দশ লেখক দশ জীবন
মুসলমানিধারার শিল্প-সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক পথচলার দলিল
জুবায়ের রশীদ
বই : দশ লেখক দশ জীবন
কালি-কলম ও পথচলার গল্প
গ্রন্থনা : জহির উদ্দিন বাবর
প্রচ্ছদ : আহমদুল্লাহ ইকরাম
পৃষ্ঠা : ৩৭৬
মূল্য : ৭০০
প্রকাশনী : রাহনুমা প্রকাশনী
লেখকপত্র নিয়মিত পড়ি। ইসলামি ধারার লেখকদের জীবন ও গল্প নিয়ে এই পত্রিকা, তাই পড়তে ভালো লাগে। কারণ আমি নিজেকে এ ধারারই একজন নগণ্য লেখক বলে জ্ঞান করি। প্রতিটি সংখ্যায় সময়ের একেকজন বরেণ্য ও বরিত লেখকের জীবনকথা বিস্তৃত পৃষ্ঠাজুড়ে সাজানো থাকে। আঙ্গিকটাও বেশ দারুণ, প্রশ্নোত্তর আকারে। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা বেশ দারুণ ও উপভোগ্য। আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, আস-সুয়ালু নিসফুল ইলম, যার সোজাসাপটা বাংলা হচ্ছে, প্রশ্ন আহরিত জ্ঞান-প্রজ্ঞার অর্ধেক। প্রশ্নকর্তা লেখকপত্রের সম্পাদক জহির উদ্দিন বাবর তার হৃদয়কোণে জমে থাকা প্রশ্নগুলো করেছেন একে একে, আর লেখক সেগুলোর জবাব দেন দারুণ মুনশিয়ানায়। প্রশ্নের পিঠে এমন অনেক আলোচনা উঠে এসেছে যা সচরাচর বলতে শুনি না।
কিন্তু পাঠক হিসেবে আমার সমস্যা হচ্ছিল, পড়ে তৃষ্ণা মেটছে না; হাতের ফাঁক গলে চড়ুই পাখি যেমন ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় তেমন করে পৃষ্ঠাগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছিল। সে থেকে অপেক্ষা করতে থাকি বই আকারে হাতে পাবার। ব্যক্তিগত আমি বইটির জন্য বেশ মুখিয়ে ছিলাম। তারপর সহসা একদিন দেখি রাহনুমা প্রকাশনীর পেইজে দশ লেখক দশ জীবন বইয়ের প্রচ্ছদ। বলতে দ্বিধা নেই, বইমেলার এই একটি বইয়ের জন্যই আমার আগ্রহ ও অপেক্ষা ছিল সর্বাধিক। অবশেষে প্রকাশনাসংক্রান্ত যাবতীয় ধাপ অতিক্রম করে ৭ মার্চ হাতে পাই গ্রন্থনায়কের অটোগ্রাফ সমেত। বই নিয়ে মেলা থেকে সন্ধ্যায় ডেরায় ফিরি। আর অপেক্ষা নয়, পড়া শুরু করি, পড়তে থাকি, গভীর রাত অবধি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে পড়ে পড়ে শেষ করি।
এ সময়ের শক্তিমান ও কিংবদন্তিতুল্য দশজন লেখকের জীবনকথায় বইটি রচিত। তাঁরা হলেন, মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মাওলানা ইসহাক ওবায়দী, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, মাওলানা লিয়াকত আলী, ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ, মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী, মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী, মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। উল্লিখিত ব্যক্তিদের কেউই এখন পর্যন্ত আত্মজীবনী লেখেননি। ইতোমধ্যে একজন আল্লাহর মেহমান হয়ে গেছেন। আরও অনেকে বার্ধক্যে উপনীত। তাদের আত্মজীবনী লেখা হয়ে উঠবে কি না তা নিশ্চিত নয়। ফলে দশ লেখক দশ জীবন সে জায়গা থেকে বিরাট শূন্যতা পূরণ করেছে।
একজন লেখকের কাছে তার পাঠক ভক্ত অনুরাগীদের অনেক কিছু জিজ্ঞাসার থাকে। যে লেখকের লেখা পড়ে আমরা বিমুগ্ধ হই, আলোড়িত হই, পাঠতৃষ্ণা নিবারণ করি; কেমন ছিল তার জীবনাচার, সময় ও সমাজ নিয়ে তার ভাবনা কী, ব্যক্তি পরিবার ও সমাজজীবনের নানা কিছু নিয়ে আমাদের কৌতূহল থাকে। সে সমস্ত গল্পই এখানে করা হয়েছে অনায়াস ভঙ্গিতে। চিত্রিত হয়েছে বিচিত্র ভঙ্গিতে লেখকদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খতিয়ান। বাদ যায়নি বাংলাদেশের ভৌগোলিক কাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থা, বিভিন্ন দশকের মুসলিম পরিবার ও সমাজব্যবস্থা এবং আর্থসামাজিক বর্ণনাও। নিজেদের দেখা ও অভিজ্ঞতার আলোকে অকপটে বয়ান করেছেন সমগ্র বাংলাদেশের চালচিত্র। পাঠকালে অন্যরকম রোমাঞ্চ ও ভালো লাগা কাজ করবে।
