বাঙালি মুসলিমের সাংস্কৃতিক সংকট
ফিরোজ মাহবুব কামাল
সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির বিষয়
সংস্কৃতি বলতে কি বুঝায়? সংস্কৃতির সুস্থতা বা কদর্যতাই বা কি? সভ্য সমাজ, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও পরিশুদ্ধ মানব গঠনে সংস্কৃতির গুরুত্ব কতটুকু? সুস্থ সংস্কৃতিই বা কীভাবে নির্মিত হয়? অপসংস্কৃতিইবা কি? অপসংস্কৃতির বিপদইবা কি? সাংস্কৃতিক সুস্থতা নিয়ে যারা বেড়ে উঠতে চায় এবং নির্মাণ করতে চায় সভ্যতর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র—এমন প্রতিটি ব্যক্তির কাছে এ প্রশ্নগুলো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। রোগ কিসে হয়, স্বাস্থ্যই বা কি করে বৃদ্ধি পায়—এটুকু না জানলে নিজ দেহের ওপরও পদে পদে অবিচার হয়। স্বাস্থ্যজ্ঞান এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো সংস্কৃতির জ্ঞানও। কারণ এটিই সুস্থতা আনে রুচিবোধে। রুচির প্রকাশ ঘটে তখন পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, আনন্দ-উল্লাস তথা বাঁচার প্রতিটি আয়োজনে। তাই জ্ঞানার্জনের লক্ষ্য নিছক তথ্য ও তত্ত্ব দান হলে চলে না, সুস্থ সংস্কৃতির নির্মাণে ও পরিচর্যায়ও তাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হয়। প্রতিটি জ্ঞানবান ব্যক্তি তখন সংস্কৃতিবান হয়। তখন পথ পায় পরিশুদ্ধ জীবন গড়ায়।
সংস্কৃতির সংজ্ঞা নিয়ে নানা মনীষীর নানা মত। এ ভিন্নতা এসেছে এসব মনীষীদের এ জীবনে বাঁচার লক্ষ্য নিয়ে ধারণাগত ভিন্নতা থেকে। আমাদের বসবাসের পৃথিবীটা এক হলেও চেতনার বা দর্শনের ভূমিটি এক নয়। এক নয় বাঁচার লক্ষ্যও। চেতনা ও বাঁচার লক্ষ্যের ভিন্নতার কারণে ভিন্ন হয় জীবনের স্বপ্নগুলোও। এ থেকেই ভিন্নতা সৃষ্টি হয় বাঁচার পথ ও পাথেয়তে। এজন্যই অমুসলিম থেকে একজন মুসলিমের জীবনের পার্থক্য বিপুল ও বহুবিধ। সে পার্থক্য নিছক খাদ্য-পানীয়তে নয়, বরং রুচিবোধ, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচারণ, শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহসহ জীবনের সর্বত্র জুড়ে। জীবন ও জগতকে সবাই একইভাবে দেখে না, তেমনি একইভাবে দেখে না সংস্কৃতির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকেও। সংস্কৃতি এজন্যই সংজ্ঞায়ীত হয়েছে নানা জনে নানাভাবে।
বাঁচার মধ্যে উচ্চতর বিবর্তন বা জীবনকে নিরন্তর সভ্যতর, রুচিশীল ও সৃষ্টিশীল করার যে অবিরাম প্রক্রিয়া সেটিই হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতি থেকে ব্যক্তি পায় সমাজকে কিভাবে প্রতিনিয়ত সভ্যতর করতে হবে তাঁর শিক্ষা। একটি দেশের ঋতু, জলবায়ু ও ভৌগোলিক প্রকৃতি নির্ধারণ করে সেখানে কি ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল বাঁচবে। তেমনি একটি দেশের সংস্কৃতিও নির্ধারণ করে সেখানে কি ধরণের মানুষ বেড়ে উঠবে। প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন নির্ধারণ করে জীবকুলের জৈবিকভাবে বেড়ে উঠাটি, তেমনি সংস্কৃতি নির্ধারণ করে নৈতিক, চারিত্রিক, রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে বেড়ে উঠাটি। তাই অভিন্ন এক ভৌগোলিক পরিমণ্ডল একই ধরণের গাছপালা ও পশুপাখির জীবন-ধারনের নিশ্চয়তা দিলেও তা একই ধরণের মানুষ গড়ে উঠার নিশ্চয়তা দেয় না। বাংলাদেশ তার উংকৃষ্ট উদাহরণ। জলবায়ু বা আবহাওয়ার দিক দিয়ে পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য নেই। কিন্তু মানুষের জীবনবোধ, রুচিবোধ, সমাজনীতি, রাজনীতি ও বাঁচার উদ্দেশ্য নিয়ে এতোই পার্থক্য যে এক অখণ্ড ভূখণ্ডে বসবাস তাদের জন্য অসম্ভব হয়েছে। ফলে ১৯৪৭ সালে রাজনৈতিকভাবে হিন্দু ও মুসলিমদের পৃথক হতে হয়েছে। সে ভিন্নতার কারণে দুটি ভিন্ন চরিত্রের দেশে তারা শামিল হয়েছে।
