ছন্দ বাংলার মাটিতে যতো গুঞ্জরিত হয়েছে বোধ হয় বিশ্বের আর কোথাও তা হয়নি। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম সন্তান, ভারতবর্ষের মানুষের গৌরব, হযরত নানুতভীর আদর্শের পতাকাবাহী মহান শায়খ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী (রহ.) এই বাংলায় তার বহিবির্শ্বের প্রথম দপ্তর খুলেছিলেন। তার এই স্বীকৃতি ও তার নেতৃত্বের পথ ধরে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ধারায় স্বাধীনতা অর্জনের যে নেয়ামত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে। তাদের একক পক্ষের ভোটে পাকিস্তান নামক এক নতুন মানচিত্রের দেশ অস্তিত্ব পেয়েছে এবং তারপর আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার নানান রাজনৈতিক চরাই উৎরাই ও তিক্ততার মধ্য দিয়ে যে অভিজ্ঞতা ও বোধি লাভ করেছে সেটিই অনুরুক্ত থাকে চিত্রিত হয় আজকের বাংলাদেশের জনজীবনে, ঢাকার শাপলা চত্বরের অনুষ্ঠানে, বৃহত্তর সমাজ সভ্যতার বুকে তার দৃঢ় পদ সঞ্চালনে, তাওহীদবাদের মহান পয়গাম বিশ্ব দরবারে উচ্চকিত করাবার বাসনার মধ্যে। বলতে দ্বিধা নেই আজকের বাংলাদেশের মনন ও মেযাজ গঠন করেছে কওমি মাদরাসা। বাংলাদেশের হাটে ঘাটে মাঠে যে কোনো সচেতন ব্যক্তির দৃষ্টিপাতে সেটি ধরা পড়ে। (সমাপ্ত)
[1] ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ সরকার দেওবন্দ মাদরাসা বন্ধ করতে কম চেষ্টা করেনি। শেষে অনেক তদবির করেছে দারুল উলুম ও তার শাখা মাদরাসাগুলো যেন তাদের অর্থসাহায্য ও সনদ গ্রহণ করে। কিন্তু দারুল উলুম তার লক্ষ আদর্শ ঠিক রেখে আজও বেঁচে আছে। ব্রিটিশের এসব কিছুর পেছনে আকাঙ্ক্ষা ছিল, পৃথিবি হতে ইসলামী শিক্ষার মুসলিম আদর্শ ও দৃষ্টান্তকে মুছে ফেলা। আকাবিরে দেওবন্দের ইস্পাতকঠিন মনোবল, উন্নত তাকওয়া ও পবিত্রতা, দুবিয়াবিমুখ জীবনদর্শন ও মুমিনের অন্তর্দৃষ্টি তাদের এমন সতত এক রাজনৈতিক জাগৃতিও দিয়েছিল অন্য কোনও জামাতের ক্ষেত্রে এমন আদর্শ দৃষ্টিগোচর হয় না। এ বিষয়ে দেখুন: তারিখে দারুল উলুম দেওবন্দ, পৃ. ৭৫৭
[2] এসব ঘটনা থেকে জানা যায়, শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের মহান ওলামায়ে কেরামের চিন্তাভাবনা অত্যন্ত সজাগ ছিল। কিন্তু পরাধীন আমলে যতটুকু জরুরি, যতটুকু সম্ভব ততটুকুই তারা রক্ষা করেছিলেন আল্লাহর ওপর ভরসা করে। আধুনিক জ্ঞানবিদ্যা ও জাগতিক বিষয়গুলোর প্রতি কোনরূপ উপেক্ষা ও অনাগ্রহ তাদের কাজকর্ম দ্বারা প্রমাণ হয় না।