মেনিনজাইটিস
যে জীবাণু মস্তিষ্কের আবরণীকে আক্রমণ করে
ডা. মনজুর হোসেন
মেনিনজাইটিস এমন একটি রোগ, যেখানে জীবাণু মস্তিষ্কের এবং মেরুরজ্জুর আবরণীকে আক্রমণ করে। রোগটির ভয়াবহতার মুখ্য কারণ হলো, যখন রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় তখন চিকিৎসার জন্য সময় থাকে ২৪ ঘণ্টারও কম। নানাবিধ কারণে মেনিনজাইটিস হতে পারে, যার মাঝে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ, আঘাত, ক্যানসার এমনকি কোনো কোনো বিশেষ ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও। প্রতিবছর বিশ্বে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়। দারিদ্র্য, ঘনবসতি এবং যথোপযুক্ত প্রতিরোধব্যবস্থা না থাকায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে।
প্রাথমিক লক্ষণ থেকে মেনিনজাইটিস শনাক্ত করা কষ্টকর। আর শনাক্ত করা গেলেও প্রায় ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মাঝে মৃত্যুবরণ করে আর ২০ শতাংশ রোগী বেঁচে গেলেও প্রতিবন্ধিতা বরণ করে নিতে হয়। পাঁচ বছরের নিচে শিশুরা আর ১৫-১৯ বছরের কিশোর-কিশোরীদের মাঝে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি।
মেনিনজাইটিস সাধারণত দুই ধরনের হয়—ভাইরাল মেনিনজাইটিস এবং ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস। ভাইরাল মেনিনজাইটিস সাধারণত কম গুরুতর এবং এই রোগে আক্রান্তের হিসাব করা খুব কঠিন। কারণ উপসর্গগুলো প্রায়ই এতটা হালকা হয় যে একে সাধারণ ফ্লু বলে মনে হতে পারে। ভাইরাল মেনিনজাইটিস শিশুদের মধ্যে এবং গ্রীষ্মকালে ব্যাপক হারে দেখা যায়।
মেনিনজাইটিসের মাঝে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হলো ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস। ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের সময়মতো এবং যথোপযুক্ত চিকিৎসা করা না হলে, এটি রক্তে সংক্রমণ ঘটায় এবং মস্তিষ্কসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্থায়ীভাবে ক্ষতিসাধন করতে পারে। এই মেনিনজাইটিস ৫ বছরের নিচে শিশুদের সাধারণত আক্রমণ করলেও মাঝে মাঝে এক বছরের কম বয়সের শিশুদের এবং ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের আক্রান্ত করে থাকে।
মেনিনজাইটিসের ব্যাকটেরিয়া বাহক থেকে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ব্যক্তি-থেকে-ব্যক্তিতে ছড়িয়ে থাকে। বদ্ধ জায়গায় বহু মানুষের অবস্থান এবং খাওয়া বা পানির পাত্র ভাগাভাগি করলে এই রোগ সহজে বিস্তার লাভ করে।
ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের লক্ষণগুলোর মাঝে রয়েছে জ্বর, বমি, মাথাব্যথা এবং পাশাপাশি ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া। অন্য উপসর্গগুলো হলো আলোক সংবেদনশীলতা, নিদ্রাহীনতা, বিভ্রান্তি, বিরক্তিভাব, প্রলাপ বকা এবং পরিশেষে কোমায় চলে যাওয়া। মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে সংক্রমণ হলে জীবন রক্ষার্থে হাত-পা বা এর অংশবিশেষ কেটে ফেলতে হতে পারে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, রোগমুক্তির পরও রোগের মারাত্মক কিছু প্রতিক্রিয়া থেকে যায়, যা তার মস্তিষ্ক এবং কিডনির কর্মক্ষমতার ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।
ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস প্রতিরোধে তিন ধরনের টিকা পাওয়া যায়—মেনিগোকক্কাল মেনিনজাইটিস, নিউমোকক্কাল মেনিনজাইটিস এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় নিউমোকক্কাল মেনিনজাইটিস এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি-এর টিকা শিশুদের বিনা মূল্যে প্রদান করছে। আর মেনিগোকক্কাল মেনিনজাইটিসের টিকা বেসরকারিভাবে বিভিন্ন হাসপাতাল এবং চিকিৎসকের চেম্বারে পাওয়া যাচ্ছে। নয় মাস থেকে ৪৫ বছর বয়সের যেকোনো সুস্থ ব্যক্তি মেনিগোকক্কাল মেনিনজাইটিসের টিকা নিতে পারে। বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, হোস্টেলে অবস্থানরত কিশোর-কিশোরী অথবা বিবিধ কারণে যাদের ঘন ঘন ভ্রমণ করতে হয়, তাদের এই টিকা অবশ্যই নেওয়া উচিত।
ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস এমন একটি রোগ, যা চিকিৎসার জন্য ২৪ ঘণ্টারও কম সময় দেয় আর তাই আসুন, দেরি না করে টিকা প্রদানের মাধ্যমে আমাদের পরিবারকে নিরাপদ রাখি! জনসচেতনতাও তৈরি করতে হবে।