মাছ যেমন পানিতে বেড়ে উঠে, মানুষও তেমনি বেড়ে উঠে নিজ নিজ সংস্কৃতির মাঝে। পানাহার কি হবে, কীরূপ হবে পোশাক-পরিচ্ছদ, কিভাবে পরিচালিত হবে বিয়ে-শাদি ও ঘর-সংসার, উপাস্য কে এবং কীভাবে তাঁর ইবাদত করতে হবে, প্রতিবেশীর সাথে আচরণই বা কীরূপ হবে, কীভাবে একজনকে আপ্যায়ান বা বিদায় জানাতে হবে এরূপ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একজন শিশু বিদ্যালয় থেকে শেখে না। সেগুলি শেখে দেশের আবহমান সংস্কৃতি থেকে। সেটি সদা ক্রিয়াশীল তার পরিবারে, তার মহল্লায়, তার নিজ শহর ও নিজ দেশে। এজন্যই শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রামীণ-শহুরে সবার জন্যই ভালো-মন্দ একটি সংস্কৃতি থাকে। সহজ ভাষায় তাই বলা যায়, মানুষ যেভাবে প্রতিদিন বাঁচে, স্বপ্ন দেখে ও সভ্যতর করে, সেটাই তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির প্রসঙ্গটি এজন্যই এতো গুরুত্বপূর্ণ।
বাঙালি মুসলিমের কেন এ সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা?
যারা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ চায় তারা শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব নিয়ে ভাবে না, তারা ভাবে দেশের বুকে সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়েও। তারা চায় নিজ আদর্শের আলোকে নতুন সংস্কৃতির নির্মাণ। কারণ রাজনীতি পথ দেখায় দেশ পরিচালনার, আর সংস্কৃতি পথ দেখায় জীবন পরিচালনার। তাই প্রতিটি দর্শন বা মতবাদের প্রতিপাদ্য বিষয় যেমন রাষ্ট্রের সংস্কার, তেমনি ব্যক্তির সংস্কার। জনজীবনে বিপ্লব আনার কাজে তাই অনিবার্য হয়ে উঠে সাংস্কৃতিক বিপ্লব। দেশের ধর্ম বা আদর্শ পাল্টে গেলে সংস্কৃতিতেও তাই পরিবরর্তন শুরু হয়। এজন্যই বাঙালি মুসলিমের সংস্কৃতি ও বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতি কোন কালেই এক ছিল না। তাই অবিভক্ত বাংলার বুকে হিন্দু বাঙালি ও মুসলিম বাঙালি—এই উভয়ের নিয়ে কোনো কালেই অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতি বলে কিছু ছিল না।
প্রতিটি আদর্শিক বিপ্লবই যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে হাজির হয়—সে প্রমাণ ইতিহাসে প্রচুর। সেটি যেমন ইসলামের বিজয়ের পর আরব দেশে দেখা গেছে, তেমনি দেখা গেছে কম্যুনিস্ট বিপ্লবের পর সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনে। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এজন্যই শুধু আবু লাহাব ও আবু জেহেলদের ন্যায় দুর্বৃত্ত নেতাদেরই নির্মূল করতে হয়নি, নির্মূল করতে হয়েছিল তাদের অসুস্থ সংস্কৃতিকেও। শুরু করতে হয়েছিল সংস্কৃতির নতুন ধারার নির্মাণ। সংস্কৃতির নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জীবন ও জগত নিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ধারণা। সে ধারণাটাই ব্যক্তিকে দেয় কিভাবে বাঁচতে হবে এবং কিভাবে বেড়ে উঠতে হবে—সে বিষয়ে দিক-নির্দেশনা। হিন্দু ও মুসলিম এবং আস্তিক ও নাস্তিকের ধারণাটি যেহেতু ভিন্ন—তাদের সংস্কৃতিও তাই ভিন্ন। তাই একই দেশ, একই ভাষা ও একই বর্ণের হয়েও মানুষ ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারার অনুসারী হয়।