আমরা যারা এ সময়ে ইসলামি ধারার বই পড়ছি তারা আলোচ্য দশ লেখকের কারও না কারও অনুরক্ত, লেখার ভক্ত, গোগ্রাসে পাঠ করি তাদের রচনা কিবা হতে পারে কোনো কারণে কারও প্রতি বিরক্ত। এই অনুরক্ত কিবা বিরক্তির পেছনে আমাদের কৌতূহল আছে, নানান প্রশ্ন আছে, বইপাঠ শেষে মনে হয়েছে লেখক আমাদের হয়ে থরে থরে প্রশ্নগুলো লেখককে করে গেছেন। ফলে বলা যায় এ বই পাঠককুলের নানান কৌতূহল ও প্রশ্নের জবাব নিয়ে হাজির হয়েছে। পাঠকদের কাছে তাই দশ লেখক দশ জীবন পড়া আনন্দদায়ক হবে। আত্মজীবনীর ভেতর দিয়ে বিরাট এক সময়কালের চিত্র ও দৃশ্যপট সহজে অনুধাবন করা যাবে। বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে চলমান একবিংশ শতাব্দীর ইসলামি শিল্প সাহিত্যের যে বয়ান এখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে তা এ ধারার লোকদের আবিষ্কার করা অপরিহার্য। বাঙালি মুসলমানি সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিবৃত্তের অন্যতম দলিল এই বই। কারোটিতে এই তথ্য হাজির রাখা নিজেদের জন্য ফলদায়ক হবে। আগামীর স্বপ্ন ও মিশন বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে দশ লেখকের অভিজ্ঞতা।
এ সময়কার তরুণ লেখকশ্রেণির জন্য বইটি অবশ্যই পাঠ্য বলে মনে করি। আজকে আমরা যারা বাসায় বসে পাণ্ডুলিপি মেইল করে পাঠিয়ে দিই আর প্রকাশক ছাপিয়ে ফেলে এবং দ্রুত সেটি বেস্টসেলার হয়ে যায়, এর পেছনে সদ্য মারা যাওয়া ইসহাক উবায়দী এবং জালালাবাদীদের ভূমিকা কী তা উদ্ঘাটন করতে হবে। নদভী, যাইনুল আবিদীন আর শরীফ মুহাম্মদরা শূন্য শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকের লেখকদের মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াতে যে কন্ট্রিবিউট করেছেন তা আবিষ্কার করতে হবে। অন্যথায় অকৃতজ্ঞার মালা পরতে হবে আমাদের। শেকড়কে ভুলে যাওয়া কিবা আবিষ্কারের চেষ্টা না করা অকৃতজ্ঞতা বৈ আর কিছু নয়। সেই সাথে তরুণদের জন্য রয়েছে উপকারী দিকনির্দেশনা, যা তাদের সুন্দর ও সাফল্যমণ্ডিত পথচলার প্রেরণা যোগাবে। পথের বাধাবিঘ্নতা পেছনে ফেলে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেবে। সংকলক জহির উদ্দিন বাবরও বিশেষ ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার, গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আঞ্জাম দেওয়ায়।
এ ব্যাপারটি আরও গভীর থেকে অনুধাবন করে কবি ও সম্পাদক নেসারুদ্দীন রুম্মান লিখেছেন, ‘আমি আমার লেখকবন্ধুদের প্রত্যেককে, বিশেষত সিয়ান-সমকালীন-সমর্পণবর্গীয় লেখকদের সকলকে এ বই পড়তে অনুরোধ করব। ২০১৩ পরবর্তী বাংলাদেশে, ২০১৫-১৬-তে এসে আপনাদের কন্ট্রিবিউশনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পাঠকমহলে ‘পড়াপড়ি’র বিপুল এক গণজোয়ার তৈরি হয়েছে, আশা করি, বাংলাদেশ এ কথা কখনও ভুলবে না। তবে আমার নিবেদন এই, আপনারা যদি বিপুল এই গণজোয়ারের রক্তবীজ অনুসন্ধান করেন, তাহলে ফিরে ফিরে মুসলমানিধারার লেখালেখির কথাই উঠে আসবে; আর এর সাথে সাথে উঠে আসবে কজনা কিংবদন্তি লেখকের নামও, যারা এই খরখরা মাঠে পূর্বসূরির নিড়ানি অব্যাহত রেখেছিলেন, রেখেছেন আজও; ‘দশ লেখক দশ জীবন’ মূখ্যত তাদের লেখালেখির জীবনের বয়ান; তাই ‘কীভাবে কীভাবে যেন রক্তবীজ সবুজ হয়েছে!’ এই অনুসন্ধান আপনাদের জীবনে থাকলে এই কিংবদন্তি লেখকদের প্রতি অভিনিবেশী হওয়া একান্ত দরকার তা লিগ্যাসির প্রয়োজনে যেমন জরুরি, জরুরি নিজ পাঠককে এই বার্তা দিতেও বাংলা ভাষায় লেখালেখি করে আসলে কোন সিলসিলা আপনি বহন করছেন!’
আলাদা করে দশ লেখকের কারও কথা চিহ্নিত করিনি। উদ্ধৃত করার মতো প্রত্যেকের জীবনকথায় অনেক কিছু ছিল। সময়ের বিচারে বিষয়ের বৈচিত্র্যে দশজনের কথাই প্রাসঙ্গিক ও কোটেশনযোগ্য। কিন্তু কলেবর সীমাবদ্ধতায় সেটা সম্ভব হয়নি। পাঠক প্রত্যেকের লেখক জীবনের বয়ান মনোযোগের সাথে পাঠ করবেন। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এ বই পাঠককে সমৃদ্ধ করবে বলে বিশ্বাস করি। বইয়ের প্রচ্ছদ, বাঁধাই ও সার্বিক গোছগাছ সুন্দর ও মার্জিত হয়েছে। পাঠকালে যা পাঠককে বাড়তি সুবিধা দেবে। সবশেষে সংকলক, প্রকাশক ও আড়ালে থাকা সকল কলাকুশলীর প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, চমৎকার একটি কাজ উপহার দেওয়ার জন্য।