মুসলিমগণ জীবন ও জগত নিয়ে ধারণাটি পায় ইসলাম থেকে। যে বিশেষ ভাবনাটি একজন মুসলিমের জীবনের মোড় পাল্টে দেয় সেটি হলো পরকালের ভাবনা। সেটি জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার ভাবনা। ঈমানদার ব্যক্তি প্রতি মুহূর্ত বাঁচে জান্নাতের জন্য নিজেকে যোগ্যতর করার ভাবনা নিয়ে। সে জন্য জরুরি হলো মহান আল্লাহ তাআলার কাছে গ্রহণযোগ্য এক পরিশুদ্ধ জীবন। সে ধরনের একটি লক্ষ্যে ঈমানদারকে প্রতিদিনের প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচতে হয় নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা নিয়ে। পরিশুদ্ধির সে প্রক্রিয়ার উপকরণ হলো কুরআনি জ্ঞান, ইবাদত, জিহাদ, আত্মসমালোচনা ও নেক আমল। তবে ব্যক্তির চারিত্রিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো কুরআনি জ্ঞান। এ কুরআনি জ্ঞানের শূন্যতায় পরিশুদ্ধ করণের অন্যান্য মাধ্যমগুলি ব্যর্থ হতে বাধ্য।
পবিত্র কুরআনের এ জ্ঞান যেমন ব্যক্তিকে ভাবতে ও আত্মসমালোচনা করতে শেখায়, তেমনি পথ দেখায় কীভাবে বাঁচতে হবে ও কীভাবে বেড়ে উঠতে হবে তা নিয়ে। তাই এই কুরআনি জ্ঞান ছাড়া মুসলিম হিসেবে বাঁচা যেমন অসম্ভব, তেমিন অসম্ভব হলো ইসলামি সংস্কৃতির নির্মাণ। বাঙালি মুসলিম জীবনে সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার মূল কারণ হলো এই কুরআনি জ্ঞানের শূন্যতা এবং এ সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার কারণে বাঙালি মুসলিমগণ ব্যর্থ হচ্ছে কাঙ্খিত পরিশুদ্ধ চরিত্রের মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে। তাদের সে ব্যর্থতাটি প্রকটভাবে ধরা পড়ে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হওয়ার মধ্য দিয়ে। চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের প্লাবন হলো—সে সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার চুড়ান্ত দলিল। জনজীবনে সাংস্কৃতিক পরিশুদ্ধি কতটা সাধিত হয়েছে সেটি বুঝা যায় দেশবাসীর মূল্যবোধ, আচরণ, রাজনীতি, সমাজনীতি ও সাহিত্যের দিকে নজর দিলে।
অপসংস্কৃতির তাণ্ডব
ধর্মীয় বোধ-শূন্য মানুষের চেতনায় প্রবলভাবে কাজ করে ইহজাগতিক সাফল্য অর্জনের ভাবনা। সেরূপ একটি ইহজাগতিক ভাবনা নিয়ে বাঁচার দর্শনটিই হলো সেক্যুলারিজম। সে ভাবনার জড়তে পরকালের ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক। সেক্যুলারগণ পরকালের ভাবনাকে অ-আধুনিক ও পশ্চাদপদতা মনে করে। এখানে যা প্রবলভাবে কাজ করে তা হলো বস্তুবাদী স্বার্থ চেতনা। ফলে তাদের জীবনে প্রবল স্বেচ্ছাচার দেখা দেয় উপভোগের পথ ও পাথেয় নিয়ে। ইসলাম পালনে অঙ্গীকারহীন হওয়ায় সংস্কৃতিতে পাপাচারও তখন গ্রহণযোগ্য গণ্য হয়। এরই ফলে সেক্যুলার বাঁচে বেশি বেশি আনন্দ ও উল্লাসের খোঁজে। আনন্দের খোঁজে নিজ ঘর ছেড়ে এরা দেশে দেশে ঘুরে। এদের প্রয়োজন মেটাতেই বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে সেক্স-টুরিজম। ব্যাপকতর হয়েছে মদ, ড্রাগ, জুয়া, অবাধ সেক্স, উলঙ্গতার ন্যায় সকল আদীম পাপ-বাণিজ্য। এসব ভোগবাদীরা পানাহারের ন্যায় এগুলিকেও অপরিহার্যভাবে। এগুলো পাপ নিয়ে বাঁচাকে বলে মৌলিক নাগরিক অধিকার। এদের আনন্দের খোরাক জোগাতে এমন কি মুসলিম বিশ্বের কোণে কোণে গড়ে উঠেছে মদের দোকান, ক্লাব-ক্যাসিনো ও পতিতাপল্লী। যা কিছু আনন্দ দেয় তাদের কাছে তাই সিদ্ধ বা জায়েজ। শিষ্ট-অশিষ্ট, শ্লীল-অশ্লীল, জায়েজ-নাজায়েজ—এসবের ধার তারা ধারে না। পর্নোগ্রাফি, চাইল্ড সেক্স ও হোমসেক্সুয়ালিটির জন্ম দিয়েছে এরাই। জগত জুড়ে এভাবেই বেড়েছে নৈতিক অসুস্থতা। অথচ এদের কাছে এগুলিও সংস্কৃতি।
ক্ষুধা মেটাতে সবাই সব কিছু খায় না। খাদ্যের বেলায় কোনটি সিদ্ধ আর কোনটি অসিদ্ধ—তা নির্ধারিত হয় ধর্মীয় অনুশাসন থেকে। তেমনি নৈতিক দিক দিয়েও সব কিছু সিদ্ধ নয়। তবে কোনটি নৈতিক আর কোনটি অনৈতিক—সেটির নির্ধারনেও নির্ভূল মানদণ্ড চাই। বিপুল ভোগ-সামগ্রীতেও জীবন যে সুখের হয় না তার বড় প্রমাণ আজকের পাশ্চাত্য জগত। এজন্যই মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঠিক হিদায়েত বা দিকনির্দেশনা। খাদ্য-পানীয় তো পশুও পায়। তবে পশু যেটি পায় না সেটি হলো হিদায়েত। তাই পশুর দ্বারা সভ্যতর সমাজও নির্মিত হয় না। তবে মানব যে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট হতে পারে ইতিহাসে সে প্রমানও প্রচুর এবং সেটি হিদায়েত না পাওয়ার কারণে। যার জীবনে হিদায়েত নাই সে ব্যক্তি সম্পদশালীই হলেও অতি দূর্ভাগা। মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে এবং নবী-রসুলগণ এসেছেন তো সে প্রয়োজনটি মেটাতেই।
ইসলাম তাই শুধু নিছক ধর্ম নয়, এটিই হলো মহান আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। ইসলামের কারণেই প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের হাতে নির্মিত হয়েছিল সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। মানুষ তখন ফেরেশতাদের চেয়েও উপরে উঠেছিল। পরিণত হয়েছিল মহান আল্লাহ তাআলার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিতে। মুসলিমগণ আজ যে কারণে নীচে নামছে তার কারণ তাদের সংখ্যা বা সম্পদের কমতি নয়, বরং সেটি হয়েছে ইসলামের অনুসরণ না করার কারণে। তারা পরিণত হয়েছে পথহারা পথিকে।
অপর দিকে পাশ্চাত্যবাসী আল্লাহ তাআলার সে মহান নেয়ামতকেই অস্বীকার করেছে। ফলে অঢেল সম্পদও তাদেরকে বিভ্রান্তি থেকে বাঁচাতে পারিনি। দিতে পারিনি মানসিক শান্তি। বরং শান্তির খোঁজে আসক্তি বেড়েছে ঘুমের বড়ি, মদ, হিরোইন, কোকেন, ক্যানাবিস বা গাঁজার ন্যায় বিবিধ মাদক দ্রব্যে। লাখে লাখে ভুগছে মানসিক রোগে।
আনন্দ খুঁজতে সমকামিতা, মদ্যপান, পর্নোগ্রাফি এবং ব্যাভিচারের মতো আদিম পাপাচারগুলিকেও বৈধতা দিয়েছে। গাধার পিঠে অন্ধ-আরোহী যেমন গাধা যেদিকে যায় সেদিকেই ধাবিত হয়, তেমনি অবস্থা পাশ্চত্যবাসীর। এখানে গাধাটি হলো তাদের রিপুর তাড়না। তাই রিপুর তাড়না যেদিকে নেয়, তারা ধেয়ে চলছে সেদিকেই।
বিধ্বস্ত সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া ও মানবিক সংকট
কোভিড, কলেরা, যক্ষা, এইডস ইত্যাদি সংক্রামক রোগের ন্যায় দুষ্ট সংস্কৃতিও প্রচণ্ডভাবে আগ্রাসী ও সংক্রামক হতে পারে। রাজনৈতিক শক্তির মতো একটি আগ্রাসী সংস্কৃতিও বিনাশ করতে পারে অপর দেশের সংস্কৃতিকে। সামরিক আগ্রাসনে লুন্ঠিত হয় পরাজিত জাতির সম্পদ। কিন্তু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে লুন্ঠিত হয় পরাজিত জাতির ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক সম্পদ। ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে বাংলার বুকে শুধু অর্থনৈতিক লুন্ঠনই হয়নি, বিনষ্ট হয়েছে বাঙালি মুসলিমের সাংস্কৃতিক সম্পদও। শত্রুর হাতে বিনাশ ঘটেছে বাঙালি মুসলিমের নীতি, নৈতিকতা ও চরিত্র। বিনষ্ট হয়েছে আদর্শিক পরিমণ্ডল ও আবহাওয়া। ব্রিটিশদের হাতে অধিকৃত হওয়ার আগে বাঙালি মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তির ভাষা ছিল ফার্সি। সেটি বিলুপ্ত করে ব্যহত করে বাঙালি মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠাকে। এভাবেই তাদের চেতনার রাজ্যে ঘটায় ভয়ানক নাশকতা। এভাবেই প্রমাণ মেলে দেশ শত্রুর দখলে গেলে পরাজিত মানুষের পক্ষে কতটা অসম্ভব হয় নিজের মত বেড়ে উঠাটি।
একটি জাতির অমূল্য সম্পদ হলো তার নৈতিক সম্পদ। এ সম্পদ কলকারখানা বা ক্ষেতখামারে গড়ে উঠে না। বরং গড়ে উঠে জাতির চেতনালোকে। যার নির্মাণে কাজ করে ধর্ম ও আদর্শ এবং সে ধর্ম ও আদর্শের পতাকাবাহী অসংখ্য আলেম বা বুদ্ধিজীবী। সংস্কৃতি নির্মাণের এ কাজটিই হলো বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। বুদ্ধিবৃত্তিক এ জিহাদের ফলেই লড়াকু সৈনিক পায় সশস্ত্র জিহাদ। বস্তুত সভ্য মানুষ, সভ্য রাষ্ট্র ও সভ্য সভ্যতা নির্মিত হয় এ জিহাদের পথ ধরেই। ইসলামে এজন্যই এটি সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। সে সমাজের এ জিহাদ নাই সে সমাজের মানুষ দিন দিন নীচে নামতে থাকে এবং দুর্বৃত্তিতে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। বাংলাদেশ তো তারই উদাহরণ। তাই যে কোন জীবন্ত ও সুস্থ জাতির জীবনে এমন একটি জিহাদী প্রচেষ্টা ক্রিয়াশীল থাকা শুধু কাঙ্খিতই নয়, অপরিহার্যও। সে প্রক্রিয়া একটি দেশে কতটা সফল এবং কতটা কার্যকর—সেটিরই পরিমাপ দেয়ে সে দেশের জনজীবনের সংস্কৃতি। খনির স্বর্ণ আর অলংকারের স্বর্ণ এক নয়, উভয়ের মাঝে যে পার্থক্য তার পশ্চাতে কাজ করে দীর্ঘ সময়ের একটি পরিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। তেমনি সভ্য মানুষ আর অসভ্য মানুষও এক নয়। এক নয় উভয়ের মাঝে দর্শন, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং বাঁচার রুচিবোধও। এ পার্থকের মূলে থাকে একটি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। সংস্কারের এ ক্রীয়াশীল প্রক্রিয়াই নামই হলো সংস্কৃতি। একটি জাতির সভ্যতর হওয়ার পিছনে মূল হাতিয়ার হলো এই সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া।
কলকারখানার কাজ কৃষি বা খনিজ পণ্যের ওপর মূল্য সংযোজন ঘটানো। সেরূপ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলেই বাজারে তার কদর বাড়ে, মূল্যও বাড়ে। অপর দিকে ব্যক্তির জীবনে মূল্য সংযোজনের কাজটি হয় তিনটি পর্যায়ে।
এক. রাজনীতিতে আদর্শিক বিপ্লব,
দুই. আলেম বা বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ,
তিন. শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে চলা পরিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া।
দেশের ক্ষেতখামার ও কলকারখানার চেয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এ তিনটি প্রক্রিয়ার গুরুত্ব কম নয়। এ তিনটি প্রক্রিয়ার কোন একটি কাজ না করলে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের কাজ ব্যর্থ হতে বাধ্য। তখন ব্যর্থ হয় সত্যিকার মুসলিম হিসেবে বেড়ে উঠার কাজ। বাংলাদেশের মতো দেশে এর কোনটিই সঠিকভাবে কাজ করছে না। অথচ নবী-রসুলগণ কাজ করেছেন এ তিনটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই।
মহান আল্লাহ তাআলা বিজ্ঞান শেখাতে নবীরসুলদের পাঠাননি। পাঠিয়েছেন মানবের আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়াটি হাতে নাতে শেখাতে। লক্ষ্য ছিল: মানুষ যাতে স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনতে হলে রাষ্ট্রীয় বিপ্লবটি হলো পূর্বশর্ত। ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া যায় না। তেমনি রাষ্ট্রীয় বিপ্লব ছাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয় না। নতুন গাছের চারা লাগাতে হলে সেখান থেকে আগের গাছটিকে শিকড়শুদ্ধ উপড়িয়ে ফেলতে হয়। দুর্বৃত্তদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা রেখে পরিশুদ্ধ মানব গড়ার সংস্কৃতি কখনোই গড়া যায় না। মহান নবীজি (সা.) তাই শুধু ধর্মের বাণী প্রচারে নিজ দায়িত্ব সীমিত রাখেননি। মদিনায় হিজরত করা মাত্রই তিনি ইসলামি রাষ্ট্র গড়েছেন এবং সে রাষ্ট্রের চালকের সিটে বসে ১০টি বছর রাষ্ট্র প্রচার করেছেন। কিন্তু মুসলিমগণ আজ বাঁচছে নবীজি (সা.) সে মৌল শিক্ষাটি বাদ দিয়েই। ফলে তাদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না নবীজি (সা.)-এর সাধিত রাজনৈতিক বিপ্লব।
আদর্শিক বিপ্লব, রাজনৈতিক বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব—এ তিনটি বিপ্লব এক সাথে চলে। সবগুলি বিপ্লবই একে অপরের পরিপূরক। এ তিনটি বিপ্লবের কাজ একত্রে না হলে ইসলামের কাঙ্খিত বিপ্লবটি কখনোই সফল হয় না। আদর্শিক বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব সুচারুভাবে সমাধা করতে জরুরি হলো শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর পূর্ণ সহযোগিতা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিপক্ষ হলে অসম্ভব হয় কোন সমাজ বিপ্লব ঘটানো। আদর্শিক, রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব একত্রে ঘটতে দেখা গেছে নবীজি (সা.)-এর আমলে। পবিত্র কুরআন হলো এ তিনটি বিপ্লবেরই রোডম্যাপ। ব্যক্তির পরিশুদ্ধির যে প্রক্রিয়া ইসলাম গড়ে তোলে সেটিকেই আরবিতে বলা হয় তাহযীব। আরবিতে যা তাহযীব, বাংলায় সেটিই হলো সংস্কৃতি। তাযযীব সংস্কৃতির একটি দর্শনগত সংজ্ঞা দেয়। তাহয়ীবের অর্থ হলো চির-চলমান এক পরিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। এটি হলো, মানুষের জীবনে নিত্য মূল্য সংযোজনের একটি প্রক্রিয়া। বিভিন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাসকারি মানুষের মাঝে যে গুণগত বিশাল তারতম্য সেটি সৃষ্টি হয় এই পরিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া কতটা সফল বা বিফল হলো তার ভিত্তিতে। মুসলিমের দায়িত্ব হলো, একটি সফল সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া গড়ে তোলায় নিজের মেধা, শ্রম ও বুদ্ধিবৃত্তির বিনিয়োগ। নইলে অসম্ভব হয় তার নিজের এবং সে সাথে আগামী প্রজন্মের পক্ষে মুসলিম হিসেবে বেড়ে উঠা। প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের থেকে আজকের মুসলিমদের যে বিশাল পার্থক্য সেটি এটিই সাক্ষ্য দেয়: সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সে প্রক্রিয়া মুসলিম দেশগুলিতে সফলভাবে কাজ করেনি।
প্রশ্ন হলো, কি সেই সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া? কি সেই উপাদান যার ভিত্তিতে একটি জাতি অন্য একটি জাতি থেকে ভিন্নতর সংস্কৃতির জন্ম দেয় বা জীবনবোধে ভিন্নতর হয়? বলা হয়, মুসলিমগণ সংস্কৃতিতে অমুসলিমদের থেকে ভিন্নতর। কিন্তু কি সে ভিন্নতা? কেন সে ভিন্নতা? ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সংস্কারের প্রেরণা আসে ধর্ম বা আদর্শ থেকে। মুসলিমের জীবনে সে ধর্ম বা আদর্শ হলো ইসলাম। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ে পবিত্র কুরআন দেয় সেই মানদণ্ড। সে মানদণ্ডের ভিত্তিতে বাঁচার মধ্যে আসে রুচিবোধ। আসে তার কর্মে আর বাঁচার প্রক্রিয়ায় পরিশুদ্ধি। ভূমি, ভাষা, জলবায়ু বা গাত্রবর্ণ এমন একটি রুচিবোধ দেয় না। কোন মানদণ্ডও দেয় না। ফলে ভাষা, জলবায়ু, ভুগোল ও বর্ণ অভিন্ন হওয়া সত্বেও বিভিন্ন ধর্ম ও আদর্শের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম হয়। মানুষ উদ্ভিদ নয় যে ভূমি বা জলবায়ু থেকে তার বাঁচার উপকরণ সংগ্রহ করবে।
ব্যক্তির নৈতিক সত্তাটিই মূল, তার দৈহিক বা জৈবিক সত্তাটি নয়। নৈতিক সত্তার কারণেই মানুষ স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। সে নৈতিক সত্তাটি পুষ্টি পায় অহীর জ্ঞান তথা কুরআন থেকে। সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে বেড়ে উঠাটি নিশ্চিত করতে মানব জাতিকে মহান আল্লাহ তাআলা শুধু পুষ্টিকর পানাহারই দেননি, আত্মার পরিপুষ্টি দিতে সর্বশ্রেষ্ঠ খাদ্য পবিত্র কুরআনও দিয়েছেন। এই কুরআনই হলো এ পৃথিবী পৃষ্ঠে মহান স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। যখনই এ সর্বশ্রেষ্ঠ দানকে এড়িয়ে বেড়ে উঠার চেষ্টা হয়েছে তখনই মানুষ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মানব সভ্যতার এবং সে সাথে মুসলিমদের ব্যর্থতার মূল কারণটি হলো, কুরআন পরিত্যাগ করা। অথচ যখনই কুরআনকে অনুসরণ করা হয়েছে তখনই সৃষ্টি হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। তারই উদাহরণ হলো গৌরব যুগের মুসলিমগণ। ইসলামকে বাদ দিয়ে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠে সেটি কখনোই মুসলিমের সংস্কৃতি নয়। সেটি মূলত কাফেরের সংস্কৃতি। মুসলিম থেকে যেমন ইসলামকে পৃথক করা যায় না, তেমনি পৃথক করা যায় না ইসলামি সংস্কৃতিকেও।
সংস্কৃতির মধ্যেই ঘটে ব্যক্তির বিশ্বাস ও চেতনার প্রকাশ। অশ্লীল সাহিত্য, নাচগান, নাটক ও সিনেমার মধ্যে যে সংস্কৃতি সেটি কখনোই মুসলিমের সংস্কৃতি হতে পারে না। এ সংস্কৃতির মাঝে প্রকাশ ঘটে কুফরির তথা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের। বিশ্বাস বা চেতনা দৃশ্যময় নয়, সেটি দৃশ্যময় হয় সংস্কৃতির মাধ্যমে। রোগের যেমন লক্ষণ থাকে, স্বাস্থ্যেরও তেমনি বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে। আল্লাহতে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী উভয়েরই তেমনি সনাক্তকরণের কিছু লক্ষণ থাকে। আল্লাহতে অবিশ্বাসী কাফির দের জীবনের লাগামটি অবাধ্য প্রবৃত্তির হাতে। এজন্যই তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও আমোদ-ফুর্তির মাঝে অশ্লীলতার প্রকাশটি স্বাভাবিক। কিন্তু মুসলিমের প্রতিটি কর্মে প্রকাশ পায় মহান আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়া। ঈমানদারের চাওয়া-পাওয়ার ওপর ইসলাম লাগাম পড়িয়ে দেয়। মুমিনের জীবন এজন্যই নিয়ন্ত্রিত। কি আনন্দ-উল্লাস, কি দুঃখ-বিষাদ সব কিছুতেই মহান আল্লাহ তাআলার ওপর থাকে তার পূর্ণ নির্ভরতা।
ইসলামের সংস্কৃতি হলো ব্যক্তির জীবনে লাগাতার পরিশুদ্ধি তথা মূল্য সংযোজনের সংস্কৃতি। বিজ্ঞানের বদৌলতে বিপুল মূল্য-সংযোজন ঘটেছে বিভিন্ন খনিজ ধাতু বা কৃষি পণ্যে। কিন্তু তা মূল্য-সংযোজন করেনি ব্যক্তির জীবনে। বরং ভয়ানক অবমূল্যায়নই ঘটিয়েছে। ফলে পাশ্চাত্যের মানুষ বেড়ে উঠছে চরিত্রহীন দস্যু, লম্পট ও বীভৎস খুনি হিসেবে। ফলে নিত্য নতুন গাড়ির মডেলের ন্যায় যোগ হচ্ছে গণহত্যার নতুন মডেল। লাম্পট্যও এখানে শিল্প হিসেবে উঠেছে। হালাকু চেঙ্গিজের চেয়ে এজন্যই তারা বহুগুণ বেশি বর্বর ও লম্পট। পশুর যেমন শিকার ধরার নিজস্ব কৌশল থাকে এবং সেটিকে একটি শিল্প হিসেবে গড়ে তুলে, পাশ্চাত্যও তেমনি শিল্প হিসেবে গড়ে তুলেছে পররাজ্য দখল ও শোষণ প্রক্রিয়াকে। সে প্রক্রিয়াতেই গড়ে উঠেছে বর্ণগত নির্মূল, গণহত্যা, উপনিবেশবাদ, নয়া-উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং দাস ব্যবসা। এ কারণেই বিশ্বের কোনে কোনে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যবহৃত হয়েছে আনবিক বোমা, ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম, মিজাইল, ক্লাস্টার বোমা এবং ড্রোন। এ ধরনের মানবধ্বংসী সংস্কৃতির কারণেই বিগত দুটি বিশ্ব যুদ্ধে তারা প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। মানুষ গড়ার শিল্পে পাশ্চাত্য যে ভয়ানকভাবে ব্যর্থ হয়েছে—তা নিয়ে কি তাই সন্দেহ থাকে? কোন প্রকাণ্ড মহামারিতেও মানব জাতির এতটা ক্ষতি হয়নি। এতটা ক্ষতি হয়নি সকল প্রজাতির সমগ্র হিংস্র পশুদের নখরেও।
আরো বিপদের কারণ এ বিধ্বংসী সংস্কৃতিরই বিশ্বব্যাপী প্রসার ঘটছে মহামারীর ন্যায়। তাই মানবজাতির আজকের সংকটের কারণগুলি শুধু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য নয়, বরং সেটি তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও। সে আগ্রাসনে বিশ্বে জুড়ে মারা পড়ছে মানবতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। বাড়ছে চরিত্রহীনতা, নগ্নতা, লাম্পট্য ও এইডস। ব্যর্থ হয়েছে চেতনা ও চরিত্র পরিশুদ্ধ করণের প্রক্রিয়া। মানব ব্যর্থ হচ্ছে মানবিক গুণে বেড়ে উঠায়। ফলে সম্পদের প্রাচুর্য ব্যর্থ হচ্ছে কদর্য চরিত্র ও দুর্বৃত্তি থেকে পরিত্রাণ দিতে। ফলে বিশ্বের কোনে কোনে বাড়ছে ধ্বংসের আয়োজন। দিন দিন দানবীয় হচ্ছে পশু শক্তির প্রয়োগ। এতে বিপন্ন হচ্ছে দরিদ্র মানুষের প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকাটিও। তাই সাংস্কৃতিক সমস্যা এটি শুধু বিশেষ কোনো দেশের সমস্যা নয়, এটি পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক সংকটে। এ সংকট তাই সমগ্র মানব সভ্যতার। তবে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ বিপদের কারণ সাংস্কৃতিক এ সংকটটি সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে গ্রাস করেছে এই দেশটিকে এবং বাড়তি বিপদ হলো, বহু দেশে এ সংকট থেকে বাঁচার চেষ্টা হলেও বাংলাদেশে এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে অতি সামান্য।